জিএসপি বহাল রাখতে ইউএসটিআরে মতামত জানাবে সরকার- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রমিক সংগঠনের অভিযোগে সুবিধা বাতিল করলে তা হবে অযৌক্তিক by এম শাহজাহান
জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বহাল রাখতে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ইউএসটিআরে মতামত জানাবে সরকার। ইতোমধ্যে বাণিজ্য সংগঠনগুলো তাদের মতামত প্রস্তুত করেছে। আগামী রবিবারের মধ্যে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইওর অভিযোগের ভিত্তিতে ইউএসটিআর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করলে তা হবে অযৌক্তিক। কারণ অভিযোগের পর গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে। অগ্নি নিরাপত্তা বাড়ানোসহ অধিকাংশ কারখানা কমপ্লায়েন্ট করা হয়েছে।শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাওয়া ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইএসটিআর) প্রশ্নের জবাবে মতামত দিয়েছে পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ। বিজিএমইএ তাদের জবাবে বলেছে, তাদের শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যা চালঞ্চ্যকর মামলার তালিকায় নিয়ে দ্রুত বিচার সম্পন্ন ও কল্পনা আক্তার, বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি দেশের প্রয়োজনে কৌশলগতভাবে নিষ্পত্তি করতে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হবে। জবাবে আরও বলা হয়, পোশাক শিল্পে শতভাগ কারখানা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা হচ্ছে। তবে মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক ফান্ডের বিরোধিতা করে বিজিএমইএ বলেছে সব কারখানা মুনাফা করে না, অনেকে লোকসানও করছে। সে ক্ষেত্রে এ বিধান মানা হলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়বে। ইউএসটিআরের জন্য তৈরি করা বিজিএমইএ এই মতামতটি শীঘ্রই মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বা জিএসপি বহাল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হচ্ছে। সকলের মতামতের ভিত্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি বক্তব্য প্রস্তুত করা হবে। ওই বক্তব্য বা প্রস্তাবনা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া হবে, যাতে জিএসপি সুবিধা বহাল রাখা হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধা পায় না। কিন্তু এটি বাতিল করা হলে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সারা বিশ্বে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আমরা ইউএসটিআরে আমাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরব।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য ২০০৭ সালে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন এএফএল-সিআইও নামের এ শ্রমিক সংগঠন ইউএসটিআরে মামলা করে। তাজরিন ইস্যুতে সম্প্রতি মামলাটি ফের পুনরজ্জীবিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশের মতামত তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, যে কারণে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করার কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ ইতোমধ্যে দেশের পোশাক কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্ট করা হয়েছে। ফায়ার সেফটি নিশ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো দেয়া হয়েছে। নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়াসহ পরিবারগুলো পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলো আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে চাই।
উল্লেখ্য, জিএসপি সুবিধা বাতিল, নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যাহার করার আগে তৈরি পোশাক শিল্প, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারের কাছে জানতে চাই ইউএসটিআর। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ইউএসটিআর মতামত সংগ্রহ করবে। এ নিয়ে সংস্থাটি নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ইউএসটিআরের চিঠি পাওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত রবিবার চারটি খাতের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট খাতে শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নের অগ্রগতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ইতোমধ্যে বিজিএমইএ পোশাক শিল্পে শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে ইউএসটিআরকে দেয়া প্রশ্নের জবাব তৈরি করেছে। অবশ্য ইউএসটিআর থেকে পোশাক শিল্পে শ্রম সংশ্লিষ্ট বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সমস্য, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অনিষ্পন্ন ফৌজদারী মামলা, আমিনুল খুনের তদন্ত, কারখানগুলোতে শ্রমিকদের সমন্বয়ে পিটিশন কমিটি গঠন, পোশাক কারখানার লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে স্থানান্তর, ন্যূনতম মজুরি না দেয়ার অভিযোগ
করা হয়। পাশাপাশি উজবেকিস্তান থেকে তুলা আমদানি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। ইউএসটিআর থেকে অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বিজিএমইএর তৈরি করা জবাবে বলা হয়, ২০১২ সালে ২ হাজার ৫৬৭ পোশাক শিল্প-কারখানা পরিদর্শন করে দেখা গেছে এক শ’ ভাগ ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা হচ্ছে। এতে কোন সন্দেহ নেই। ন্যূনতম মজুরি প্রদানের ব্যাপারে সরকার ও বিজিএমইএ মনিটরিং করছে। ইউএসটিআর থেকে বলা হয়েছে কারখানাগুলোতে পুরোপুরি পিটিশন কমিটি গঠন হয়নি। শ্রমিকদের সিলেকশন নয় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে পিটিশিন কমিটিতে আনতে হবে। ইউএসটিআরের এই অভিযোগের উত্তরে বলা হয় ইতোমধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৪০৬টি কারখানায় ইতোমধ্যে পিটিশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক কারখানার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধির অংশগ্রহণে এই পিটিশন কমিটি গঠন করা হয়। জবাবে আরও বলা হয়, পিটিশন কমিটিতে ২০ জন শ্রমিক প্রতিনিধি দরকার। এক্ষেত্রে শ্রমিক প্রতিনিধি ১৯ জন আসলে সেখানে ভোটের প্রয়োজন হয় না। সিলেকশনের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু ২০ শ্রমিক প্রতিনিধির স্থানে ২৫ জন আসলে নির্বাচনের প্রয়োজন হবে। ইউএসটিআরের প্রশ্নের জবাবে আরও বলা হয় বাকি কারখানাগুলোতে শীঘ্রই পিটিশন কমিটি গঠন করা হবে।
ইউএসটিআর থেকে বলা, প্রায় সময় পোশাক শিল্প মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে স্থানান্তর করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারও জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অবশ্য বিজিএমইএ এর বিরোধিতা করেছে। বিজিএমইএ জবাবে বলেছে সব পোশাক শিল্প মুনাফা করে না। অনেকে লোকসান করছে। লোকসানী প্রতিষ্ঠান ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে টাকা স্থানান্তর করতে গেলে শ্রমিক অসন্তোষ আরও বাড়বে। প্রতিষ্ঠানের লোকসান হলে কল্যাণ তহবিলে টাকা স্থানান্তর করতে হবে কি হবে না এটিও ইউএসটিআর পরিষ্কার করেনি। ইউএসটিআর অভিযোগে বলে রেইন নিট ওয়্যার লিমিটেডে শ্রমিক ইউনিয়ন, মার্সকট এ্যাপারেলস লিমিটেডে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, রাসতাস এ্যাপারেল লিমিটেডে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, টোকিও মুড লিমিটেডে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন গঠন করতে চাইলেও নিবন্ধন দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে বিজিএমইএ বলেছে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন দেয়ার ক্ষমতা বিজিএমইএর নেই। কেন নিবন্ধন পায়নি এটি সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন বলতে পারবে। এ ছাড়া শ্রম সংশ্লিষ্ট বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নেয়ার ক্ষেত্রে আবেদনে অনেক সময় ত্রুটি থাকে। যেসব তথ্য চাওয়া হয় তা দেয়া হয় না। যে কারণে অনেকের নিবন্ধন পেতে সমস্যা হয়। সরকার উজবেকিস্তান থেকে তুলা আমদানির জন্য একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। অবশ্য ইএসটিআর থেকে বলা হয় উজবেকিস্তানে তুলা উৎপাদনে শিশুশ্রম ব্যবহার করা হয়। তাই বাংলাদেশকে উজবেকিস্তান থেকে তুলা আমদানি করতে চিন্তা করতে হবে। বিজিএমইএ বলেছে তুলা আমদানি পোশাক শিল্পে হচ্ছে না। এটি টেক্সটাইল মিলে হচ্ছে। তার পরও সরকার উজবেকিস্তান থেকে তুলা আমদানি করছে। এর জবাব সরকার দিতে পারবে। এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পোশাক শিল্পের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ আসছে এর জবাব তৈরি করা হয়েছে। বিজিএমইএ যথাসময়ে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। তিনি বলেন, পোশাক রফতানি বাণিজ্যে ভাবমূর্তি বড় বিষয়। পোশাক শিল্প জিএসপি সুবিধা না পেলেও যেটিতে দেয়া হচ্ছে তা বহাল রাখতে হবে।
No comments