শিকড়ের সন্ধান by এমাজউদ্দীন আহমদ
স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় চার দশক। ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ হিসেবে বাংলাদেশের বয়স কিন্তু চার হাজার বছরেরও বেশি। সমুদ্র সৈকতে বালুকারাজির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রত্নভাণ্ডার, সমুদ্রের বেলাভূমিতে,
সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনীবাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের উপযোগী স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালি দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া কখন যে শুরু হয় তা কেউ জানি না বটে, ইতিহাসবিদদের ধারণায় কিন্তু এই জনপদে মানুষের বসবাস শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালেরও বহু আগে।
ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে। কিন্তু এ জনপদ দীর্ঘদিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষদিকে কিংবদন্তির সেই গঙ্গারিডাই (Gangaridai) সাম্রাজ্যের আমল থেকে শুরু করে, মৌর্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে, পাল ও সেন রাজাদের রাজত্ব পার হয়ে, দিলি্লর সালতানাত ও মোগল সাম্রাজ্যের অবসানের পর ব্রিটিশ-ভারত পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিবৃত্ত একই রকম, অনেকটা সরলরৈখিক। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গ (Vangah) রাধা (Radhah)), গৌড় (Gaudah), পুণ্ড্র (Pundrah) ইত্যাদি গোত্র-গোষ্ঠীর আবাসভূমি-রূপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদের এই খণ্ডছিন্ন রাজনৈতিক একক হিসেবে সর্বপ্রথম ইতিহাসের আলোকে এলেও, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, পর্যায়ক্রমে তা বঙ্গ (ঠধহমধ), বাঙ্গালা (Bangala) এবং বাংলাদেশ (Bangladesh)-রূপে আবির্ভূত হয়েছে সগৌরবে। ছোট ছোট লোকালয় সর্বপ্রথম পরিচিত হয় সদাসিক্ত বৃষ্টিবিধৌত বন্স্ অথবা বং (Bans or Bang)-রূপে। সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭) এসব জনপদকে ঐক্যবদ্ধ করে সর্বপ্রথম বাঙ্গালা (Bangala)-রূপে অভিহিত করেন। তিনি নিজেও শাহ-ই-বাঙ্গালা (Shah-i-Bangala) উপাধি ধারণ করেন। পরবর্তী সময়ে বাঙ্গালা হয়ে ওঠে বাংলা। ব্রিটিশ-ভারতে বাংলা ও বঙ্গ রূপান্তরিত হয় বেঙ্গলে (ইবহমধষ)। স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে তা হয় বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে, একদিকে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব-এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত বাংলাদেশে বসবাস করেছেন কয়েক হাজার বছর ধরে বহু নৃতাত্তি্বকগোষ্ঠীর জনসমষ্টি। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্তত ৫৭টি নৃতাত্তি্বকগোষ্ঠীর মানুষ এ দেশে এখন বসবাস করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন কিছু আদিবাসী। অন্যরা এই উর্বর জনপদে এসেছেন বিভিন্ন কারণে। কেউ এসেছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, কেউবা এসেছেন সেখানকার শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে। বিজয়ীর বেশে এসেও কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করে হয়ে গেছেন স্থানীয়। এসেছেন উত্তর দিক থেকে, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম থেকে। আবার কেউ কেউ এসেছেন দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব দিক থেকে। হাজার হাজার বছরের ব্যাপনকালে আদিবাসী ও বাইরে থেকে আগত জনসমষ্টি মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা, প্রথা, জীবনাচারের হাজারো প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায় এ অঞ্চলে জন্মলাভ করে এক নতুন সংস্কৃতি।
এ সংস্কৃতি ছিল বৈরী প্রকৃতির দাপট সহ্য করে সবাই মিলে টিকে থাকার, ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের উদ্যত ফণা জাপটে ধরে আত্মরক্ষার এবং পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর থেকে আসা দখলদারদের প্রতিহত করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করার। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, যে অঞ্চল আজ স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে চিহ্নিত, তার অবয়ব খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী শতাব্দীতেও সম্পূর্ণ হয়নি। প্রথম শতাব্দীতে খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং ফরিদপুরের কোটালীপাড়া ও তৎসংলগ্ন এলাকা সমুদ্রস্নাত হয়ে সবেমাত্র মাথা উঁচু করে জনবসতির উপযোগী হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি তার পরের ২০০ বছর পর্যন্ত যশোর-কুষ্টিয়ার বৃহৎ এলাকা তো বটেই, এমনকি রাজধানী ঢাকার আশপাশ পর্যন্ত বিধৌত করেছে। উর্বর এবং শ্যামল এই নতুন মাটি অল্পায়াসে যেমন কৃষকদের গোলা ভরিয়েছে সোনালি ফসলে, তেমনি রোগব্যাধি-মহামারি কেড়ে নিয়েছে হাজারো প্রাণ_অকস্মাৎ, অনেকটা বিনা নোটিশে।
তাই এই ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের মন যেমন কোমল, উদার, সবাইকে আপন করার মতো ভাবঘন, তেমনি বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য দুর্জয় সাহসে ভরা। একদিকে প্রকৃতির দুর্দমনীয় তাণ্ডবলীলা মানুষকে করেছে ভাববাদী, অন্যদিকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং চারপাশে সবুজের ঘন আস্তরণে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ সবাইকে করে তোলে স্বভাবকবি। তাই এই জনপদের জনগণের কাছে প্রবাদ-প্রবচন যে প্রাত্যহিক চলন-বলনের মতোই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাণপণ করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে দৃঢ়সংকল্প এ দেশের জনগণকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে বলে একদিকে যেমন তারা নির্ভীক, অন্যদিকে ছলে-বলে-কৌশলে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেও ভীষণ দক্ষ। দক্ষ তারা কথার পাশে কথা সাজিয়ে গান রচনায়। দক্ষ গ্রামীণ জীবনের অনেক সত্যকে সুরেলা কণ্ঠে মন মাতানো ঢঙে উপস্থাপনে। প্রবাদ-প্রবচনে তাই প্রতিফলিত হয়েছে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের নিকট হস্তান্তরযোগ্য মূল্যবান অভিজ্ঞান।
অনেক সময় বলেছি, বাংলাদেশকে ভালোভাবে জানতে হলে গ্রামে যেতে হবে, কেননা গ্রামেই বাংলাদেশের হৃদয় স্পন্দিত। এখন বলতে চাই, গ্রামীণ জীবনের ঋদ্ধি ও সৌকর্য সম্পর্কে অবহিত হতে হলে দৃষ্টি ফেরাতে হবে আমাদের সনাতন প্রবাদ-প্রবচনের দিকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের অবয়বে কারুকার্য নেই বটে, কিন্তু সমাজজীবনের বৈচিত্র্য ভরা দিকনির্দেশনা এবং নিখাদ অভিজ্ঞতার পসরায় আমাদের প্রবাদ-প্রবচন ভীষণভাবে সমৃদ্ধ। এসবের মধ্যেই মিলবে সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের এবং জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শিকড়ের সন্ধান। বাংলাদেশের প্রবাদ-প্রবচন কয়েকটি কারণে এ সমাজের জ্ঞান-অভিজ্ঞান, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক অবস্থা, জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ-মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রবাদ-প্রবচন আমাদের সমাজের প্রাচীনত্বের নিদর্শন। এসব প্রবাদ-প্রবচন লোকজ্ঞানের গভীরতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন যে ভয়ংকর, জীবন্ত এসব প্রবাদ-প্রবচন তার স্মারকতুল্য। এই সম্পদকে সর্বসাধারণের মধ্যে বিতরণ করতে পারলে এবং এর সঠিক মূল্যায়ন সম্পন্ন হলে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাব বেশ কয়েক শ যোজন।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে। কিন্তু এ জনপদ দীর্ঘদিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষদিকে কিংবদন্তির সেই গঙ্গারিডাই (Gangaridai) সাম্রাজ্যের আমল থেকে শুরু করে, মৌর্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে, পাল ও সেন রাজাদের রাজত্ব পার হয়ে, দিলি্লর সালতানাত ও মোগল সাম্রাজ্যের অবসানের পর ব্রিটিশ-ভারত পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিবৃত্ত একই রকম, অনেকটা সরলরৈখিক। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গ (Vangah) রাধা (Radhah)), গৌড় (Gaudah), পুণ্ড্র (Pundrah) ইত্যাদি গোত্র-গোষ্ঠীর আবাসভূমি-রূপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদের এই খণ্ডছিন্ন রাজনৈতিক একক হিসেবে সর্বপ্রথম ইতিহাসের আলোকে এলেও, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, পর্যায়ক্রমে তা বঙ্গ (ঠধহমধ), বাঙ্গালা (Bangala) এবং বাংলাদেশ (Bangladesh)-রূপে আবির্ভূত হয়েছে সগৌরবে। ছোট ছোট লোকালয় সর্বপ্রথম পরিচিত হয় সদাসিক্ত বৃষ্টিবিধৌত বন্স্ অথবা বং (Bans or Bang)-রূপে। সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭) এসব জনপদকে ঐক্যবদ্ধ করে সর্বপ্রথম বাঙ্গালা (Bangala)-রূপে অভিহিত করেন। তিনি নিজেও শাহ-ই-বাঙ্গালা (Shah-i-Bangala) উপাধি ধারণ করেন। পরবর্তী সময়ে বাঙ্গালা হয়ে ওঠে বাংলা। ব্রিটিশ-ভারতে বাংলা ও বঙ্গ রূপান্তরিত হয় বেঙ্গলে (ইবহমধষ)। স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে তা হয় বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে, একদিকে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব-এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত বাংলাদেশে বসবাস করেছেন কয়েক হাজার বছর ধরে বহু নৃতাত্তি্বকগোষ্ঠীর জনসমষ্টি। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্তত ৫৭টি নৃতাত্তি্বকগোষ্ঠীর মানুষ এ দেশে এখন বসবাস করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন কিছু আদিবাসী। অন্যরা এই উর্বর জনপদে এসেছেন বিভিন্ন কারণে। কেউ এসেছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, কেউবা এসেছেন সেখানকার শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে। বিজয়ীর বেশে এসেও কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করে হয়ে গেছেন স্থানীয়। এসেছেন উত্তর দিক থেকে, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম থেকে। আবার কেউ কেউ এসেছেন দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব দিক থেকে। হাজার হাজার বছরের ব্যাপনকালে আদিবাসী ও বাইরে থেকে আগত জনসমষ্টি মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা, প্রথা, জীবনাচারের হাজারো প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায় এ অঞ্চলে জন্মলাভ করে এক নতুন সংস্কৃতি।
এ সংস্কৃতি ছিল বৈরী প্রকৃতির দাপট সহ্য করে সবাই মিলে টিকে থাকার, ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের উদ্যত ফণা জাপটে ধরে আত্মরক্ষার এবং পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর থেকে আসা দখলদারদের প্রতিহত করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করার। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, যে অঞ্চল আজ স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে চিহ্নিত, তার অবয়ব খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী শতাব্দীতেও সম্পূর্ণ হয়নি। প্রথম শতাব্দীতে খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং ফরিদপুরের কোটালীপাড়া ও তৎসংলগ্ন এলাকা সমুদ্রস্নাত হয়ে সবেমাত্র মাথা উঁচু করে জনবসতির উপযোগী হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি তার পরের ২০০ বছর পর্যন্ত যশোর-কুষ্টিয়ার বৃহৎ এলাকা তো বটেই, এমনকি রাজধানী ঢাকার আশপাশ পর্যন্ত বিধৌত করেছে। উর্বর এবং শ্যামল এই নতুন মাটি অল্পায়াসে যেমন কৃষকদের গোলা ভরিয়েছে সোনালি ফসলে, তেমনি রোগব্যাধি-মহামারি কেড়ে নিয়েছে হাজারো প্রাণ_অকস্মাৎ, অনেকটা বিনা নোটিশে।
তাই এই ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের মন যেমন কোমল, উদার, সবাইকে আপন করার মতো ভাবঘন, তেমনি বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য দুর্জয় সাহসে ভরা। একদিকে প্রকৃতির দুর্দমনীয় তাণ্ডবলীলা মানুষকে করেছে ভাববাদী, অন্যদিকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং চারপাশে সবুজের ঘন আস্তরণে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ সবাইকে করে তোলে স্বভাবকবি। তাই এই জনপদের জনগণের কাছে প্রবাদ-প্রবচন যে প্রাত্যহিক চলন-বলনের মতোই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাণপণ করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে দৃঢ়সংকল্প এ দেশের জনগণকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে বলে একদিকে যেমন তারা নির্ভীক, অন্যদিকে ছলে-বলে-কৌশলে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেও ভীষণ দক্ষ। দক্ষ তারা কথার পাশে কথা সাজিয়ে গান রচনায়। দক্ষ গ্রামীণ জীবনের অনেক সত্যকে সুরেলা কণ্ঠে মন মাতানো ঢঙে উপস্থাপনে। প্রবাদ-প্রবচনে তাই প্রতিফলিত হয়েছে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের নিকট হস্তান্তরযোগ্য মূল্যবান অভিজ্ঞান।
অনেক সময় বলেছি, বাংলাদেশকে ভালোভাবে জানতে হলে গ্রামে যেতে হবে, কেননা গ্রামেই বাংলাদেশের হৃদয় স্পন্দিত। এখন বলতে চাই, গ্রামীণ জীবনের ঋদ্ধি ও সৌকর্য সম্পর্কে অবহিত হতে হলে দৃষ্টি ফেরাতে হবে আমাদের সনাতন প্রবাদ-প্রবচনের দিকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের অবয়বে কারুকার্য নেই বটে, কিন্তু সমাজজীবনের বৈচিত্র্য ভরা দিকনির্দেশনা এবং নিখাদ অভিজ্ঞতার পসরায় আমাদের প্রবাদ-প্রবচন ভীষণভাবে সমৃদ্ধ। এসবের মধ্যেই মিলবে সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের এবং জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শিকড়ের সন্ধান। বাংলাদেশের প্রবাদ-প্রবচন কয়েকটি কারণে এ সমাজের জ্ঞান-অভিজ্ঞান, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক অবস্থা, জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ-মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রবাদ-প্রবচন আমাদের সমাজের প্রাচীনত্বের নিদর্শন। এসব প্রবাদ-প্রবচন লোকজ্ঞানের গভীরতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন যে ভয়ংকর, জীবন্ত এসব প্রবাদ-প্রবচন তার স্মারকতুল্য। এই সম্পদকে সর্বসাধারণের মধ্যে বিতরণ করতে পারলে এবং এর সঠিক মূল্যায়ন সম্পন্ন হলে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাব বেশ কয়েক শ যোজন।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments