ট্রাইব্যুনালে মোমেনার জবানবন্দী আর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ডকুমেন্টে গরমিল by মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের
মোল্লাকে যে দু’টি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার
একটি হলো মিরপুর কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা
এবং মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা।
এ
ঘটনায় বেঁচে যান হযরত আলী লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা বেগম। মোমেনা বেগম
ট্রাইব্যুনালে এসে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এ
ঘটনার। একই সাক্ষী মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণের
ঘটনা বিষয়ে ২০০৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে জবানবন্দী
দিয়েছেন। ট্রাইবু্যুনালে মোমেনা বেগম বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি সেখানে
উপস্থিত ছিলেন এবং পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা দেখেছেন। তিনি
নিজেও লাঞ্ছনার শিকার হন এবং একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন। অপর দিকে
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, ঘটনার দুই দিন
আগে তিনি শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান। কোর্টে বলেন,
ঘটনাস্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত বক্তব্যে দেখা
যায় তিনি ঘটনার দুই দিন আগে শ্বশুর বাড়ি চলে যান।
ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বারকক্ষে বিচার পরিচালনা) মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে। ফলে সে সময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে বর্ণনা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে বললেন, কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারি সাগরেদ আক্তার গুণ্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এর পর তারা বাইরে বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দা হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে হত্যা করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করা হয়।
মোমেনা জানায় সে এবং তার ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খাটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং একপর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়। একপর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। একপর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। তার পরনের প্যান্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবায় কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শ্বশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।
রায়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়ে তাদের পরিবারের যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র এটি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে
হজরত আলী হত্যাকাণ্ডসহ আরো অনেক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাৎকার, লিখিত বক্তব্যের মূলকপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এ ছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা জাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্পহাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারিরা বাঙালিদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাঙ্কি এবং পাশের ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্পহাউজকে জল্লাদখানা জাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারের অনেক আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে তা জাদুঘরে সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
যে হজরত আলী হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরণ রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। হজরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ণনা লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। মোমেনা বেগমের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরণ তারা সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শ্বশুরবাড়ি চলে যান।
হজরত আলী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাৎকার জাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০০৭ তারিখ। তিনি ঘটনার যে বিবরণ দেন তা নিম্নরূপ। ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সাথে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করত। ৭ মার্চের পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে যান। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হজরত আলী লস্করের পরিবার।
হজরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সবাই যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হজরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তার যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল ৭টার দিকে বিহারিরা হজরত আলী লস্করের বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তার স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সবাইকে একসাথে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভেতর সারা দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হজরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুই দিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সে-ই প্রাণে বেঁচে যায়। প্রসঙ্গত হজরত আলীর স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
কয়েক দিন পরই এ খবর হজরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।
রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে মোমেনা বেগম পিতামাতা ও ভাইবোনকে হত্যার ঘটনাটি যে স্বচক্ষে দেখেছেন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তার বয়স ছিল তখন ১৩ বছর এবং অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। রায়ে মোমেনা বেগমের জবানবন্দী বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
আসামি পক্ষ থেকে দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানানো হয়েছে মোমেনা বেগমের যে জবানবন্দী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রক্ষিত রয়েছে তা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছিলেন তারা। ট্রাইব্যুনাল তা নথিভুক্ত করে জানিয়েছিলেন বিষয়টি তারা রায়ের সময় বিবেচনা করবেন। তবে রায়ে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে রায়ে আসামি পক্ষের দাবি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আসামি পক্ষ দাবি করেছে মোমেনা বেগম হজরত আলী লস্করের মেয়ে নন। তিনি যে হজরত আলী লস্করের মেয়ে সে মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো ডকুমেন্ট হাজির করেনি। তা ছাড়া জেরায় আসামি পক্ষ মোমেনা বেগমের যেসব দুর্বল বিষয় আনে তাও উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।
আসামি পক্ষ কর্তৃক মোমেনা বেগমের জেরা পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়েছে, জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে মোমেনা বেগম জানান, পাকিস্তান আর্মি ও বিহারিদের সাথে যে বাঙালি এসেছিল তিনি বাংলায় কথা বলেছিলেন এবং তার বাবার কলার ধরে যিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হলেন কাদের মোল্লা। তিনি খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেন। কাদের মোল্লা যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এর মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে মোমেনা বেগমের মা বাবা ভাইবোনকে কাদের মোল্লা নিজে হত্যা করেছে চার্জে সে অভিযোগ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে রায়ে বলা হয়েছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, তার সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। মানবতাবিরোধী এ ধরনের হত্যার ঘটনা ব্যক্তি সরাসরি ঘটিয়েছে তা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ ঘটনায় একজনমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী জীবিত সাক্ষী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলেন মোমেনা বেগম। তার অ্যাভিডেন্সকে পাশ কাটানো যায় না বা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যায় না।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় এর পাঁচটি অভিযোগে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। হজরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিল ছয় নম্বর অভিযোগ। এ অভিযোগসহ আরো একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয়। হজরত আলী আওয়ামী লীগ করার কারণে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় আব্দুল কাদের মোল্লা বিহারি ও আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বারকক্ষে বিচার পরিচালনা) মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে। ফলে সে সময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে বর্ণনা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে বললেন, কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারি সাগরেদ আক্তার গুণ্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এর পর তারা বাইরে বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দা হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে হত্যা করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করা হয়।
মোমেনা জানায় সে এবং তার ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খাটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং একপর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়। একপর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। একপর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। তার পরনের প্যান্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবায় কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শ্বশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।
রায়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়ে তাদের পরিবারের যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র এটি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে
হজরত আলী হত্যাকাণ্ডসহ আরো অনেক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাৎকার, লিখিত বক্তব্যের মূলকপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এ ছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা জাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্পহাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারিরা বাঙালিদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাঙ্কি এবং পাশের ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্পহাউজকে জল্লাদখানা জাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারের অনেক আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে তা জাদুঘরে সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
যে হজরত আলী হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরণ রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। হজরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ণনা লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। মোমেনা বেগমের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরণ তারা সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শ্বশুরবাড়ি চলে যান।
হজরত আলী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাৎকার জাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০০৭ তারিখ। তিনি ঘটনার যে বিবরণ দেন তা নিম্নরূপ। ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সাথে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করত। ৭ মার্চের পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে যান। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হজরত আলী লস্করের পরিবার।
হজরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সবাই যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হজরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তার যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল ৭টার দিকে বিহারিরা হজরত আলী লস্করের বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তার স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সবাইকে একসাথে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভেতর সারা দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হজরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুই দিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সে-ই প্রাণে বেঁচে যায়। প্রসঙ্গত হজরত আলীর স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
কয়েক দিন পরই এ খবর হজরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।
রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে মোমেনা বেগম পিতামাতা ও ভাইবোনকে হত্যার ঘটনাটি যে স্বচক্ষে দেখেছেন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তার বয়স ছিল তখন ১৩ বছর এবং অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। রায়ে মোমেনা বেগমের জবানবন্দী বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
আসামি পক্ষ থেকে দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানানো হয়েছে মোমেনা বেগমের যে জবানবন্দী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রক্ষিত রয়েছে তা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছিলেন তারা। ট্রাইব্যুনাল তা নথিভুক্ত করে জানিয়েছিলেন বিষয়টি তারা রায়ের সময় বিবেচনা করবেন। তবে রায়ে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে রায়ে আসামি পক্ষের দাবি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আসামি পক্ষ দাবি করেছে মোমেনা বেগম হজরত আলী লস্করের মেয়ে নন। তিনি যে হজরত আলী লস্করের মেয়ে সে মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো ডকুমেন্ট হাজির করেনি। তা ছাড়া জেরায় আসামি পক্ষ মোমেনা বেগমের যেসব দুর্বল বিষয় আনে তাও উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।
আসামি পক্ষ কর্তৃক মোমেনা বেগমের জেরা পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়েছে, জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে মোমেনা বেগম জানান, পাকিস্তান আর্মি ও বিহারিদের সাথে যে বাঙালি এসেছিল তিনি বাংলায় কথা বলেছিলেন এবং তার বাবার কলার ধরে যিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হলেন কাদের মোল্লা। তিনি খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেন। কাদের মোল্লা যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এর মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে মোমেনা বেগমের মা বাবা ভাইবোনকে কাদের মোল্লা নিজে হত্যা করেছে চার্জে সে অভিযোগ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে রায়ে বলা হয়েছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, তার সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। মানবতাবিরোধী এ ধরনের হত্যার ঘটনা ব্যক্তি সরাসরি ঘটিয়েছে তা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ ঘটনায় একজনমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী জীবিত সাক্ষী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলেন মোমেনা বেগম। তার অ্যাভিডেন্সকে পাশ কাটানো যায় না বা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যায় না।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় এর পাঁচটি অভিযোগে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। হজরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিল ছয় নম্বর অভিযোগ। এ অভিযোগসহ আরো একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয়। হজরত আলী আওয়ামী লীগ করার কারণে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় আব্দুল কাদের মোল্লা বিহারি ও আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
No comments