শুধু ফাঁসি নয়, জনজোয়ার থেকে উঠেছে নতুন দাবি-জামায়াত নিষিদ্ধ চাই
যেতে হবে শাহবাগ। সেখান থেকে ভেসে আসছে
উত্তাল প্রতিবাদে শামিল হওয়ার ডাক। সেই ডাক প্রজন্ম চত্বর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে
দিকে দিকে। তাতে সাড়া দিয়ে মানুষ এসেছে একা অথবা দল বেঁধে। তারপর মিশে
গেছে এক স্রোতে, অভিন্ন আবেগে। প্রজন্ম চত্বরে বেড়েই চলেছে
উত্তাপ-উত্তেজনার পারদ।
বাড়ছে জনসমুদ্রের ব্যাপ্তি। কারো
হাতে প্ল্যাকার্ড, কারো হাতে ব্যানার। কণ্ঠে উদ্দীপনার স্লোগান। কখনো
প্রতিবাদী সংগীতের সুর, কখনো কবিতার শানিত পঙ্ক্তিমালা। কখনো বা
যুক্তিমণ্ডিত উদ্দীপ্ত ভাষণ। তাতে কথা, সুর ও স্লোগানে উঠে আসছে মানুষের
প্রাণের দাবি, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। শুধু তা-ই নয়, জনতার জোয়ারে দাবি
উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করারও।
ছাত্র-জনতার বজ কণ্ঠে আওয়াজ উঠেছে, 'আইন করে নিষিদ্ধ করো/ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি', 'জামায়াত-শিবির-রাজাকার/এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়', 'জামায়াত-শিবিরের কালো হাত/ ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।'
আইন করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উন্মাতাল হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম। তাদের এ দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে নানা শ্রেণীর, নানা বয়সের লাখো মানুষ। রাজধানীর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে চলমান আন্দোলন থেকে ধ্বনিত হচ্ছে তাদের এই প্রাণের দাবি।
গতকাল বৃহস্পতিবার আন্দোলনের তৃতীয় দিনটিও উত্তাল ছিল তরুণ প্রজন্ম ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য ও ব্লগারদের নানা আয়োজনে। প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তারা আইন করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক তারেক রেজা এবং প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহমুদুল হাসান সকালেই শাহবাগ এসে যোগ দেন আন্দোলনে। সঙ্গে এসেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। তাঁরা বিশাল এক ব্যানার নিয়ে উপস্থিত। তাতে লেখা, 'জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো, করতে হবে।' তারেক রেজা বললেন, "একাত্তরে যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন করেছিল, এখন একইভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে 'দ্বিতীয় যুদ্ধ' ঘোষণা করে পুলিশসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি এখন মানুষের প্রাণের দাবি।" পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
তরুণদের উদ্যোগে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের তৃতীয় দিন ছিল গতকাল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে যুক্ত হয়েছেন এ আন্দোলনের সঙ্গে। ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এর ব্যাপ্তি। একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিসেনারাও প্রতিবাদের এ আন্দোলনে একাত্ম হয়ে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন নতুন প্রজন্মের তরুণদের। প্রতিবাদের সেই সমুদ্র থেকে বারবার উঠে আসছে রাজাকারের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শাহবাগ মোড়েই আন্দোলনকারীদের অবস্থান বজায় থাকলে বিকেল থেকে এর পরিধি বাড়তেই থাকে। সমাবেশের বিস্তৃতি দক্ষিণে চারুকলা, উত্তরে রূপসী বাংলা হোটেল, পশ্চিমে আজিজ সুপার মার্কেট এবং পূর্বে শিশু পার্ক ছুঁয়ে যায়। গতকাল এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানতে এসে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্বাধীনতাবিরোধীরা একাত্তরের পর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, সরকারের বিরুদ্ধে সরকার গড়ে তুলেছে। তারা দেশকে মৌলবাদের রাষ্ট্র বানাতে তাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জামায়াত কোনোভাবেই ইসলামী দল নয়।'
আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে গতকালও আসেন রাজনীতিবিদরা। আসেন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা, লেখক-সাহিত্যিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
তারুণ্যের জোয়ার : জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সোচ্চার এখন দেশের তরুণ প্রজন্ম। শাহবাগ চত্বরে ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান উঠছে এ দাবিতে। বাতাসে ভাসছে আহ্বান- 'এসো ভাই এসো বোন/গড়ে তুলি আন্দোলন, জ্বালো জ্বালো/আগুন জ্বালো, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই/যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়/রাজাকারদের ঠাঁই নাই।'
গতকালও আন্দোলনকারী তরুণরা জানায়, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠা শাহবাগ ছেড়ে যাবে না তারা।
গতকাল সকাল থেকেই প্রতিবাদী মঞ্চ ঘিরে বাড়ছে সংহতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যাও। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকে শাহবাগের দিকে। অনেকেরই মাথা আর হাতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা। মুখে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান।
সকাল ১০টার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ঢাকঢোলসহ মিছিল নিয়ে সংহতি জানাতে আসে শিক্ষার্থীরা। ঘোষণা মঞ্চ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের খবর উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। এ বার্তা যেন তাদের রাত জাগার ক্লান্তি অনেকটাই ভুলিয়ে দেয়।
সকাল সাড়ে ১০টায় ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। এ সময় মঞ্চ থেকে ক্রমাগতভাবে স্লোগান চলতে থাকে, 'ক-তে কাদের মোল্লা/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'ন-তে নিজামী/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'ম-তে মুজাহিদ/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'গ-তে গোলাম আযম/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার'।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মঞ্চে রাজাকারদের কুশপুত্তলিকায় জুতা নিক্ষেপ চলে। আগের দুই দিনের মতো গতকাল অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগ মোড়ে আসেন তরুণদের এ আয়োজনে সংহতি জানাতে। তাঁদেরই একজন পুরান ঢাকার বাসিন্দা কাজল উদ্দিন সরকার। আবেগভরা কণ্ঠে ষাটোর্ধ্ব এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, 'আমি প্রাণ ভরে দোয়া করি, ওরা অনেক বড় হবে। জাতির মেরুদণ্ড আজ শক্ত হয়েছে। এ প্রজন্ম অনেক একতাবদ্ধ। বায়ান্ন থেকে একাত্তর এবং পরবর্তীতে যে বাঁধন ছিঁড়ে গিয়েছিল, আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে সে বাঁধন আসলে ছেঁড়েনি। আমাদের সন্তানদের হাতেই আমাদের পতাকা নিরাপদ।'
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহনেওয়াজ বারী সারা রাত ছিলেন শাহবাগে। তিনি বলেন, 'এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। রাতে জাদুঘরের সামনে সবজি-খিচুড়ি রান্না হয়েছিল। সবাই ভাগাভাগি করে খেয়েছি, একেক প্লেটে দুজন।' এ ছাড়া সমাবেশস্থলে সারা রাত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠন।
সন্ধ্যার শাহবাগ জনসমুদ্র : শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর গতকাল সন্ধ্যায় রূপ নেয় উত্তাল এক মহাসমুদ্রে। হাজার হাজার মানুষ গণসংগীত আর স্লোগানে ফুঁসে ওঠে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিতে।
'স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর এমন আন্দোলন আর দেখেনি ঢাকাবাসী। নব্বইয়ের দশকের পর দেশবাসী আর কখনো জাতীয় ইস্যুতে এমন দেশপ্রেমে জাগেনি কখনো।' যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ চত্বরে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনরা বললেন এ কথা।
গতকাল সন্ধ্যায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শত শত সদস্য বিশাল মশাল মিছিল করেন। পাবলিক লাইব্রেরি গেটে গণসাংস্কৃতিক মৈত্রী মঞ্চ পরিবেশন করে গণসংগীত। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করে চারুকলার দ্বিতীয় গেটে। বিচার প্রতিরোধ মঞ্চ চারুকলার সামনে করেছে পথনাটক। চারুকলার শিক্ষার্থীরা সামনের রাস্তায় করছেন প্রতিবাদী চিত্রকর্ম অঙ্কন। শিল্পীসমাজ মঞ্চ করেছে চারুকলার গেটে। চারুকলার দেয়ালে বিশাল কার্টুন আঁকা ব্যানার এঁকেছে স্বাধীন বাংলা কার্টুনিস্ট পরিষদ। জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করছে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক। শাহবাগ মোড় থেকে আজিজ সুপার মার্কেট পর্যন্ত বিশাল সাদা কাপড়ে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছে আন্দোলনকারীরা।
চাপা পড়ে গেল হানিফের বক্তব্য : গতকাল বিকেল সোয়া ৫টায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দঞ্চে এসে একাত্মতা প্রকাশের জন্য বক্তব্য শুরু করতেই 'দালালি না রাজপথ- রাজপথ-রাজপথ', 'আপস না সংগ্রাম- সংগ্রাম, সংগ্রাম', 'একটা-দুইটা দালাল ধর, ধইরা ধইরা নাশতা কর' ইত্যাদি স্লোগান শুরু হয়। ওই স্লোগানের আড়ালে চাপা পড়ে যায় মাহবুব-উল-আলম হানিফের কণ্ঠ। এক পর্যায়ে হানিফ থেমে যান। এর আগে বক্তব্য দিতে গিয়ে একই রকম প্রতিরোধের সম্মুখীন হন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুন।
সন্ধ্যার আগে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ ও সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন সমাবেশে এসে একাত্মতা প্রকাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, 'আমরা এখন একাত্তরের রণাঙ্গনে আছি। এই চত্বরে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম নতুন এক মুক্তিযুদ্ধে মিলিত হয়েছে। আমরা ১৯৭১ সালেও পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাজিত করেছি। এবার তোমরাও তাদের পরাজিত করবে।'
অধ্যাপক আনোয়ার আরো বলেন, দেশের সব স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুত হতে হবে। সব শিক্ষাঙ্গন শিবিরমুক্ত করতে হবে।
ছাত্র-জনতার বজ কণ্ঠে আওয়াজ উঠেছে, 'আইন করে নিষিদ্ধ করো/ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি', 'জামায়াত-শিবির-রাজাকার/এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়', 'জামায়াত-শিবিরের কালো হাত/ ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।'
আইন করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উন্মাতাল হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম। তাদের এ দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে নানা শ্রেণীর, নানা বয়সের লাখো মানুষ। রাজধানীর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে চলমান আন্দোলন থেকে ধ্বনিত হচ্ছে তাদের এই প্রাণের দাবি।
গতকাল বৃহস্পতিবার আন্দোলনের তৃতীয় দিনটিও উত্তাল ছিল তরুণ প্রজন্ম ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য ও ব্লগারদের নানা আয়োজনে। প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তারা আইন করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক তারেক রেজা এবং প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহমুদুল হাসান সকালেই শাহবাগ এসে যোগ দেন আন্দোলনে। সঙ্গে এসেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। তাঁরা বিশাল এক ব্যানার নিয়ে উপস্থিত। তাতে লেখা, 'জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো, করতে হবে।' তারেক রেজা বললেন, "একাত্তরে যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন করেছিল, এখন একইভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে 'দ্বিতীয় যুদ্ধ' ঘোষণা করে পুলিশসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি এখন মানুষের প্রাণের দাবি।" পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
তরুণদের উদ্যোগে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের তৃতীয় দিন ছিল গতকাল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে যুক্ত হয়েছেন এ আন্দোলনের সঙ্গে। ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এর ব্যাপ্তি। একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিসেনারাও প্রতিবাদের এ আন্দোলনে একাত্ম হয়ে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন নতুন প্রজন্মের তরুণদের। প্রতিবাদের সেই সমুদ্র থেকে বারবার উঠে আসছে রাজাকারের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শাহবাগ মোড়েই আন্দোলনকারীদের অবস্থান বজায় থাকলে বিকেল থেকে এর পরিধি বাড়তেই থাকে। সমাবেশের বিস্তৃতি দক্ষিণে চারুকলা, উত্তরে রূপসী বাংলা হোটেল, পশ্চিমে আজিজ সুপার মার্কেট এবং পূর্বে শিশু পার্ক ছুঁয়ে যায়। গতকাল এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানতে এসে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্বাধীনতাবিরোধীরা একাত্তরের পর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, সরকারের বিরুদ্ধে সরকার গড়ে তুলেছে। তারা দেশকে মৌলবাদের রাষ্ট্র বানাতে তাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জামায়াত কোনোভাবেই ইসলামী দল নয়।'
আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে গতকালও আসেন রাজনীতিবিদরা। আসেন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা, লেখক-সাহিত্যিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
তারুণ্যের জোয়ার : জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সোচ্চার এখন দেশের তরুণ প্রজন্ম। শাহবাগ চত্বরে ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান উঠছে এ দাবিতে। বাতাসে ভাসছে আহ্বান- 'এসো ভাই এসো বোন/গড়ে তুলি আন্দোলন, জ্বালো জ্বালো/আগুন জ্বালো, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই/যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়/রাজাকারদের ঠাঁই নাই।'
গতকালও আন্দোলনকারী তরুণরা জানায়, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠা শাহবাগ ছেড়ে যাবে না তারা।
গতকাল সকাল থেকেই প্রতিবাদী মঞ্চ ঘিরে বাড়ছে সংহতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যাও। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকে শাহবাগের দিকে। অনেকেরই মাথা আর হাতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা। মুখে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান।
সকাল ১০টার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ঢাকঢোলসহ মিছিল নিয়ে সংহতি জানাতে আসে শিক্ষার্থীরা। ঘোষণা মঞ্চ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের খবর উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। এ বার্তা যেন তাদের রাত জাগার ক্লান্তি অনেকটাই ভুলিয়ে দেয়।
সকাল সাড়ে ১০টায় ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। এ সময় মঞ্চ থেকে ক্রমাগতভাবে স্লোগান চলতে থাকে, 'ক-তে কাদের মোল্লা/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'ন-তে নিজামী/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'ম-তে মুজাহিদ/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'গ-তে গোলাম আযম/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার'।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মঞ্চে রাজাকারদের কুশপুত্তলিকায় জুতা নিক্ষেপ চলে। আগের দুই দিনের মতো গতকাল অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগ মোড়ে আসেন তরুণদের এ আয়োজনে সংহতি জানাতে। তাঁদেরই একজন পুরান ঢাকার বাসিন্দা কাজল উদ্দিন সরকার। আবেগভরা কণ্ঠে ষাটোর্ধ্ব এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, 'আমি প্রাণ ভরে দোয়া করি, ওরা অনেক বড় হবে। জাতির মেরুদণ্ড আজ শক্ত হয়েছে। এ প্রজন্ম অনেক একতাবদ্ধ। বায়ান্ন থেকে একাত্তর এবং পরবর্তীতে যে বাঁধন ছিঁড়ে গিয়েছিল, আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে সে বাঁধন আসলে ছেঁড়েনি। আমাদের সন্তানদের হাতেই আমাদের পতাকা নিরাপদ।'
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহনেওয়াজ বারী সারা রাত ছিলেন শাহবাগে। তিনি বলেন, 'এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। রাতে জাদুঘরের সামনে সবজি-খিচুড়ি রান্না হয়েছিল। সবাই ভাগাভাগি করে খেয়েছি, একেক প্লেটে দুজন।' এ ছাড়া সমাবেশস্থলে সারা রাত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠন।
সন্ধ্যার শাহবাগ জনসমুদ্র : শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর গতকাল সন্ধ্যায় রূপ নেয় উত্তাল এক মহাসমুদ্রে। হাজার হাজার মানুষ গণসংগীত আর স্লোগানে ফুঁসে ওঠে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিতে।
'স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর এমন আন্দোলন আর দেখেনি ঢাকাবাসী। নব্বইয়ের দশকের পর দেশবাসী আর কখনো জাতীয় ইস্যুতে এমন দেশপ্রেমে জাগেনি কখনো।' যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ চত্বরে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনরা বললেন এ কথা।
গতকাল সন্ধ্যায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শত শত সদস্য বিশাল মশাল মিছিল করেন। পাবলিক লাইব্রেরি গেটে গণসাংস্কৃতিক মৈত্রী মঞ্চ পরিবেশন করে গণসংগীত। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করে চারুকলার দ্বিতীয় গেটে। বিচার প্রতিরোধ মঞ্চ চারুকলার সামনে করেছে পথনাটক। চারুকলার শিক্ষার্থীরা সামনের রাস্তায় করছেন প্রতিবাদী চিত্রকর্ম অঙ্কন। শিল্পীসমাজ মঞ্চ করেছে চারুকলার গেটে। চারুকলার দেয়ালে বিশাল কার্টুন আঁকা ব্যানার এঁকেছে স্বাধীন বাংলা কার্টুনিস্ট পরিষদ। জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করছে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক। শাহবাগ মোড় থেকে আজিজ সুপার মার্কেট পর্যন্ত বিশাল সাদা কাপড়ে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছে আন্দোলনকারীরা।
চাপা পড়ে গেল হানিফের বক্তব্য : গতকাল বিকেল সোয়া ৫টায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দঞ্চে এসে একাত্মতা প্রকাশের জন্য বক্তব্য শুরু করতেই 'দালালি না রাজপথ- রাজপথ-রাজপথ', 'আপস না সংগ্রাম- সংগ্রাম, সংগ্রাম', 'একটা-দুইটা দালাল ধর, ধইরা ধইরা নাশতা কর' ইত্যাদি স্লোগান শুরু হয়। ওই স্লোগানের আড়ালে চাপা পড়ে যায় মাহবুব-উল-আলম হানিফের কণ্ঠ। এক পর্যায়ে হানিফ থেমে যান। এর আগে বক্তব্য দিতে গিয়ে একই রকম প্রতিরোধের সম্মুখীন হন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুন।
সন্ধ্যার আগে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ ও সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন সমাবেশে এসে একাত্মতা প্রকাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, 'আমরা এখন একাত্তরের রণাঙ্গনে আছি। এই চত্বরে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম নতুন এক মুক্তিযুদ্ধে মিলিত হয়েছে। আমরা ১৯৭১ সালেও পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাজিত করেছি। এবার তোমরাও তাদের পরাজিত করবে।'
অধ্যাপক আনোয়ার আরো বলেন, দেশের সব স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুত হতে হবে। সব শিক্ষাঙ্গন শিবিরমুক্ত করতে হবে।
No comments