১৫ জানুয়ারি প্রয়াত হলেন আবদুশ শাকুর। সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে তিনি ছিলেন আগ্রহী। তাঁকে নিয়ে এই স্মৃতিচারণা... -শব্দ ও সুরের কারিগর by বেলাল চৌধুরী
না, তাঁর অসামান্য যোগ্যতার প্রতি সম্মান জানাতে আমরা কিছুই করে উঠতে পারিনি। অথচ বিগত ৩৫ বছরের অধিককাল থেকে আবদুশ শাকুর লেখালেখি করে আসছেন। তাঁর প্রথম জীবনের লেখা ক্ষীয়মাণ পড়েই মনে হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী কাজ হওয়ার জন্যই কুশাগ্র কলম হাতে নিয়েছেন।
রম্যরচনায় তিনি যে ক্ষণস্থায়ী নন, প্রথম পাঠেই সেটা টের পাওয়া গিয়েছিল। এরপর এখানে-ওখানে ইতিউতি কদাচিৎ তাঁর লেখা চোখে পড়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে একসময় আমি আমার এক ধনাঢ্য আর বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনপ্রিয় মেজো মামার কেয়ার অবে কাটিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। মামার শ্যালকেরা তখন প্রায় লেখাপড়ায় নিযুক্ত। তাঁদের অনেক বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালে প্রথমে লেখক পরে সম্প্রচার-বিশারদ হিসেবে খ্যাতিমান হুমায়ুন চৌধুরী। তিনি একসময় অসাধারণ সব গল্প লিখে সবাইকে চমকে দিয়ে কী এক অজ্ঞাত কারণে আর লিখলেনই না। ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জনকারী হেমায়েত ও আবদুশ শাকুরসহ আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয়ের পর মামার শালারাও যথার্থ কারণে মামা হয়ে আমার মামাবাহিনীকে যে বেশ বৃহৎ করে তুলল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁদের সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বেশ মেধাবী ছিলেন। সেই থেকে শাকুরের সঙ্গে আমার মামা-ভাগনে সম্পর্ক বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠল। তার পরিচয় পাওয়া গেল সুদীর্ঘকাল বাদে, যখন শাকুর লিখতে শুরু করলেন। তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল রম্যলেখক হিসেবে প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ক্ষীয়মাণ দিয়ে। কোনো প্যাঁচ-পয়জার নেই। নিখুঁত চলনের গল্প। নেহাত রামগরুড়ের ছানা না হলে বিরস বদনে ওই গল্প হজম করা কঠিন।
আসলে জীবনের নানা বাঁকে যে যাঁর মতো জীবিকার তাড়নায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে চলে যাওয়ায় কথাবার্তা তো দূরের কথা, দেখা-সাক্ষাৎও হতো না বলতে গেলে। তবে একমাত্র লেখালেখির কারণে জানা যেত কে কোন অবস্থানে আছেন। সর্বোপরি মনে হতো, আচ্ছা, বেঁচে-বর্তে তো আছেন! ব্যস, ওই পর্যন্তই। আকস্মিকভাবে মামার শালা মামাদের সঙ্গে দেখা হলে কথা প্রসঙ্গে জানা যেত কে কোথায় আছেন বা কেমন আছেন। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন, মাস, বছরের পর বছর। প্রায় তিন যুগ বাদে যে ফের তাঁর সঙ্গে দেখা, সেও ওই লেখালেখির কারণেই। এর মধ্যে আমাদের বুড়িগঙ্গা দিয়ে যেমন অনেক পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে, তেমনি ঢের দুঃস্বপ্ন আর মানুষের গৃধ্নুতা আর লোভ বুড়িগঙ্গাকে শুধু গ্রাসই নয়, কলুষিতও করে তুলেছে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল আবদুশ শাকুর সরকারের সচিব হিসেবে বসবাস করছেন ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে। আমি তখন একটি নগণ্য সাপ্তাহিকীর সঙ্গে জড়িত। জানি না কিংবা আজ আর মনে করতে পারছি না—‘মরহুম’ শব্দটা লিখতে গিয়ে বুকটা ধক করে উঠছে—আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঝালাই করার জন্যই শাকুরের বাড়িতে গেলাম। শাকুর তো একেবারে অভিভূত। শাকুরকে যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন তিনি একসঙ্গে কত রকমের কাজে নিজেকে বেশ নিবিষ্টভাবে রাখতে পারেন। একদিকে যেমন সাহিত্য আর লেখালেখির কথা বলছেন, অন্যদিকে আবার হারমোনিয়াম নিয়ে গজল বা অন্য কোনো রাগপ্রধান গানের প্রভেদ বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
তাঁর কথা বলার ধরনটা ছিল এক প্রসঙ্গে গেলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার। তা দেখে আমার মতো অর্বাচীনের হাস্যোদ্রেক সামলানো কঠিন হয়ে পড়ত। মান্নানের মতো নিবিষ্ট শ্রোতা থাকাতে রক্ষা। একদিন কথায় কথায় আমি আমার ওই অকিঞ্চিৎকর সাপ্তাহিকীর জন্য একটা লেখা চাইলাম। কথায় কথায় শাকুরের বাড়ির ছাদে তাঁর গোলাপ চাষের কথা উঠতেই মান্নান রিখিয়ায় কবি বিষ্ণু দের গোলাপ চাষের কথা বলে একটি কবিতার পঙিক্ত আওড়াতেই দৃশ্যত শাকুর প্রায় উত্তেজিত হয়ে উর্দু, ফারসি, ইংরেজি, বাংলায় গোলাপ বিষয়ে কত যে কবিতা আর কবিতার পঙিক্ত অনর্গল বলে যেতে থাকলেন তার কোনো হিসাব নেই। এরপর শুরু হলো গোলাপচর্চার হাজারও কিচ্ছাকাহিনি।
ছাদে অসংখ্য অজস্র টবে রংবেরঙের গোলাপ। তাদের জাতকুলের আদি-অন্ত শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা। এরপর বহু কষ্টে, এদিকে ক্রমেই আঁধারও ঘনিয়ে আসছিল বলেই হয়তো, গোলাপ বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম। এরপর নিচে নেমে ঘরে গিয়ে চা-বিস্কুট খেতে খেতে আবার সংগীত বিষয়ে কথা। এক ফাঁকে আমি বললাম, গোলাপ বিষয়ে মামা আমাকে একটা লেখা দিন না? প্রয়োজনবোধে আমি একটা ছেলেকেও পাঠিয়ে দিতে পারি। ব্যস, ওই কথার ওপর ভিত্তি করেই গোলাপসংগ্রহ-এর লেখা শুরু। তারপর তো সবটাই মামার করোটিজাত আর হাতযশ। গোলাপ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য তো বটেই, আমার ধারণা, বাংলা ভাষায়ও গোলাপ বিষয়ে কত যে লেখালেখি আছে তা এক কথায় বলা দুঃসাধ্য।
ছবিসমেত আবদুশ শাকুরের দ্বিশতাধিক স্বীয় গোলাপ সংগ্রহ পাঠ মানে এক মহাসমুদ্র পরিভ্রমণের শামিল। তাঁর সহজাত ভাষাশৈলী ‘সাধের সাহিত্য’ আর ‘সখের সংগীত’—এই দুই ধারার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে আবদুশ শাকুর তাকে গোলাপসুন্দরীর প্রেমে মজিয়ে কীভাবে ত্রিচারিণী করে তুললেন, তারই এক মনোজ্ঞ ইতিহাস এ বইয়ের পাতায় পাতায়। এর জন্য তিনি তাবৎ শিল্প, কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আদি-অন্ত রোমন্থন করে যে ক্ষীরসমুদ্রে অবগাহন করালেন তা এক কথায় দ্বিতীয়রহিত। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে আবদুশ শাকুর কী আনেননি? প্রবাদ-প্রবচন, পুরাণ, ব্যুৎপত্তি কী নেই তাতে? খুঁজে দেখতে হলে গোয়েন্দা লাগাতে হবে।
আবদুশ শাকুর কত না বিষয়ে চর্চা করেছেন, লিখেছেন। শুধু বিষয়ই নয়, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাঁর পরিভ্রমণ ছিল ঈর্ষণীয়। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাঁর রবীন্দ্রনাথচর্চা। বাংলা একাডেমীর অজুরা নিয়ে তিনি পরিকল্পিত রবীন্দ্রজীবনের কয়েক খণ্ডের মধ্যে দুই খণ্ড শেষ করে গেছেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর রচিত মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, পরম্পরাহীন রবীন্দ্রনাথ, মহাগদ্যকবি রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু জানি, রবীন্দ্রনাথের অনুজ্জ্বল অঞ্চল, চিরনতুন রবীন্দ্রনাথ, শ্রোতার কৈফিয়ত উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, তাঁর পরিকল্পিত কয়েক খণ্ডে আত্মজীবনী কাঁটাতেও গোলাপ থাকে মাত্র লিখতে শুরু করেছিলেন। এক কি দুই খণ্ডের মতো লিখে গেছেন সম্ভবত।
সবশেষে গোলাপসংগ্রহ আর গল্পগ্রন্থ ঘোর-এর পরিবর্ধিত সংস্করণ বের করে গেছেন। নিজের রম্যরচনার সংকলন রমণীয় রচনা দেখে গেছেন। আর কিছু অভিনব সম্পাদনার কাজ শেষ করে গেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য—সংগীতজ্ঞ অমিয়নাথ সান্যালের স্মৃতির অতলের এবং পরশুরাম, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী আর ধারখ্যাত আসহাব উদ্দিন আহমদের। বাঙালির মুক্তির গান নামে যে সংকলনটি সম্পাদনা করে গেছেন, সেটি ঘরে ঘরে রাখার মতো সম্পদ হিসেবে গণ্য হতে পারে। সেই সঙ্গে সংগীতসম্পর্কিত তাঁর অন্যান্য বইও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মহান শ্রোতা, সাংগীতিক সাক্ষরতা, সংগীত সংগীত, সংগীত সংবিত বইগুলো সংগীতপ্রেমীদের জন্য অতি-অবশ্য পাঠ্য।
এসবের মধ্যেও চারটি অনন্যসাধারণ ছোটগল্পের সংযুক্তি আমাদের বাড়তি পাওনা।
মাত্র ৭২ বছর বয়স্ক আবদুশ শাকুর ছিলেন সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ। ছোটবেলায় কামিল মাদ্রাসায় পড়া আবদুশ শাকুর প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন, যাতে কোনো ফাঁকফোকরের অবকাশ ছিল না। তিনি কলকাতায় যেতেন তাঁর সংগীতগুরু পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর কাছে। শাকুরের কাছে সুরের সাধনা ছিল অকৃত্রিম বিশুদ্ধতার ধ্রুবপদবিশেষ।
লেখক হিসেবে আবদুশ শাকুর বহুমাত্রিক এবং বহুপ্রসূ। এই তো বছর খানেক আগে তাঁর গল্পসমগ্র বইটির জন্য পেয়েছেন অমিয়ভূষণ পুরস্কার। কিন্তু কথা হচ্ছে, অন্য দেশে তাঁর মূল্যায়ন হলেও, কথায় বলে না গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, তাঁকে যথার্থ সম্মান আমাদের দেওয়া হলো না।
ব্যক্তিগত জীবনে একসময় আমি আমার এক ধনাঢ্য আর বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনপ্রিয় মেজো মামার কেয়ার অবে কাটিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। মামার শ্যালকেরা তখন প্রায় লেখাপড়ায় নিযুক্ত। তাঁদের অনেক বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালে প্রথমে লেখক পরে সম্প্রচার-বিশারদ হিসেবে খ্যাতিমান হুমায়ুন চৌধুরী। তিনি একসময় অসাধারণ সব গল্প লিখে সবাইকে চমকে দিয়ে কী এক অজ্ঞাত কারণে আর লিখলেনই না। ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জনকারী হেমায়েত ও আবদুশ শাকুরসহ আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয়ের পর মামার শালারাও যথার্থ কারণে মামা হয়ে আমার মামাবাহিনীকে যে বেশ বৃহৎ করে তুলল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁদের সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বেশ মেধাবী ছিলেন। সেই থেকে শাকুরের সঙ্গে আমার মামা-ভাগনে সম্পর্ক বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠল। তার পরিচয় পাওয়া গেল সুদীর্ঘকাল বাদে, যখন শাকুর লিখতে শুরু করলেন। তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল রম্যলেখক হিসেবে প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ক্ষীয়মাণ দিয়ে। কোনো প্যাঁচ-পয়জার নেই। নিখুঁত চলনের গল্প। নেহাত রামগরুড়ের ছানা না হলে বিরস বদনে ওই গল্প হজম করা কঠিন।
আসলে জীবনের নানা বাঁকে যে যাঁর মতো জীবিকার তাড়নায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে চলে যাওয়ায় কথাবার্তা তো দূরের কথা, দেখা-সাক্ষাৎও হতো না বলতে গেলে। তবে একমাত্র লেখালেখির কারণে জানা যেত কে কোন অবস্থানে আছেন। সর্বোপরি মনে হতো, আচ্ছা, বেঁচে-বর্তে তো আছেন! ব্যস, ওই পর্যন্তই। আকস্মিকভাবে মামার শালা মামাদের সঙ্গে দেখা হলে কথা প্রসঙ্গে জানা যেত কে কোথায় আছেন বা কেমন আছেন। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন, মাস, বছরের পর বছর। প্রায় তিন যুগ বাদে যে ফের তাঁর সঙ্গে দেখা, সেও ওই লেখালেখির কারণেই। এর মধ্যে আমাদের বুড়িগঙ্গা দিয়ে যেমন অনেক পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে, তেমনি ঢের দুঃস্বপ্ন আর মানুষের গৃধ্নুতা আর লোভ বুড়িগঙ্গাকে শুধু গ্রাসই নয়, কলুষিতও করে তুলেছে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল আবদুশ শাকুর সরকারের সচিব হিসেবে বসবাস করছেন ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে। আমি তখন একটি নগণ্য সাপ্তাহিকীর সঙ্গে জড়িত। জানি না কিংবা আজ আর মনে করতে পারছি না—‘মরহুম’ শব্দটা লিখতে গিয়ে বুকটা ধক করে উঠছে—আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঝালাই করার জন্যই শাকুরের বাড়িতে গেলাম। শাকুর তো একেবারে অভিভূত। শাকুরকে যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন তিনি একসঙ্গে কত রকমের কাজে নিজেকে বেশ নিবিষ্টভাবে রাখতে পারেন। একদিকে যেমন সাহিত্য আর লেখালেখির কথা বলছেন, অন্যদিকে আবার হারমোনিয়াম নিয়ে গজল বা অন্য কোনো রাগপ্রধান গানের প্রভেদ বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
তাঁর কথা বলার ধরনটা ছিল এক প্রসঙ্গে গেলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার। তা দেখে আমার মতো অর্বাচীনের হাস্যোদ্রেক সামলানো কঠিন হয়ে পড়ত। মান্নানের মতো নিবিষ্ট শ্রোতা থাকাতে রক্ষা। একদিন কথায় কথায় আমি আমার ওই অকিঞ্চিৎকর সাপ্তাহিকীর জন্য একটা লেখা চাইলাম। কথায় কথায় শাকুরের বাড়ির ছাদে তাঁর গোলাপ চাষের কথা উঠতেই মান্নান রিখিয়ায় কবি বিষ্ণু দের গোলাপ চাষের কথা বলে একটি কবিতার পঙিক্ত আওড়াতেই দৃশ্যত শাকুর প্রায় উত্তেজিত হয়ে উর্দু, ফারসি, ইংরেজি, বাংলায় গোলাপ বিষয়ে কত যে কবিতা আর কবিতার পঙিক্ত অনর্গল বলে যেতে থাকলেন তার কোনো হিসাব নেই। এরপর শুরু হলো গোলাপচর্চার হাজারও কিচ্ছাকাহিনি।
ছাদে অসংখ্য অজস্র টবে রংবেরঙের গোলাপ। তাদের জাতকুলের আদি-অন্ত শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা। এরপর বহু কষ্টে, এদিকে ক্রমেই আঁধারও ঘনিয়ে আসছিল বলেই হয়তো, গোলাপ বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম। এরপর নিচে নেমে ঘরে গিয়ে চা-বিস্কুট খেতে খেতে আবার সংগীত বিষয়ে কথা। এক ফাঁকে আমি বললাম, গোলাপ বিষয়ে মামা আমাকে একটা লেখা দিন না? প্রয়োজনবোধে আমি একটা ছেলেকেও পাঠিয়ে দিতে পারি। ব্যস, ওই কথার ওপর ভিত্তি করেই গোলাপসংগ্রহ-এর লেখা শুরু। তারপর তো সবটাই মামার করোটিজাত আর হাতযশ। গোলাপ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য তো বটেই, আমার ধারণা, বাংলা ভাষায়ও গোলাপ বিষয়ে কত যে লেখালেখি আছে তা এক কথায় বলা দুঃসাধ্য।
ছবিসমেত আবদুশ শাকুরের দ্বিশতাধিক স্বীয় গোলাপ সংগ্রহ পাঠ মানে এক মহাসমুদ্র পরিভ্রমণের শামিল। তাঁর সহজাত ভাষাশৈলী ‘সাধের সাহিত্য’ আর ‘সখের সংগীত’—এই দুই ধারার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে আবদুশ শাকুর তাকে গোলাপসুন্দরীর প্রেমে মজিয়ে কীভাবে ত্রিচারিণী করে তুললেন, তারই এক মনোজ্ঞ ইতিহাস এ বইয়ের পাতায় পাতায়। এর জন্য তিনি তাবৎ শিল্প, কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আদি-অন্ত রোমন্থন করে যে ক্ষীরসমুদ্রে অবগাহন করালেন তা এক কথায় দ্বিতীয়রহিত। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে আবদুশ শাকুর কী আনেননি? প্রবাদ-প্রবচন, পুরাণ, ব্যুৎপত্তি কী নেই তাতে? খুঁজে দেখতে হলে গোয়েন্দা লাগাতে হবে।
আবদুশ শাকুর কত না বিষয়ে চর্চা করেছেন, লিখেছেন। শুধু বিষয়ই নয়, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাঁর পরিভ্রমণ ছিল ঈর্ষণীয়। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাঁর রবীন্দ্রনাথচর্চা। বাংলা একাডেমীর অজুরা নিয়ে তিনি পরিকল্পিত রবীন্দ্রজীবনের কয়েক খণ্ডের মধ্যে দুই খণ্ড শেষ করে গেছেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর রচিত মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, পরম্পরাহীন রবীন্দ্রনাথ, মহাগদ্যকবি রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু জানি, রবীন্দ্রনাথের অনুজ্জ্বল অঞ্চল, চিরনতুন রবীন্দ্রনাথ, শ্রোতার কৈফিয়ত উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, তাঁর পরিকল্পিত কয়েক খণ্ডে আত্মজীবনী কাঁটাতেও গোলাপ থাকে মাত্র লিখতে শুরু করেছিলেন। এক কি দুই খণ্ডের মতো লিখে গেছেন সম্ভবত।
সবশেষে গোলাপসংগ্রহ আর গল্পগ্রন্থ ঘোর-এর পরিবর্ধিত সংস্করণ বের করে গেছেন। নিজের রম্যরচনার সংকলন রমণীয় রচনা দেখে গেছেন। আর কিছু অভিনব সম্পাদনার কাজ শেষ করে গেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য—সংগীতজ্ঞ অমিয়নাথ সান্যালের স্মৃতির অতলের এবং পরশুরাম, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী আর ধারখ্যাত আসহাব উদ্দিন আহমদের। বাঙালির মুক্তির গান নামে যে সংকলনটি সম্পাদনা করে গেছেন, সেটি ঘরে ঘরে রাখার মতো সম্পদ হিসেবে গণ্য হতে পারে। সেই সঙ্গে সংগীতসম্পর্কিত তাঁর অন্যান্য বইও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মহান শ্রোতা, সাংগীতিক সাক্ষরতা, সংগীত সংগীত, সংগীত সংবিত বইগুলো সংগীতপ্রেমীদের জন্য অতি-অবশ্য পাঠ্য।
এসবের মধ্যেও চারটি অনন্যসাধারণ ছোটগল্পের সংযুক্তি আমাদের বাড়তি পাওনা।
মাত্র ৭২ বছর বয়স্ক আবদুশ শাকুর ছিলেন সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ। ছোটবেলায় কামিল মাদ্রাসায় পড়া আবদুশ শাকুর প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন, যাতে কোনো ফাঁকফোকরের অবকাশ ছিল না। তিনি কলকাতায় যেতেন তাঁর সংগীতগুরু পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর কাছে। শাকুরের কাছে সুরের সাধনা ছিল অকৃত্রিম বিশুদ্ধতার ধ্রুবপদবিশেষ।
লেখক হিসেবে আবদুশ শাকুর বহুমাত্রিক এবং বহুপ্রসূ। এই তো বছর খানেক আগে তাঁর গল্পসমগ্র বইটির জন্য পেয়েছেন অমিয়ভূষণ পুরস্কার। কিন্তু কথা হচ্ছে, অন্য দেশে তাঁর মূল্যায়ন হলেও, কথায় বলে না গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, তাঁকে যথার্থ সম্মান আমাদের দেওয়া হলো না।
No comments