আলোচিত আঁতাত, অনালোচিত দুর্বলতা by আজাদুর রহমান চন্দন
একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা (Genocide) ও
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে শুরু থেকেই নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে
দেশে-বিদেশে। এ আলোচনা-সমালোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে গত মঙ্গলবার
জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার পর।
রায় ঘোষণার পরপরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা, এ
মামলার কয়েকজন সাক্ষীসহ বিশিষ্টজনরা রায়ের ব্যাপারে গভীর হতাশা, এমনকি
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ট্রাইব্যুনালের বাইরের চত্বরে এবং
পাশেই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
এরপর সন্ধ্যায় শাহবাগ এলাকায় জড়ো হতে থাকেন তরুণ ব্লগাররা। এক পর্যায়ে
তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণী-পেশার
মানুষ। রাতভর তাঁরা সেখানে অবস্থান করেন এবং একাত্তরে 'মিরপুরের কসাই' নামে
পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানান। শাহবাগে ওই কর্মসূচি চলছে এবং
ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশব্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল
ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও এ রায়ের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত
করেছে। নানা কর্মসূচিও দিয়েছে অনেক সংগঠন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। প্রমাণিত পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি অভিযোগের (মিরপুরের আলোকদী গ্রামে ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণ) দায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি অভিযোগে তাঁকে দেওয়া হয়েছে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড। অথচ এগুলোও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। এসব হত্যা ও ব্যাপক হত্যার দায়ে কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে- এটিই ছিল জাতির প্রত্যাশা। এর আগে বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মামলায় তাঁকে সর্বোচ্চ সাজাই দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই বাচ্চু রাজাকার একাত্তরে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীর কোনো বড় মাপের নেতা বা কমান্ডার ছিলেন না, ছিলেন একজন স্থানীয় পাতি নেতা। অন্যদিকে কাদের মোল্লা ছিলেন কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর হাইকমান্ডের সদস্য। ওই গোপন কমান্ডো বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। সংগত কারণেই দেশের মানুষ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর প্রত্যাশিত রায় না হওয়ার জন্য বিশেষ রাজনৈতিক আঁতাতকেই দায়ী করা হচ্ছে সব মহল থেকে।
রাজনৈতিক আঁতাতের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসছে গত কয়েক দিনে সরকার এবং জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ও কর্মকাণ্ডের কারণে। এ ছাড়া রায় ঘোষণার সময় কাদের মোল্লার একাত্তরের ভূমিকা এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার বর্ণনা যখন ট্রাইব্যুনাল দিচ্ছিলেন, তখনো সেখানে উপস্থিত আসামিসহ কেউই ধারণা করতে পারেননি যে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না। এ বিষয়ে গত বুধবার কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রায় ঘোষণার আগে কাদের মোল্লার চেহারা ছিল ফ্যাকাসে। চোখে-মুখে ছিল স্পষ্ট নার্ভাসনেস। বিচারকরা যখন একে একে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ-মুখ ধূসর থেকে ধূসরতর হচ্ছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হতেই অন্য রূপ তাঁর।' কালের কণ্ঠের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়, "মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন সাজার রায় শোনার পর আবদুল কাদের মোল্লা হাতের দুই আঙুল তুলে বিজয়সূচক 'ভি' চিহ্ন দেখান, যেন তিনি এই শাস্তি পেয়ে সন্তুষ্ট।"
অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যদি রায়ে আসামি সন্তুষ্ট হন, তাহলে বাদীপক্ষসহ অন্যদের ক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ মামলায় বাদী হলো গোটা জাতির পক্ষে রাষ্ট্র। কাজেই এ রায়ে জাতির ক্ষুব্ধ না হওয়ার কারণ নেই। এ কারণেই খতিয়ে দেখা জরুরি আইনের কোন ফাঁক দিয়ে এমনটি ঘটল। প্রচলিত আইনে কোন অপরাধের কী দণ্ড হবে, এর একটি সর্বোচ্চ (কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বনিম্নও) সীমা দেওয়া আছে। ওই সীমার মধ্যে কাকে কোন দণ্ড দেওয়া হবে, সেটি নির্ভর করে বিচারকের বিবেচনার ওপর। তবে হত্যাকাণ্ডের অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজা অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। কোনো ক্ষেত্রে আসামিকে সাজা কম দিতে হলে এর কারণ উল্লেখ করতে হয় রায়ে। এটি হলো সাধারণ হত্যাকাণ্ডের বিচার-সংক্রান্ত আইনের বিধান। আর আলোচিত অপরাধগুলো সে তুলনায় অনেক গুরুতর।
কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে বিচারকরা উল্লেখ করেছেন, 'হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহ, যা মানুষের বিবেককে দংশন করে, সেসব অপরাধের গভীরতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। আমরা সতর্কতার সঙ্গে অভিযুক্ত আসামির অপরাধের গভীরতা বিবেচনায় নিয়েছি। সুতরাং আমাদের রায় অবশ্যই অপরাধের গভীরতা ও আসামির ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।' ট্রাইব্যুনালের এ মন্তব্যের পর ঘোষিত দণ্ড দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি অপরাধের গভীরতার তুলনায় এর সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ততটা গভীর নয়? নাকি তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জে অপরাধের সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ততটা জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়নি? এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব এ মুহূর্তে বিস্তারিতভাবে দেওয়া কঠিন। তবে দ্রুত পর্যবেক্ষণে কিছু দুর্বলতা তো স্পষ্টতই ধরা পড়ে। এ বিচারপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ গণহত্যার (জেনোসাইড) বিষয়টি ব্যাপক হত্যার (Mass Killing) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। একসঙ্গে বেশি লোক হত্যাকেই তারা বিবৃত করেছে গণহত্যা হিসেবে। অথচ ১৯৭৩ সালে পাস হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে জেনোসাইড বলতে মাস কিলিংকেই শুধু বোঝানো হয়নি; বরং কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী, বর্ণগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা অংশবিশেষকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ওই জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, এমনকি তাদের দৈহিক বা মানসিক ক্ষতি সাধনকেও বোঝানো হয়েছে।
রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টের ৩(২)(গ) ধারায় গণহত্যার কোনো অভিযোগই আনা হয়নি। শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের [৩(২)(ক) ধারা অনুযায়ী] অভিযোগ আনা হয়েছে; এবং সে অনুযায়ী সাজা দেওয়া হয়েছে; যদিও মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড।
রায়ে অপরাধের সঙ্গে আসামির সম্পৃক্ততার ধরন বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর থেকে আশঙ্কা হয়, আইসিটি অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর ৪(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংঘটনকারী সশস্ত্র বা প্রতিরক্ষা বাহিনী কিংবা এর সহযোগী বাহিনীর কমান্ডার বা সুপিরিয়র অফিসারের যে দায়দায়িত্ব সেটিকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি না অথবা রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়টি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছে কি না। দেখা যায়, আইনের ৪(২) ধারায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কোনো চার্জ আনা হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর হাইকমান্ডের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এ বিষয়েও কোনো অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ আনেনি। রাষ্ট্রপক্ষের অনেক দুর্বলতার বিষয় জানেন অনেকেই। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমকে শক্তিশালী করার দাবি জানানো হয়েছে শুরু থেকেই। এক পর্যায়ে তদন্ত সংস্থা শক্তিশালী করা হলেও তাদের সঙ্গে কোনো গবেষক রাখা হয়নি। আর প্রসিকিউশন টিমের দু-একজন সদস্য ছাড়া অন্যদের পেশাগত জীবনে সাধারণ মামলা পরিচালনায়ও দক্ষতা দেখানোর নজির নেই। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরসহ আরো কয়েকজন কৌঁসুলির নজরে আনা সত্ত্বেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট উপস্থাপনই করেননি। এর মধ্যে একটি হলো, একাত্তরে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে কাদের মোল্লার ছবি। ছবিটি এখন ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে। আরো একাধিক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সেগুলোতে গণহত্যা ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। সবাই জানেন, গোলাম আযমসহ শীর্ষস্থানীয় চার আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনাল প্রথম দফায় ফেরত দিয়েছিলেন সেগুলো সুবিন্যস্তভাবে লেখা না হওয়ায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা উল্টো প্রসিকিউটরদের সাফাই গেয়েছেন। ওই মন্ত্রীরা হয়তো জানেন না, অপরাধের ধরন অনুযায়ী কিভাবে সুবিন্যস্ত করে ফরমাল চার্জ লিখতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরদের শুধু মৌখিকভাবেই বলা হয়নি, লিখিত নমুনাও দেওয়া হয়েছিল। একজন প্রসিকিউটর এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু পেপারের ওপরে সংশ্লিষ্ট গবেষকের নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে নিজের নামের লেবেল লাগিয়ে যাদের দেখালে ব্যক্তিগত লাভ হবে, তাদের শুধু দেখিয়েছেন, সেগুলো ভালো করে পড়ে দেখারও তাগিদ বোধ করেননি কিংবা সেসব অনুধাবন করার ক্ষমতাই তাঁর নেই। অভিযোগগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আরেকটি দুর্বলতা হলো, অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি দলিল উপস্থাপন না করা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি, ওই সব দলিল সত্যায়িত করিয়ে আনবে কে, সেটা নাকি তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি।
তবে সব যুক্তি ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি জনমনকে আলোড়িত করছে তা হলো, হত্যা-ব্যাপক হত্যার পাঁচটি অভিযোগ 'সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত' হওয়া সত্ত্বেও কেন কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়নি?
লেখক : সাংবাদিক
মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। প্রমাণিত পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি অভিযোগের (মিরপুরের আলোকদী গ্রামে ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণ) দায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি অভিযোগে তাঁকে দেওয়া হয়েছে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড। অথচ এগুলোও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। এসব হত্যা ও ব্যাপক হত্যার দায়ে কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে- এটিই ছিল জাতির প্রত্যাশা। এর আগে বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মামলায় তাঁকে সর্বোচ্চ সাজাই দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই বাচ্চু রাজাকার একাত্তরে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীর কোনো বড় মাপের নেতা বা কমান্ডার ছিলেন না, ছিলেন একজন স্থানীয় পাতি নেতা। অন্যদিকে কাদের মোল্লা ছিলেন কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর হাইকমান্ডের সদস্য। ওই গোপন কমান্ডো বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। সংগত কারণেই দেশের মানুষ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর প্রত্যাশিত রায় না হওয়ার জন্য বিশেষ রাজনৈতিক আঁতাতকেই দায়ী করা হচ্ছে সব মহল থেকে।
রাজনৈতিক আঁতাতের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসছে গত কয়েক দিনে সরকার এবং জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ও কর্মকাণ্ডের কারণে। এ ছাড়া রায় ঘোষণার সময় কাদের মোল্লার একাত্তরের ভূমিকা এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার বর্ণনা যখন ট্রাইব্যুনাল দিচ্ছিলেন, তখনো সেখানে উপস্থিত আসামিসহ কেউই ধারণা করতে পারেননি যে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না। এ বিষয়ে গত বুধবার কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রায় ঘোষণার আগে কাদের মোল্লার চেহারা ছিল ফ্যাকাসে। চোখে-মুখে ছিল স্পষ্ট নার্ভাসনেস। বিচারকরা যখন একে একে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ-মুখ ধূসর থেকে ধূসরতর হচ্ছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হতেই অন্য রূপ তাঁর।' কালের কণ্ঠের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়, "মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন সাজার রায় শোনার পর আবদুল কাদের মোল্লা হাতের দুই আঙুল তুলে বিজয়সূচক 'ভি' চিহ্ন দেখান, যেন তিনি এই শাস্তি পেয়ে সন্তুষ্ট।"
অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যদি রায়ে আসামি সন্তুষ্ট হন, তাহলে বাদীপক্ষসহ অন্যদের ক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ মামলায় বাদী হলো গোটা জাতির পক্ষে রাষ্ট্র। কাজেই এ রায়ে জাতির ক্ষুব্ধ না হওয়ার কারণ নেই। এ কারণেই খতিয়ে দেখা জরুরি আইনের কোন ফাঁক দিয়ে এমনটি ঘটল। প্রচলিত আইনে কোন অপরাধের কী দণ্ড হবে, এর একটি সর্বোচ্চ (কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বনিম্নও) সীমা দেওয়া আছে। ওই সীমার মধ্যে কাকে কোন দণ্ড দেওয়া হবে, সেটি নির্ভর করে বিচারকের বিবেচনার ওপর। তবে হত্যাকাণ্ডের অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজা অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। কোনো ক্ষেত্রে আসামিকে সাজা কম দিতে হলে এর কারণ উল্লেখ করতে হয় রায়ে। এটি হলো সাধারণ হত্যাকাণ্ডের বিচার-সংক্রান্ত আইনের বিধান। আর আলোচিত অপরাধগুলো সে তুলনায় অনেক গুরুতর।
কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে বিচারকরা উল্লেখ করেছেন, 'হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহ, যা মানুষের বিবেককে দংশন করে, সেসব অপরাধের গভীরতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। আমরা সতর্কতার সঙ্গে অভিযুক্ত আসামির অপরাধের গভীরতা বিবেচনায় নিয়েছি। সুতরাং আমাদের রায় অবশ্যই অপরাধের গভীরতা ও আসামির ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।' ট্রাইব্যুনালের এ মন্তব্যের পর ঘোষিত দণ্ড দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি অপরাধের গভীরতার তুলনায় এর সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ততটা গভীর নয়? নাকি তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জে অপরাধের সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ততটা জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়নি? এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব এ মুহূর্তে বিস্তারিতভাবে দেওয়া কঠিন। তবে দ্রুত পর্যবেক্ষণে কিছু দুর্বলতা তো স্পষ্টতই ধরা পড়ে। এ বিচারপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ গণহত্যার (জেনোসাইড) বিষয়টি ব্যাপক হত্যার (Mass Killing) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। একসঙ্গে বেশি লোক হত্যাকেই তারা বিবৃত করেছে গণহত্যা হিসেবে। অথচ ১৯৭৩ সালে পাস হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে জেনোসাইড বলতে মাস কিলিংকেই শুধু বোঝানো হয়নি; বরং কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী, বর্ণগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা অংশবিশেষকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ওই জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, এমনকি তাদের দৈহিক বা মানসিক ক্ষতি সাধনকেও বোঝানো হয়েছে।
রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টের ৩(২)(গ) ধারায় গণহত্যার কোনো অভিযোগই আনা হয়নি। শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের [৩(২)(ক) ধারা অনুযায়ী] অভিযোগ আনা হয়েছে; এবং সে অনুযায়ী সাজা দেওয়া হয়েছে; যদিও মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড।
রায়ে অপরাধের সঙ্গে আসামির সম্পৃক্ততার ধরন বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর থেকে আশঙ্কা হয়, আইসিটি অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর ৪(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংঘটনকারী সশস্ত্র বা প্রতিরক্ষা বাহিনী কিংবা এর সহযোগী বাহিনীর কমান্ডার বা সুপিরিয়র অফিসারের যে দায়দায়িত্ব সেটিকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি না অথবা রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়টি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছে কি না। দেখা যায়, আইনের ৪(২) ধারায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কোনো চার্জ আনা হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর হাইকমান্ডের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এ বিষয়েও কোনো অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ আনেনি। রাষ্ট্রপক্ষের অনেক দুর্বলতার বিষয় জানেন অনেকেই। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমকে শক্তিশালী করার দাবি জানানো হয়েছে শুরু থেকেই। এক পর্যায়ে তদন্ত সংস্থা শক্তিশালী করা হলেও তাদের সঙ্গে কোনো গবেষক রাখা হয়নি। আর প্রসিকিউশন টিমের দু-একজন সদস্য ছাড়া অন্যদের পেশাগত জীবনে সাধারণ মামলা পরিচালনায়ও দক্ষতা দেখানোর নজির নেই। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরসহ আরো কয়েকজন কৌঁসুলির নজরে আনা সত্ত্বেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট উপস্থাপনই করেননি। এর মধ্যে একটি হলো, একাত্তরে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে কাদের মোল্লার ছবি। ছবিটি এখন ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে। আরো একাধিক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সেগুলোতে গণহত্যা ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। সবাই জানেন, গোলাম আযমসহ শীর্ষস্থানীয় চার আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনাল প্রথম দফায় ফেরত দিয়েছিলেন সেগুলো সুবিন্যস্তভাবে লেখা না হওয়ায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা উল্টো প্রসিকিউটরদের সাফাই গেয়েছেন। ওই মন্ত্রীরা হয়তো জানেন না, অপরাধের ধরন অনুযায়ী কিভাবে সুবিন্যস্ত করে ফরমাল চার্জ লিখতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরদের শুধু মৌখিকভাবেই বলা হয়নি, লিখিত নমুনাও দেওয়া হয়েছিল। একজন প্রসিকিউটর এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু পেপারের ওপরে সংশ্লিষ্ট গবেষকের নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে নিজের নামের লেবেল লাগিয়ে যাদের দেখালে ব্যক্তিগত লাভ হবে, তাদের শুধু দেখিয়েছেন, সেগুলো ভালো করে পড়ে দেখারও তাগিদ বোধ করেননি কিংবা সেসব অনুধাবন করার ক্ষমতাই তাঁর নেই। অভিযোগগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আরেকটি দুর্বলতা হলো, অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি দলিল উপস্থাপন না করা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি, ওই সব দলিল সত্যায়িত করিয়ে আনবে কে, সেটা নাকি তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি।
তবে সব যুক্তি ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি জনমনকে আলোড়িত করছে তা হলো, হত্যা-ব্যাপক হত্যার পাঁচটি অভিযোগ 'সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত' হওয়া সত্ত্বেও কেন কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়নি?
লেখক : সাংবাদিক
No comments