আবুলকে আসামি করলেই অর্থছাড়! by আরিফুর রহমান

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা মামলার চার্জশিটে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেই প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করবে বলে নিশ্চয়তা দিয়েছেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম।
যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক ষড়যন্ত্র করছে বলে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক নয় বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক মুকেশ নন্দন প্রসাদ প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। জিম ইয়ং কিমের এমন মনোভাবের কথা মুকেশ প্রসাদ গত বুধবার ওয়াশিংটন সময় দুপুরবেলায় ই-মেইল করে পাঠান প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীকে। বাংলাদেশে তখন রাত। রাতেই গওহর রিজভী ই-মেইলের প্রতিলিপি পাঠান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। অর্থমন্ত্রী তখন ভারতে অবস্থান করছিলেন। অর্থমন্ত্রী মুহিত বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের এ মনোভাবের কথা জানান রাশিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরকারী সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ কথা জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর সংস্থাটিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ওই সময় তিনি ওয়াশিংটনে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, গওহর রিজভীর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে পুনরায় ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছিল।
ই-মেইলে জিম ইয়ং কিমের উদ্ধৃতি দিয়ে মুকেশ বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থ দিতে প্রস্তুত। এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করতে উদগ্রীব হয়ে আছে বিশ্বব্যাংক। তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, সেই অনুযায়ী মামলার চার্জশিটে আবুল হোসেনের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেই দ্রুত অর্থছাড়ের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে প্যানেলের মতামত বাস্তবায়িত না হলে অর্থ ছাড় করা হবে না। বিশ্বব্যাংক সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয় বলেও জানান জিম।
বিশ্বব্যাংকের এ অবস্থানের কথা সরকার অবগত আছে উল্লেখ করে একজন নীতিনির্ধারক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি এখন সম্পূর্ণ দুদকের হাতে। এ ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই। তবে সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করবে না। দুদকের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে সব কিছু।
দুদক চেয়ারম্যানের কাছে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধানের লেখা চিঠিকে নেতিবাচক বলে মনে করেন না ওই নীতিনির্ধারক। তবে চিঠিতে যে বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে দুদক যদি তা নিষ্পন্ন করতে পারে তবে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোনো সন্দেহ নেই বলে তিনি জানান।
আসামিদের তালিকায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছেন ঢাকা ঘুরে যাওয়া বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান মোরেনো ওকাম্পো। চিঠি পাওয়ার পর দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, তাঁকে আসামি করার মতো যথেষ্ট তথ্য আগে তাঁদের হাতে ছিল না। একজন তদন্ত কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, আসামিদের তালিকায় নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করার সময় বা সুযোগ পেরিয়ে যায়নি। দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন এরই মধ্যে বলেছেন, আগামী সোমবারের মধ্যে দুদক ওকাম্পোর চিঠির উত্তর দেবে।
পদ্মা সেতুর বিষয়ে সরকারের হাতে যে সময় আর বেশি নেই- মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে মন্ত্রীরা তা উপলব্ধি করছেন। কলকাতা থেকে ফিরে গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত এ মাসেই জানতে চায় সরকার। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলে সরকার বিকল্প উপায় খুঁজবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল দুদকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। আমাদের সঙ্গে প্যানেলের কোনো যোগাযোগ নেই। তদন্তের বিষয়টি দুদক ও প্যানেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশ্বব্যাংক ছাড়া অন্য উপায় কী হতে পারে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'অন্য অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান আছে। আমরা নিজস্ব অর্থায়নেও শুরু করতে পারি।'
এদিকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোন উপায়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে সে বিষয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর বিশ্বব্যাংকের সহায়তা না পেলে বিকল্প উপায়ে এই সেতু নির্মাণ করা হবে। বর্তমান সরকারের আমলেই পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের (ইউআইটিএস) বসন্তকালীন নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
সাবেক সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে গত ১৭ ডিসেম্বর সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলা থেকে বাইরে রাখা হয়। ওই সময় দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা না হলেও তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে চার্জশিট দেওয়ার সময় তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।
গত ৯ জানুয়ারি পাঠানো বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত প্রসঙ্গে গতকাল অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে দুদিকেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, তা তাদের নিজস্ব মতামত। এটি বিশ্বব্যাংকের মতামত নয়। বিশ্বব্যাংককে দ্রুত এর সমাধান করার ওপর জোর দেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি মৌসুমেই সরকার পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে চায়।
মন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে কিছু প্রশ্নের জবাব চেয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দ্রুত পাঠাতে দুদক চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। দুদককে বলা হয়েছে প্যানেলের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান করতে।

No comments

Powered by Blogger.