ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে- লুটপাট অসম্পূর্ণ ব্রিজ কালভার্টে by জাফর আহমেদ

 রাস্তা নির্মাণের চেয়ে কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ অনেক বেশি লাভজনক। তাই সেতুর দুই পাশে সংযোগ সড়ক তৈরি না করে নদী বা খালের উপর একটি ব্রিজ তৈরি করে ফেলে রাখা হয়েছে; যা এখন কোন কাজে আসছে না।
অথচ ওই একটা সেতু নির্মাণ করতেই সাড়ে ৮ কোটি টাকার প্রকল্প উন্নীত করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকায়। আর ৩ বছরের প্রকল্পটিতে কাজ চালানো হয়েছে ৯ বছর। কিনত্মু দিগুণ সময় এবং দেড়গুণ অর্থ বৃদ্ধি করেও শেষ পর্যনত্ম দু'পাশের সংযোগ সড়ক তৈরি না করে নদী বা খালের ওপর একটি নেংটা ব্রিজ তৈরি করে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করেছে। দেশব্যাপী কয়েক শ' ব্রিজ তৈরি করে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করার পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে আরো পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যনত্ম চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প শেষে বাসত্মবায়ন, পরীবিণ এবং মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পে এ ভয়ঙ্কর চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সংশিস্নষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্প শেষে সরকারী উন্নয়ন কাজ বাসত্মবায়ন পরীবিণ এবং মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এসব প্রকল্প তদনত্মে গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। তদনত্ম শেষে সংশিস্নষ্ট তদনত্ম কর্মকর্তারা এসব প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু সরকারের অর্থ লুটপাট ছাড়া প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাসত্মবায়নে কোন রকম চেষ্টাই করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের দুই বছর মেয়াদে শুধু একটি ব্রিজ তৈরি করে বাকি কাজ বা সংযোগ সড়কসহ প্রয়োজনীয় কাজ না করে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। কিনত্মু তারা অর্থ তুলে নিয়েছেন পুরো প্রকল্পের। সরকারের কাছে হিসেব দাখিলের সময় কিছু অর্থ তাদের কাছে আছে বলে জানালেও ওই অর্থ তারা ফেরত দেয়নি। এক কথায়_ সংশিস্নষ্ট ঠিকাদাররা জনগণের এই অর্থ লুটে সরকার, প্রশাসন এবং আইন ও বিচারব্যবস্থা কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি। তাই এসব ঠিকাদারকে খুঁজে বের করে তাদের বিরম্নদ্ধে চরম শাসত্মিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তেমনই একটি প্রকল্প নবীনগরের বুড়ি ও তিতাস নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প। ১৯৯৯ সালের একনেক সভায় নবীনগর উপজেলার সাধারণ মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় সহজে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে বুড়ি এবং তিতাস নদীর ওপর দুটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প নির্দেশনায় বলা হয় যে, শিবপুর থেকে নবীনগর শহরের যোগাযোগ নদীপথের পরিবর্তে ব্রিজ নির্মাণ করে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ খুবই উপকৃত হবে। একই উদ্দেশ্যে তিতাস নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করে নবীনগর, শিবপুর, রাধিকাসহ সকল এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই দুটি ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হয়।
ওই সময়ে প্রকল্পটি মাত্র ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় সম্পন্ন করার নকশা দিয়ে ৩ বছর মেয়াদে ২০০০ সালে এর কাজ শুরম্ন করা হয়। সে হিসেবে ২০০২ সালে প্রকল্পটি শেষ করার কথা। কিনত্মু প্রকল্পটি শুরম্ন করার পর থেকেই সংশিস্নষ্ট ঠিকাদার নানা রকম অপেশাদারিত্বমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যায়, যার কারণে প্রকল্পের পুরো মেয়াদেও মাত্র ১০ শতাংশের কম অগ্রগতি হয়। ফলে ২০০২ সালে প্রকল্পটিতে সংশোধনী আনা শুরম্ন হয়। সর্বশেষ তিনবার সংশোধনী এনে মেয়াদ বৃদ্ধি করে ৩ বছরের প্রকল্পকে নিয়ে যাওয়া হয় ৯ বছর মেয়াদে। অর্থাৎ শেষ পর্যনত্ম ওই প্রকল্পটি ২০০৮ সালে শেষ করার ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি সাড়ে আট কোট টাকার প্রকল্পটির বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
সূত্র জানায়, এর পরও ২০০৮ সালে পুরো ৯ বছর প্রকল্পটির কর্মকা- চালু রেখে মেয়াদ শেষে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। প্রকল্প শেষে আইএমইডির পর্যবেণ দল সরেজমিন দেখতে পায়, তিতাস নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কিনত্মু ব্রিজটি শুধুমাত্র নদীর উপর খাড়া করে রাখা হয়েছে। সেতুর দুই মাথায় কোন রকম সংযোগ সড়ক তৈরি করা হয়নি। তিতাস সেতু থেকে রাধিকা পর্যনত্ম ৩/৪ কিলোমিটার এলাকায় কোন রাসত্মা নেই। এমনকি ওই এলাকায় সেতুর দিকে আসার জন্য একটি বাঁধও নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ওই ব্রিজটি এমনি দাঁড়িয়ে আছে। অপরদিকে, বুড়ি নদীর ওপর নির্মিত সেতু হতে নবীনগর বাজার পর্যনত্ম এক কিলোমিটার কোন রকম সংযোগ সড়ক স্থাপন করা হয়নি। যার কারণে ওই সেতুটিও এমনিই খাড়া হয়ে আছে। দুটি সেতুই মানুষের কোন কাজে আসছে না। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রকল্প পরিদর্শন শেষে আইএমইডির প থেকে সুপারিশ করা হয়েছে, মাত্র ৩ বছরের একটি প্রকল্প ৯ বছরেও বাসত্মবায়ন না করে সরকারী সম্পদ তিগ্রসত্ম করার জন্য সংশিস্নষ্ট ঠিকাদারকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাসত্মির মুখোমুখি করা । তা ছাড়া প্রকল্পটি শেষ করে সরকারের কাছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সকল অর্থ তুলে নিলেও এই অর্থের হিসেব দিতে পারেনি। আবার ওই অর্থ সরকারী কোষাগারে জমাও দেননি। সংশিস্নষ্ট অব্যয়িত অর্থ ফেরত নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ রকম আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে, গৌরীপুর- কচুয়া এবং হাজিগঞ্জের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পটিতেও বরাদ্দ প্রায় ১শ' ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করার পরও ১১ কিলোমিটার রাসত্মা প্যাভমেন্টের কথা থাকলেও করা হয়েছে মাত্র আট কিলোমিটার রাসত্মা। রাসত্মায় যে সব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে সে সব সেতুর সংযোগ সড়কের কাজ সম্পন্ন করা হয়নি। যার কারণে ওই প্রকল্পটিও সফলতার মুখ দেখেনি। প্রকল্পটিতে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়। তাই সংশিস্নষ্ট ঠিকাদার এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরম্নদ্ধে শাসত্মিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতি পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারী উন্নয়ন কাজে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সরকারী সম্পদ লুটের এই মনোভাব দেশে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কারণ, বেশিরভাগ সময় এসব দুর্নীতিবাজ সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ বোঝাপড়ার মাধ্যমে পার পেয়ে যায়; যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাই এসব অপরাধীকে খুঁজে বের করে দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মির ব্যবস্থা করা উচিত বলে তারা মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.