ডেসটিনির সব সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখবে দুদক- ১০৯ গাড়ি, ছয় শ’ কোটি টাকার জমি, ৪৫ লাখ গাছ ও ২২ ফ্ল্যাট রক্ষণাবেক্ষণে রিসিভার নিয়োগ হবে by মহিউদ্দিন আহমেদ

ডেসটিনি গ্রুপের ১০৯টি গাড়ি, ২১ জেলার প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার জমি, ৪২ বাগানের ৪৫ লাখ গাছ, তিন শীর্ষ কর্মকর্তার রাজধানীর ২২টি ফø্যাটসহ সকল সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থায়ী রিসিভার নিয়োগের অনুমতি চেয়ে আগামী সপ্তাহে আদালতে আবেদন করবেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে ৫টি দেশে পাচার করা বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ফেরত আনতে খোলা হচ্ছে স্টোলেন এ্যাসেট রিকভারি এ্যাকাউন্ট। দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সূত্রে এসব খবর জানা গেছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ‘প্রতারণা’ করে প্রায় ৩ হাজার তিনশ’ কোটি টাকা আত্মসাত করে নেয়ার অভিযোগে গত বছরের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ২২ জনকে আসামি করে মানিলন্ডারিং আইনে দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুটি মামলা তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তদন্তের সুবিধার্থে ডেসটিনি গ্রুপের কর্ণধার মোঃ রফিকুল আমীন, সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ, মোহাম্মদ হোসাইন, দিদারুল আলমকে গ্রেফতার করে দুদক। এর মধ্যে হারুন-অর-রশিদ শর্তসাপক্ষে জামিনে আছেন। গ্রেফতারকৃত বাকি তিনজন আছেন জেলহাজতে। মামলার অপর আসামিরা পালাতক রয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্তে দুদক তদন্ত কর্মকর্তারা ডেসটিনি গ্রুপের ১০৯টি গাড়ি পেয়েছেন। এর মধ্যে রফিকুল আমীনের ব্যক্তিগত ২টি, তাঁর স্ত্রী ফারাহ্্ দিবার ৩টি, মোহাম্মদ হোসাইনের ৩টি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। এছাড়া বাকি গাড়িগুলো কোম্পানির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার হতো। দুদক কর্মকর্তারা ডেসটিনি গ্রুপের গাড়ির সংখ্যা জানতে চেয়ে বিআরটিএর কাছে লেখা একটি পত্রের ভিত্তিতে বিআরটিএ থেকে এসব গািড়র তালিকা প্রেরণ করা হয়। এছাড়া দুদক এ পর্যন্ত দেশের ২১টি জেলায় ডেসটিনি গ্রুপের নামে ক্রয় করা ৫শ’ ৯২ কোটি ২০ লাখ টাকার জমি পেয়েছে। যেসব জেলায় জমি পাওয়া গেছে সেসব জেলা হচ্ছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বি বাড়িয়া, ফেনী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, পটুয়াখালী, মেহেরপুর, রাজবাড়ী, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ এবং সাভার। ব্যক্তিগতভাবে রফিকুল আমীন, তাঁর স্ত্রী ফারাহ্্ দিবা এবং মোহাম্মদ হোসাইনের ব্যক্তিগত নামে রাজধানীতে ২২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। যে ট্রি প্লান্টেশন প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ডেসটিনি গ্রুপ, সেই প্রকল্পে বড় জালিয়াতি ধরা পড়ে। ছয় কোটি ১৮ লাখ গাছের কথা বলে টাকা নেয়। গাছ লাগানোর দাবি করে ৮১ লাখ। প্রকৃত পক্ষে গাছ পাওয়া গেছে ৪৫ লাখ। চট্টগ্রামের চারটি জেলায় ৪২টি বাগানে এসব গাছ পাওয়া গেছে। বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছে। সিঙ্গাপুরে ডেসটিনির দুটি এ্যাকাউন্টে অর্থ পাচারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই দুটি এ্যাকাউন্টের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনের। অন্যটি প্রতিষ্ঠানের নামে। ওই দুই এ্যাকাউন্টে প্রায় ৭৭ হাজার ছয়শ’ সিঙ্গাপুর ডলার পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে রফিকুল আমীনের এ্যাকাউন্টে ৬৪ হাজার ৫৮১ সিঙ্গাপুর ডলার এবং প্রতিষ্ঠানের এ্যাকাউন্টে ১৩ হাজার ২৭ দশমিক ৭৮ সিঙ্গাপুর ডলার পাচার করা হয়েছে। হংকংয়ের একটি ব্যাংকে সফটেড অনলাইন (এইচকে) লিমিটেডে (ইন কর্পোরেশন নং-৮৯৭০১৯ বিআরসি) নামে ৫০ কোটি টাকার মালপত্র আমদানি দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
ফ্রান্সে বেস্ট এভিয়েশন লিমিটেডের নামে একটি ব্যাংকে ৮৪ হাজার ছয় শ’ ইউরো অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। এছাড়া কানাডার নভস্কশিয়ার ব্যাংকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জেপি মর্গান চেজ ব্যাংকে (এ্যাকাউন্ট নং-৩০৩০৬১০০৪৬) ডেসটিনির এমডির নিজ নামে পৃথক দুটি এ্যাকাউন্টে কিছু অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব অর্থ ফেরত আনার জন্য এ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে দ্রুত মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলআর) পাঠানোর তদন্ত কর্মকর্তারা কমিশনকে অবহিত করেছেন। শীঘ্রই সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রীয় শীর্ষ আইনকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে বলে জানায় দুদক। একই সঙ্গে অর্থ ফেরত আনতে দুদক একটি আলাদা ব্যাংক হিসাব খুলবে বলে জানা গেছে।
দুদকের দীর্ঘ তদন্তে এসব তথ্য বের হয়ে আসার পর, সাময়িকভাবে ডেসটিনির গাড়ি দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয় বিআরটিএকে। কিন্তু এত গাড়ি রাখার জায়গা না থাকায় তারা গাড়ি জব্দ করতে পারেনি। তারা শুধু গাড়ির সংখ্যা এবং রেজিস্ট্রেশন নং এবং কারা ব্যবহার করে তাদের চিহ্নিত করে দুদকের কাছে একটি তালিকা দিয়ে রেখেছে। ২১ জেলার জমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুদক চিঠি পাঠিয়েছে জেলার শীর্ষ আইন কর্মকর্তাকে। আর ঢাকার জমি ও ফø্যাট নিয়ন্ত্রণে আছে মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে। এমন অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বে ডেসটিনির সম্পদ যথাযথ তদারকি হচ্ছে না বলে দুদকে অভিযোগ আসে। তাই এসব সম্পদ-সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থায়ীভাবে রিসিভার নিয়োগ করার জন্য দুদক আগামী সপ্তাহে আদালতের কাছে আবেদন করবে। মানিলন্ডারিং আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী এ আবেদন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.