পুরনো চাঁদ নতুন করে দেখা by ড. এ কে মনোওয়ার উদ্দীন আহমদ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বারবার আন্দোলিত করেন। তিনি বলেছেন, ঘটে যা তা সত্য নহে, সে সত্য যা রচিবে তুমি, কবি তব মনভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো। আমাদের দেশে রাজনীতিতে অনেক বড় বড় বিতর্ক আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একটি বড় স্বপ্ন দেখে।
সে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণের কল্পনার শেখ মুজিব ছিলেন এক সীমাহীন ও দুর্জয় শক্তি। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের স্বপ্ন। কাজেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরে সুর মিলিয়ে বলতেই হবে, জনগণের স্বপ্নের শেখ মুজিব আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে চরম সত্য। এ জায়গা আর কেউ নিতে পারবে না। বলা নিষ্প্রয়োজন, এ স্বপ্ন হঠাৎ তৈরি হয়নি। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ_আজ সবই আমাদের অতি নিকট-অতীত। স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ_যে স্বপ্ন শেখ মুজিব দেখিয়েছিলেন, বাস্তবে আমরা তা কতটা অর্জন করতে পেরেছি, সেটা আজ পেছনে ফিরে দেখার সময় এসেছে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে উচ্চ আদালতের রায় থেকে যে বার্তা পেয়েছি তা হলো, সামরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক। তাঁর ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তী সময়ে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশের মূল কাঠামোরই পরিবর্তন করা হয়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সামরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মধ্যে কে বেশি দোষী? এ প্রেক্ষাপটে আজ পেছন ফিরে তাকানো অত্যন্ত জরুরি। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। নিকট-অতীতের ঘটনাপ্রবাহের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন কঠিন কাজ। তবুও এই আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর দিতেই হবে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল। এ সময়ের অর্থনৈতিক সমস্যার বিশ্লেষণ ও পলিসির মূল্যায়ন করেছেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। এসব বিষয় নিয়ে আমার কথা নয়। তবে তিনটি বিষয়, অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইন, বাকশাল সরকার গঠন এবং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই স্বপ্নের বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো চিন্তা করা হয়েছিল তা থেকে যে অনেক দূরে সরে আসা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকার, দল ও নেতৃত্বের নিজস্ব যুক্তি যা-ই হোক না কেন; সাধারণ মানুষ যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, বঙ্গবন্ধুর সরকার এ তিনটি পদক্ষেপের মাধ্যমে তার মূলে কুঠারাঘাত করে। আমরা লক্ষ করেছি, যদিও বিশেষ ক্ষমতা আইনটি প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বলা যায়, পরবর্তী সময়ে এ দেশের সব সরকারই এ আইনের আশ্রয় নিয়েছে। সুখের বিষয় এই যে এই স্বৈরাচারী আইনে আজ পর্যন্ত যত আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে, হাইকোর্ট প্রায় সব ক্ষেত্রে এসব সরকারি আদেশ অবৈধ ও বেআইনি বলে ঘোষণা করেছেন। উযধশধ খধ িজবঢ়ড়ৎঃ (উখজ)-এর পাতা উল্টালেই তা দেখতে পাওয়া যাবে। এটা খুবই খারাপ একটা আইন, উচ্চ আদালতের রায়ে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হয়েছে। অথচ কোনো সরকারই এটা বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়া দূরের কথা, এ নিয়ে কোনো চিন্তাই করেনি। এই তো স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাস্তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নমুনা! ১৯৭৫ সালে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। খন্দকার মোশতাক আহমদের ক্ষমতা গ্রহণ এবং ইনডেমনিটি আইন জারি_এ সবই ছিল বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না; এমন একটি আইন জারি করার মতো কাজটি যে স্বপ্নের বাংলাদেশের মূল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী, তা কি বলার কোনো প্রয়োজন আছে? তখন দেশে রাজনৈতিক হোলিখেলা চলছিল। সামরিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই শাসনতন্ত্রে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আনলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলেন। আদর্শগতভাবে এটা ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এক চরম আঘাত। যে স্বপ্নের বাংলাদেশ সব ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং যার জন্য মুক্তি-সংগ্রাম হয়েছিল, সামরিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় তা সম্পূর্ণ উল্টে দিলেন।
সুশীল সমাজ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি কে করেছেন? সেনাপতি জিয়াউর রহমান, না সেনাপতি এরশাদ? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর বড়ই জটিল। এক কথায় বলা যায়, কেউ কারো চেয়ে কম নন। সামরিক রাষ্ট্রপতি সেনাপতি জিয়াউর রহমান নির্বাচন করেছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেনারেল ওসমানী। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল এই মর্মে যে কর্মরত ইউনিফর্ম পরা কোনো সামরিক অফিসার নির্বাচন করতে পারেন না। সেনাপতি জিয়াউর রহমানের তখন এজেন্ট ছিলেন মওদুদ আহমদ। আজ আমরা অনেকেই তা ভুলে গেছি। মওদুদ আহমদ তখন তাঁর ব্রিফকেস থেকে কাগজ বের করে দেখান যে ইত্যবসরে সামরিক রাষ্ট্রপতি সেনাপতি জিয়াউর রহমান আর্মি অ্যাক্ট পরিবর্তন করেছেন। পরিবর্তন করেছেন গোপনে এবং এই মর্মে যে যখন সেনাবাহিনীর কোনো অফিসার প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে কাজ করবেন, তখন তিনি নির্বাচনসহ যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই পরিবর্তন আজও বহাল আছে। সেনাপতি জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে স্লোগান হিসেবে জিন্দাবাদ প্রবর্তন করেন, শাসনতন্ত্রে আনেন বিসমিল্লাহ এবং আর্মি অ্যাক্টের পরিবর্তন সাধন করেন। এসব কাজ অবশ্যই অমার্জনীয় অপরাধ। সম্প্রতি মওদুদ আহমদ দাবি করেছেন, তিনি সামরিক আইন বা প্রশাসনের অংশ ছিলেন না। তাহলে তিনি কী ছিলেন?
সামরিক রাষ্ট্রপতি সেনাপতি জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন সেনাপতি এরশাদ। অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে শান্ত মস্তিষ্কে এগিয়ে যান সেনাপতি এরশাদ। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সে ব্যাপারে সাধারণ নাগরিক হিসেবে শুধু এটুকু বলা যে_আপনারা বুঝতে চেষ্টা করুন, তাঁরা কী বলতে চাচ্ছেন। আমার মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। আদালত তাঁর পরিধি লঙ্ঘন না করে এক বস্তুনিষ্ঠ রায় দিয়েছেন, যা আমাদের সবার জন্য শিরোধার্য এবং এ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ক্ষমতালিপ্সু সেনাপতি এরশাদ বিচারপতি সাত্তার ক্ষমতায় বসার কিছু দিন পর তাঁর বাসভবনে সাংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা ও দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভাগ দাবি করেন। আর্মির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য তখনই তাঁর বিচার হওয়া উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের অধীন এক কর্মকর্তা অর্থাৎ সিপাহশালার এরশাদ এমন একটি অমার্জনীয় অপরাধ করলেন, যার কোনো বিচারই হলো না। সেনাপতি এরশাদ খেললেন এবং অবশেষে বাংলার মসনদে আরোহণ করলেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সেনাপতি এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার আগেও ইয়াহিয়ার সামরিক আদালতের একজন বিচারক ছিলেন। উযধশধ খধ িজবঢ়ড়ৎঃ (উখজ) ১৯৭০ দেখলেই তা-ও নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাঁর কাজের পূর্ণাঙ্গ বয়ান সম্ভব নয়। তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চালু করেন। তাঁর মতো একজন লোক এ কাজ করে ইসলামেরই অবমাননা করেছেন। কারণ, বাংলাদেশ সব ধর্ম ও মতাবলম্বী মানুষের স্বপ্নের সোনার বাংলা। সেনাপতি এরশাদ আরো অনেক ক্ষতিসাধন করেছেন। অবশ্য এ প্রক্রিয়া শুরু হয় সেনাপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই। রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় আর্মি অফিসারদের অবস্থান নিয়ে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সবাই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা সচিব এদের সবার ওপরে। আগেই উল্লেখ করেছি যে সেনাবাহিনী প্রধান প্রতিরক্ষা সচিবের অধীনস্থ কর্মকর্তা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের নিয়মকানুন ভঙ্গ করে সিপাহশালার এরশাদ এসব ভঙ্গ করেছেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ উভয়েই বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন। এরশাদের হাইকোর্ট bifurcation বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তাতেও প্রমাণিত হয় যে তিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন এনে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন।
সামরিক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। অসাংবিধানিক ও বেআইনি কাজ আমরা যে-ই করি না কেন, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ করলেও কিন্তু বৈধতা পাবে না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ শপথ ভঙ্গ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন এবং কাজ শেষে আবার প্রধান বিচারপতির কাজে ফিরে গেলেন আইন সংশোধনের মাধ্যমে, যা ভালো কাজ হয়নি বলেই আমাদের মনে হয়। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটি করল বটে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর (স্বপ্নের বাংলাদেশের) সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক ও নৈতিক চরম ব্যর্থতার দলিল হচ্ছে provision of a caretaker government. আমি মনে করি, এটি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। এটি স্বপ্নের বাংলাদেশের যে ধারণা, তার সঙ্গে খাপ খায় না। পরবর্তী সময়ে এ ধারার অপপ্রয়োগ এবং আধা-সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে এটাও স্বৈরাচারী একটি পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর কিন্তু এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিলেন। খালেদা জিয়া দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে যেভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হয়েছে, বিশেষ করে নারী নির্যাতন হয়েছে_তা অবশ্যই ইতিহাসের কালো অধ্যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু তা-ও হোঁচট খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ ভুল এবং অন্যায় স্বীকার করতে হবে। সোনার বাংলা গড়তে হলে সবাইকে সংশোধন হতে হবে। কাজটি খুব জটিল ও কঠিন। তবে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে দুরূহও কোনো বিষয় নয়। মহাজোট সরকার তাদের শাসনকালের দুই বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছে আর মাত্র দুই দিন পর। অনেক ক্ষেত্রেই এ সরকারের সাফল্য-অর্জন কম নয়; কিন্তু দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতার দাগটি যথেষ্ট মোটা। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এ সরকারকে তাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাজ করতে সচেষ্ট হতেই হবে। সামনের তিন বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক কালো অধ্যায় আছে। এবার আমরা আলো চাই।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল। এ সময়ের অর্থনৈতিক সমস্যার বিশ্লেষণ ও পলিসির মূল্যায়ন করেছেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। এসব বিষয় নিয়ে আমার কথা নয়। তবে তিনটি বিষয়, অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইন, বাকশাল সরকার গঠন এবং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই স্বপ্নের বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো চিন্তা করা হয়েছিল তা থেকে যে অনেক দূরে সরে আসা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকার, দল ও নেতৃত্বের নিজস্ব যুক্তি যা-ই হোক না কেন; সাধারণ মানুষ যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, বঙ্গবন্ধুর সরকার এ তিনটি পদক্ষেপের মাধ্যমে তার মূলে কুঠারাঘাত করে। আমরা লক্ষ করেছি, যদিও বিশেষ ক্ষমতা আইনটি প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বলা যায়, পরবর্তী সময়ে এ দেশের সব সরকারই এ আইনের আশ্রয় নিয়েছে। সুখের বিষয় এই যে এই স্বৈরাচারী আইনে আজ পর্যন্ত যত আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে, হাইকোর্ট প্রায় সব ক্ষেত্রে এসব সরকারি আদেশ অবৈধ ও বেআইনি বলে ঘোষণা করেছেন। উযধশধ খধ িজবঢ়ড়ৎঃ (উখজ)-এর পাতা উল্টালেই তা দেখতে পাওয়া যাবে। এটা খুবই খারাপ একটা আইন, উচ্চ আদালতের রায়ে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হয়েছে। অথচ কোনো সরকারই এটা বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়া দূরের কথা, এ নিয়ে কোনো চিন্তাই করেনি। এই তো স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাস্তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নমুনা! ১৯৭৫ সালে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। খন্দকার মোশতাক আহমদের ক্ষমতা গ্রহণ এবং ইনডেমনিটি আইন জারি_এ সবই ছিল বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না; এমন একটি আইন জারি করার মতো কাজটি যে স্বপ্নের বাংলাদেশের মূল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী, তা কি বলার কোনো প্রয়োজন আছে? তখন দেশে রাজনৈতিক হোলিখেলা চলছিল। সামরিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই শাসনতন্ত্রে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আনলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলেন। আদর্শগতভাবে এটা ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এক চরম আঘাত। যে স্বপ্নের বাংলাদেশ সব ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং যার জন্য মুক্তি-সংগ্রাম হয়েছিল, সামরিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় তা সম্পূর্ণ উল্টে দিলেন।
সুশীল সমাজ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি কে করেছেন? সেনাপতি জিয়াউর রহমান, না সেনাপতি এরশাদ? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর বড়ই জটিল। এক কথায় বলা যায়, কেউ কারো চেয়ে কম নন। সামরিক রাষ্ট্রপতি সেনাপতি জিয়াউর রহমান নির্বাচন করেছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেনারেল ওসমানী। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল এই মর্মে যে কর্মরত ইউনিফর্ম পরা কোনো সামরিক অফিসার নির্বাচন করতে পারেন না। সেনাপতি জিয়াউর রহমানের তখন এজেন্ট ছিলেন মওদুদ আহমদ। আজ আমরা অনেকেই তা ভুলে গেছি। মওদুদ আহমদ তখন তাঁর ব্রিফকেস থেকে কাগজ বের করে দেখান যে ইত্যবসরে সামরিক রাষ্ট্রপতি সেনাপতি জিয়াউর রহমান আর্মি অ্যাক্ট পরিবর্তন করেছেন। পরিবর্তন করেছেন গোপনে এবং এই মর্মে যে যখন সেনাবাহিনীর কোনো অফিসার প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে কাজ করবেন, তখন তিনি নির্বাচনসহ যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই পরিবর্তন আজও বহাল আছে। সেনাপতি জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে স্লোগান হিসেবে জিন্দাবাদ প্রবর্তন করেন, শাসনতন্ত্রে আনেন বিসমিল্লাহ এবং আর্মি অ্যাক্টের পরিবর্তন সাধন করেন। এসব কাজ অবশ্যই অমার্জনীয় অপরাধ। সম্প্রতি মওদুদ আহমদ দাবি করেছেন, তিনি সামরিক আইন বা প্রশাসনের অংশ ছিলেন না। তাহলে তিনি কী ছিলেন?
সামরিক রাষ্ট্রপতি সেনাপতি জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন সেনাপতি এরশাদ। অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে শান্ত মস্তিষ্কে এগিয়ে যান সেনাপতি এরশাদ। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সে ব্যাপারে সাধারণ নাগরিক হিসেবে শুধু এটুকু বলা যে_আপনারা বুঝতে চেষ্টা করুন, তাঁরা কী বলতে চাচ্ছেন। আমার মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। আদালত তাঁর পরিধি লঙ্ঘন না করে এক বস্তুনিষ্ঠ রায় দিয়েছেন, যা আমাদের সবার জন্য শিরোধার্য এবং এ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ক্ষমতালিপ্সু সেনাপতি এরশাদ বিচারপতি সাত্তার ক্ষমতায় বসার কিছু দিন পর তাঁর বাসভবনে সাংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা ও দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভাগ দাবি করেন। আর্মির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য তখনই তাঁর বিচার হওয়া উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের অধীন এক কর্মকর্তা অর্থাৎ সিপাহশালার এরশাদ এমন একটি অমার্জনীয় অপরাধ করলেন, যার কোনো বিচারই হলো না। সেনাপতি এরশাদ খেললেন এবং অবশেষে বাংলার মসনদে আরোহণ করলেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সেনাপতি এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার আগেও ইয়াহিয়ার সামরিক আদালতের একজন বিচারক ছিলেন। উযধশধ খধ িজবঢ়ড়ৎঃ (উখজ) ১৯৭০ দেখলেই তা-ও নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাঁর কাজের পূর্ণাঙ্গ বয়ান সম্ভব নয়। তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চালু করেন। তাঁর মতো একজন লোক এ কাজ করে ইসলামেরই অবমাননা করেছেন। কারণ, বাংলাদেশ সব ধর্ম ও মতাবলম্বী মানুষের স্বপ্নের সোনার বাংলা। সেনাপতি এরশাদ আরো অনেক ক্ষতিসাধন করেছেন। অবশ্য এ প্রক্রিয়া শুরু হয় সেনাপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই। রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় আর্মি অফিসারদের অবস্থান নিয়ে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সবাই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা সচিব এদের সবার ওপরে। আগেই উল্লেখ করেছি যে সেনাবাহিনী প্রধান প্রতিরক্ষা সচিবের অধীনস্থ কর্মকর্তা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের নিয়মকানুন ভঙ্গ করে সিপাহশালার এরশাদ এসব ভঙ্গ করেছেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ উভয়েই বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন। এরশাদের হাইকোর্ট bifurcation বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তাতেও প্রমাণিত হয় যে তিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন এনে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন।
সামরিক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। অসাংবিধানিক ও বেআইনি কাজ আমরা যে-ই করি না কেন, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ করলেও কিন্তু বৈধতা পাবে না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ শপথ ভঙ্গ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন এবং কাজ শেষে আবার প্রধান বিচারপতির কাজে ফিরে গেলেন আইন সংশোধনের মাধ্যমে, যা ভালো কাজ হয়নি বলেই আমাদের মনে হয়। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটি করল বটে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর (স্বপ্নের বাংলাদেশের) সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক ও নৈতিক চরম ব্যর্থতার দলিল হচ্ছে provision of a caretaker government. আমি মনে করি, এটি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। এটি স্বপ্নের বাংলাদেশের যে ধারণা, তার সঙ্গে খাপ খায় না। পরবর্তী সময়ে এ ধারার অপপ্রয়োগ এবং আধা-সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে এটাও স্বৈরাচারী একটি পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর কিন্তু এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিলেন। খালেদা জিয়া দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে যেভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হয়েছে, বিশেষ করে নারী নির্যাতন হয়েছে_তা অবশ্যই ইতিহাসের কালো অধ্যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু তা-ও হোঁচট খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ ভুল এবং অন্যায় স্বীকার করতে হবে। সোনার বাংলা গড়তে হলে সবাইকে সংশোধন হতে হবে। কাজটি খুব জটিল ও কঠিন। তবে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে দুরূহও কোনো বিষয় নয়। মহাজোট সরকার তাদের শাসনকালের দুই বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছে আর মাত্র দুই দিন পর। অনেক ক্ষেত্রেই এ সরকারের সাফল্য-অর্জন কম নয়; কিন্তু দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতার দাগটি যথেষ্ট মোটা। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এ সরকারকে তাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাজ করতে সচেষ্ট হতেই হবে। সামনের তিন বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক কালো অধ্যায় আছে। এবার আমরা আলো চাই।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments