নারী অধিকার-নারী নির্যাতন, নারীর পরিচয় ও আমাদের নারী আন্দোলন by ফরিদা আখতার
সম্প্র্রতি নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা যেন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ ঘটনা মাত্র ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা। করেছে এমন একজন, যে একই শিশুকে ধর্ষণ করার কারণে জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়েছে।
এগুলো কিসের আলামত? যে দেশে একটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নেই, সে দেশের আর কী থাকে! এই শিশুটি যে বয়সের, তাকে নারী বলা যায় না। যে বয়সে সামাজিকভাবে নারী-পুরুষ বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে; শিশুটি তার অনেক দূরে। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলে, খায়-দায়, ঘুমায়, দুষ্টামি করে। এই বয়সের শিশুকে নারী বানিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। নারী হওয়ার বয়সে না পেঁৗছেও রেহাই পায়নি সে এই বর্বরতা থেকে। এরই মধ্যে আরও অনেক ভয়ানক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে মধুপুরের ঘটনার বিরুদ্ধে বড় আকারে প্রতিবাদ হয়েছে; তাও দিলি্লর প্রতিবাদের জের ধরে। এখন আবার সবাই চুপ। এর মধ্যে আরও ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে হ্যাঁ, জেলা পর্যায়ে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। আর সরকারের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। তাদের কিছুই যেন যায়-আসে না।
নারী নির্যাতন যখন ঘটে, তখন ধরে নেওয়া হয়_ সে অন্তত ১৫ বছর পার করেছে। এই বয়সে তার পড়াশোনা করার কথা। কিন্তু শিক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গরিব মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে না। তাদের কাজ করতে হয়, কিংবা অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। আইন অনুযায়ী তা বাল্যবিয়ের পর্যায়ে পড়ে, যা নিষিদ্ধ। কিন্তু গ্রামে, এমনকি শহরেও এই বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মা-বাবাকে প্রশ্ন করি_ কেন মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন এত অল্প বয়সে? উত্তর শোনার পর বলার কিছু থাকে না। মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। শহরে বস্তিবাসী মহিলা যদি কাজ করে, তাহলে ঘরে কিশোরী মেয়ে রেখে যাওয়া বিপজ্জনক। তাই বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান মা। এই বিয়ে যে সব সময় টেকে_ তাও নয়। তবু মেয়ের কোনো ধরনের 'দুর্ঘটনা' হওয়ার আগে একবার বিয়ের ছাপ্পড় পড়ে গেলে সামাজিকভাবে মা-বাবার দায়িত্ব শেষ।
অন্যদিকে যৌতুক ব্যবস্থা তো আছেই। মেয়ের বয়স যত বেশি, যৌতুকের চাহিদাও তত বেশি। এত সামর্থ্য মা-বাবার কোথায়? তাই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো পরবর্তী সময়ে মেয়ের সংসার জীবনে প্রভাব ফেলে, যা সবসময় ইতিবাচক হয় না। অনেক মেয়েই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। এরা গরিব নারী। আমরা নীরবেই যেন মেনে নিয়েছি তাদের এই অবস্থা। কোনো বড় ধরনের মিডিয়া আকর্ষণকারী ঘটনা না ঘটলে তাদের খবর নেওয়া হয় না।
নারী আন্দোলনের দিক থেকে 'নারী নির্যাতন প্রতিরোধ' অন্যতম প্রধান কাজ বলে বিবেচিত দীর্ঘদিন ধরেই। নারী-পুরুষের সমতা অর্জন, সর্বক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ থাকার আন্দোলন এবং নারীরা আজ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই উপস্থিত আছেন। বঞ্চনা ও বৈষম্যও আছে, কিন্তু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে নারীর গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে। কোনো মহিলাকে ট্রাফিক পুলিশ বা কাস্টম অফিসার বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কেউ এখন তওবা করে ওঠেন না। দুই নেত্রীর ব্যাপারে আপত্তি উঠছে পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষমূলক আচরণের জন্য। কিন্তু এখনও তাদের নেতৃত্ব চায় অধিকাংশ মানুষ। কাউকে তো নাউজুবিল্লাহ বলতে শুনিনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এ দেশের মানুষ অনেক প্রগতিশীল।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ থাকুক_ আমরা সবাই চাই। শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি এলেই নারীমুক্তি হয় না_ এ বিতর্কের অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে। নারী নিজে যদি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় না থাকতে পারে, তাহলে তার পক্ষে নীতি গ্রহণ করা হবে_ এমনটি আশা করা যায় না। তাই নারীদের রাজনীতিতে আসতে হবে। এখানেই এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাজনীতি মানে শুধু একটি বিশেষ ধরনের রাজনীতি হতে হবে_ এমন কোনো কথা নেই। দেশে বৈধভাবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। তারা প্রকাশ্যেই রাজনীতি করছে। যে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ক্ষমতা থেকে হটানো হয়েছে, তার সঙ্গে জোট বেঁধেই বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপিও যতটুকু আসন পেয়েছে, তার অংশীদার হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। বাম রাজনৈতিক দলেও নারীরা সক্রিয়। বাম রাজনীতি নিয়েও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের তর্ক থাকতে পারে। সব দলের সক্রিয় বিভিন্ন নারীর সঙ্গে মতপার্থক্য বা আদর্শিক বিরোধিতা থাকতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক। এই মতপার্থক্য অনুযায়ী তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারিত হবে অবশ্যই। কিন্তু যখন নারী হিসেবে দেখি, কেউ নির্যাতিত হচ্ছেন, তখন তিনি কোন দল করেন, সেটা বিচার করে তার পক্ষে দাঁড়াব কি দাঁড়াব না_ সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। অথচ তাই যেন আজকাল দেখছি। দেখছি নারীকে নির্যাতন করা হচ্ছে, কিন্তু তখন যেন নারী কোন দলের_ সেই বিষয়টাই মুখ্য হয়ে উঠছে। নারী হওয়ার কারণেই তিনি নির্যাতিত হচ্ছেন_ সেটা দেখার পরেও তিনি তখন কোন দলের_ সেই পরিচয়ের ভিত্তিতেই তার ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার প্রশ্ন উঠছে। উঠছে তাদের মধ্যেই নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে যারা উচ্চকণ্ঠ।
আমি এ কথা বলছি অনেক ভেবেচিন্তে এবং বেশ আত্মসমালোচনা করেই। নারী আন্দোলনে আমরা একটি বিষয় সব সময় বলে থাকি, কোনো নারী ধর্ষিত হলে কিংবা উত্ত্যক্ত বা অন্য কোনো হয়রানির শিকার হলে প্রশ্ন ওঠে_ সে কোথায় ছিল, কী অবস্থায় ছিল, কী পোশাক পরে ছিল ইত্যাদি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধরে নেয় তার পোশাকের কারণেই তার প্রতি পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই নারীদের পোশাকের স্বাধীনতা একটি আন্তর্জাতিক দাবি। কিন্তু পোশাক মানে কি শুধু আধুনিক বা সংক্ষিপ্ত পোশাক? নিশ্চয়ই না। নিজের শখে, কাজের প্রয়োজনে অনেক ধরনের পোশাক পুরুষদের যেমন পরতে হয়, তেমনি নারীদেরও। এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু কোনো নারী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা তার ধর্মীয় অবস্থানের কারণে হিজাব বা বোরকা পরেন, তাহলে কি তিনি নারী আন্দোলনের 'নারী'র সংজ্ঞায় পড়বেন না? সম্প্র্রতি রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় ২১ নারীকে গ্রেফতার এবং পরে তাদের হিজাব খুলে আদালতে হাজির করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আমরা যদি আমাদের আন্দোলনে সততার পরিচয় দিই, তাহলে কি বলতে পারব_ এটা নারী নির্যাতন নয়? কোথায় লেখা আছে যে, আদালতে হিজাব পরে যেতে পারবে না?
আমি বিষয়টিকে শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতার দৃষ্টিতে দেখতে চাই না। আমি দেখছি নারীদের পোশাকের স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে। হিজাব বা বোরকা না পরার অধিকার যেমন থাকা উচিত (কেউ যেন ধর্মের নামে নারীদের ওপর হিজাব বা বোরকা চাপিয়ে না দেয়), তেমনি যারা হিজাব ও বোরকা পরেন তাদের প্রতি বিরূপ আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে পড়ে না। নারী আন্দোলনের দিক থেকে দেখতে গেলে এই বৈষম্যের বিরোধিতা করাও আমাদের কাজ। কেউ হিজাব পরেছেন বলেই তার প্রতি নির্যাতন হয়েছে দেখেও আমরা নীরব রয়েছি। কারণ তার পক্ষে বললে মনে হচ্ছে, আমরা যেন তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থন করছি। অর্থাৎ কে নারী বা নারী নয়, কিংবা কে মানুষ আর কে মানুষ নয়_ সেটা আমরা নির্ণয় করছি রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে। বিরোধী দলের অবরোধের দিনে বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সবাই সোচ্চার হয়েছে। কারণ সে ছিল সাধারণ পথচারী। কিন্তু আলাপ-আলোচনা শুনলে মনে হয়, বিশ্বজিৎ যদি সত্যি কোনো পিকেটার হতো, তাহলে তার প্রতি এতটা সহানুভূতি মিলত না; তা যত নৃশংসই হোক না কেন। তেমনি একটি বিশেষ মতাদর্শের নারী হওয়ার কারণে এই নারী নির্যাতনের ব্যাপারে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের নীরবতা ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে কালো অক্ষরেই লেখা হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে আমাদের জবাবদিহি অবশ্যই করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।
ফরিদা আখতার : গবেষক; নারী আন্দোলনের নেত্রী
নারী নির্যাতন যখন ঘটে, তখন ধরে নেওয়া হয়_ সে অন্তত ১৫ বছর পার করেছে। এই বয়সে তার পড়াশোনা করার কথা। কিন্তু শিক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গরিব মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে না। তাদের কাজ করতে হয়, কিংবা অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। আইন অনুযায়ী তা বাল্যবিয়ের পর্যায়ে পড়ে, যা নিষিদ্ধ। কিন্তু গ্রামে, এমনকি শহরেও এই বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মা-বাবাকে প্রশ্ন করি_ কেন মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন এত অল্প বয়সে? উত্তর শোনার পর বলার কিছু থাকে না। মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। শহরে বস্তিবাসী মহিলা যদি কাজ করে, তাহলে ঘরে কিশোরী মেয়ে রেখে যাওয়া বিপজ্জনক। তাই বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান মা। এই বিয়ে যে সব সময় টেকে_ তাও নয়। তবু মেয়ের কোনো ধরনের 'দুর্ঘটনা' হওয়ার আগে একবার বিয়ের ছাপ্পড় পড়ে গেলে সামাজিকভাবে মা-বাবার দায়িত্ব শেষ।
অন্যদিকে যৌতুক ব্যবস্থা তো আছেই। মেয়ের বয়স যত বেশি, যৌতুকের চাহিদাও তত বেশি। এত সামর্থ্য মা-বাবার কোথায়? তাই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো পরবর্তী সময়ে মেয়ের সংসার জীবনে প্রভাব ফেলে, যা সবসময় ইতিবাচক হয় না। অনেক মেয়েই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। এরা গরিব নারী। আমরা নীরবেই যেন মেনে নিয়েছি তাদের এই অবস্থা। কোনো বড় ধরনের মিডিয়া আকর্ষণকারী ঘটনা না ঘটলে তাদের খবর নেওয়া হয় না।
নারী আন্দোলনের দিক থেকে 'নারী নির্যাতন প্রতিরোধ' অন্যতম প্রধান কাজ বলে বিবেচিত দীর্ঘদিন ধরেই। নারী-পুরুষের সমতা অর্জন, সর্বক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ থাকার আন্দোলন এবং নারীরা আজ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই উপস্থিত আছেন। বঞ্চনা ও বৈষম্যও আছে, কিন্তু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে নারীর গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে। কোনো মহিলাকে ট্রাফিক পুলিশ বা কাস্টম অফিসার বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কেউ এখন তওবা করে ওঠেন না। দুই নেত্রীর ব্যাপারে আপত্তি উঠছে পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষমূলক আচরণের জন্য। কিন্তু এখনও তাদের নেতৃত্ব চায় অধিকাংশ মানুষ। কাউকে তো নাউজুবিল্লাহ বলতে শুনিনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এ দেশের মানুষ অনেক প্রগতিশীল।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ থাকুক_ আমরা সবাই চাই। শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি এলেই নারীমুক্তি হয় না_ এ বিতর্কের অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে। নারী নিজে যদি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় না থাকতে পারে, তাহলে তার পক্ষে নীতি গ্রহণ করা হবে_ এমনটি আশা করা যায় না। তাই নারীদের রাজনীতিতে আসতে হবে। এখানেই এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাজনীতি মানে শুধু একটি বিশেষ ধরনের রাজনীতি হতে হবে_ এমন কোনো কথা নেই। দেশে বৈধভাবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। তারা প্রকাশ্যেই রাজনীতি করছে। যে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ক্ষমতা থেকে হটানো হয়েছে, তার সঙ্গে জোট বেঁধেই বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপিও যতটুকু আসন পেয়েছে, তার অংশীদার হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। বাম রাজনৈতিক দলেও নারীরা সক্রিয়। বাম রাজনীতি নিয়েও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের তর্ক থাকতে পারে। সব দলের সক্রিয় বিভিন্ন নারীর সঙ্গে মতপার্থক্য বা আদর্শিক বিরোধিতা থাকতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক। এই মতপার্থক্য অনুযায়ী তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারিত হবে অবশ্যই। কিন্তু যখন নারী হিসেবে দেখি, কেউ নির্যাতিত হচ্ছেন, তখন তিনি কোন দল করেন, সেটা বিচার করে তার পক্ষে দাঁড়াব কি দাঁড়াব না_ সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। অথচ তাই যেন আজকাল দেখছি। দেখছি নারীকে নির্যাতন করা হচ্ছে, কিন্তু তখন যেন নারী কোন দলের_ সেই বিষয়টাই মুখ্য হয়ে উঠছে। নারী হওয়ার কারণেই তিনি নির্যাতিত হচ্ছেন_ সেটা দেখার পরেও তিনি তখন কোন দলের_ সেই পরিচয়ের ভিত্তিতেই তার ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার প্রশ্ন উঠছে। উঠছে তাদের মধ্যেই নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে যারা উচ্চকণ্ঠ।
আমি এ কথা বলছি অনেক ভেবেচিন্তে এবং বেশ আত্মসমালোচনা করেই। নারী আন্দোলনে আমরা একটি বিষয় সব সময় বলে থাকি, কোনো নারী ধর্ষিত হলে কিংবা উত্ত্যক্ত বা অন্য কোনো হয়রানির শিকার হলে প্রশ্ন ওঠে_ সে কোথায় ছিল, কী অবস্থায় ছিল, কী পোশাক পরে ছিল ইত্যাদি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধরে নেয় তার পোশাকের কারণেই তার প্রতি পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই নারীদের পোশাকের স্বাধীনতা একটি আন্তর্জাতিক দাবি। কিন্তু পোশাক মানে কি শুধু আধুনিক বা সংক্ষিপ্ত পোশাক? নিশ্চয়ই না। নিজের শখে, কাজের প্রয়োজনে অনেক ধরনের পোশাক পুরুষদের যেমন পরতে হয়, তেমনি নারীদেরও। এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু কোনো নারী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা তার ধর্মীয় অবস্থানের কারণে হিজাব বা বোরকা পরেন, তাহলে কি তিনি নারী আন্দোলনের 'নারী'র সংজ্ঞায় পড়বেন না? সম্প্র্রতি রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় ২১ নারীকে গ্রেফতার এবং পরে তাদের হিজাব খুলে আদালতে হাজির করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আমরা যদি আমাদের আন্দোলনে সততার পরিচয় দিই, তাহলে কি বলতে পারব_ এটা নারী নির্যাতন নয়? কোথায় লেখা আছে যে, আদালতে হিজাব পরে যেতে পারবে না?
আমি বিষয়টিকে শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতার দৃষ্টিতে দেখতে চাই না। আমি দেখছি নারীদের পোশাকের স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে। হিজাব বা বোরকা না পরার অধিকার যেমন থাকা উচিত (কেউ যেন ধর্মের নামে নারীদের ওপর হিজাব বা বোরকা চাপিয়ে না দেয়), তেমনি যারা হিজাব ও বোরকা পরেন তাদের প্রতি বিরূপ আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে পড়ে না। নারী আন্দোলনের দিক থেকে দেখতে গেলে এই বৈষম্যের বিরোধিতা করাও আমাদের কাজ। কেউ হিজাব পরেছেন বলেই তার প্রতি নির্যাতন হয়েছে দেখেও আমরা নীরব রয়েছি। কারণ তার পক্ষে বললে মনে হচ্ছে, আমরা যেন তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থন করছি। অর্থাৎ কে নারী বা নারী নয়, কিংবা কে মানুষ আর কে মানুষ নয়_ সেটা আমরা নির্ণয় করছি রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে। বিরোধী দলের অবরোধের দিনে বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সবাই সোচ্চার হয়েছে। কারণ সে ছিল সাধারণ পথচারী। কিন্তু আলাপ-আলোচনা শুনলে মনে হয়, বিশ্বজিৎ যদি সত্যি কোনো পিকেটার হতো, তাহলে তার প্রতি এতটা সহানুভূতি মিলত না; তা যত নৃশংসই হোক না কেন। তেমনি একটি বিশেষ মতাদর্শের নারী হওয়ার কারণে এই নারী নির্যাতনের ব্যাপারে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের নীরবতা ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে কালো অক্ষরেই লেখা হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে আমাদের জবাবদিহি অবশ্যই করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।
ফরিদা আখতার : গবেষক; নারী আন্দোলনের নেত্রী
No comments