প্রণমহি বঙ্গমাতা- কে দিল পিরিতের বেড়া by সাইমন জাকারিয়া
আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে ২০০১ সালের শেষের দিকে নেত্রকোনা জেলায় গিয়ে ঘাটুগানের অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম। সেখানকার কেন্দুয়া উপজেলার সিংহের গাঁও থেকে শুরু করে রামপুরা, কুনুহাঁটি আরও অনেক গ্রাম ঘুরেও তখন কোনো ঘাটুগানের সংগঠিত দলের সন্ধান পাইনি,
যা পেয়েছিলাম তা হলো রামপুরা বাজারে বসে আবদুল বাশার তালুকদারের মুখ থেকে সুরসহ একটি সংলাপাত্মক ঘাটুগানের বাণী—
: কে দিল পিরিতের বেড়া/ লেচুরও বাগানে?
: লেচুরও বাগানে নয় গো/ কমলার বাগানে।
: কমলার বাগানে নয় গো/ লেচুরও বাগানে।
: ছোডু ছোডু লেচুগুলি/ বন্ধু তুলে আমিও তুলি।
: বন্ধু দেয় গো আমার মুখে/ আমি দেই বন্ধুর মুখে।
এই গানের সুর ও বাণী শুনে সেদিন খুব মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আর তার পর থেকে ভাবছিলাম এত মধুর সুর ও নাটকীয় বাণী প্রধান গানের সত্যিকার পরিবেশনারীতি কবে দেখব। ওই এলাকার বহু সাধকশিল্পী, গুণীজন, গ্রামের বিচিত্র পেশার মানুষের সঙ্গে এই অবসরে সখ্যও তৈরি হয়। বারবার সেখানে গিয়ে কিচ্ছাগান ও জারিগানের পাশাপাশি গাজির গীত, ভাবগান ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু ঘাটুগানের আসর দেখার সৌভাগ্য হয় না। শেষ পর্যন্ত সে সুযোগ আসে ২০০৯ সালের ২৫ মে। সেদিন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পাঁচহার গ্রামে বিষাদ-জারি পরিবেশন শেষে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের কথা বিবেচনা করে জারিগানের প্রখ্যাত সাধক-শিল্পী আবদুল হালিম বয়াতি ঘাটুগান পরিবেশনের জন্য জসিম ওঝা ও আনোয়ারা বেগমকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। জানতে পারলাম, জসিম ওঝা ও আনোয়ারা বেগম সাংসারিক জীবনে যুগলবন্দী তথা স্বামী-স্ত্রী, তাঁরা মূলত গান গেয়ে ও ঝাড়-ফুঁক করে সাপে কাটা ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা করেন, পাশাপাশি আনোয়ারা বেগম কিচ্ছা ও ঘাটুগান পরিবেশন করেন, ঘাটুগান পরিবেশনের ক্ষেত্রে সেদিন আসরে তাঁরা ৯-১০ বছর বয়সী নাতি আশিককে সঙ্গে এনেছিলেন। নাতি আশিকের সঙ্গে নেচে নেচে আনোয়ারা আমাদের ঘাটুগান পরিবেশন করে দেখালেন। ঘাটুগানের আসরের প্রচলিত যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে নারীদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায় না, কিন্তু আনোয়ারা বেগমের পরিবেশিত ঘাটুগান সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা যায়, তাই আমার মন ভরে না। অনুসন্ধান থেমে থাকে না, ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক জাহিদুল করিমকে বারবার তাগাদা দিয়ে বলি—ত্রিশাল অঞ্চলটি ঘাটুগানের প্রসিদ্ধ এলাকা, ওই এলাকায় ঘাটুগানের অস্তিত্ব থাকতে পারে। ঠিকই সে জানাতে সক্ষম হয়, ওই অঞ্চলে কিছু প্রবীণ ব্যক্তি আছেন—যাঁরা ঘাটুগান জানেন, কিন্তু ঘাটুগানের প্রচলন এখন আর নেই। ঘাটুগানের অন্যান্য সমৃদ্ধ অঞ্চল টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-ঘাটাইল এবং সিলেট-হবিগঞ্জ থেকেও একই ধরনের তথ্য পাই। তাহলে কি প্রবীণদের স্মৃতিসত্তায় জীবন্ত ঘাটুগান সাম্প্রতিক সময়ের জনসমাজে চর্চিত হচ্ছে না? এই জিজ্ঞাস্য আমাদের তাড়া করে ফেরে।
শেষ পর্যন্ত কেন্দুয়ার সেনবাড়ির উঠানে ঝঙ্কার শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে কান্দিউড়া গ্রামের আবদুর রশীদ খান সুকন ও রিপনের পরিবেশনায় ঘাটুগানের একটি পূর্ণাঙ্গ আসর দেখার সুযোগ আসে। সে এক ভিন্ন বাস্তবতা, সময় টিভির জন্য ‘অন্তরে অচিন পাখি’ নামে পাক্ষিকে প্রচারিত ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্রের গবেষণা ও সঞ্চালনার কাজে যুক্ত হয়ে যখন ওই অঞ্চলের ভাবসাধক জালাল খাঁ ও উকিল মুন্সীর ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে যাই, তখন জানতে পারি উকিল মুন্সী প্রথম জীবনে ঘাটুগানের দলে সংগীত পরিবেশন করতেন। অতএব প্রয়োজন পড়ে একটি ঘাটুগানের আসরের, আমাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন ঝঙ্কার শিল্পীগোষ্ঠীর সুশেনদা ও দিলবাহার খান। মূলত তাঁদের তৎপরতায় কেন্দুয়া সেনবাড়িতে ঘাটুগানের আসর বসে। আসরে সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন ঘাটুগানের বর্তমান সময়ের চর্চাকারী উদ্যোক্তা ফজলুর রহমান ও প্রদীপ পণ্ডিত। কিন্তু আসরের তাতে খুব বেশি ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি বলে দর্শকদের অভিমত।
ঘাটুগানের শুরুতে বাঁশের বাঁশি হাতে সুসজ্জিত পোশাকে একজন শৌখিনদার আসরে প্রবেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রী ও দোহার দল থেকে গীত শুরু হয়—
কি দিয়া বাঁচাইব আমি/ ঘর গোষ্ঠী সকল রে/ নাইল্যা বেইচ্যা ধইল্যা রে করব/ হরু বেইচ্যা খাই/ তিল বেচিয়া ধুতি চাদর/ ঘাটুর লাইগ্যা যাই রে/ নাইল্যা জলে করল তল,
এই গানের সঙ্গে শৌখিনদার বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি করেন, যা মূলত নৃত্য। এই গানের পর পরই পুরুষ শিল্পী সুকন কলসি কাঁখে নারীর বেশে আসরে প্রবেশ করেন এবং আসরের এক পাশে কাঁখের কলসি রেখে নদীতে গোসল করার ভঙ্গি করেন। সে সময় শৌখিনদার ঘাটুর গোসল দেখতে চাইলে ঘাটু গেয়ে ওঠেন—
ভাইসাব রে/ তুই জলে ভাসা সাবান কিইন্যা দিলে না/ সাবান কিইন্যা দিলে নারে
উত্তরে শৌখিনদার গানের শুরুটা করেন—
সাবান আছে ঘরে ঘরে/ বিকায় সাবান বিষ্যুদবারে
ঘাটু বলেন—
কারবলি সাবানে ভাইসাব/ শইলের ময়লা উঠে না/ যদি করো আমার আশা/ সাবান আইনো জলে ভাসা/ নইলে রবে ভাসা ভাসা
আশা পূরণ হবে না।
এ পর্যায়ে শৌখিনদার বিষয় পরিবর্তন করে ভিন্ন সুরে গেয়ে ওঠেন—
পালঙ্ক সাজাও প্রাণসজনী/ আসব তোমার মন্দিরে গো/ গুয়া ফাড কুডি কুডি/ লঙ দিয়া বানাইব বিড়ি/ পান খাইব ঢালবো পিচকি/ তোমার ভরা যৈবনে গো।
শৌখিনদারের এই গান শেষ হতেই ভিন্ন গানে ঘাটু বলেন আরেক কথা—
বন্ধু এমন হইলে আমার বাড়িত/ আর আইও না/ আর আইও না রে বন্ধু/ আর আইও না/ আইস বন্ধু বইস কাছে/ হাত দিও না ডালুম গাছে/ পাকলে ডালুম তোমায় দিব/ আর কেউ রে দিব না রে বন্ধু।
আসরের শেষে হয়তো দর্শক-শ্রোতারা রাধা-কৃষ্ণের মিলনের মতো শৌখিনদার ও ঘাটুর জন্য মিলন প্রার্থী হয়ে ওঠেন। তাই বুঝি দোহার-বাদ্যযন্ত্রীরা গেয়ে ওঠেন এই গান—
আমার রাই মিলিলো গো শ্যাম সনে/ এগো শ্যামের হাতের মোহন বাঁশি/ রাধাই নিয়া যায় গো/ বৃন্দাবনে প্রেমে ভেসে যায়/ এগো শ্যামের মাথার মোহন চূড়া/ রাধাই নিয়া যায় গো।
এই গানের শেষে এসে শৌখিনদার ও ঘাটু রাধা-কৃষ্ণের মতো যুগলবন্দী হয়ে আসরে দাঁড়ান। আর এভাবেই শেষ হয় ঘাটুগানের সেদিনের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে ঘাটুগানের শিল্পী আবদুর রশীদ খান সুকন বলেন, ‘আমি তো একজন পুরুষ, আমার সংসার আছে, সন্তান আছে। ঘাটুগানের আসরে আমি নারী সেজে ঘাটুর পাট করি। এলাকার মানুষ এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না, তাই নিজের এলাকায় আমি ঘাটুগান করি না, করলে অনেকেই টিটকারি দেয়। কিন্তু এই ঘাটুগানকে আমি ভালোবাসি। এলাকার মানুষের মধ্যে যদি এই গান নিয়ে ভালো কোনো ধারণা না আসে, তো আমার মনে হয় এই গান আমার পর আর কেউ করবে কি না, সন্দেহ আছে। এখানে আমরা এই গান করতে পারছি শুধু ঝঙ্কারের প্রদীপ পণ্ডিত, ফজলুর রহমান, সুশেনদা, দিলবাহার ভাইদের উৎসাহে।’
প্রায় এক যুগের এই ঘাটুগান অনুসন্ধানের পথ বিশ্লেষণ করে বলতে পারি যে ঘাটুগানের কোনো সংগঠিত দলের অস্তিত্ব গ্রামীণ সমাজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু একই এলাকার অন্যান্য পরিবেশনা তথা গাজির গীত, জারিগান, কিচ্ছাগানের অনেক সংগঠিত দলের অস্তিত্ব রয়েছে। তাহলে ঘাটুগানের সংগঠিত দলের অস্তিত্ব না-থাকার কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের জন্য সমাজ মানুষের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন, প্রচলিত ধর্মাচার, শিক্ষার প্রসার, ভূপ্রকৃতি ও মূল্যবোধকে বিচার করা যেতে পারে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে জানতে পারি, ঘাটুগানের উৎপত্তির সঙ্গে সমাজ, মানুষের অর্থনীতি ও ভূপ্রকৃতির একটি যোগ ছিল। কেননা, একটি বিবরণে জানা গেছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে একসময় নদীপথে নৌকায় করে মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে আসামে যেত এবং যাওয়ার পথে বিভিন্ন ঘাটে নৌকা বেঁধে যে নাচ-গান করত, তা-ই ঘাটুগান নামে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। আবার অন্য বিবরণে জানা গেছে, শহরের বিত্তশালী ও রাজপরিবারের লোকজন বাড়িতে নারী রক্ষিতা রেখে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, কিন্তু গ্রামীণ জীবনে বিত্তশালী ও ভূস্বামীদের পক্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে যখন নারী রক্ষিতা রাখা সম্ভব হয়নি—তখন তাঁরা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কম বয়সী পুরুষদের নারীর বেশে সাজিয়ে যে নাচ-গানের আয়োজন করতেন, তা ঘাটুগান হিসেবে রূপ লাভ করে। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূপ্রাকৃতিক ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিকেও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই পরিবর্তনের নিষ্ঠুরতার ভেতর ঘাটুগানের ঐতিহ্য হয়তো-বা গুমরে গুমরে কেঁদে ফিরছে, জানি না ঘাটুগানের বেঁচে থাকার নীরব কান্নায় হাসি ফুটবে কি না!
: কে দিল পিরিতের বেড়া/ লেচুরও বাগানে?
: লেচুরও বাগানে নয় গো/ কমলার বাগানে।
: কমলার বাগানে নয় গো/ লেচুরও বাগানে।
: ছোডু ছোডু লেচুগুলি/ বন্ধু তুলে আমিও তুলি।
: বন্ধু দেয় গো আমার মুখে/ আমি দেই বন্ধুর মুখে।
এই গানের সুর ও বাণী শুনে সেদিন খুব মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আর তার পর থেকে ভাবছিলাম এত মধুর সুর ও নাটকীয় বাণী প্রধান গানের সত্যিকার পরিবেশনারীতি কবে দেখব। ওই এলাকার বহু সাধকশিল্পী, গুণীজন, গ্রামের বিচিত্র পেশার মানুষের সঙ্গে এই অবসরে সখ্যও তৈরি হয়। বারবার সেখানে গিয়ে কিচ্ছাগান ও জারিগানের পাশাপাশি গাজির গীত, ভাবগান ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু ঘাটুগানের আসর দেখার সৌভাগ্য হয় না। শেষ পর্যন্ত সে সুযোগ আসে ২০০৯ সালের ২৫ মে। সেদিন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পাঁচহার গ্রামে বিষাদ-জারি পরিবেশন শেষে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের কথা বিবেচনা করে জারিগানের প্রখ্যাত সাধক-শিল্পী আবদুল হালিম বয়াতি ঘাটুগান পরিবেশনের জন্য জসিম ওঝা ও আনোয়ারা বেগমকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। জানতে পারলাম, জসিম ওঝা ও আনোয়ারা বেগম সাংসারিক জীবনে যুগলবন্দী তথা স্বামী-স্ত্রী, তাঁরা মূলত গান গেয়ে ও ঝাড়-ফুঁক করে সাপে কাটা ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা করেন, পাশাপাশি আনোয়ারা বেগম কিচ্ছা ও ঘাটুগান পরিবেশন করেন, ঘাটুগান পরিবেশনের ক্ষেত্রে সেদিন আসরে তাঁরা ৯-১০ বছর বয়সী নাতি আশিককে সঙ্গে এনেছিলেন। নাতি আশিকের সঙ্গে নেচে নেচে আনোয়ারা আমাদের ঘাটুগান পরিবেশন করে দেখালেন। ঘাটুগানের আসরের প্রচলিত যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে নারীদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায় না, কিন্তু আনোয়ারা বেগমের পরিবেশিত ঘাটুগান সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা যায়, তাই আমার মন ভরে না। অনুসন্ধান থেমে থাকে না, ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক জাহিদুল করিমকে বারবার তাগাদা দিয়ে বলি—ত্রিশাল অঞ্চলটি ঘাটুগানের প্রসিদ্ধ এলাকা, ওই এলাকায় ঘাটুগানের অস্তিত্ব থাকতে পারে। ঠিকই সে জানাতে সক্ষম হয়, ওই অঞ্চলে কিছু প্রবীণ ব্যক্তি আছেন—যাঁরা ঘাটুগান জানেন, কিন্তু ঘাটুগানের প্রচলন এখন আর নেই। ঘাটুগানের অন্যান্য সমৃদ্ধ অঞ্চল টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-ঘাটাইল এবং সিলেট-হবিগঞ্জ থেকেও একই ধরনের তথ্য পাই। তাহলে কি প্রবীণদের স্মৃতিসত্তায় জীবন্ত ঘাটুগান সাম্প্রতিক সময়ের জনসমাজে চর্চিত হচ্ছে না? এই জিজ্ঞাস্য আমাদের তাড়া করে ফেরে।
শেষ পর্যন্ত কেন্দুয়ার সেনবাড়ির উঠানে ঝঙ্কার শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে কান্দিউড়া গ্রামের আবদুর রশীদ খান সুকন ও রিপনের পরিবেশনায় ঘাটুগানের একটি পূর্ণাঙ্গ আসর দেখার সুযোগ আসে। সে এক ভিন্ন বাস্তবতা, সময় টিভির জন্য ‘অন্তরে অচিন পাখি’ নামে পাক্ষিকে প্রচারিত ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্রের গবেষণা ও সঞ্চালনার কাজে যুক্ত হয়ে যখন ওই অঞ্চলের ভাবসাধক জালাল খাঁ ও উকিল মুন্সীর ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে যাই, তখন জানতে পারি উকিল মুন্সী প্রথম জীবনে ঘাটুগানের দলে সংগীত পরিবেশন করতেন। অতএব প্রয়োজন পড়ে একটি ঘাটুগানের আসরের, আমাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন ঝঙ্কার শিল্পীগোষ্ঠীর সুশেনদা ও দিলবাহার খান। মূলত তাঁদের তৎপরতায় কেন্দুয়া সেনবাড়িতে ঘাটুগানের আসর বসে। আসরে সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন ঘাটুগানের বর্তমান সময়ের চর্চাকারী উদ্যোক্তা ফজলুর রহমান ও প্রদীপ পণ্ডিত। কিন্তু আসরের তাতে খুব বেশি ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি বলে দর্শকদের অভিমত।
ঘাটুগানের শুরুতে বাঁশের বাঁশি হাতে সুসজ্জিত পোশাকে একজন শৌখিনদার আসরে প্রবেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রী ও দোহার দল থেকে গীত শুরু হয়—
কি দিয়া বাঁচাইব আমি/ ঘর গোষ্ঠী সকল রে/ নাইল্যা বেইচ্যা ধইল্যা রে করব/ হরু বেইচ্যা খাই/ তিল বেচিয়া ধুতি চাদর/ ঘাটুর লাইগ্যা যাই রে/ নাইল্যা জলে করল তল,
এই গানের সঙ্গে শৌখিনদার বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি করেন, যা মূলত নৃত্য। এই গানের পর পরই পুরুষ শিল্পী সুকন কলসি কাঁখে নারীর বেশে আসরে প্রবেশ করেন এবং আসরের এক পাশে কাঁখের কলসি রেখে নদীতে গোসল করার ভঙ্গি করেন। সে সময় শৌখিনদার ঘাটুর গোসল দেখতে চাইলে ঘাটু গেয়ে ওঠেন—
ভাইসাব রে/ তুই জলে ভাসা সাবান কিইন্যা দিলে না/ সাবান কিইন্যা দিলে নারে
উত্তরে শৌখিনদার গানের শুরুটা করেন—
সাবান আছে ঘরে ঘরে/ বিকায় সাবান বিষ্যুদবারে
ঘাটু বলেন—
কারবলি সাবানে ভাইসাব/ শইলের ময়লা উঠে না/ যদি করো আমার আশা/ সাবান আইনো জলে ভাসা/ নইলে রবে ভাসা ভাসা
আশা পূরণ হবে না।
এ পর্যায়ে শৌখিনদার বিষয় পরিবর্তন করে ভিন্ন সুরে গেয়ে ওঠেন—
পালঙ্ক সাজাও প্রাণসজনী/ আসব তোমার মন্দিরে গো/ গুয়া ফাড কুডি কুডি/ লঙ দিয়া বানাইব বিড়ি/ পান খাইব ঢালবো পিচকি/ তোমার ভরা যৈবনে গো।
শৌখিনদারের এই গান শেষ হতেই ভিন্ন গানে ঘাটু বলেন আরেক কথা—
বন্ধু এমন হইলে আমার বাড়িত/ আর আইও না/ আর আইও না রে বন্ধু/ আর আইও না/ আইস বন্ধু বইস কাছে/ হাত দিও না ডালুম গাছে/ পাকলে ডালুম তোমায় দিব/ আর কেউ রে দিব না রে বন্ধু।
আসরের শেষে হয়তো দর্শক-শ্রোতারা রাধা-কৃষ্ণের মিলনের মতো শৌখিনদার ও ঘাটুর জন্য মিলন প্রার্থী হয়ে ওঠেন। তাই বুঝি দোহার-বাদ্যযন্ত্রীরা গেয়ে ওঠেন এই গান—
আমার রাই মিলিলো গো শ্যাম সনে/ এগো শ্যামের হাতের মোহন বাঁশি/ রাধাই নিয়া যায় গো/ বৃন্দাবনে প্রেমে ভেসে যায়/ এগো শ্যামের মাথার মোহন চূড়া/ রাধাই নিয়া যায় গো।
এই গানের শেষে এসে শৌখিনদার ও ঘাটু রাধা-কৃষ্ণের মতো যুগলবন্দী হয়ে আসরে দাঁড়ান। আর এভাবেই শেষ হয় ঘাটুগানের সেদিনের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে ঘাটুগানের শিল্পী আবদুর রশীদ খান সুকন বলেন, ‘আমি তো একজন পুরুষ, আমার সংসার আছে, সন্তান আছে। ঘাটুগানের আসরে আমি নারী সেজে ঘাটুর পাট করি। এলাকার মানুষ এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না, তাই নিজের এলাকায় আমি ঘাটুগান করি না, করলে অনেকেই টিটকারি দেয়। কিন্তু এই ঘাটুগানকে আমি ভালোবাসি। এলাকার মানুষের মধ্যে যদি এই গান নিয়ে ভালো কোনো ধারণা না আসে, তো আমার মনে হয় এই গান আমার পর আর কেউ করবে কি না, সন্দেহ আছে। এখানে আমরা এই গান করতে পারছি শুধু ঝঙ্কারের প্রদীপ পণ্ডিত, ফজলুর রহমান, সুশেনদা, দিলবাহার ভাইদের উৎসাহে।’
প্রায় এক যুগের এই ঘাটুগান অনুসন্ধানের পথ বিশ্লেষণ করে বলতে পারি যে ঘাটুগানের কোনো সংগঠিত দলের অস্তিত্ব গ্রামীণ সমাজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু একই এলাকার অন্যান্য পরিবেশনা তথা গাজির গীত, জারিগান, কিচ্ছাগানের অনেক সংগঠিত দলের অস্তিত্ব রয়েছে। তাহলে ঘাটুগানের সংগঠিত দলের অস্তিত্ব না-থাকার কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের জন্য সমাজ মানুষের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন, প্রচলিত ধর্মাচার, শিক্ষার প্রসার, ভূপ্রকৃতি ও মূল্যবোধকে বিচার করা যেতে পারে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে জানতে পারি, ঘাটুগানের উৎপত্তির সঙ্গে সমাজ, মানুষের অর্থনীতি ও ভূপ্রকৃতির একটি যোগ ছিল। কেননা, একটি বিবরণে জানা গেছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে একসময় নদীপথে নৌকায় করে মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে আসামে যেত এবং যাওয়ার পথে বিভিন্ন ঘাটে নৌকা বেঁধে যে নাচ-গান করত, তা-ই ঘাটুগান নামে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। আবার অন্য বিবরণে জানা গেছে, শহরের বিত্তশালী ও রাজপরিবারের লোকজন বাড়িতে নারী রক্ষিতা রেখে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, কিন্তু গ্রামীণ জীবনে বিত্তশালী ও ভূস্বামীদের পক্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে যখন নারী রক্ষিতা রাখা সম্ভব হয়নি—তখন তাঁরা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কম বয়সী পুরুষদের নারীর বেশে সাজিয়ে যে নাচ-গানের আয়োজন করতেন, তা ঘাটুগান হিসেবে রূপ লাভ করে। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূপ্রাকৃতিক ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিকেও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই পরিবর্তনের নিষ্ঠুরতার ভেতর ঘাটুগানের ঐতিহ্য হয়তো-বা গুমরে গুমরে কেঁদে ফিরছে, জানি না ঘাটুগানের বেঁচে থাকার নীরব কান্নায় হাসি ফুটবে কি না!
No comments