রাজনৈতিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ভাষা by শহিদুল ইসলাম
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভাষার প্রশ্নটি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বলা যায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে
কেন্দ্র করেই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। তাই ভাষা ও তদসংক্রান্ত
বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
ভাষা আন্দোলনের
কথা জানেন না কিংবা শোনেননি এমন একজন মানুষ বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না।
তার ওপর একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের ইউনেসকো 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'
ঘোষণা করে আমাদের সে সংগ্রামের কথা বিশ্ববাসীর আলোচনায় পরিণত করেছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরের
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল
হকের 'পাকিস্তান প্রস্তাবের পরপরই এ দেশের বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাই বলা
যায়, ১৯৪৮ সালের জিন্নাহর ঘোষণার আগেই বাংলা ভাষা ও সে ভাষায় রচিত
সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে শিক্ষিত শ্রেণী পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। তার
সামান্য ইতিহাস সবার জানা দরকার।
কেবল ভাষার প্রশ্নই নয়, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস লিখতে বসলে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতা সব সময় আমাদের সামনে রাখা উচিত। কারণ তারপরই এ কে ফজলুল হক পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে যে 'পাকিস্তান প্রস্তাব'টি পাঠ করেন, জিন্নাহ তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তাঁর ভাবাদর্শিক ভিত্তিটি ঘোষণা করেন। সেই বক্তৃতা পাকিস্তান সৃষ্টির দর্শন, যা 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' নামে ইতিহাসে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, ভারতবর্ষে বসবাসরত হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। তিনি বলেন, যেকোনো রাষ্ট্রীয় দর্শনের আলোকে ভারতের সব মুসলমান একটি জাতি। এতে কোনো ভুল নেই। তিনি সেদিন শুধু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকেই আক্রমণ করেন তা নয়, তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদেরও কঠোর ভাষায় গালাগাল করেন হিন্দুদের দালাল বলে। সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদটি এখানে উল্লেখ করা হলো। পাঠক লক্ষ করবেন, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে জিন্নাহর সেই 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' আজ ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দুবারের সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ সবাই বলেন, কেবল ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের মধ্যে আর কোনো মিল নেই। অথচ জিন্নাহ বলেন, 'আমরা ১০০' মিলিয়নের একটি জাতি। তার চেয়েও বড় এটা যে আমাদের ভিন্নতর সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যশিল্প, নাম ও নামকরণের পদ্ধতি, মূল্যবোধ ও তার পরিসীমা সম্পর্কে আমাদের ধারণা, আইন ও নৈতিক মূল্যবোধ, পোশাক-আশাক ও ক্যালেন্ডার, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রবণতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাসহ আমরা একটি আলাদা জাতি। সংক্ষেপে জীবনবোধ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিকোণ আলাদা- একান্তভাবে তা আমাদের। সব আন্তর্জাতিক আইনানুসারে আমরা একটি জাতি।' এটাই পাকিস্তানের মূল আদর্শিক ভিত্তি।
কিন্তু আজ প্রমাণিত হয়েছে, জিন্নাহর সে কথা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। জিন্নাহর সেই ভুল কথায় আস্থা স্থাপন করেছিল ভারতবর্ষের প্রায় সব মুসলমান। কিছুদিনের জন্য তারা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিনের জন্য সত্যিই তারা কালোকে সাদা বলতেও প্রস্তুত ছিল। একমাত্র ধর্ম ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আর কোনো কিছুতেই মিল ছিল না। আজ ভাবলে অবাক হতে হয়, 'ভারতবর্ষের ১০০ মিলিয়ন মুসলমান' একই ভাষায় কথা বলত, জিন্নাহর এত বড় মিথ্যা কথা তারা বিশ্বাস করল কী করে? কিন্তু সত্যি কথাটা তো মওলানা আবুল কালাম আজাদ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন। আজ জিন্নাহর কথা অবিশ্বাস করার মানুষের অভাব নেই। সবাই সে কথা বলেন। আজ মাত্র একজনের কথা আমি উল্লেখ করব। কারণ তিনি একজন সাচ্চা পাকিস্তানি এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি মুক্তিফৌজ ও ভারতের যৌথ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে এ অঞ্চলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষণা করেন। তিনি জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। ১৯৯৮ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত 'পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা' নামের গ্রন্থে তিনি যা লেখেন, তা জিন্নাহর সে দাবি নাকচ করে দেয়। নিয়াজি লেখেন, 'পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের মধ্যে ধর্ম ছাড়া আর তেমন কোনো সাদৃশ্য নেই। দুই প্রদেশের মধ্যে দূরত্ব বড় বাধা। দুই প্রদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তাদের ভাষা আলাদা। তাদের আচার-অনুষ্ঠান-ঐতিহ্য মিলেমিশে কখনোই এক হতে পারেনি। তাদের খাদ্যাভ্যাস আলাদা। পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে কোনো মিল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক। উভয়েই তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, অভ্যাস ও সামাজিক অবকাঠামোয় বিশ্বাসী।'
নিয়াজির এ বক্তব্য জিন্নাহর বক্তব্যকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয়। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে দূরত্বকে জিন্নাহ সেদিন পাত্তাই দেননি। আজ নিয়াজি বলছেন, দুই প্রদেশের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের সেটাই ছিল বড় বাধা। জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতবর্ষের ১০০ মিলিয়ন মুসলমান এক ভাষাতেই কথা বলে। নিয়াজি তা বিশ্বাস করেন না। মওলানা আজাদ বলেছিলেন, পাকিস্তান অর্জন ও তা ভোগ না করা পর্যন্ত ভারতবর্ষের মুসলমান জিন্নাহর সে মিথ্যাচার স্বীকার করবে না। ঠিক তা-ই হয়েছে। পাকিস্তান অর্জন করে ২৪ বছর তা ভোগ করার পর যখন পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যায়, তখনই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সে কথাটি স্বীকার করলেন। সেই সত্যটি প্রমাণ করতে ৩০ লাখ বাঙালিকে জীবন ও চার লাখ মা-বোনকে তাদের সম্মান ও জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল। পাকিস্তান অর্জনের পরপরই ভাষার প্রশ্নও সামনে চলে আসে এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে নিয়েই গড়ে ওঠে এ দেশের পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতি। ভারতবর্ষের সব প্রদেশের মুসলমান যে একই ভাষায় কথা বলত না, এখনো বলে না, সে কথা প্রমাণ করার জন্য আমাদের অন্য কোনো দেশে যেতে হয় না। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলোর মানুষের ভাষা-বৈচিত্র্যের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ৯৭ শতাংশ এবং পূর্ব বাংলার ৮০ শতাংশ মানুষ ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের ভাষা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। দেখা যায়, পূর্ব বাংলা প্রায় একটি একক জনগোষ্ঠীর অঞ্চল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান একটি বহু ভাষাভিত্তিক অঞ্চল। পূর্ব বাংলায় বাংলা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের ভাষাভাষী মানুষের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ঠিক তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো প্রদেশে বাংলাভাষী মানুষের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশের ভাষার এই পার্থক্য যে কোনো একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গড়ে তোলা ছিল অসম্ভব। কোনো একটি ভাষা উভয় অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বাঙালির মাতৃভাষা যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল প্রায় অপরিচিত; তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ভাষা যেমন পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচ পূর্ব বাংলায় ছিল অপরিচিত। অবশ্য উর্দু পূর্ব বাংলার কিছু লোক বলত। তারা বিহার থেকে আসা উদ্বাস্তু এবং নবাব ও অভিজাত শ্রেণীর কিছু মানুষ। শুধু তাই নয়, তাদের লিপির পার্থক্য কোনো একটি ভাষাকে অপর অংশে প্রচলন করা কঠিন করে তুলেছিল। বাঙালিরা তাদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে। উনিশ শতকীয় ভারতবর্ষের নবজাগরণের সূচনা এ বাংলা থেকেই। বাংলা ভাষা ভারতবর্ষের একমাত্র ভাষা, যে ভাষায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান এবং বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেন। বিশ্বকবির মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্বভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। তাই বাঙালি তার ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে ক্রমেই গর্বিত হয়ে উঠতে থাকে।
১৯২৫ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলমানের জন্য 'মুসলিম সাহিত্য' রচনার অনুরোধ করেছিলেন। 'মুসলিম সাহিত্য' কী জিনিস নজরুল তা বুঝতে পারেননি। ১৩৫১ বঙ্গাব্দে কলকাতার 'রেনেসাঁ সোসাইটি'র উদ্যোগে রেনেসাঁ-সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ স্পষ্টই বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুব উন্নত সাহিত্য। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন। তবু এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানের কোনো দান নেই। শুধু তা-ই নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রাণ-প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানি নয়, এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। প্রথমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথাই ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু মনীষার সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু-সংস্কৃতকে বুনিয়াদ করে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই তাঁরা করেছেন। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না; কিন্তু সত্য কথা এই যে ওই সাহিত্যকে মুসলমানরা জাতীয় সাহিত্য মনে করে না।'
দেখা যায়, ১৯৪২ সালেই ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্নে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশ সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দরাবাদ মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং একই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানি জাতির (!) পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা দেওয়ার আগেই উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দিতে শুরু করেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা আর বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে তা মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য- এমন বক্তব্য প্রকাশ করতে থাকে প্রতিক্রিয়াশলী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। ইতিহাস প্রমাণ করে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। দেশভাগের আগে সে আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল কেবল শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। ১৯৪৮ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জিন্নাহর ঘোষণা সে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে, রাজনৈতিক রং চড়ায়।
বাংলা ভাষার পক্ষেও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ লেখালেখি শুরু করে। সম্ভবত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলার পক্ষে প্রথম কলমযুদ্ধ শুরু করেন। ড. জিয়াউদ্দীন আহমদের ওই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধে নানা যুক্তি তুলে ধরেন এবং শেষে বলেন, 'বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতিবিরোধী নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।'
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা নতুন করে আরেক পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানপন্থীদের উর্দুর পক্ষাবলম্বনের বিরুদ্ধে প্রথম যুগে যাঁরা বাংলা ভাষার পক্ষে কলম তুলে নেন, তাঁদের পথিকৃৎ হলেন প্রখাত প্রাবন্ধিক আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বিভিন্ন ছদ্মনামে চারটি প্রবন্ধ লেখেন। সেসব প্রবন্ধে তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলা ভাষার পক্ষে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে 'বাংলা বানান বিষয়ে প্রস্তাব' (২২ ও ২৩ জুন, ১৯৪৭)' 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (দৈনিক আজাদ, ৩০ জুন ১৯৪৭), 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে' (ইত্তেহাদ, ২৭ জুলাই, ১৯৪৭) এবং 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (সাপ্তাহিক বেগম, ৩ আগস্ট ১৯৪৭) তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর পেছনে লেগে যায়। পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার জোর প্রচার চালান। প্রতিবাদে আবদুল হক লেখেন 'আরবি হরফে বাংলা' (দৈনিক ইত্তেহাদ ও রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগ, ২০ মার্চ, ১৯৪৯)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পর ভাষাবিষয়ক আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। পাকিস্তানি ভাবাদর্শ 'দ্বিজাতিতত্ত্বের' বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরুর আগে বাংলা ভাষা ও সে ভাষায় রচিত সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই তা শুরু হয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের অর্থ কী? জিন্নাহ ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ অধিবেশনে তা সবিস্তারে উত্থাপন করেছিলেন। তার অর্থ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসরত ১০০ মিলিয়ন মুসলমান একটি আলাদা জাতি আর হিন্দুরা আরেকটি জাতি। ধর্ম দিয়েই জিন্নাহ জাতিতত্ত্বের সংজ্ঞা নির্ণয় করেছিলেন। প্রখ্যাত ভারততাত্ত্বিক ক্রেগ ব্যাক্সটার বলেন, জিন্নাহ জাতি ও জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ করতে পারেননি। 'প্রথম জাতি বলতে তিনি হিন্দু ও মুসলমানকে বুঝিয়েছেন। তারপর জাতির অর্থ তার কাছে দাঁড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান।' বিল ও লাইডেনের বই থেকে জানা যায়, পশ্চিমা শক্তি ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১৯৫৮ সালের আগে দুটি যুদ্ধে পরাজয়ের পর আরব দেশগুলো অনুভব করে, ধর্মের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে একত্রিত হলেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব। তাই ১৯৫০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমপ্রধান দেশগুলো একত্রিত হতে চেষ্টা করে; কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কারণ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এত গভীর যে সে ঐক্যপ্রক্রিয়া সাফল্যের মুখ দেখেনি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে কোনো 'জাতিরাষ্ট্র' গঠিত হয়নি। তাই ১৯৯১ সালে বিবিসির সংবাদদাতা তাঁর বিখ্যাত Waiting For Allah বইতে লিখেছেন, 'জিন্নাহ একটি জাতির (মুসলমান) জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন, ৪৫ বছর পর সেই রাষ্ট্রটি (পাকিস্তান) আজও একটি জাতির সন্ধানে ঘুরে ফিরছে।' আসলেই জিন্নাহর দাবি ছিল সোনার পাথরবাটি। তাই আজও তা মিলল না।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান 'মুসলমান বাঙালি'তে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তাই অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন' বলে অভিহিত করা হয়েছিল। মওলানা আজাদ বলেছিলেন, পাকিস্তান না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যুক্তি মুসলমানদের কানে ঢুকবে না। ঠিক তা-ই হয়েছে। ব্রিটিশের অত্যাচার-নির্যাতন ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ একটি ভারতীয় জাতি গঠনে সহায়ক হয়েছিল। তেমনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায় এবং মুসলমান বাঙালি দ্রুত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' পরিত্যাগ করে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদে' বিশ্বাস স্থাপন করে। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকে এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি প্রমাণ করে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মাথায় বাঙালি মুসলমানের মোহ অনেকটাই কেটে গেছে।
পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শকের কাজ করেছে। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার বিরোধিতা থেকে শুরু করে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন ও 'ছায়ানট' নামের প্রতিবাদী রবীন্দ্রসংগীত একাডেমী গঠন এবং ১৯৬৭ সালে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের গৌরবময় প্রতিবাদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা 'উদীচী' তার উজ্জ্বলতম সাক্ষ্য। প্রমাণ করা মোটেই কষ্টকর নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সব সময়ই পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী এক হাতিয়ার ছিল। কিন্তু ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজের উপরিকাঠামোর অন্তর্গত। অর্থনীতিই হলো সমাজের মূল কাঠামো। তার ওপরই গড়ে ওঠে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিসহ সব কিছু। তাই পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে প্রথমে এ দেশের মানুষ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সে দাবি এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার দাবিতে পৌঁছে দেয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ
কেবল ভাষার প্রশ্নই নয়, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস লিখতে বসলে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতা সব সময় আমাদের সামনে রাখা উচিত। কারণ তারপরই এ কে ফজলুল হক পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে যে 'পাকিস্তান প্রস্তাব'টি পাঠ করেন, জিন্নাহ তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তাঁর ভাবাদর্শিক ভিত্তিটি ঘোষণা করেন। সেই বক্তৃতা পাকিস্তান সৃষ্টির দর্শন, যা 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' নামে ইতিহাসে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, ভারতবর্ষে বসবাসরত হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। তিনি বলেন, যেকোনো রাষ্ট্রীয় দর্শনের আলোকে ভারতের সব মুসলমান একটি জাতি। এতে কোনো ভুল নেই। তিনি সেদিন শুধু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকেই আক্রমণ করেন তা নয়, তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদেরও কঠোর ভাষায় গালাগাল করেন হিন্দুদের দালাল বলে। সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদটি এখানে উল্লেখ করা হলো। পাঠক লক্ষ করবেন, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে জিন্নাহর সেই 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' আজ ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দুবারের সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ সবাই বলেন, কেবল ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের মধ্যে আর কোনো মিল নেই। অথচ জিন্নাহ বলেন, 'আমরা ১০০' মিলিয়নের একটি জাতি। তার চেয়েও বড় এটা যে আমাদের ভিন্নতর সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যশিল্প, নাম ও নামকরণের পদ্ধতি, মূল্যবোধ ও তার পরিসীমা সম্পর্কে আমাদের ধারণা, আইন ও নৈতিক মূল্যবোধ, পোশাক-আশাক ও ক্যালেন্ডার, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রবণতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাসহ আমরা একটি আলাদা জাতি। সংক্ষেপে জীবনবোধ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিকোণ আলাদা- একান্তভাবে তা আমাদের। সব আন্তর্জাতিক আইনানুসারে আমরা একটি জাতি।' এটাই পাকিস্তানের মূল আদর্শিক ভিত্তি।
কিন্তু আজ প্রমাণিত হয়েছে, জিন্নাহর সে কথা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। জিন্নাহর সেই ভুল কথায় আস্থা স্থাপন করেছিল ভারতবর্ষের প্রায় সব মুসলমান। কিছুদিনের জন্য তারা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিনের জন্য সত্যিই তারা কালোকে সাদা বলতেও প্রস্তুত ছিল। একমাত্র ধর্ম ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আর কোনো কিছুতেই মিল ছিল না। আজ ভাবলে অবাক হতে হয়, 'ভারতবর্ষের ১০০ মিলিয়ন মুসলমান' একই ভাষায় কথা বলত, জিন্নাহর এত বড় মিথ্যা কথা তারা বিশ্বাস করল কী করে? কিন্তু সত্যি কথাটা তো মওলানা আবুল কালাম আজাদ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন। আজ জিন্নাহর কথা অবিশ্বাস করার মানুষের অভাব নেই। সবাই সে কথা বলেন। আজ মাত্র একজনের কথা আমি উল্লেখ করব। কারণ তিনি একজন সাচ্চা পাকিস্তানি এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি মুক্তিফৌজ ও ভারতের যৌথ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে এ অঞ্চলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষণা করেন। তিনি জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। ১৯৯৮ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত 'পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা' নামের গ্রন্থে তিনি যা লেখেন, তা জিন্নাহর সে দাবি নাকচ করে দেয়। নিয়াজি লেখেন, 'পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের মধ্যে ধর্ম ছাড়া আর তেমন কোনো সাদৃশ্য নেই। দুই প্রদেশের মধ্যে দূরত্ব বড় বাধা। দুই প্রদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তাদের ভাষা আলাদা। তাদের আচার-অনুষ্ঠান-ঐতিহ্য মিলেমিশে কখনোই এক হতে পারেনি। তাদের খাদ্যাভ্যাস আলাদা। পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে কোনো মিল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক। উভয়েই তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, অভ্যাস ও সামাজিক অবকাঠামোয় বিশ্বাসী।'
নিয়াজির এ বক্তব্য জিন্নাহর বক্তব্যকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয়। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে দূরত্বকে জিন্নাহ সেদিন পাত্তাই দেননি। আজ নিয়াজি বলছেন, দুই প্রদেশের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের সেটাই ছিল বড় বাধা। জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতবর্ষের ১০০ মিলিয়ন মুসলমান এক ভাষাতেই কথা বলে। নিয়াজি তা বিশ্বাস করেন না। মওলানা আজাদ বলেছিলেন, পাকিস্তান অর্জন ও তা ভোগ না করা পর্যন্ত ভারতবর্ষের মুসলমান জিন্নাহর সে মিথ্যাচার স্বীকার করবে না। ঠিক তা-ই হয়েছে। পাকিস্তান অর্জন করে ২৪ বছর তা ভোগ করার পর যখন পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যায়, তখনই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সে কথাটি স্বীকার করলেন। সেই সত্যটি প্রমাণ করতে ৩০ লাখ বাঙালিকে জীবন ও চার লাখ মা-বোনকে তাদের সম্মান ও জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল। পাকিস্তান অর্জনের পরপরই ভাষার প্রশ্নও সামনে চলে আসে এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে নিয়েই গড়ে ওঠে এ দেশের পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতি। ভারতবর্ষের সব প্রদেশের মুসলমান যে একই ভাষায় কথা বলত না, এখনো বলে না, সে কথা প্রমাণ করার জন্য আমাদের অন্য কোনো দেশে যেতে হয় না। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলোর মানুষের ভাষা-বৈচিত্র্যের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ৯৭ শতাংশ এবং পূর্ব বাংলার ৮০ শতাংশ মানুষ ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের ভাষা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। দেখা যায়, পূর্ব বাংলা প্রায় একটি একক জনগোষ্ঠীর অঞ্চল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান একটি বহু ভাষাভিত্তিক অঞ্চল। পূর্ব বাংলায় বাংলা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের ভাষাভাষী মানুষের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ঠিক তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো প্রদেশে বাংলাভাষী মানুষের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশের ভাষার এই পার্থক্য যে কোনো একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গড়ে তোলা ছিল অসম্ভব। কোনো একটি ভাষা উভয় অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বাঙালির মাতৃভাষা যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল প্রায় অপরিচিত; তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ভাষা যেমন পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচ পূর্ব বাংলায় ছিল অপরিচিত। অবশ্য উর্দু পূর্ব বাংলার কিছু লোক বলত। তারা বিহার থেকে আসা উদ্বাস্তু এবং নবাব ও অভিজাত শ্রেণীর কিছু মানুষ। শুধু তাই নয়, তাদের লিপির পার্থক্য কোনো একটি ভাষাকে অপর অংশে প্রচলন করা কঠিন করে তুলেছিল। বাঙালিরা তাদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে। উনিশ শতকীয় ভারতবর্ষের নবজাগরণের সূচনা এ বাংলা থেকেই। বাংলা ভাষা ভারতবর্ষের একমাত্র ভাষা, যে ভাষায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান এবং বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেন। বিশ্বকবির মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্বভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। তাই বাঙালি তার ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে ক্রমেই গর্বিত হয়ে উঠতে থাকে।
১৯২৫ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলমানের জন্য 'মুসলিম সাহিত্য' রচনার অনুরোধ করেছিলেন। 'মুসলিম সাহিত্য' কী জিনিস নজরুল তা বুঝতে পারেননি। ১৩৫১ বঙ্গাব্দে কলকাতার 'রেনেসাঁ সোসাইটি'র উদ্যোগে রেনেসাঁ-সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ স্পষ্টই বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুব উন্নত সাহিত্য। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন। তবু এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানের কোনো দান নেই। শুধু তা-ই নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রাণ-প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানি নয়, এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। প্রথমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথাই ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু মনীষার সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু-সংস্কৃতকে বুনিয়াদ করে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই তাঁরা করেছেন। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না; কিন্তু সত্য কথা এই যে ওই সাহিত্যকে মুসলমানরা জাতীয় সাহিত্য মনে করে না।'
দেখা যায়, ১৯৪২ সালেই ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্নে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশ সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দরাবাদ মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং একই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানি জাতির (!) পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা দেওয়ার আগেই উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দিতে শুরু করেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা আর বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে তা মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য- এমন বক্তব্য প্রকাশ করতে থাকে প্রতিক্রিয়াশলী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। ইতিহাস প্রমাণ করে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। দেশভাগের আগে সে আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল কেবল শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। ১৯৪৮ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জিন্নাহর ঘোষণা সে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে, রাজনৈতিক রং চড়ায়।
বাংলা ভাষার পক্ষেও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ লেখালেখি শুরু করে। সম্ভবত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলার পক্ষে প্রথম কলমযুদ্ধ শুরু করেন। ড. জিয়াউদ্দীন আহমদের ওই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধে নানা যুক্তি তুলে ধরেন এবং শেষে বলেন, 'বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতিবিরোধী নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।'
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা নতুন করে আরেক পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানপন্থীদের উর্দুর পক্ষাবলম্বনের বিরুদ্ধে প্রথম যুগে যাঁরা বাংলা ভাষার পক্ষে কলম তুলে নেন, তাঁদের পথিকৃৎ হলেন প্রখাত প্রাবন্ধিক আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বিভিন্ন ছদ্মনামে চারটি প্রবন্ধ লেখেন। সেসব প্রবন্ধে তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলা ভাষার পক্ষে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে 'বাংলা বানান বিষয়ে প্রস্তাব' (২২ ও ২৩ জুন, ১৯৪৭)' 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (দৈনিক আজাদ, ৩০ জুন ১৯৪৭), 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে' (ইত্তেহাদ, ২৭ জুলাই, ১৯৪৭) এবং 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (সাপ্তাহিক বেগম, ৩ আগস্ট ১৯৪৭) তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর পেছনে লেগে যায়। পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার জোর প্রচার চালান। প্রতিবাদে আবদুল হক লেখেন 'আরবি হরফে বাংলা' (দৈনিক ইত্তেহাদ ও রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগ, ২০ মার্চ, ১৯৪৯)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পর ভাষাবিষয়ক আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। পাকিস্তানি ভাবাদর্শ 'দ্বিজাতিতত্ত্বের' বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরুর আগে বাংলা ভাষা ও সে ভাষায় রচিত সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই তা শুরু হয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের অর্থ কী? জিন্নাহ ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ অধিবেশনে তা সবিস্তারে উত্থাপন করেছিলেন। তার অর্থ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসরত ১০০ মিলিয়ন মুসলমান একটি আলাদা জাতি আর হিন্দুরা আরেকটি জাতি। ধর্ম দিয়েই জিন্নাহ জাতিতত্ত্বের সংজ্ঞা নির্ণয় করেছিলেন। প্রখ্যাত ভারততাত্ত্বিক ক্রেগ ব্যাক্সটার বলেন, জিন্নাহ জাতি ও জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ করতে পারেননি। 'প্রথম জাতি বলতে তিনি হিন্দু ও মুসলমানকে বুঝিয়েছেন। তারপর জাতির অর্থ তার কাছে দাঁড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান।' বিল ও লাইডেনের বই থেকে জানা যায়, পশ্চিমা শক্তি ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১৯৫৮ সালের আগে দুটি যুদ্ধে পরাজয়ের পর আরব দেশগুলো অনুভব করে, ধর্মের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে একত্রিত হলেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব। তাই ১৯৫০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমপ্রধান দেশগুলো একত্রিত হতে চেষ্টা করে; কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কারণ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এত গভীর যে সে ঐক্যপ্রক্রিয়া সাফল্যের মুখ দেখেনি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে কোনো 'জাতিরাষ্ট্র' গঠিত হয়নি। তাই ১৯৯১ সালে বিবিসির সংবাদদাতা তাঁর বিখ্যাত Waiting For Allah বইতে লিখেছেন, 'জিন্নাহ একটি জাতির (মুসলমান) জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন, ৪৫ বছর পর সেই রাষ্ট্রটি (পাকিস্তান) আজও একটি জাতির সন্ধানে ঘুরে ফিরছে।' আসলেই জিন্নাহর দাবি ছিল সোনার পাথরবাটি। তাই আজও তা মিলল না।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান 'মুসলমান বাঙালি'তে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তাই অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন' বলে অভিহিত করা হয়েছিল। মওলানা আজাদ বলেছিলেন, পাকিস্তান না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যুক্তি মুসলমানদের কানে ঢুকবে না। ঠিক তা-ই হয়েছে। ব্রিটিশের অত্যাচার-নির্যাতন ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ একটি ভারতীয় জাতি গঠনে সহায়ক হয়েছিল। তেমনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায় এবং মুসলমান বাঙালি দ্রুত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' পরিত্যাগ করে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদে' বিশ্বাস স্থাপন করে। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকে এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি প্রমাণ করে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মাথায় বাঙালি মুসলমানের মোহ অনেকটাই কেটে গেছে।
পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শকের কাজ করেছে। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার বিরোধিতা থেকে শুরু করে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন ও 'ছায়ানট' নামের প্রতিবাদী রবীন্দ্রসংগীত একাডেমী গঠন এবং ১৯৬৭ সালে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের গৌরবময় প্রতিবাদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা 'উদীচী' তার উজ্জ্বলতম সাক্ষ্য। প্রমাণ করা মোটেই কষ্টকর নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সব সময়ই পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী এক হাতিয়ার ছিল। কিন্তু ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজের উপরিকাঠামোর অন্তর্গত। অর্থনীতিই হলো সমাজের মূল কাঠামো। তার ওপরই গড়ে ওঠে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিসহ সব কিছু। তাই পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে প্রথমে এ দেশের মানুষ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সে দাবি এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার দাবিতে পৌঁছে দেয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments