নারী অধিকার-আর নয় নীরবতা, প্রতিরোধ এখনই by সালমা আলী

দিলি্লতে মেডিকেল ছাত্রীকে গণধর্ষণ, পাশবিক নির্যাতন ও পরে তার মৃত্যুর সংবাদের ঘটনা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক কিছু। এত সংবেদনশীল বিষয়টির প্রতি ভারত সরকার ও বিরোধী দল এবং অন্যান্য যারা নির্দলীয়, একবারে ব্যক্তিগত পর্যায়েও সবাই দারুণভাবে সোচ্চার ছিল,
এখনও প্রতিবাদ অব্যাহত আছে এ জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ছিল সবার মুখে মুখে, এখনও হচ্ছে। কেউ কাউকে (রাজনৈতিক দলগুলো) অহেতুক দোষারোপ না করে মেয়েটির যাতে সর্বোচ্চ স্বার্থরক্ষা হয় তার ব্যাপারে সজাগ ছিল। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিবৃতি আসতে বা সরকারপ্রধান জনসমক্ষে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে, আদেশ-নির্দেশ দিতে অযথা কালক্ষেপণ করেননি। লোকসভা ও রাজ্যসভায় আলোচনা হয়েছিল, আলোচনা হয়েছিল কীভাবে আইন আরও কঠোর করা যায়, দোষীদের বিচার কীভাবে কঠোর আইনের মাধ্যমে সম্পাদন করা যায় এমন গঠনমূলক আলোচনা, পরামর্শই সহমত হয়ে করতে দেখেছি। এটাও জানি, এমন কঠোর আইন প্রণয়ন করতে ভারতের মতো একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের অনেক সময় লাগবে। পারস্পরিক রাজনৈতিক শ্রদ্ধাবোধের এ ব্যাপারটি আমাদের দেশে এখনও সুদূরপরাহত। তাদের জবাবদিহিতার জায়গাটা অনেক সমুন্নত, রাজনৈতিক দল তথা রাজনীতিকদের কাছে জনগণের কথা মূল্যবান।
দিলি্ল ঘটনার রেশ না কাটতেই অতি সম্প্রতি টাঙ্গাইলের নবম শ্রেণীতে পড়ূয়া যে মেয়েটি গণধর্ষণের শিকার হলো তা আমাদের নজরে এলো ঘটনা সংঘটিত হওয়ারও কয়েক সপ্তাহ পর। সমাজ ও লোকনিন্দার ভয়ে মেয়েটির বাবা তথা পরিবার তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়, হতভাগ্য মেয়েটির ঠাঁই হয় অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় এক মামার বাড়িতে। পত্রিকায় খবরটি পাওয়ামাত্র আমি ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওসিসিতে, যেদিন তাকে সবেমাত্র ঢাকায় স্থানান্তর করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে তার চিকিৎসা শুরু হয়। এখনো মেয়েটি ওসিসিতে চিকিৎসাধীন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আমরা তার সব ধরনের আইনি কর্মকাণ্ড ও কাউন্সেলিংসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছি এবং পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনে তার আশ্রয় সেবা প্রদানে প্রস্তুত।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। আমাদের মাদার ল পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত পাঁচ প্রকার বর্ণনাধীন যে কোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌনসহবাস করে, সেই ব্যক্তি 'নারী ধর্ষণ' করে বলে গণ্য হবে :
প্রথমত, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত, তার সম্মতি ব্যতিরেকে; তৃতীয়ত, তার সম্মতিক্রমে, সে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তার সম্মতি আদায় করা হয়; চতুর্থত, তার সম্মতিক্রমে যেখানে লোকটি জানে যে তার স্বামী নয় এবং সে নারীটি এই বিশ্বাসে সম্মতি দান করে যে, সে লোকটি এমন কোনো লোক যার সাথে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে তার সাথে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে; পঞ্চমত, তার সম্মতি থাকুক বা নাই থাকুক যদি সে অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়।
ধর্ষণজনিত অপরাধের বিচার এবং শাস্তি_ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী :
১। যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
২। যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্য কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূ্যন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
৩। যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূ্যন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
সবাই যখন টাঙ্গাইলের ধর্ষণ ঘটনাটি শুনল, তখনই আবার সাভারের ব্যাংক কলোনিতে আরেকটি মেয়ের একইভাবে ধর্ষিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। গোপনে সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করারও একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বেশ কিছুদিন গোপন রাখার পর ধর্ষক ধর্ষণচিত্রের ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেবে বলে বল্গ্যাকমেইলিং করছিল এবং আবার তাদের (ধর্ষকদের) কাছে যেতে বলা হচ্ছিল এবং পরে ফুটেজটি কিন্তু ঠিকই ছড়িয়ে দিয়েছিল, যা ১০ বছর বয়সী শিশুদের হাতেও এসে পড়ে! অতঃপর মেয়েটির মা মামলা করেন।
এ ক্ষেত্রে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করব পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১২-এর আরও কঠোর প্রয়োগ ও দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যাপারে। কারণ অল্পবয়স্ক এসব শিশু-কিশোরের হাতে যখন এসব ফুটেজ চলে আসে বা বাজারে যখন অতি সহজলভ্য হয় তখন এই শিশু-কিশোররাই অল্প বয়সে এসব জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এমনও হচ্ছে, ১৩-১৪ বছরের একটি শিশু তার চেয়েও দ্বিগুণ, তিনগুণ বয়সী নারীকে রাস্তায় যৌন হয়রানিসহ অশ্লীল আচরণ করছে। এভাবেই তারা শিশু বয়স থেকে বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে নিজের অজান্তেই ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এটি সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই একটি ভয়ঙ্কর অশনিসংকেত। আরেকটি বিষয় সত্যি, সাধারণ মানুষ পরিবার, পরিবারের সদস্যদের থেকে শুরু করে সমাজের বিশিষ্টজন ও নীতি-নির্ধারণী মহলসহ সর্বত্র কেন যেন ধর্ষণ-সংক্রান্ত মতবিনিময়, আলোচনাকে বিব্রতকর মনে করে।
এই যে এত বড় একেকটি ঘটনা নির্যাতিতা ও তাদের পরিবার গোপন করতে চাইছিল, আইনি পদক্ষেপ নিতে চাইছিল না এটি কিন্তু বারবার আমরা প্রায় প্রতিটি ধর্ষণ-সংক্রান্ত ঘটনাতেই দেখি। ভিকটিমের পরিবার ও তার সদস্যরা প্রথমত ভয় পায় মিডিয়াতে যখন সংবাদটি প্রকাশিত হবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, সামাজিক অবস্থান ও লোকলজ্জা নিয়ে। দ্বিতীয়ত, আসামিপক্ষের হুমকি, তাদের দ্বারা পুনরায় ভিকটিম ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নির্যাতিত হওয়া। তৃতীয়ত, বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি কারণে। বেশিরভাগ সময় থানায় গিয়েও বাদীকে অনেক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। থানায় প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় কিছু অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার উৎকোচ দাবির অভিযোগও আমরা পেয়ে থাকি এবং সেখানেও যথেষ্ট কালক্ষেপণ হয়। আসামিপক্ষ শক্তিশালী হওয়ার কারণে পুলিশ তাদের পক্ষ নেয়, সালিশির মাধ্যমেও বেশিরভাগ সময় এ ধরনের ঘটনার মীমাংসা করে ফেলা হয়, যদিও ধর্ষণের ঘটনা সালিশি অযোগ্য। ঘটনা-পরবর্তী এসব প্রভাবের কারণে পুরো পরিবারটি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, অত্যন্ত অসহায় বোধ করে, একঘরে হয়ে যায়।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অত্যন্ত কঠোর আমরা জানি। কিন্তু বিচারিক কার্যক্রম, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা না থাকায় ভিকটিম/ভুক্তভোগী ও সাক্ষী অনাগ্রহী হয়, মামলাটি মেরিট হারায়, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। ধর্ষণের শিকার একটি মেয়েকে বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিতীয়বারও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, যৌন হয়রানির কারণে বিচার চাইতে গিয়ে তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, মেয়েটি হার না মেনে মামলা করে বলে তাকে এসিড নিক্ষেপের হুমকি দেওয়া হয়, পরে তাকে সেই এসিড নিক্ষেপের করুণ পরিণতিও বরণ করে নিতে হয়।
নির্যাতনের শিকার এসব নারী সমাজের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয় না। আইন-কানুন বা বিচারব্যবস্থা যেমনই হোক না তা পুরোপুরি প্রয়োগ ও বিচার নিশ্চিত হবে শুধু তখনই যখন এর পাশাপাশি রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি সক্রিয় থাকে। রাষ্ট্রপক্ষকেই উদ্যোগী হতে হবে একটি মামলা যাতে কোনো দীর্ঘসূত্রতা বা রাজনৈতিক পেশিশক্তি দ্বারা প্রভাবান্বিত না হয়, আপস হয়ে যেতে বাধ্য না হয়।
সরকারের সব শাখা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি সমন্বয় থাকা জরুরি এবং সব সেবাদান প্রক্রিয়া হওয়া উচিত 'ওয়ান স্টপ সার্ভিস'_ যাতে কোনো কালক্ষেপণ ছাড়াই শিগগির একজন সেবাপ্রার্থী উপকৃত হতে পারেন। প্রতিটি সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ভিকটিম কাউন্সেলিং ও সুরক্ষাসেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সংশয় জাগে, নারী অগ্রগতি কি তবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এসব ক্রমবর্ধিষ্ণু সহিংসতায়? সহিংসতা শুধু আইনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যাবে না তা যত কঠোরই হোক না কেন যদি না তার যথার্থ প্রয়োগ অর্থাৎ সুবিচার নিশ্চিত না হয়, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হয় এবং যদি না হয় সচেতনতাবোধ জাগ্রত, নারীকে মূল্যায়ন করার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন।
এ ক্ষেত্রে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আইন না সামাজিক পরিবর্তন_ কোনটির প্রয়োজন সর্বাগ্রে? আমি বলব, দুটিই গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে।

সালমা আলী :মানবাধিকার কর্মী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

No comments

Powered by Blogger.