প্রধানমন্ত্রীর উচিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা by সিরাজুর রহমান

মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান অনুপস্থিত ছিলেন। জ্ঞাতসারে ধরা দিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারাও স্বদেশে ছিলেন না।
এরা পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন, ভারত সরকারের দাক্ষিণ্যে কলকাতার হোটেল ও গেস্ট হাউজগুলোতে আরামেই ছিলেন। শেখ হাসিনারও কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি মুক্তিযুদ্ধে। সে সময়েই জন্ম হয় সজীবের। নিরাশার ঘনঘটাময় সে দিনগুলোতে নাতি আসায় বেগম মুজিবের প্রাণ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। তিনি নাতির নাম রাখেন সজীব। বেগম মুজিব নিজে আমাকে বলেছেন সেসব কথা। তাছাড়া জ্যেষ্ঠ কন্যাকে রাজনীতি করার উপযোগী বুদ্ধিমান মনে করেননি শেখ মুজিব। কন্যা ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তিনি শঙ্কিত হয়েছিলেন। তার মাথা থেকে ‘রাজনীতির ভূত, দূর করার আশাতেই তিনি কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধে। কেউ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, কেউ জনমত গঠন করেছেন। অন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সাহায্য দিয়েছেন, তাদের মনোবল বাড়িয়েছেন। বিদেশে আমরা যারা বিশ্বজনমত গঠনে ব্যস্ত ছিলাম, প্রায়ই আমাদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কোন পথে চলবে সে দেশ? কী নীতি ও আদর্শে দেশ চালাবে তোমরা? ইত্যাদি। জবাবগুলো আমাদের কর্মীদের শিখিয়ে দিতে হয়নি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা বলেছেন, গণতন্ত্র আমাদের সংস্কৃতি, সংসদীয় গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাসী। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতির অনুসরণে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলব।

মনে রাখবেন, আমরা তখনো পরাধীন ছিলাম। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আর সামরিক জান্তা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন আমাদের ওপর। আমার বিরুদ্ধে বিবিসির কাছে, আর বিবিসির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারবার অভিযোগ করেছেন এরা। বলেছেন, আমরা বিদেশে স্বদেশের বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়াচ্ছি, আমরা রাষ্ট্রদ্রোহিতা করছি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমাদের আর মাতৃভূমিতে ফেরত যাওয়া সম্ভব হবে না।

নিন্দা করা, অপবাদ দেয়া ভালো কথা কিংবা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নয়। স্বদেশের বিরুদ্ধে বিদেশে অপবাদ প্রচার করা তো নয়ই। কিন্তু… একটা কিন্তু সব ব্যাপারেই থাকে। একাত্তরে আমরা উপায়ান্তরবিহীন ছিলাম, একটা জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন ছিল। আমাদের সংগ্রাম ছিল চরম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার সংগ্রাম। পাকিস্তানকে তখন আর আমরা স্বদেশ মনে করতে পারছিলাম না। আমাদের সমালোচনা তখন ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন।

এমন কিছু মানুষ থাকে, স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তির নিয়মের মধ্যে এরা পড়ে না। নিন্দা করা, কুৎসা রটনা তাদের স্বাভাবিক ধর্ম। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারে যারা আছেন, তারা সে জাতের মানুষ। রাজনৈতিক বিরোধীদের, বিশেষ করে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। এটা আজকের কিংবা গতকালের কথা নয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কর্মসূচি অনুসারে ১৯৮১ সালের মে মাসে আওয়ামী লীগের দু’জন সিনিয়র নেতা ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। এর মাত্র ১৩ দিন পর এক সামরিক ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন।



গালিগালাজের মহাভারত

সেদিন থেকেই শেখ হাসিনা যে জিয়া, তার পরিবার ও তার দলের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপবাদ রটনা শুরু করেছিলেন আজ অবধি তাতে বিরতি হয়নি। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। সারা দুনিয়ার কয়েক শ’ সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক সে উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে ৪৫ মিনিট ধরে খালেদা জিয়া, তার পরিবার ও বিএনপির বিরুদ্ধে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেন। বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা স্তম্ভিত, মর্মাহত হয়ে গিয়েছিলেন সে রাতে।

তারপর থেকে কুৎসা ও অপবাদ রটনাকে তার স্বাভাবিক চরিত্র ও সংস্কৃতির গণ্ডি হিসেবে সবাই ধরে নিয়েছেন। প্রতিনিয়তই তিনি খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে গালাগালি করছেন, ক্রুদ্ধ হুঙ্কার চাড়ছেন তাদের বিরুদ্ধে। পুরনো ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানতে পারে না, তাদের জানতে দেয়া হয় না। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযানের সেটাই উদ্দেশ্য।

বিদেশ ভ্রমণ শেখ হাসিনার সবচেয়ে প্রিয় বিলাস। একটা গরিব রাষ্ট্রের ব্যয়ে (যে রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা) কত দেশ যে তিনি ভ্রমণ করেছেন, হিসাবে রাখা আর সম্ভব নয়। নিজের ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনী, ছোটবোন ও তার সন্তানদের জন্মদিন, বিয়ে উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফাইটে ডজন ডজন চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেন, রাষ্ট্রের ব্যয়ে সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে থাকেন, পার্টি করেন। বাংলাদেশের জাতীয় এয়ারলাইন যেসব কারণে প্রায়ই দেউলিয়া অবস্থায় থাকে তার অন্যতম হচ্ছে হাসিনার ভ্রমণ বিলাস।

একটি পত্রিকা গোষ্ঠী, কোনো কোনো বিদেশী দূতাবাস আর একজন দেশদ্রোহী সেনাপতির সাথে ষড়যন্ত্র করে শেখ হাসিনা একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকার এনেছিলেন ২০০৭ সালে। মাইনাস-টুর ছদ্মবেশে এরা মাইনাস-ওয়ান চালু করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে। খালেদা জিয়া আর বিএনপিকে মাইনাস করা গেলে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র চালুতে বাধা থাকবে নাÑ সেটাই ছিল পরিকল্পনা। অনেক ঢং করেছে সে সরকার। খালেদা জিয়াকে নির্বাসনে পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে তাকে কারারুদ্ধ করে তারা। লোক-দেখানোভাবে শেখ হাসিনাকেও কিছু দিন বিশেষ কারাগারে রাখা হয় কিন্তু কিছু দিনের ভেতরই চিকিৎসার নাম করে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় তাকে। মাতৃস্নেহে বিমানবন্দরে তিনি বলে যান, ফখরুদ্দীন-মইন উ সরকার তার আন্দোলনের ফসল এবং গদি ফিরে পেলে সে সরকারের সব কাজকর্ম তিনি বৈধ করে দেবেন।

মাতৃস্নেহের লালিত ষড়যন্ত্র

আসলে চিকিৎসা একটা ছলনামাত্র ছিল। দেখা গেল সে সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও গেছেন ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফিনল্যান্ডে এবং বরাবরের স্বভাব অনুযায়ী সর্বত্রই তিনি খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের ও দেশের প্রধান বিরোধী দলকে গালিগালাজ করেছেন। বলাই বাহুল্য, প্যারোলের শর্ত ভঙ্গ করে বিদেশে তার এসব রাজনৈতিক অপকর্মের বিরুদ্ধে বর্ণচোরা সামরিক সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

২০০৭ সালের ষড়যন্ত্রে গদি পেয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা ও রাষ্ট্রকে চুরি করেছেন। বিরোধী দলগুলোর সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। তাদের সভা-সমিতি কিংবা মিছিল করার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে একান্তভাবেই রাজনৈতিক বিরোধিতা দলনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের উদ্যোগে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও খুন করা হচ্ছে। খুন, গ্রেফতার, হামলা ও মামলা এ সরকারের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলগুলোকে দলনের কাজে পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর ক্যাডারদের নামানো হচ্ছে। সরকার বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে আওয়ামী লীগ ময়দানে থাকবে। কিন্তু সারা পৃথিবী জানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা পুলিশের দায়িত্ব, কোনো রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের নয়। বাংলাদেশ আজ ভয়-ভীতি, আতঙ্ক আর প্রতিহিংসার দেশ।



পাঁচ কিলোমিটারের সেতু চুরি

একই সাথে চুরি ও দুর্নীতির জন্য বিশ্বব্যাপী ধিকৃত ও কুখ্যাত আজকের বাংলাদেশ সরকার। শেয়ারবাজার লুণ্ঠন করে ৩৫ লাখ মধ্যবিত্তের যৎসামান্য সঞ্চয় শাসকগোষ্ঠী শুষে নিয়েছে। টেন্ডারবিহীন কুইক রেন্টাল বাবদ রাষ্ট্র হারিয়েছে আনুমানিক ২০ হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি গ্রুপ আর হলমার্ক কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে জনসাধারণের গচ্ছিত আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরি করেছে। সরকারের নিজের সবচেয়ে বড় চুরি হচ্ছে পদ্মা সেতু।

সুরম্য সড়ক ও রেললাইনবিশিষ্ট পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ অপূর্ব একটি সেতুর নকশা তৈরি হয়েছিল। সেতুটি তৈরি হলে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ নাটকীয়ভাবে উন্নত হতো। কথা ছিল ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ের ১২০ কোটি ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক। অবশিষ্ট অর্থের জোগান দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান উন্নয়ন সংস্থাÑজাইকা। কিন্তু গোড়াতেই সরকারি মহল থেকে চুরি হলো এবং চুরি ধরে ফেলল বিশ্বব্যাংক। তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে সরকার গোড়া থেকেই আপত্তি করে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের (যাকে হাসিনা দেশপ্রেমিক বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন) বিচারের দাবিতে বিশ্বব্যাংক সেতুর অর্থায়ন করতে অসম্মতি জানায়।

তাদের দেখাদেখি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও অর্থায়নের প্রস্তাব থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। গত রোববার সেতুর অর্থায়নের লক্ষ্যে আহূত সম্মেলনে ৪০টির বেশি সম্ভাব্য দাতা দেশ ও সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তাদের অর্ধেকেরও কম সম্মেলনে উপস্থিত ছিল। যারা এসেছিল তারাও অর্থের জোগান দিতে উৎসাহ দেখায়নি। আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারে কেন সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর এত আপত্তি? তার বিচার হলে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের কারো কোনো বিপদের কারণ ঘটত কি?

পদ্মা সেতু চুরি করেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি। এখন আবার চলছে দেশবাসীকে প্রতারণা করার চক্রান্ত। মন্ত্রীদের একেকজন একেক কথা বলে জনসাধারণের বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর যে ভীমরতি ধরেছে সেটা সবাই এখন বুঝে গেছে। তিনি বলছেন, তিন বছরের মধ্যেই সেতু তৈরি হবে এবং নিজস্ব সম্পদ থেকেই পদ্মা সেতু তৈরি হবে। কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, বিদেশী সাহায্য ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যেই নানা ফেরেববাজি ধরা পড়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে সেতু হবে, কিন্তু তাতে রেলপথ থাকবে না। এক আবুল হোসেন কি এতই গুরুত্বপূর্ণ? অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেতু তৈরির টেন্ডার আহ্বান করা হবে। কিন্তু মাত্র তার আগের সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে সেতুর সংশোধিত নকশা চূড়ান্ত করার জন্য বুয়েটের প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, নকশা তৈরির আগেই সেতু তৈরির টেন্ডার দেয়া হবে? অর্থাৎ আরো হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির আয়োজন কি শুরু হয়ে গেছে?



সারা বিশ্বের অচ্ছুত দেশ বাংলাদেশ

বাংলাদেশের নামে সারা দুনিয়া আজ ছি ছি করে। প্রথমে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকারের চূড়ান্ত অবমাননা, তারপর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের ক্রুসেড, বিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও স্বৈরতন্ত্রী প্রশাসন স্টাইল, পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের ধরা পড়ে যাওয়া দুর্নীতি এবং চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী আর মোফাজ্জল হোসেন মজুমদার প্রমুখ প্রভাবশালী বিএনপি নেতাকে ছিনতাই ও গুম করে ফেলা ইত্যাদি কারণে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের সোচ্চার নিন্দা করছে। বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। তৈরী পোশাকসহ বাংলাদেশের রফতানি বাজার ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। বিদেশে এই হচ্ছে অবস্থা। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালে দিল্লিতে গিয়ে অজ্ঞাতসংখ্যক গোপন চুক্তি করে এসেছেন। চুক্তির বিবরণ জাতিকে জানতে দেয়া হয়নি কিন্তু সেসব চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক এলাকা ও সম্পদ ভারতের কাছে সমর্পণ করা হচ্ছে।

সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করা কারো কারো বিলাস। ২০০৭ সালেই শুধু নয়, তার আগেও কয়েকবার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য কেউ কেউ সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটা ব্যর্থ অভ্যুত্থান করিয়েছিলেন কারা, তা সবার জানা। নয় বছরের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সময় কে জেনারেল এরশাদকে সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছেন, এরশাদের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন কারা! যে ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন সে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহের জালের বাইরে নন। বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন পদস্থ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, কিন্তু সেই বিদ্রোহের পটভূমি সম্বন্ধে কোনো তদন্ত হয়নি এবং হচ্ছে না।

‘সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনী প্রতিহত করবে’Ñ এই আশা সবাই করতে পারেন। কিন্তু কেউ কি এ কথাও কখনো ভেবে দেখেছেন, সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী কাজগুলো করছেন কে? মন্ত্রিসভার অনুমোদন না নিয়ে অত্যন্ত চড়া সুদের ঋণে রাশিয়া থেকে সন্দেহজনক পদ্ধতিতে সমরাস্ত্র ক্রয় কি গণতান্ত্রিক স্টাইল?  সমালোচনা ও সভা-সমাবেশ করার যে অধিকার সংবিধানে বিরোধী দলকে দেয়া হয়েছে সে অধিকারে হস্তক্ষেপ কি সংবিধান লঙ্ঘন নয়?

আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের গণতন্ত্র এবং আমাদের সম্পদ বিপন্ন। অনুরূপ অবস্থার প্রতিবিধানের জন্যই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সেজন্যই প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের সর্বস্ব দিয়ে আন্দোলন করেছিল, বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ দিলেও আমরা পিছপা হইনি।

আজ আবার সে একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আরো একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন এখন তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। সৌভাগ্যবশত বিশ্বের মিডিয়া পরিস্থিতি একাত্তরের চেয়ে কয়েক শত গুণ এগিয়ে গেছে। এখন আর প্রিন্ট মিডিয়ার ওপর বিশ্বের জনমত নির্ভর করে না। স্যাটেলাইট, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির দৌলতে কোনো দেশেরই ভেতরের খবর বাইরের বিশ্বের অজানা থাকছে না।

হয়তো সে কারণেই প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন জানতে চেয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা। কোনো গোপন কথা লেখেননি তিনি, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কোনোভাবে বিপন্ন করেননি। তিনি শুধু শাসক রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচার আর গণতন্ত্র হত্যার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ঠিক এ কাজই আমরা বিদেশে বসে ১৯৭১ সালে এবং কিছু পরিমাণে আশির দশকের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সময়ে করেছিলাম।

তাছাড়া ইন্টারনেটের দৌলতে এসব বিষয়ই বিশ্ববাসীর জানা হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার আওয়ামী লীগ ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছে। সেটাও খুবই স্বাভাবিক। ফাঁদে পড়ে গেলে শেয়াল আর ধরা পড়ে গেলে চোর কেমন ক্রোধে ফেটে পড়ে সবারই জানা আছে। একাত্তর সালে ইয়াহিয়া খান আর তার সামরিক জান্তা এর চেয়ে কম ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন আমাদের ওপর? কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে, তাদের ক্রোধ আর হিংস্রতার কারণে বিশ্বজনমত আমাদের দিকেই সরে এসেছিল, আমাদের জয় হয়েছিল। এবারো জয় গণতন্ত্রের হবে। হিংস্র স্বৈরতন্ত্র যে তৈমুর লং আর চেঙ্গিস খানের সময়েই খতম হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের হট-হেডরা সেটা মনে রাখলে ভালো করবেন।

প্রতিদিনই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করার, তাকে গ্রেফতার করার ভয় দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার স্থূলমতি নেতারা। সেটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। সাজানো মামলা এবং প্রতিপক্ষের ওপর হামলা এ সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তারা ভেবেচিন্তে কথা বলে না। ইতিহাসের ওপর তাদের জাতক্রোধ। ইতিহাসকে তারা বিকৃত করে কিন্তু নিজেদের ইতিহাসও একবার পর্যালোচনা করে দেখে না। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানিরা বারবার জেলে পুরেছে। আগরতলা মামলাসহ আরো অনেক মামলা করেছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে দলীয়কৃত ও আজ্ঞাবহ আদালতের ওপরেও আরো বড় আদালত আছে। গণশক্তির কাছে সব আদালতকেই পরাজয় স্বীকার করতে হয়। ১৯৬৯ সালে জনশক্তির রোষের মুখেই পাকিস্তানিরা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

খালেদা জিয়ার পেছনে বাংলাদেশে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী গণ-আন্দোলন প্রস্তুত হয়ে আছে। তিনি যদি তাদের নির্দেশ দেবার সাহস সঞ্চয় করতে পারেন যেকোনো মুহূর্তে এ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সঙ্ঘবদ্ধ জনতা উদগ্রীব হয়ে আছে। এক জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনেই হিমশিম খাচ্ছে সরকার। তার ওপর খালেদা জিয়ার গায়ে যদি হাত দেয়া হয়, যদি তাকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে ভেবে দেখা নিজেদের স্বার্থেই সরকারের উচিত হবে।

(লন্ডন, ০৫.০২.২০১৩)

serajurrahman34@gmail.com

 

No comments

Powered by Blogger.