কল্পকথার গল্প-'ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না' by আলী হাবিব
'কহো ভাই কহো রে, আঁকাচোরা শহরে/বদ্যিরা কেউ নাকি/আলুভাতে খায় না/লেখা আছে কাগজে/আলু খেলে মগজে/ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে/বুদ্ধি গজায় না'-ছড়া সম্রাট সুকুমার রায়ের এই ছড়াটি অনেকেরই পড়া। আলু খেলে মগজের ঘিলু নষ্ট হয়ে যাবে_এমন কথা ভেবে কিন্তু আলু খাওয়া বন্ধ নেই।
আলু খেলে বুদ্ধি লোপ পায় বা বুদ্ধি গজায় না_এমন কোনো তত্ত্ব বা তথ্যও জানা নেই আমাদের। বিশ্বজুড়ে আলুর ফলন বেড়েছে। বিকল্প খাদ্য হিসেবে আলুর কদর বেড়েছে। আলু নিয়ে কত রকমের রেসিপি হতে পারে, তার একটা প্রদর্শনী হয়েছিল রাজধানীর একটি বড় হোটেলে। সেখানে আলু খেয়ে অনেকে ধন্য ধন্য করেছিলেন কিংবা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আলুর স্যুপ থেকে শুরু করে আলু নিয়ে নানা পদ পরিবেশন করা হয়েছিল। সেখানে আলুর নানা পদ খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে যাঁরা সেদিন ওই অভিজাত হোটেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল কিংবা মস্তিষ্কে বুদ্ধি গজায়নি_এমন কোনো খবর আমাদের কাছে নেই। অর্থাৎ, আলু খেলে মগজে বুদ্ধি গজায় না_এমন কথা সত্য বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে না। সুকুমার রায় তাঁর ননসেন্স রাইমে যা লিখেছেন, তা যে নিছকই মজা করার জন্য, সেটা বুঝতেও কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তার পরও আমাদের বুদ্ধি কমছে। শুধু যে বুদ্ধি কমছে তা নয়, কমছে আমাদের ঘিলুও। ঘিলু যত কমছে, ততই নাকি বুদ্ধি কমছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের মাথায় নাকি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ঘিলু ছিল। ছিল অনেক বেশি বুদ্ধিও। কিন্তু আমাদের ঘিলু ও বুদ্ধি_দুটোই নাকি কম।
মাথায় ঘিলু কম, বুদ্ধি কম_এমন কথা কেউ নির্বিচারে বলে দিলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু মেনে না নিয়েও উপায় নেই। কারণ বিজ্ঞানীরা যখন বলছেন, তখন তা মেনে না নিয়েই বা উপায় কী! বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই তথ্য-উপাত্ত হাতে না নিয়ে কোনো কথা বলতে যাননি। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। এর পরই না একটি তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছেন। বিজ্ঞানীদের এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা দিন দিন বেকুব হচ্ছি। অন্য কোনো প্রাণী বেকুব হয়ে গেলে আমরা মেনে নিতে পারি, কিন্তু মানুষ বেকুব হয়ে যাচ্ছে_এটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু খবর বলছে, বিজ্ঞানীরা ২০ হাজার বছর আগের একটি মানুষের মাথার খুলি নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেটার একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিরূপ তৈরি করেছেন। এতে দেখা গেছে, খুলিটির ভেতর সেই আদি মানবের মস্তিষ্কের আয়তন দেড় হাজার ঘনসেন্টিমিটার। অথচ এখন আমাদের মস্তিষ্কের আয়তন গড়ে এক হাজার ৩৫০ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ গত ২০ হাজার বছরে আমাদের মস্তিষ্কের আকার কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর এই হিসাব গোটা পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-গোষ্ঠীর মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে সত্য। নারী-পুরুষেও এর কোনো হেরফের হয়নি। নারীদের ক্ষেত্রেও ঘিলুর আকার ছোট হয়ে আসার এ ব্যাপারটি একইভাবে ঘটেছে। অর্থাৎ এভাবে ঘিলুর আকার ছোট হয়ে আমরা আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেকুব হচ্ছি।
কিন্তু মানুষের বুদ্ধি কমে যাচ্ছে, ঘিলু কমে যাচ্ছে_এমন তত্ত্ব কিংবা তথ্য মেনে নেওয়াটাও খুব কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই এ তত্ত্বের বিপক্ষেও যুক্তি আছে। এ তত্ত্বের বিপক্ষে যাঁরা, তাঁদের যুক্তি হলো, খুলির আকার ছোট হয়ে আসার মানেই যে মানুষের বুদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে, তা সত্য নয়। ছোট হয়ে আসছে_এটা ঠিক, তবে এর বিপরীতে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের নৃতত্ত্ববিদ ড. জন হকস এই ধারার একজন। ঘিলুর আকার ছোট হয়ে আসার কারণ কী? এর ব্যাখ্যা কী? অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, বৈরী পরিবেশে কেবল 'শক্ত-পোক্ত'রাই টিকে থাকতে পেরেছেন। আর শক্ত-পোক্তদের সবারই মস্তিষ্কের আকার বড়। তবে পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে টিকে থাকার লড়াই দিন দিন কমে বা সহজতর হয়ে এসেছে। সমাজ যত আধুনিক আর জটিল আকার ধারণ করেছে, টিকে থাকার জন্য মানুষের লড়াইয়ের প্রয়োজনও ততই কমেছে। ফলে মস্তিষ্কের আকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়েছে। এর পরও বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ বলছেন, ঘিলুর আকার কমছে এবং আমরা দিন দিন বেকুব থেকে বেকুবতর হচ্ছি।
মানুষ অন্য প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধিমান_এটা সবাইকে মানতে হবে। বুদ্ধির জোরে মানুষ অন্য প্রাণীকে পোষ মানায়, বশে রাখে। প্রাণিকুলে মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধি বোধ হয় ডলফিনের। বাড়িতে বউ আর অফিসে বসকে বশে রাখার কৌশল মানুষ আয়ত্ত করেছে বুদ্ধির জোরেই। বুদ্ধি না থাকলে তা সম্ভব হতো না। ২০ হাজার বছর আগের মানুষের মাথার খুলি নিয়ে যতই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক না কেন, ওই সময় মানুষকে এত বুদ্ধি খরচ করতে হতো না। আগে তো আর এখনকার মতো বুদ্ধির প্রতিযোগিতা ছিল না। রাজনীতি-অর্থনীতি ছিল না, তালেবান ছিল না, রাজাকার-আলবদর-আলশামস ছিল না। বুদ্ধির লড়াই করতে হতো না। লড়াই করতে হতো প্রকৃতির সঙ্গে। লড়াই করে টিকে থাকতে হতো। এখন মানুষকে যেভাবে বুদ্ধিতে শাণ দিতে হয়, আগে সেভাবে দিতে হতো না। এখনকার মতো সেই আমলে নির্বাচন ছিল না। টিকে থাকার অন্য রকম লড়াই হয়তো ছিল, কিন্তু এখনকার মতো বুদ্ধি খরচ করতে হতো কি না তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। যদি শারীরিক শক্তির কথা বলা হয়, তাহলে হয়তো মেনে নেওয়া যেতে পারে। সেই আমলে মানুষকে শক্তির জোরে টিকে থাকতে হতো। কিন্তু সেটা আদৌ বুদ্ধির শক্তি ছিল_এটা বোধ হয় নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এখন মানুষকে বুদ্ধি খরচ করতে হয়। মানুষের ঘিলুতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বুদ্ধি জমা হয়। জমা হওয়া বুদ্ধি খরচ না করলে তা মগজেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই আমলে এত বদবুদ্ধি-কূটবুদ্ধিও ছিল না। মানুষকে কম বুদ্ধি খরচ করতে হতো।
কয়েক বছর আগে আইনস্টাইনের ঘিলু নিয়ে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল কোনো একটি বিদেশি পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়, আইনস্টাইনের ঘিলু সাধারণ মানুষের ঘিলুর চেয়ে আকারে বড়। সেই ঘিলু কোনো এক বিজ্ঞান জাদুঘরে রাখা আছে। আইনস্টাইনকে উদাহরণ হিসেবে টেনে বলা যেতে পারে, ঘিলু বড় হলে বুদ্ধি বেশি থাকে। তাই বলে ঘিলুর পরিমাণ কম হলেই যে বুদ্ধি কম হবে, এমন কথা কি বলা যায়? ছোট হলেই কি সব কিছু খারাপ? আগের দিনে বেশ বড় বড় বাড়ি তৈরি হতো। এখন অল্প জমিতে বেশি বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আগের দিনে যৌথ পরিবার ছিল। যৌথ পরিবার ভেঙে পরিবার ছোট হয়েছে। ছোট ঘর, ছোট আশা_গান হচ্ছে। মানুষ গুনগুন করে গাইছে, 'ছোট আমার ঘর/ছোট ছোট আশা'। মানুষের বুদ্ধি যদি আগের চেয়ে কমবে, তাহলে মানুষ আগের চেয়ে বড় বড় কাজ করছে কিভাবে? আগের দিনে মানুষ আকাশে উড়তে পারত না। এখন মানুষ আকাশে উড়ছে। আকাশে ওড়ার কথা বাদ দেওয়া যাক। মানুষ মহাশূন্য জয় করেছে। চাঁদে গেছে। মঙ্গলে যাই-যাই করছে। এখানে-ওখানে ঢুঁ মারছে। এখন তো আর আয় আয় চাঁদ মামা নয়, চাঁদে পা ফেলে মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে, কোথাও যেতে আর মানা নেই। চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দেবে কী, চাঁদেই তো মানুষের পায়ের ছাপ আঁকা হয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও মানুষের বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন। অন্য কোনো প্রাণীর বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুললে না হয় মেনে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু মানুষের বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা! তবে বুদ্ধির জোর নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কাউকে বুদ্ধিমান, কাউকে বোকা বলা যেতে পারে। একটা কুকুরের গল্প বলা যাক। এক কুকুর একটা বাস্কেট নিয়ে মাংসের দোকানে এসে হাজির। দোকানের মালিক বা কসাই দেখল, বাস্কেটে ৫০০ গ্রাম মাংসের দাম রাখা আছে। একটি চিরকুটে লেখা আছে_৫০০ গ্রাম মাংস দিতে হবে। কসাই বাস্কেট থেকে টাকাটা তুলে নিয়ে ৪০০ গ্রাম মাংস একটি প্যাকেটে দিয়ে বাস্কেটে রাখতেই কুকুরটা খেপে গেল। কসাইকে কামড়াতে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে কসাই ভাবল, এই কুকুর বেশ বুদ্ধিমান; একে ঠকানো যাবে না। সে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে আরো ১০০ গ্রাম মাংস সেখানে দিয়ে প্যাকেটটা আবার বাস্কেটে রাখল। কুকুরটা ঘুরে চলতে শুরু করল। কসাই দোকান ছেড়ে কুকুরের পেছনে যেতে শুরু করল। এমন বুদ্ধিমান কুকুরের মালিক কে, সেটা তাকে দেখতে হবে। কুকুরটা একটা বহুতল ভবনে ঢুকল। কসাই তার পেছনে। কুকুরটা লিফটে উঠল। উঠল কসাইও। কুকুরটা লিফটের বাটন চাপ দিল। নির্দিষ্ট ফ্লোরে থামল লিফট। কুকুরটার সঙ্গে নেমে গেল কসাই। কুকুর এবার একটি ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপল। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রলোক। কসাইকে দেখে বললেন, 'মাফ করবেন, আপনাকে কষ্ট করে আসতে হলো। বোকা কুকুরটা এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ফ্ল্যাটের চাবিটা না নিয়ে বাইরে চলে গেছে।' বিস্মিত কসাইয়ের আর বলা হলো না, এই কুকুরটি যদি বোকা হয়, তাহলে বুদ্ধিমান কে!
মগজ কিংবা ঘিলু এবং বুদ্ধি নিয়েই যখন কথা উঠেছে, তখন ওই ব্যাপারেই থাকা যাক। আরেকটি গল্পে ফেরা যাক। বহুবার ব্যবহৃত গল্পটি একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা যাক। এক ভদ্রলোক সারাজীবন কিছুই করতে পারেননি। রাজনীতি করতেন তিনি। নীতি ও আদর্শের কথা বলতেন। কিন্তু ওই আদর্শের রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁর কিছুই করা হয়নি। এ নিয়ে ঘরে স্ত্রী অসন্তুষ্ট। আত্মীয়-স্বজনরা মুখ ঘুরিয়ে থাকেন। ভদ্রলোক ভাবেন, কী করা যায়? এভাবে তো আর চলছে না। দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন। অথচ তাঁর একটা বাড়ি নেই, গাড়ি নেই। সমসাময়িক অনেকেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। অথচ তাঁর কিছুই হয়নি। একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। হঠাৎ একটি সাইনবোর্ডে চোখ আটকে যায় তাঁর। সাইনবোর্ডে লেখা আছে_'এখানে ব্রেইন পরিবর্তন করা যায়'। সাইনবোর্ড দেখে ভদ্রলোকের মনে পড়ল আগের রাতের কথা।
আগের রাতে বাড়িতে ফেরার পর খাওয়ার সময় স্ত্রী ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, 'তোমার মাথায় কি কোনো দিনই বুদ্ধি হবে না? কত লোক কত কিছু করছে। তুমি কি কিছুই করতে পারবে না?' ভদ্রলোক গেলেন সেখানে। কথা বললেন। তাঁকে জানানো হলো, ওখানে নানা রকম ব্রেইন ডেভেলপ করা যায়। এ জন্য ব্রেইন খুলে রেখে আসতে হবে। এক মাস পর ডেলিভারি। ভদ্রলোক নিজের ব্রেইন ডেভেলপ করার জন্য খুলে দিয়ে এলেন। এক মাস পর গিয়ে নিয়ে আসবেন, কথা হলো।
এক মাস পর ভদ্রলোকের দেখা নেই। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক একদিন টেলিভিশনে দেখলেন, এক ভদ্রলোক কোনো এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন। চিকিৎসক চিনতে পারলেন, এটা তাঁরই রোগী। একদিন কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখাও হয়ে গেল। চিকিৎসক ধরলেন তাঁকে। ভদ্রলোক বললেন, ওই ব্রেইনের আর দরকার নেই তাঁর। ব্রেইন খুলে দিয়ে আসার পর থেকেই তিনি ভালো আছেন। তাঁর দিন বদলে গেছে। তিনি এখন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ।
লেখক : সাংবাদিক
habib.clihabbib@yahoo.com
মাথায় ঘিলু কম, বুদ্ধি কম_এমন কথা কেউ নির্বিচারে বলে দিলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু মেনে না নিয়েও উপায় নেই। কারণ বিজ্ঞানীরা যখন বলছেন, তখন তা মেনে না নিয়েই বা উপায় কী! বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই তথ্য-উপাত্ত হাতে না নিয়ে কোনো কথা বলতে যাননি। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। এর পরই না একটি তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছেন। বিজ্ঞানীদের এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা দিন দিন বেকুব হচ্ছি। অন্য কোনো প্রাণী বেকুব হয়ে গেলে আমরা মেনে নিতে পারি, কিন্তু মানুষ বেকুব হয়ে যাচ্ছে_এটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু খবর বলছে, বিজ্ঞানীরা ২০ হাজার বছর আগের একটি মানুষের মাথার খুলি নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেটার একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিরূপ তৈরি করেছেন। এতে দেখা গেছে, খুলিটির ভেতর সেই আদি মানবের মস্তিষ্কের আয়তন দেড় হাজার ঘনসেন্টিমিটার। অথচ এখন আমাদের মস্তিষ্কের আয়তন গড়ে এক হাজার ৩৫০ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ গত ২০ হাজার বছরে আমাদের মস্তিষ্কের আকার কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর এই হিসাব গোটা পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-গোষ্ঠীর মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে সত্য। নারী-পুরুষেও এর কোনো হেরফের হয়নি। নারীদের ক্ষেত্রেও ঘিলুর আকার ছোট হয়ে আসার এ ব্যাপারটি একইভাবে ঘটেছে। অর্থাৎ এভাবে ঘিলুর আকার ছোট হয়ে আমরা আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেকুব হচ্ছি।
কিন্তু মানুষের বুদ্ধি কমে যাচ্ছে, ঘিলু কমে যাচ্ছে_এমন তত্ত্ব কিংবা তথ্য মেনে নেওয়াটাও খুব কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই এ তত্ত্বের বিপক্ষেও যুক্তি আছে। এ তত্ত্বের বিপক্ষে যাঁরা, তাঁদের যুক্তি হলো, খুলির আকার ছোট হয়ে আসার মানেই যে মানুষের বুদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে, তা সত্য নয়। ছোট হয়ে আসছে_এটা ঠিক, তবে এর বিপরীতে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের নৃতত্ত্ববিদ ড. জন হকস এই ধারার একজন। ঘিলুর আকার ছোট হয়ে আসার কারণ কী? এর ব্যাখ্যা কী? অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, বৈরী পরিবেশে কেবল 'শক্ত-পোক্ত'রাই টিকে থাকতে পেরেছেন। আর শক্ত-পোক্তদের সবারই মস্তিষ্কের আকার বড়। তবে পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে টিকে থাকার লড়াই দিন দিন কমে বা সহজতর হয়ে এসেছে। সমাজ যত আধুনিক আর জটিল আকার ধারণ করেছে, টিকে থাকার জন্য মানুষের লড়াইয়ের প্রয়োজনও ততই কমেছে। ফলে মস্তিষ্কের আকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়েছে। এর পরও বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ বলছেন, ঘিলুর আকার কমছে এবং আমরা দিন দিন বেকুব থেকে বেকুবতর হচ্ছি।
মানুষ অন্য প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধিমান_এটা সবাইকে মানতে হবে। বুদ্ধির জোরে মানুষ অন্য প্রাণীকে পোষ মানায়, বশে রাখে। প্রাণিকুলে মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধি বোধ হয় ডলফিনের। বাড়িতে বউ আর অফিসে বসকে বশে রাখার কৌশল মানুষ আয়ত্ত করেছে বুদ্ধির জোরেই। বুদ্ধি না থাকলে তা সম্ভব হতো না। ২০ হাজার বছর আগের মানুষের মাথার খুলি নিয়ে যতই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক না কেন, ওই সময় মানুষকে এত বুদ্ধি খরচ করতে হতো না। আগে তো আর এখনকার মতো বুদ্ধির প্রতিযোগিতা ছিল না। রাজনীতি-অর্থনীতি ছিল না, তালেবান ছিল না, রাজাকার-আলবদর-আলশামস ছিল না। বুদ্ধির লড়াই করতে হতো না। লড়াই করতে হতো প্রকৃতির সঙ্গে। লড়াই করে টিকে থাকতে হতো। এখন মানুষকে যেভাবে বুদ্ধিতে শাণ দিতে হয়, আগে সেভাবে দিতে হতো না। এখনকার মতো সেই আমলে নির্বাচন ছিল না। টিকে থাকার অন্য রকম লড়াই হয়তো ছিল, কিন্তু এখনকার মতো বুদ্ধি খরচ করতে হতো কি না তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। যদি শারীরিক শক্তির কথা বলা হয়, তাহলে হয়তো মেনে নেওয়া যেতে পারে। সেই আমলে মানুষকে শক্তির জোরে টিকে থাকতে হতো। কিন্তু সেটা আদৌ বুদ্ধির শক্তি ছিল_এটা বোধ হয় নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এখন মানুষকে বুদ্ধি খরচ করতে হয়। মানুষের ঘিলুতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বুদ্ধি জমা হয়। জমা হওয়া বুদ্ধি খরচ না করলে তা মগজেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই আমলে এত বদবুদ্ধি-কূটবুদ্ধিও ছিল না। মানুষকে কম বুদ্ধি খরচ করতে হতো।
কয়েক বছর আগে আইনস্টাইনের ঘিলু নিয়ে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল কোনো একটি বিদেশি পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়, আইনস্টাইনের ঘিলু সাধারণ মানুষের ঘিলুর চেয়ে আকারে বড়। সেই ঘিলু কোনো এক বিজ্ঞান জাদুঘরে রাখা আছে। আইনস্টাইনকে উদাহরণ হিসেবে টেনে বলা যেতে পারে, ঘিলু বড় হলে বুদ্ধি বেশি থাকে। তাই বলে ঘিলুর পরিমাণ কম হলেই যে বুদ্ধি কম হবে, এমন কথা কি বলা যায়? ছোট হলেই কি সব কিছু খারাপ? আগের দিনে বেশ বড় বড় বাড়ি তৈরি হতো। এখন অল্প জমিতে বেশি বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আগের দিনে যৌথ পরিবার ছিল। যৌথ পরিবার ভেঙে পরিবার ছোট হয়েছে। ছোট ঘর, ছোট আশা_গান হচ্ছে। মানুষ গুনগুন করে গাইছে, 'ছোট আমার ঘর/ছোট ছোট আশা'। মানুষের বুদ্ধি যদি আগের চেয়ে কমবে, তাহলে মানুষ আগের চেয়ে বড় বড় কাজ করছে কিভাবে? আগের দিনে মানুষ আকাশে উড়তে পারত না। এখন মানুষ আকাশে উড়ছে। আকাশে ওড়ার কথা বাদ দেওয়া যাক। মানুষ মহাশূন্য জয় করেছে। চাঁদে গেছে। মঙ্গলে যাই-যাই করছে। এখানে-ওখানে ঢুঁ মারছে। এখন তো আর আয় আয় চাঁদ মামা নয়, চাঁদে পা ফেলে মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে, কোথাও যেতে আর মানা নেই। চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দেবে কী, চাঁদেই তো মানুষের পায়ের ছাপ আঁকা হয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও মানুষের বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন। অন্য কোনো প্রাণীর বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুললে না হয় মেনে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু মানুষের বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা! তবে বুদ্ধির জোর নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কাউকে বুদ্ধিমান, কাউকে বোকা বলা যেতে পারে। একটা কুকুরের গল্প বলা যাক। এক কুকুর একটা বাস্কেট নিয়ে মাংসের দোকানে এসে হাজির। দোকানের মালিক বা কসাই দেখল, বাস্কেটে ৫০০ গ্রাম মাংসের দাম রাখা আছে। একটি চিরকুটে লেখা আছে_৫০০ গ্রাম মাংস দিতে হবে। কসাই বাস্কেট থেকে টাকাটা তুলে নিয়ে ৪০০ গ্রাম মাংস একটি প্যাকেটে দিয়ে বাস্কেটে রাখতেই কুকুরটা খেপে গেল। কসাইকে কামড়াতে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে কসাই ভাবল, এই কুকুর বেশ বুদ্ধিমান; একে ঠকানো যাবে না। সে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে আরো ১০০ গ্রাম মাংস সেখানে দিয়ে প্যাকেটটা আবার বাস্কেটে রাখল। কুকুরটা ঘুরে চলতে শুরু করল। কসাই দোকান ছেড়ে কুকুরের পেছনে যেতে শুরু করল। এমন বুদ্ধিমান কুকুরের মালিক কে, সেটা তাকে দেখতে হবে। কুকুরটা একটা বহুতল ভবনে ঢুকল। কসাই তার পেছনে। কুকুরটা লিফটে উঠল। উঠল কসাইও। কুকুরটা লিফটের বাটন চাপ দিল। নির্দিষ্ট ফ্লোরে থামল লিফট। কুকুরটার সঙ্গে নেমে গেল কসাই। কুকুর এবার একটি ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপল। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রলোক। কসাইকে দেখে বললেন, 'মাফ করবেন, আপনাকে কষ্ট করে আসতে হলো। বোকা কুকুরটা এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ফ্ল্যাটের চাবিটা না নিয়ে বাইরে চলে গেছে।' বিস্মিত কসাইয়ের আর বলা হলো না, এই কুকুরটি যদি বোকা হয়, তাহলে বুদ্ধিমান কে!
মগজ কিংবা ঘিলু এবং বুদ্ধি নিয়েই যখন কথা উঠেছে, তখন ওই ব্যাপারেই থাকা যাক। আরেকটি গল্পে ফেরা যাক। বহুবার ব্যবহৃত গল্পটি একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা যাক। এক ভদ্রলোক সারাজীবন কিছুই করতে পারেননি। রাজনীতি করতেন তিনি। নীতি ও আদর্শের কথা বলতেন। কিন্তু ওই আদর্শের রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁর কিছুই করা হয়নি। এ নিয়ে ঘরে স্ত্রী অসন্তুষ্ট। আত্মীয়-স্বজনরা মুখ ঘুরিয়ে থাকেন। ভদ্রলোক ভাবেন, কী করা যায়? এভাবে তো আর চলছে না। দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন। অথচ তাঁর একটা বাড়ি নেই, গাড়ি নেই। সমসাময়িক অনেকেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। অথচ তাঁর কিছুই হয়নি। একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। হঠাৎ একটি সাইনবোর্ডে চোখ আটকে যায় তাঁর। সাইনবোর্ডে লেখা আছে_'এখানে ব্রেইন পরিবর্তন করা যায়'। সাইনবোর্ড দেখে ভদ্রলোকের মনে পড়ল আগের রাতের কথা।
আগের রাতে বাড়িতে ফেরার পর খাওয়ার সময় স্ত্রী ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, 'তোমার মাথায় কি কোনো দিনই বুদ্ধি হবে না? কত লোক কত কিছু করছে। তুমি কি কিছুই করতে পারবে না?' ভদ্রলোক গেলেন সেখানে। কথা বললেন। তাঁকে জানানো হলো, ওখানে নানা রকম ব্রেইন ডেভেলপ করা যায়। এ জন্য ব্রেইন খুলে রেখে আসতে হবে। এক মাস পর ডেলিভারি। ভদ্রলোক নিজের ব্রেইন ডেভেলপ করার জন্য খুলে দিয়ে এলেন। এক মাস পর গিয়ে নিয়ে আসবেন, কথা হলো।
এক মাস পর ভদ্রলোকের দেখা নেই। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক একদিন টেলিভিশনে দেখলেন, এক ভদ্রলোক কোনো এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন। চিকিৎসক চিনতে পারলেন, এটা তাঁরই রোগী। একদিন কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখাও হয়ে গেল। চিকিৎসক ধরলেন তাঁকে। ভদ্রলোক বললেন, ওই ব্রেইনের আর দরকার নেই তাঁর। ব্রেইন খুলে দিয়ে আসার পর থেকেই তিনি ভালো আছেন। তাঁর দিন বদলে গেছে। তিনি এখন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ।
লেখক : সাংবাদিক
habib.clihabbib@yahoo.com
No comments