ইসরায়েলের পরবর্তী যুদ্ধ by অ্যাঁলেই গ্রেস

১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ার ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিঙ্নের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। গোল্ডামায়ারকে নিঙ্ন বলেন, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত একটি পূর্ণ শান্তি আলোচনায় প্রস্তুত আছেন।
মায়ার তখন নিঙ্নকে আশ্বাস দেন যে ইসরায়েলও শান্তি চায়। কিন্তু কায়রোকে বিশ্বাস করা যায় না; তাই তিনি পূর্ণ চুক্তি নয়, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সমঝোতার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। গোল্ডামায়ার জানিয়েছিলেন, মিসরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৯৬৭ সালের ৪ জুনের সীমান্তরেখা থেকে ইসরায়েলি সেনা তুলে নিতে বাধ্য করা, অতঃপর ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনের বিভক্তিরেখা অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিকল্পনা আবার ফিরিয়ে আনা। তিনি নিঙ্নকে বলেছিলেন, ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে ইয়াসির আরাফাত ও 'সন্ত্রাসী'দের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।
উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইসরায়েলের সাংবাদিক অ্যালুফ বেন এ আলোচনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। তিনি ইসরায়েলের সে সময়ের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির একটি তুলনামূলক চিত্র এঁকেছেন। তখন ইসরায়েলের শান্তি আলোচনা প্রত্যাখ্যানের ফলে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিসরীয় বাহিনী সুয়েজ চ্যানেল অতিক্রম করেছিল। একই রকম বিষয় দেখা যাচ্ছে বারাক ওবামার প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও। বেন উল্লেখ করেছেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের সে ঘটনাকেই পুনরায় টেনে আনছেন। তাঁর মতে, 'গোল্ডামায়ার ও নিঙ্নের সেই আলোচনা শুনে কি নেতানিয়াহু নিজেকে শুধরে নেবেন? তিনি কি নিজেকে একবারও জিজ্ঞেস করবেন না যে দেশটিতে ইয়ম কুপুরের সেই ধ্বংসাত্মক ঘটনার মতো একই ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে ক্ষেত্রে তাঁর কী করণীয় এবং তিনি কিভাবে সে ভুল এড়িয়ে যেতে পারেন?' সেই যুদ্ধে দুই হাজার ৬০০ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছিল। কলামিস্ট থমাস এল ফ্রিডম্যান আরবদের প্রতি সহানুভূতিশীল নন বলেই পরিচিত। কিন্তু তিনিও মনে করেন, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বন্ধ করার প্রস্তাব ইসরায়েলের নাকচ করা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে, ইসরায়েলের ওপর বারাক ওবামা চাপ প্রয়োগ করতে অক্ষম। আর সে কারণেই নেতানিয়াহু মীমাংসা-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। পূর্বসূরিদের মতো নেতানিয়াহু বলে চলেছেন যে তিনি শান্তি চান। কিন্তু সে শান্তি তিনি চান ফিলিস্তিনিদের অধিকার অস্বীকার করে ও নিজেদের জয় নিশ্চিত করে শান্তি পদদলিত করার মধ্য দিয়ে। গত বছর তিনি সব অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বারবার ফিলিস্তিনিদের চাপ দিয়েছেন ইসরায়েলের গৃহীত 'সিকিউরিটি কনসেপ্ট' গ্রহণ করে নিতে। এই সিকিউরিটি কনসেপ্টের পাশাপাশি তিনি ইসরায়েলি সেনাদের জর্ডান উপত্যকায়ও (ফিলিস্তিনি অংশের ভেতর) মোতায়েন করে রেখেছেন এবং পশ্চিম তীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে রেখেছেন। তিনি এ কথাও বলেননি যে কত দিন ধরে এ দখলদারি চলতে থাকবে।
এই অবিচল সিকিউরিটি কনসেপ্ট ইসরায়েলি সেনাদের আবার যুদ্ধের দিকে ধাবিত করছে। সিকিউরিটি কনসেপ্টের মূল চরিত্র হলো, এ অঞ্চলে যে ইসরায়েলের এই সিকিউরিটি কনসেপ্ট গ্রহণ না করবে, সে-ই হলো সন্ত্রাসী এবং তাকেই ধ্বংস করতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এমন ধরনের কোনো সিকিউরিটি কনসেপ্ট নেই। অর্থাৎ এ সিকিউরিটি কনসেপ্টের মধ্যেই রয়েছে ইসরায়েলের স্থায়ীভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে থাকার বিষয়টি। এরপর ইসরায়েল কোথায় আক্রমণ করবে_গাজায়? দুই বছর আগে ইসরায়েলি ট্যাংক ও এয়ারক্রাফট ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এবং শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। গোল্ডস্টোনের প্রতিবেদনে এ আক্রমণকে শুধু যুদ্ধাপরাধ নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ হামাস কিন্তু একই রকম শক্তিশালী রয়ে গেছে। আর লেবাননে? ২০০৬ সালের জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত অভিযানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামাসকে কাবু করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু মাঝখান থেকে দেশটি ধ্বংস করে ফেলেছে। হিজবুল্লাহ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিক শক্তিশালী। ফলে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড একটি বড় অভিযান চালিয়ে, এমনকি লেবাননের আংশিক দখল করে নেওয়ার আশঙ্কার কথাও এখন বাতিল করতে পারছে না।
আর ইরানের বেলায়? ইরাক থেকে লেবানন পর্যন্ত এবং আফগানিস্তান থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ঝুঁকির ব্যাপারে? মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো অস্থিরতা যুদ্ধকে অপরিহার্য করে তুলবে। আবারও ১৯৭৩ সালের মতো ইসরায়েল প্রথমেই সরাসরি পদক্ষেপ নিতে চাইবে। কিন্তু এখন তাদের অনেক বেশি শক্তিশালী শত্রুকে মোকাবিলা করতে হবে।
শান্তির মধ্যস্থতাকারী ইউরি আভনেরি বিশ্বমতামতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করেছেন। ব্রাজিল, বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনা ফিলিস্তিনকে ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমান্ত অনুসারে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপের ২৬ জন বিশিস্ট ব্যক্তি (ক্রিস প্যাটেন, গুলিয়ানো আমাতো, ফেলিপ গনজালেস, লিওনেল জসপাঁ, হুবার্ট ভেদ্রিন, রোমানো প্রোদি, হাভিয়ার সোলানাসহ) চিঠি দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, যদি আগামী বসন্তের মধ্যে ইসরায়েল তার নীতি পরিবর্তন না করে, তাহলে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। ১৯ ডিসেম্বর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সিস্টেমেটিক বৈষম্যের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েল সরকারকে তহবিল প্রদান বন্ধ করতে, যে তহবিল ব্যবহৃত হচ্ছে বসতি স্থাপনে (এক বিলিয়ন ডলারের বেশি)।
আভনেরি উল্লেখ করেছেন, 'কেউ একজন এ সপ্তাহে লিখেছেন : যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সহায়তা দেশটির আত্মহত্যায় সহায়তা করার শামিল। ইসরায়েলের আইন অনুসারে, আত্মহত্যায় সহায়তা করা একটি অপরাধ। কিন্তু আমাদের আইনে নিজের ইচ্ছায় আত্মহত্যা অনুমোদিত। যাদের ঈশ্বর ধ্বংস করতে চান, তাদের তিনি প্রথমে উন্মাদ করে তোলেন। আমরা আশা করি, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই আমরা নিজেদের শুধরে নেব।
লেখক : ফ্রান্সের বহুলপ্রচারিত লা মঁদ পত্রিকার ডেপুটি চেয়ারম্যান।
লা মঁদ থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.