ঐতিহ্য-গোল্লাছুট প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা ২০১১ সালে পুরস্কার পাওয়া গল্পগুলো ছাপা হচ্ছে- পাখির জয় by তাহিয়া জারিন
ক- বিভাগ দ্বিতীয় বাবুই পাখির বাসা সবার ওপরে ঝুলছে। এখান থেকে পুরো বনটাই সে দেখতে পায়। বনের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছলছল নদী। ওপরে বিশাল আকাশ।
নিচে সবুজ। বনে তো শুধু বাবুই পাখি থাকে না। আছে বুলবুলি, ময়ূর, ময়না, চন্দনা, দোয়েল, ইগল, চিল, কোকিল, মাছরাঙা, বউ কথা কও আরও কত পাখি। শীতকালে সাতসাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে অতিথি পাখিরা এসে বনে উৎসব বসিয়ে দেয়। বনের পাখিরা তখন ভীষণ ব্যস্ত। অতিথি আসছে না। তাদের থাকার ব্যবস্থা, খাবার ব্যবস্থা—সব তো তাদেরই করতে হবে। সব গোছগাছ সেরে পাখিরা বসে অতিথিদের নিয়ে গল্প করতে। গল্পের আসরে সব পাখি যোগ দিল। বরফ পড়ার দেশে তারা কীভাবে থাকে, কী খেলে, কী খেতে পছন্দ করে। কীভাবে বরফ পড়ে—এসব নিয়ে আলোচনা চলে। তারপর বুলবুলি গান শোনাল। টুনটুনি নাচ দেখাল। ময়ূর কি আর বসে থাকে। সে-ও তার পেখম মেলে দিল। ছোট্ট তিতির ছড়া শোনাল। মিষ্টি চন্দনা শোলক বলল। পেঁচা বাবুর কৌতুক শুনে সবাই হাসিতে কুটি কুটি হলো।
এভাবেই আনন্দ-আহ্লাদে দিন কাটতে লাগল পাখিদের। একদিন কয়েকটি মানুষ বন্দুক আর জাল নিয়ে বনে ঢুকল। তখন সব পাখি নদীর পাড়ে গাছের ডালে বসে অতিথি পাখিদের জলকেলি দেখছিল মুগ্ধ হয়ে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ হলো। দুটি পানকৌড়ি মারা গেল। একটি জলসারসীর অর্ধেক ডানা ভেঙে গেল। তাই দেখে সব পাখি ভয়ে পড়িমরি করে পালাল।
রাতে দুশ্চিন্তায় তাদের একটুও ঘুম হলো না। আজ দুটো প্রাণ গেল। কাল চারটা, পরশু আটটা প্রাণ যাবে, এভাবে কি চলতে দেওয়া যায়! ভোর না হতেই সবাই গিয়ে হাজির হলো বাবুই পাখির বাসার সামনে বড় কড়ইগাছটায়। পুরো গাছটায় পাখি আর পাখি। গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা গেল না। বাবুই সবাইকে সাবধান করে বলল, কেউ জলে যাবে না। নিচে নামবে না। গাছের পাতার আড়ালে থাকবে। আনন্দ করতে গিয়ে কেউ বিপদ ঘটিয়ো না। বিপদ দেখলে উঁচু গাছে আশ্রয় নেবে। বাবুইর কথামতো সবাই চলল। কোনো বিপদ ঘটল না। ধীরে ধীরে তাদের শোকের ঘা শুকিয়ে গেল। ভয় কেটে গেল। বনে আবার আগের মতো আনন্দ ফিরে এল।
শীত যাই-যাই করছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি গজিয়েছে। পাখিদের বুঝতে বাকি নেই—দুদিন বাদেই বসন্ত। আহা, কী আনন্দ! কোকিলের কুহুতান শোনা যাচ্ছে। চড়ুই, টুনটুনি আর মুনিয়ারা মিলে এডাল-ওডাল ফুড়ুৎ উড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। চারদিকে এত আনন্দ দেখে বউ কথা কও কি আর চুপ থাকতে পারে। ময়না, ময়ূর, টিয়েরা বাসন্তী সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। অতিথি পাখিরাও যোগ দিল তাদের সাথে। বাসন্তী উৎসবে বন মাতিয়ে তুলল পাখিরা। রং মেখে পুরো বন রাঙিয়ে তুলল। গানে গানে মধুর করে তুলল। উৎসবের আবেশ তখনো কাটেনি। একদিন সকালবেলায় একদল মানুষ গড়গড় শব্দ করে, ধুলো উড়িয়ে একটা প্রকাণ্ড মেশিন নিয়ে হাজির হলো বনে। তারা গাছ কাটতে শুরু করল। একটা একটা করে তারা বনের অনেকগুলো গাছ কেটে সাফ করে ফেলল। অনেক পাখির বাসার গাছও কাটা পড়ল। পাখিরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। বক হাঁটুজলে এক পা ডুবিয়ে ভাবতে লাগল। পেঁচার গম্ভীর মুখ চিন্তায় আরও মলিন হয়ে গেল। টিয়ের লাল ঠোঁট বেয়ে অশ্রু গড়াল। পাপিয়া বাসা হারানোয় বিলাপ করতে লাগল। পাখিরা ডালে বসে দেখে আর কাঁদে। দেখে মানুষগুলো মেহগনি, গর্জন, গেওয়া, শিমুল, দেবদারু—কোনো গাছই ছাড়ল না। অতিথি পাখিরা বনের পাখিদের কষ্ট দেখে সহানুভূতি জানাল।
সবার এ অবস্থা দেখে একদিন বাবুই পাখি সবাইকে ডাকল সেই কড়ইগাছটায়। জ্ঞানী বাবুই সবাইকে বলল, মানুষেরা হলো নির্বোধ। গাছ কেটে তারা শুধু আমাদের ক্ষতি করছে না, তাদের নিজেদেরও সর্বনাশ ডেকে আনছে। গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে, অক্সিজেন ত্যাগ করে। আর মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে, কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। নির্বোধ মানুষগুলো যদি গাছ কেটে ফেলে তবে অক্সিজেন পাবে কোথায়? কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করার মতো গাছ না থাকলে মানুষ যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে তা বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যাবে। পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হবে। আমাদেরও প্রাণ যাবে। তাই আমাদের বসে বসে কাঁদলে চলবে না। মানুষদের গাছ কাটতে বাধা দিতে হবে। সবাইকে বীর হনুমান হতে হবে।
কীভাবে বাধা দেওয়া যায় সে জন্য বিভিন্ন পাখি বিভিন্ন বুদ্ধি দিল। শেষে বুড়ো এক অতিথি পাখি বলল, আমরা সবাই এক সাথে তাদের ওপর হামলা করব। কারণ, একতাই বল। আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা কি তোমাদের জানা আছে? সে আবাবিল পাখির কথা? তারা পাথর মেরে বিশাল হস্তী বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমরাও পারব। বলো, জয় আবাবিল!
পরদিন কথামতো সবাই ঠোঁটে করে পাথর নিয়ে এল। মানুষেরা যখন গাছ কাটতে বনে ঢুকল, পাখিরা সব একসাথে উড়ে তাদের গায়ে পাথর ফেলল। ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’ করে দৌড়ে পালাল মানুষগুলো।
পাখিরা বনটিকে আগের মতো করে গোছাতে লাগল। অতিথি পাখিরা ফিরতে শুরু করেছে তাদের দেশে। গুলি খেয়ে ডানা ভাঙা জলসারসীও রওনা দিয়েছে তার দেশে। কিন্তু সে যে ভালো উড়তে পারে না। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। বনের পাখিরা তাকে থেকে যেতে বলল। সে বলল, থাকতে যে পারছি না। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আমার বন্ধুরা ফিরে আমাকে খুঁজবে সেখানে। আর সেটা আমার মাতৃভূমি। আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই। বিদায় বন্ধুরা, বিদায়।
ডানা ডাঙা জলসারসী ডানা ঝাপটে উড়াল দিল আকাশে। সাত সাগর তেরো নদীর পথযাত্রায়, তার মাতৃভূমিতে।
বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা
এভাবেই আনন্দ-আহ্লাদে দিন কাটতে লাগল পাখিদের। একদিন কয়েকটি মানুষ বন্দুক আর জাল নিয়ে বনে ঢুকল। তখন সব পাখি নদীর পাড়ে গাছের ডালে বসে অতিথি পাখিদের জলকেলি দেখছিল মুগ্ধ হয়ে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ হলো। দুটি পানকৌড়ি মারা গেল। একটি জলসারসীর অর্ধেক ডানা ভেঙে গেল। তাই দেখে সব পাখি ভয়ে পড়িমরি করে পালাল।
রাতে দুশ্চিন্তায় তাদের একটুও ঘুম হলো না। আজ দুটো প্রাণ গেল। কাল চারটা, পরশু আটটা প্রাণ যাবে, এভাবে কি চলতে দেওয়া যায়! ভোর না হতেই সবাই গিয়ে হাজির হলো বাবুই পাখির বাসার সামনে বড় কড়ইগাছটায়। পুরো গাছটায় পাখি আর পাখি। গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা গেল না। বাবুই সবাইকে সাবধান করে বলল, কেউ জলে যাবে না। নিচে নামবে না। গাছের পাতার আড়ালে থাকবে। আনন্দ করতে গিয়ে কেউ বিপদ ঘটিয়ো না। বিপদ দেখলে উঁচু গাছে আশ্রয় নেবে। বাবুইর কথামতো সবাই চলল। কোনো বিপদ ঘটল না। ধীরে ধীরে তাদের শোকের ঘা শুকিয়ে গেল। ভয় কেটে গেল। বনে আবার আগের মতো আনন্দ ফিরে এল।
শীত যাই-যাই করছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি গজিয়েছে। পাখিদের বুঝতে বাকি নেই—দুদিন বাদেই বসন্ত। আহা, কী আনন্দ! কোকিলের কুহুতান শোনা যাচ্ছে। চড়ুই, টুনটুনি আর মুনিয়ারা মিলে এডাল-ওডাল ফুড়ুৎ উড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। চারদিকে এত আনন্দ দেখে বউ কথা কও কি আর চুপ থাকতে পারে। ময়না, ময়ূর, টিয়েরা বাসন্তী সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। অতিথি পাখিরাও যোগ দিল তাদের সাথে। বাসন্তী উৎসবে বন মাতিয়ে তুলল পাখিরা। রং মেখে পুরো বন রাঙিয়ে তুলল। গানে গানে মধুর করে তুলল। উৎসবের আবেশ তখনো কাটেনি। একদিন সকালবেলায় একদল মানুষ গড়গড় শব্দ করে, ধুলো উড়িয়ে একটা প্রকাণ্ড মেশিন নিয়ে হাজির হলো বনে। তারা গাছ কাটতে শুরু করল। একটা একটা করে তারা বনের অনেকগুলো গাছ কেটে সাফ করে ফেলল। অনেক পাখির বাসার গাছও কাটা পড়ল। পাখিরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। বক হাঁটুজলে এক পা ডুবিয়ে ভাবতে লাগল। পেঁচার গম্ভীর মুখ চিন্তায় আরও মলিন হয়ে গেল। টিয়ের লাল ঠোঁট বেয়ে অশ্রু গড়াল। পাপিয়া বাসা হারানোয় বিলাপ করতে লাগল। পাখিরা ডালে বসে দেখে আর কাঁদে। দেখে মানুষগুলো মেহগনি, গর্জন, গেওয়া, শিমুল, দেবদারু—কোনো গাছই ছাড়ল না। অতিথি পাখিরা বনের পাখিদের কষ্ট দেখে সহানুভূতি জানাল।
সবার এ অবস্থা দেখে একদিন বাবুই পাখি সবাইকে ডাকল সেই কড়ইগাছটায়। জ্ঞানী বাবুই সবাইকে বলল, মানুষেরা হলো নির্বোধ। গাছ কেটে তারা শুধু আমাদের ক্ষতি করছে না, তাদের নিজেদেরও সর্বনাশ ডেকে আনছে। গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে, অক্সিজেন ত্যাগ করে। আর মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে, কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। নির্বোধ মানুষগুলো যদি গাছ কেটে ফেলে তবে অক্সিজেন পাবে কোথায়? কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করার মতো গাছ না থাকলে মানুষ যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে তা বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যাবে। পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হবে। আমাদেরও প্রাণ যাবে। তাই আমাদের বসে বসে কাঁদলে চলবে না। মানুষদের গাছ কাটতে বাধা দিতে হবে। সবাইকে বীর হনুমান হতে হবে।
কীভাবে বাধা দেওয়া যায় সে জন্য বিভিন্ন পাখি বিভিন্ন বুদ্ধি দিল। শেষে বুড়ো এক অতিথি পাখি বলল, আমরা সবাই এক সাথে তাদের ওপর হামলা করব। কারণ, একতাই বল। আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা কি তোমাদের জানা আছে? সে আবাবিল পাখির কথা? তারা পাথর মেরে বিশাল হস্তী বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমরাও পারব। বলো, জয় আবাবিল!
পরদিন কথামতো সবাই ঠোঁটে করে পাথর নিয়ে এল। মানুষেরা যখন গাছ কাটতে বনে ঢুকল, পাখিরা সব একসাথে উড়ে তাদের গায়ে পাথর ফেলল। ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’ করে দৌড়ে পালাল মানুষগুলো।
পাখিরা বনটিকে আগের মতো করে গোছাতে লাগল। অতিথি পাখিরা ফিরতে শুরু করেছে তাদের দেশে। গুলি খেয়ে ডানা ভাঙা জলসারসীও রওনা দিয়েছে তার দেশে। কিন্তু সে যে ভালো উড়তে পারে না। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। বনের পাখিরা তাকে থেকে যেতে বলল। সে বলল, থাকতে যে পারছি না। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আমার বন্ধুরা ফিরে আমাকে খুঁজবে সেখানে। আর সেটা আমার মাতৃভূমি। আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই। বিদায় বন্ধুরা, বিদায়।
ডানা ডাঙা জলসারসী ডানা ঝাপটে উড়াল দিল আকাশে। সাত সাগর তেরো নদীর পথযাত্রায়, তার মাতৃভূমিতে।
বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা
No comments