৯০% আক্রান্ত ডায়রিয়া ম্যালেরিয়ায় ক্যান্সারে ২৫% শ্বাসকষ্টে ৬০%- দূষণের ফল by নিখিল মানখিন
পরিবেশ দূষণজনিত রোগে প্রতিদিন আক্রানত্ম হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান প্রতিনিয়ত নানাভাবে দূষণের শিকার হচ্ছে। পরিবেশের উপাদান পানিদূষণে পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও জন্ডিসে আক্রানত্মের সংখ্যা বাড়ছে।
বায়ুদূষণে শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে আক্রানত্ম হচ্ছে মানুষ। শব্দদূষণে শ্রবণ প্রতিবন্ধীসহ বস্নাড প্রেসার ও মানসিক রোগে আক্রানত্ম হতে হয়। আর বর্জ্য দূষণে বিভিন্ন ক্যান্সারে আক্রানত্ম এবং বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্মের ঘটনা ঘটছে। আর আর্সেনিকের কারণে চর্মরোগে আক্রানত্মের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ মতা কমে যাচ্ছে। আর্সেনিক রোগী অন্যান্য জটিল রোগে খুব সহজেই আক্রানত্ম হয়। ডায়রিয়া ও ম্যালেরিয়া রোগের পেছনে পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে শতকরা ৯০ ভাগ। ক্যান্সারে শতকরা ২৫ ভাগ, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ৬০ ভাগ ও মানসিক রোগে শতকরা ১০ ভাগ ভূমিকা রাখে। পরিবেশ দূষণে সৃষ্ট নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রানত্ম হয়ে বেড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয়। যা মানুষের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।পরিবেশ ও রোগ বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। নানা রোগ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে পরিবেশ দূষণ। স্থানভেদে পরিবেশ দূষণের চিত্র বিভিন্ন রকম। পরিবেশ দূষণের ধরন অনুযায়ী সংশিস্নষ্ট এলাকা বা স্থানে বিসত্মার লাভ করা রোগের রূপও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। রাজধানীর তেজগাঁও রেলগেট থেকে এফডিসি রেলগেট পর্যনত্ম দু'পাশে কয়েক হাজার বসত্মিবাসীর বসবাস। পলিথিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে তৈরি তাদের কুঁড়েঘর। পায়খানা ও প্রস্রাবের নির্ধারিত কোন স্থান নেই। এমন পরিবেশে গত দেড় বছর ধরে এখানে বাস করছে আসছে বেলাল হোসেনের পরিবার। তার দু'টি শিশুসনত্মানের মধ্যে চার বছরের ইলিয়াস মিয়া ভুগছে শ্বাসকষ্টে। বেলায়েত হোসেন জানান, নওগাঁর পাহাড়পুরের বাসিন্দা তাঁরা। বসত্মিতে ওঠার আগে ইলিয়াসের শ্বাসকষ্ট ছিল না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণেই শিশুটির এমন অবস্থা হতে পারে। সকল বসত্মিবাসীকেই কম বেশি চুলকানিসহ নানা চর্মরোগে ভুগতে হয়। শ্বাসকষ্ট রোগের পেছনে পরিবেশ দূষণের ভূমিকার ব্যাপারে সোহরাওয়াদর্ী হাসপাতালের বব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, শিশু ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগের পেছনে পরিবেশ দূষণের ভূমিকা থাকে। তিনি বলেন, শ্বাসকষ্টজনিত রোগের মধ্যে ব্রংকিউলাইটিস ও হাঁপানিতে আক্রানত্ম হয় শিশুরা পরিবেশের দূষণের কারণে। পরিবেশ দূষণের কারণে বয়স্করা সাধারণত 'উপরের শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ' ও 'নিচের শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ'-এ আক্রানত্ম হয়। উপরের শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহের মধ্যে রয়েছে সর্দি, হাঁচি, কাশি ও গলাব্যথা ও এলার্জিক রায়নাইটিস। আর উপরের শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহের মধ্যে রয়েছে হাঁপানি, সিওএডি এবং আইএলডি (ইন্টারস্পেশাল লাংগস ডিজিজ)। তিনি বলেন, ধোঁয়া ও দূষিত বায়ু বাড়িয়ে ব্রংকিউলাইটিস হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রানত্মের মাত্রা।টেনারি, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরীর মতো আঁশযুক্ত কারখানা বাড়িয়ে দেয় ইন্টারস্পেশাল লাংগস ডিজিজে আক্রানত্মের ঝুঁকি। সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ এলার্জেন হিসেবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রানত্ম করে।
আইইডিসিআরের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক ডা. মুসত্মাক হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, পরিবেশের উপাদান পানি দূষণে পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও জন্ডিসে আক্রানত্মের সংখ্যা বাড়ছে। বায়ুদূষণে শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে আক্রানত্ম হচ্ছে মানুষ। শব্দ দূষণে শ্রবণ প্রতিবন্ধীসহ বস্নাড প্রেসার ও মানসিক রোগে আক্রানত্ম হতে হয়। আর বর্জ্য দূষণে বিভিন্ন ক্যান্সার আক্রানত্ম হয় এবং বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্মের ঘটনা ঘটছে। আর আর্সেনিকের কারণে চর্মরোগে আক্রানত্মের পাশাপাশি রোগীর রোগ প্রতিরোধ মতা কমে যায়। ফলে রোগীটি অন্যান্য রোগে খুব সহজেই আক্রানত্ম হয় বলে তিনি জানান।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, ডায়রিয়ায় আক্রানত্ম হয়ে গত তিনদিন ধরে রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআরবিতে চিকিৎসাধীন আছেন মোঃ হাবিবের সাত বছরের শিশুসনত্মান জিন্নাত আরা বেগম। মেরম্নল বাড্ডার ৫৪/ বি হোল্ডিংয়ের টিনশেডে ভাড়াটে হাবিবের পরিবার। মোঃ হাবিবের ধারণা, দূষিত পানি পান করেই তার সনত্মান ডায়রিয়ায় আক্রানত্ম হয়েছে। ডায়রিয়ায় পরিবেশ দূষণের ভূমিকার কথা স্বীকার করে আইসিডিডিআরবির বিভাগীয় প্রধান ও বৈজ্ঞানিক ড. শাহাদত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবেশের বড় একটি উপাদান হচ্ছে পানি। দূষিত পানি পান করলেও যেকোন বয়সের মানুষকে ডায়রিয়ায় আক্রানত্ম হতে বাধ্য। অধিকাংশ সময় ওয়াসার লাইন পানি জীবাণুমুক্ত থাকে না। এই পানি ফুটিয়ে খেতে হয়। ফুটিয়ে না খেলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রানত্ম হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর যেখানে সেখানে জমে আছে ময়লা-আবর্জনার সত্মূপ। টেনারি এলাকাসহ অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে নেই বর্জ্য শোধনাগার। পাবলিক টয়লেটের অভাবে রাসত্মার পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে পথচারীরা। ড্রেনগুলোর মুখে নেই ঢাকনা। রাসত্মাঘাট ও ফুটপাথে হাট গেলেই মানুষকে গ্রহণ করতে এখানে সৃষ্ট দুর্গন্ধযুক্ত কার্বন মনো অক্সাইড। লোকজন আক্রানত্ম হচ্ছে ফুসফুসের নানা জটিল ব্যাধিতে। বাসা থেকে বের হলেই মানুষকে শব্দ দূষণের শিকার হতে হয়। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকলেও চলতে থাকে যানবাহনগুলোর হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা। হাইড্রোলিক হর্নের মাত্রাতিরিক্ত শব্দে কান ফেটে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হয় মানুষকে। এই হচ্ছে শহুরে জীবনে রোগে সৃষ্টিতে পরিবেশ দূষণের ভূমিকা। শব্দদূষণ ছাড়া গ্রামাঞ্চলেও চলছে পরিবেশের অন্য সব উপাদানের দূষণ ও নানা রোগে আক্রানত্মের অভিন্ন চিত্র।
বাংলাাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. মোঃ আব্দুল মতিন বলেন, পরিবেশ দূষণের কারণে নানা জটিল রোগে আক্রানত্ম এবং মৃতু্যর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রতিদিন নানা জটিলরোগে আক্রানত্ম হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিতে পরিবেশের প্রভাবের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ডায়রিয়া ও ম্যালেরিয়া রোগের পেছনে পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে শতকরা ৯০ ভাগ। এভাবে ক্যান্সারে শতকরা ২৫ ভাগ, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ৬০ ভাগ ও মানসিক রোগে শতকরা ১০ ভাগ ভূমিকা রাখে।
No comments