হৃদয়নন্দন বনে-ওই পোহাইল তিমির রাতি by আলী যাকের
একাত্তরের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন
রেসকোর্স ময়দান থেকে যখন উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের
মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', তখন সেই উত্তাল
জনসমুদ্র থেকে সন্ধ্যাবেলায় আমরা কতিপয় বন্ধু ফিরে চলেছি আমাদের ডেরায় আর
বসন্তের মৃদুমন্দ দখিনা বাতাস ছিল আমাদের সহযাত্রী।
হৃদয়ে
পুলক, আর ওই বাসন্তী বাতাসে পাচ্ছিলাম স্বাধীন দেশের অবাধ, অবিকৃত স্বাদ।
কিন্তু সেই বাসন্তী বাতাস আমাদের স্বাধীনতার পরে আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে
আসে। শুরু হয় রক্তক্ষরণের রাজনীতি। বড় দুর্দিন নেমে আসে এদেশের মুক্তিকামী
মানুষের জীবনে। এরই মধ্য দিয়ে সময় এগিয়ে চলে। আমরা কখনও আশার আলো দেখি,
কখনও নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার। যে আদর্শ এবং মূল্যবোধের জন্য লড়াই করেছিলাম
পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে, সেই আদর্শ এবং মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেছি তো
আমরা সবাই! ইতিমধ্যে আমাদের বয়স বেড়েছে চার দশক। আমরা ক্রমে নিরুত্তেজ হয়ে
পড়েছি। তেমন উৎসাহ আর খুঁজে পাই না সেই সংগ্রামে ব্রতী হতে, যার স্বপ্ন
আমাদেরকে সদাই অনুপ্রাণিত করত '৭০-এর বাংলাদেশে। তারপর হঠাৎ করেই এই প্রবীণ
দেহ এবং মনে আবার যেন সেই বসন্তের মন মাতানো বাতাস আশার চেতনা বইয়ে দিয়ে
গেল এবারের বসন্তকালে। আবার উজ্জীবিত হলাম। আশাবাদী হলাম। মনে হলো সব শেষ
হয়ে যায়নি। ভাবলাম, কী হয়েছে জীবন থেকে চলি্লশটা বছর খসে পড়েছে বলে? ফিরে
পেলাম সেই প্রত্যয় যে, একদিন যারা আমার সকল আত্মীয় এবং বন্ধুদের হত্যা
করেছিল নির্বিচারে, কিংবা হত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছিল অথবা চরম সম্মানহানি
করেছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের যথাযোগ্য শাস্তি তবে আমাদের জীবদ্দশাতেই আমরা
দেখে যেতে পারব। গঠিত হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, একেবারে
আইনসিদ্ধভাবে। শুরু হলো সেই বিচারের কাজ, যার জন্য অধীর আগ্রহে আমরা ছিলাম
অপেক্ষমাণ। যাদের এই বিচার সভায় হাজির করা হলো, তারা সবাই মানবতার বিরুদ্ধে
চিহ্নিত অপরাধী। অতএব, চরম শাস্তি তাদের পেতেই হবে। বিচার শেষে শাস্তি
প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম, অবশেষে আমার আত্মীয়-বন্ধুর
রক্তের ঋণ বোধহয় শেষ পর্যন্ত শোধ করতে পারব আমরা।
এই দাবি, যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধীদের বিচার এই বাংলাদেশের মাটিতেই হবে, সেই অঙ্গীকারে আমাদের তরুণ সমাজ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। আমরা দেখলাম নির্বাচিত সরকার তাদের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকেই এগোচ্ছে। তবে প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। অনুমান করি, এই বিলম্বের পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে পারে। হয়তো সব দিক গুছিয়ে এই বিচারকে বিতর্কের ঊধর্ে্ব রেখে কাজটি শেষ করার চিন্তা করেছে আমাদের সরকার। এছাড়াও সেই সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, তাদেরও একটা চাপ নিশ্চয়ই আছে আমাদের সরকারের ওপরে। ওইসব দেশের দ্বারা কম অপকর্ম তো সংঘটিত হয়নি আমাদের এই হতভাগা দেশে অতীতে। এখন তো এ কথা সর্বজনবিদিত যে, তাদেরই ষড়যন্ত্রে প্রাণ দিতে হয়েছিল আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অতএব, যে কোনো সরকারেরই মানবতার পক্ষে মানবতাবিরোধী শক্তিকে চরম শাস্তি দিতে হলে শঙ্কা তো হতেই পারে। আমরা যারা কোনোভাবেই দেশের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত নই, তারা অনেক বাহুল্য কথাই অবলীলায় বলে যেতে পারি। তবে, সত্যকে বিচক্ষণতার সঙ্গে সত্য হিসেবে না দেখলে তা দেশ এবং জাতির জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এত সব চাপ এবং ভয়-ভীতি সত্ত্বেও এই সরকার মানবতাবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। আমরা আশা করব, এই প্রক্রিয়াটি একদিন শেষ হবে এবং আমরা আমাদের শহীদদের কাছে দেয় অঙ্গীকার রক্ষা করতে সক্ষম হব।
ইতিমধ্যে ওই জঘন্য অপরাধে অপরাধী একজনের বিরুদ্ধে আনীত পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ড প্রদানের পর আমরা দেখতে পেলাম, তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। যে মানুষ কয়েকশ' মানুষ হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল, সে এত অল্পতে পার পেয়ে যাবে, এটা কখনও গ্রহণ করতে পারে না বাংলাদেশের জনসাধারণ। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ উঠেছে সারাদেশে। আকাশ-বাতাস মথিত করে উঠছে স্লোগানের পর স্লোগান। শাহবাগ মোড়ে, যার নামকরণ করেছে তরুণরা 'প্রজন্ম চত্বর', হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে জড়ো হয়েছে। রাতের পর রাত জেগে তারা প্রতিবাদ করছে। এই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একটিই কথা_ বাংলার বুকে বাঙালি হন্তারকদের ঠাঁই নেই। দেরিতে হলেও আমাদের জনগণ তাদের করণীয় সম্বন্ধে সচেতন হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। আমরা এই বিক্ষুব্ধ জনতাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই।
তবে, কিছু কথা থেকে যায়। যে দেশের বিরুদ্ধে জন্মলগ্ন থেকে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, যে ষড়যন্ত্রের ফলে আমাদের জাতির পিতা, চারজন জাতীয় নেতা এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র এত সহজে শেষ হয়ে যাবে, সেটি কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। অতএব, এই উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝেও যে বাংলাদেশবিরোধী কিছু দুষ্টগ্রহ ঢুকে পড়বে না, সেটাও হলফ করে বলা যায় না। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে একটি চক্র সরকারবিরোধী অবস্থানই কেবল গ্রহণ করেনি, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদানকেও ক্ষুদ্র করে দেখছে। তারা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে জাতীয় যে স্লোগান 'জয় বাংলা' সেটি উচ্চারণ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়। তারা ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়াকে উপহাস করে এমন কথাও বলছে যে, এই সরকার জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছে। অথচ এ কথাটি তারা বোঝার চেষ্টা করছে না যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে বর্তমান সরকার এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, এমন অপপ্রচারও কিছু কিছু মানুষ শুরু করেছে যে, বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলে এই যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জেল থেকে প্রত্যাবর্তনের ১৪ দিনের মধ্যে, ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২-এ রাষ্ট্রীয় আদেশ বলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার জারি করেছিলেন (পি.ও নাম্বার ৮, ১৯৭২)। এই আদেশ বলে যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসরদের বিচারের পথ খুলে যায়। বস্তুতপক্ষে তার সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারিক ব্যবস্থায় আনার জন্য ১৯৭২-এ দালাল আইন এবং ১৯৭৩-এ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করে। এই আদেশের ভিত্তিতে প্রথম দফায় ৩৭ হাজার দালালকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে ২৬ হাজারের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ৮০০ মামলা সমাপ্তির পর অপরাধীদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আরও ১১ হাজার অপরাধীর বিরুদ্ধে, যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিজামী এবং আব্বাস আলী খান অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ এবং ৩৮ নম্বর ধারায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে সামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তারা এসব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুনরায় চালু করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার ফলে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর আমির, পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং নাগরিকত্ব অর্জন করেন। এর দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের পক্ষে কোন শক্তি সর্বদাই কাজ করে এসেছে এবং কারাই বা এর বিপক্ষে ছিল, আছে।
আজকে যে গণজোয়ার শুরু হয়েছে প্রজন্ম চত্বর (শাহবাগ মোড়) থেকে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আশা করব যে, এদেশে সংঘটিত স্বাধীনতাবিরোধী সব অপকর্মকে এই জোয়ার খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। জয় হোক গণমানুষের। জয় হোক নব প্রজন্মের।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এই দাবি, যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধীদের বিচার এই বাংলাদেশের মাটিতেই হবে, সেই অঙ্গীকারে আমাদের তরুণ সমাজ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। আমরা দেখলাম নির্বাচিত সরকার তাদের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকেই এগোচ্ছে। তবে প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। অনুমান করি, এই বিলম্বের পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে পারে। হয়তো সব দিক গুছিয়ে এই বিচারকে বিতর্কের ঊধর্ে্ব রেখে কাজটি শেষ করার চিন্তা করেছে আমাদের সরকার। এছাড়াও সেই সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, তাদেরও একটা চাপ নিশ্চয়ই আছে আমাদের সরকারের ওপরে। ওইসব দেশের দ্বারা কম অপকর্ম তো সংঘটিত হয়নি আমাদের এই হতভাগা দেশে অতীতে। এখন তো এ কথা সর্বজনবিদিত যে, তাদেরই ষড়যন্ত্রে প্রাণ দিতে হয়েছিল আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অতএব, যে কোনো সরকারেরই মানবতার পক্ষে মানবতাবিরোধী শক্তিকে চরম শাস্তি দিতে হলে শঙ্কা তো হতেই পারে। আমরা যারা কোনোভাবেই দেশের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত নই, তারা অনেক বাহুল্য কথাই অবলীলায় বলে যেতে পারি। তবে, সত্যকে বিচক্ষণতার সঙ্গে সত্য হিসেবে না দেখলে তা দেশ এবং জাতির জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এত সব চাপ এবং ভয়-ভীতি সত্ত্বেও এই সরকার মানবতাবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। আমরা আশা করব, এই প্রক্রিয়াটি একদিন শেষ হবে এবং আমরা আমাদের শহীদদের কাছে দেয় অঙ্গীকার রক্ষা করতে সক্ষম হব।
ইতিমধ্যে ওই জঘন্য অপরাধে অপরাধী একজনের বিরুদ্ধে আনীত পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ড প্রদানের পর আমরা দেখতে পেলাম, তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। যে মানুষ কয়েকশ' মানুষ হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল, সে এত অল্পতে পার পেয়ে যাবে, এটা কখনও গ্রহণ করতে পারে না বাংলাদেশের জনসাধারণ। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ উঠেছে সারাদেশে। আকাশ-বাতাস মথিত করে উঠছে স্লোগানের পর স্লোগান। শাহবাগ মোড়ে, যার নামকরণ করেছে তরুণরা 'প্রজন্ম চত্বর', হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে জড়ো হয়েছে। রাতের পর রাত জেগে তারা প্রতিবাদ করছে। এই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একটিই কথা_ বাংলার বুকে বাঙালি হন্তারকদের ঠাঁই নেই। দেরিতে হলেও আমাদের জনগণ তাদের করণীয় সম্বন্ধে সচেতন হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। আমরা এই বিক্ষুব্ধ জনতাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই।
তবে, কিছু কথা থেকে যায়। যে দেশের বিরুদ্ধে জন্মলগ্ন থেকে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, যে ষড়যন্ত্রের ফলে আমাদের জাতির পিতা, চারজন জাতীয় নেতা এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র এত সহজে শেষ হয়ে যাবে, সেটি কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। অতএব, এই উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝেও যে বাংলাদেশবিরোধী কিছু দুষ্টগ্রহ ঢুকে পড়বে না, সেটাও হলফ করে বলা যায় না। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে একটি চক্র সরকারবিরোধী অবস্থানই কেবল গ্রহণ করেনি, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদানকেও ক্ষুদ্র করে দেখছে। তারা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে জাতীয় যে স্লোগান 'জয় বাংলা' সেটি উচ্চারণ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়। তারা ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়াকে উপহাস করে এমন কথাও বলছে যে, এই সরকার জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছে। অথচ এ কথাটি তারা বোঝার চেষ্টা করছে না যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে বর্তমান সরকার এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, এমন অপপ্রচারও কিছু কিছু মানুষ শুরু করেছে যে, বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলে এই যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জেল থেকে প্রত্যাবর্তনের ১৪ দিনের মধ্যে, ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২-এ রাষ্ট্রীয় আদেশ বলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার জারি করেছিলেন (পি.ও নাম্বার ৮, ১৯৭২)। এই আদেশ বলে যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসরদের বিচারের পথ খুলে যায়। বস্তুতপক্ষে তার সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারিক ব্যবস্থায় আনার জন্য ১৯৭২-এ দালাল আইন এবং ১৯৭৩-এ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করে। এই আদেশের ভিত্তিতে প্রথম দফায় ৩৭ হাজার দালালকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে ২৬ হাজারের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ৮০০ মামলা সমাপ্তির পর অপরাধীদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আরও ১১ হাজার অপরাধীর বিরুদ্ধে, যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিজামী এবং আব্বাস আলী খান অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ এবং ৩৮ নম্বর ধারায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে সামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তারা এসব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুনরায় চালু করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার ফলে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর আমির, পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং নাগরিকত্ব অর্জন করেন। এর দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের পক্ষে কোন শক্তি সর্বদাই কাজ করে এসেছে এবং কারাই বা এর বিপক্ষে ছিল, আছে।
আজকে যে গণজোয়ার শুরু হয়েছে প্রজন্ম চত্বর (শাহবাগ মোড়) থেকে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আশা করব যে, এদেশে সংঘটিত স্বাধীনতাবিরোধী সব অপকর্মকে এই জোয়ার খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। জয় হোক গণমানুষের। জয় হোক নব প্রজন্মের।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments