ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা- যেন যুদ্ধক্ষেত্র সমুদ্রে সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে নৌবাহিনীর ১৬ দিনের মহড়া শেষ by ফিরোজ মান্না

 বঙ্গপোসাগরে ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণের শব্দ যেন কাঁপিয়ে তোলে। এ যেন মহড়া নয়, যুদ্ধক্ষেত্রের একটি দৃশ্য। বৃহস্পতিবার সারাদিন ধরে চলেছে। গভীর সাগরে এমন দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে যুদ্ধ না মহড়া।
আসলে এটা ছিল নৌবাহিনীর ১৬ দিনের মহড়ার শেষ দিনের চিত্র। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই মহড়া শেষ হয়।
কক্সল্যান্ড ও হিরণল্যান্ড দুটি বাহিনীর মধ্যে অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি হয় একটি সফল নৌ-সামরিক অভিযানে। এমন কাল্পনিক দুটি দলের মধ্যে মহড়াযুদ্ধের মাধ্যমে কক্সল্যান্ডের দখল থেকে রাঙ্গাবালী দ্বীপ উদ্ধার করে হিরণল্যান্ড।
বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বার্ষিক সমুদ্র মহড়া ‘এক্সারসাইজ সী থান্ডার-২০১৩’-এর এমন চিত্র ফুটে ওঠে।
সফল মিসাইল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে ১৬ দিনের মহড়া শেষ হয়। মহড়ার সমাপনী দিনে বিএনএস বঙ্গবন্ধু জাহাজে উপস্থিত থেকে মহড়া অবলোকন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, নৌবাহিনীপ্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ, আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল দূরে গভীর সাগরে যুদ্ধাজাহাজ ধলেশ্বরী থেকে দূরপাল্লার মিসাইল নিক্ষেপ করা হয় শত্রুর জাহাজে। এই আগ্নেয়াস্ত্র বিস্ফোরণের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। এরপর বিএনএস বঙ্গবন্ধু থেকে বিমানবিধ্বংসী শক্তিশালী মিসাইল নিক্ষেপ করা হয় আকাশে স্টারশেলে (প্রতিকী লক্ষ্যবস্তু)। জাহাজ থেকে গভীর জলে সাবমেরিনবিধ্বংসী রকেট ছোড়া হয়। মহড়ায় একটি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়লে নৌ-কমান্ডোর দল দস্যুদের পরাস্ত করে নিরাপদে আশ্রয়ে চলে আসে।
মহড়া শেষে নৌবাহিনীর বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩০টির মতো জাহাজ বিএনএস বঙ্গবন্ধু জাহজটিকে অভিবাদন জানায়। এ সময় সাগরে অন্যরকম দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। দেখে যেন মনে হয় সত্যিকারের কোন যুদ্ধের জয় শেষে বাড়ি ফেরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর জানান, সমুদ্রসীমা রক্ষায় নৌ-বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা হবে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরকে পাহারা দিয়ে আসছে। যে কারণে অর্থনৈতিভাবে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে লাভবান হয়েছে। জেলেরা স্বাধীনভাবে মাছ ধরতে পেরেছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে চলেছে আমাদের সরকার। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। আমরা ২শ’ নটিক্যাল মাইল পেয়েছি। এখন সমুদ্রসীমা বেড়েছে। এ জন্য নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা হবে।
এ সময় নৌবাহিনীপ্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, নেভী একমাত্র সার্ভিস যারা চব্বিশ ঘণ্টা সমুদ্রপাহারা দিয়ে থাকে। চল্লিশ বছরে সরকার নৌবাহিনীর দিকে নজর দেয়নি। বর্তমান সরকার গত চার বছরে ১৬টি জাহাজ নৌ-বহরে যুক্ত হয়েছে। সাবমেরিনের জন্য চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। ধলেশ্বরী ও বিজয়কে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। আরও চারটি জাহাজকে আধুনিকীকরণ করা হবে। ২০১৬ সালের মধ্যে আরও দুটি অত্যাধুনিক জাহাজ নৌবহরে যুক্ত হবে। এ দুটি জাহাজ ১৭ কোটি টাকায় চীন থেকে কেনা হয়েছে। গত চার বছরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে। এ.ডব্লিউ. ১০৯ মডেলের দুটি হেলিকপ্টার কেনা হয়েছে। ৪০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম মিসাইল কেনা হয়েছে। ৫ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। আগামী জুনে আরও ২টি হেলিকপ্টার নৌবাহিনীতে যোগ হবে। দেশেও তৈরি হচ্ছে যুদ্ধজাহাজ। আগামী ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে তৈরি যুদ্ধজাহাজ উদ্বোধন করবেন।
তিনি বলেন, নৌবাহিনীকে আধুনিকীকরণের জন্য বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে আবার দেশেও বিদেশী প্রশিক্ষক আনা হচ্ছে।
দীর্ঘ ১৬ দিনব্যাপী আয়োজিত এ মহড়ায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট, করভেট, ওপিভি, মাইনসুইপার, পেট্রোলবোট, গানবোট, টর্পেডোবোটসহ ছোটবড় ৫৭টি জাহাজ এবং সদ্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সংযোজিত মেরিটাইম হেলিকপ্টার। এছাড়াও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, সেনা ও বিমানবাহিনীসহ সরকারের ৭টি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ১৯টি সংশ্লিষ্ট মেরিটাইম সংস্থা মহড়ায় প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। মোট চারটি ধাপে অনুষ্ঠিত এ মহড়ার উল্লেখযোগ্য দিকসমূহে অন্তর্ভুক্ত ছিল নৌবহরের বিভিন্ন কলাকৌশল অনুশীলন, সমুদ্র এলাকায় পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান, লজিস্টিক অপারেশন, ল্যান্ডিং অপারেশন, উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত নৌ-স্থাপনাসমূহের প্রতিরক্ষা মহড়া প্রভৃতি। নৌবাহিনীর এ বার্ষিক মহড়ার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সমুদ্র এলাকায় দেশের সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, সমুদ্র সম্পদের হেফাজত, সমুদ্রপথের নিরাপত্তা বিধানসহ সমুদ্রপথে চোরাচালানরোধ, জলদস্যুতা দমন, উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সমুদ্র এলাকায় প্রহরা নিশ্চিতকরণ। চূড়ান্ত দিনের মহড়ার উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ হতে মিসাইল উৎক্ষেপণ, সাবমেরিনবিধ্বংসী গোলা নিক্ষেপ, বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলাবর্ষণ ও নৌযুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল।
মহড়ার সফল সমাপ্তির পর প্রধান অতিথি মহড়ায় অংশগ্রহণকারী সকল কর্মকর্তা ও নাবিকদের অভিনন্দন জানান এবং নৌ সদস্যদের উঁচু পেশাগতমান, দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে সম্প্রতিকালে বাংলাদেশের সমুদ্রজয় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানান। মাননীয় মন্ত্রী দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নৌ ও সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন এবং সে লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া প্রধান অতিথি দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্রিয় ভূমিকারও প্রশংসা করেন।
নৌ-মহড়ার এ চূড়ান্ত দিনের কর্মসূচীতে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ, নৌ-সদর দফতরের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারগণ, কমডোর কমান্ডিং বিএন ফ্লোটিলাসহ পদস্থ নৌ-কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.