মেয়েটিকে তুলে নিয়ে জোর করে বলানো হলো 'সব মিথ্যা'

এমপির 'এপিএস' কাজল মোল্লা ঢুকলেন সংবাদ সম্মেলনকক্ষে। সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। তাঁদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান এক কিশোরী ও একজন মাঝবয়সী হতদরিদ্র চেহারার মানুষ। মেয়েটির চেহারা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না।
দুই হাতের আঙুল থেকে কবজি পর্যন্ত পোড়া দাগ। মুখমণ্ডলে একাধিক ক্ষতচিহ্ন। সম্পর্কে তারা বাবা-মেয়ে। কারো দিকে তাকাচ্ছেনও না তাঁরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কাপাসিয়ায় সদর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে হাজির ছিলেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির এপিএস পরিচয়ধারী কাজল মোল্লা। উদ্দেশ্য, কালের কণ্ঠে প্রকাশিত 'পশু দম্পতি' শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ-নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরে কাজল মোল্লা গতকাল বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামেন। সকাল থেকেই নির্যাতিত গৃহপরিচারিকার বাড়ির চারপাশে বসান ক্যাডারদের পাহারা। দুপুরের দিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান নির্যাতিত কিশোরী ও তার বাবাকে। তাদেরকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে প্রথমে অর্থের লোভ দেখানো হয়। তাতে কাজ না হওয়ায় প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হয়, সংবাদ সম্মেলনে কোনো কথা বলা যাবে না। এর পরিবর্তে মেয়েটির সই নিয়ে তাতে নিজেরা পছন্দমতো বক্তব্য লিখে নেন। বাবাকে বাধ্য করা হয়, ধর্ষণ-নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা বলে ঘোষণা দিতে। এভাবে পরিস্থিতি শতভাগ অনুকূলে বিবেচনা করে কাদের মোল্লা তাদেরকে নিয়ে হাজির হন সংবাদ সম্মেলনে। বাইরে পাহারায় বসান ক্যাডার বাহিনীকে।
কাজল মোল্লার ঢাকার মিরপুরের বাসায় কিশোরী গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণ ও মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের খবর গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠে প্রকাশের পর কাপাসিয়াসহ গাজীপুরজুড়ে ছিল তা মুখ্য আলোচ্য বিষয়।
প্রতিবেশীরা জানায়, গতকাল সকাল থেকেই কাজল মোল্লার ক্যাডাররা মেয়েটির বাড়ির চারদিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। বাইরের কাউকে ওই বাড়ির ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা বাড়ির ভেতরে ঢুকে নির্যাতিতার পরিবারকে কয়েকবার প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
দুপুরের দিকে কাপাসিয়া সদর ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য ও উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক কানিজ ফাতেমা রুহিতা বড়টেক গ্রামের বাড়ি থেকে বাবাসহ কিশোরীটিকে তাঁর মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যান। এর পর থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে অজ্ঞাত স্থান থেকে তাদের কাজল মোল্লার সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়।
ইউপি সদস্য কানিজ ফাতেমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি মেয়েটির বাড়িতে গিয়েছিলাম। তবে তাকে সঙ্গে আনিনি।' তবে ওই ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার শাহনাজ পারভীন শিখা জানান, মেয়েটিকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে মেম্বার কানিজ ফাতেমাকে কাপাসিয়ার দিকে যেতে দেখেছেন তিনি। একই কথা বলেন গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেনসহ অনেকেই।
এদিকে কাজল মোল্লার অপকর্মের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশসহ সরকারি দলের কিছু নেতাও উঠেপড়ে লেগেছেন। স্থানীয় থানা পুলিশের ভূমিকা ও বক্তব্য অনেকটাই দলীয় ক্যাডারের মতো।
কাজলের সংবাদ সম্মেলন : কাজল মোল্লা গতকাল বিকেলে কাপাসিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ঘিরে রাখে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের শতাধিক ক্যাডার। নির্যাতনের শিকার কিশোরীটিকে অজ্ঞাত স্থান থেকে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। স্থানীয় এক সাংবাদিক এ সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিশোরীটি প্রশ্ন করেন, 'তোমাকে তো নির্যাতন করা হয়নি, তাই না?' এ সময় মেয়েটি কোনো কথা না বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। অন্য কোনো সাংবাদিককে আর কোনো প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে মেয়েটির স্বাক্ষরযুক্ত একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থিত সাংবাদিকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই কাগজে কিশোরীটির জবানিতে বলা হয়, 'পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনা সঠিক নয়। সব মিথ্যা।' ক্যাডারদের রক্তচক্ষুর কারণে কিশোরীর বাবাও 'ঘটনা কিছুই না' বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কাজল মোল্লা মাত্র কয়েক মিনিটেই তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন। বাবাসহ কিশোরীটিকেও তাঁর লোকজন সঙ্গে নিয়ে যায়। পরে রাত ৮টায় বাবা ও মেয়েকে ক্যাডার পাহারায় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে কাপাসিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরিষদের মেম্বার ওবায়দুল কবির ও উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক কানিজ ফাতেমা রুহিতাও উপস্থিত ছিলেন।
পরিবারের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেশী একটি সূত্র জানায়, মেয়েটিকে গোপন স্থানে নিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের লোভ দেখানো হয়। শর্ত দেওয়া হয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংবাদ সম্মেলনে 'কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ মিথ্যা' মর্মে বক্তব্য দিতে হবে। কিন্তু নির্যাতিত কিশোরী ও তার বাবা তাতে রাজি হননি। পরে তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা না বলার নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা আরো জানায়, মেয়েটির শারীরিক অবস্থা ভালো না। তাকে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া দরকার। তারা চেষ্টা করছে মেয়েটিকে দ্রুত গাজীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে।
সংবাদ সম্মেলনের পর কিশোরীটির বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে এমন মিথ্যা বলতে হয়েছে। সত্য কথা বললে মেয়ের লাশও কেউ খুঁজে পাবে না- কাজল মোল্লার হয়ে তাঁদের এমন হুমকি দেওয়া হয়েছে।
কাপাসিয়া থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন জানান, এ বিষয়ে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কেউ থানায় অভিযোগ করেনি। নির্যাতিতা ও তার পরিবারকে ভয়ভীতি দেখানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাটি ডাহা মিথ্যা। ভয়ভীতি দেখানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি।'
গাজীপুরের পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেন, 'বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে ব্যস্ততার কারণে সারা দিন ব্যস্ত ছিলাম। ওসির কাছে ঘটনা শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
স্থানীয় ইউপি মেম্বার আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্যাতিত মেয়েটি এলাকার অনেককেই ঘটনাটি জানিয়েছে। প্রতিকার বা বিচারের উদ্যোগ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। কালের কণ্ঠ সত্য খবর প্রকাশ করেছে।
পাশে দাঁড়াবে মহিলা আইনজীবী সমিতি : এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি নির্যাতনের শিকার কিশোরী ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী কিশোরীটির চিকিৎসাসহ আইনি সহায়তা প্রদানের আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর হয়ে অ্যাডভোকেট সোহেল রানা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, তিনিসহ সংগঠনের কয়েকজন সদস্য আজ শুক্রবার কিশোরীর বাড়িতে যাবেন। মেয়েটি যেতে চাইলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.