বৌদ্ধ জনপদে হামলা-বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা বৌদ্ধদের by তোফায়েল আহমেদ ও নওশাদ জামিল
রামুর চৌমুহনী থেকে কিছুদূর এগোলে তিনটি প্রাচীন মন্দির- সাদাচিং, লালচিং আর অপর্ণচরণ। কারুকার্যময় এই মন্দিরগুলো পাশাপাশি বিশাল জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যুগ যুগ ধরে। কিন্তু এখন আর আগের অবস্থায় নেই। দুর্বৃত্তদের হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মন্দিরগুলো।
২৯ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কাঠের তৈরি সাদাচিং ও লালচিং। অপর্ণচরণ মন্দিরের চালের টিন পুড়ে গেছে, কিন্তু ইটের তৈরি দেয়াল টিকে আছে।
বিধ্বস্ত লাল চিংয়ের সামনেই সরু গলিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন বৃদ্ধ প্রিয়নাথ বড়ুয়া। বয়স ষাটের ঘরে। দূর থেকে তিনি দেখছিলেন লালচিং মেরামতকাজ। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে মন্দিরের মেরামত ও পুনর্নির্মাণ। প্রিয়নাথ বড়ুয়ার কাছে গিয়ে বসতেই তিনি তাকান বিহ্বল দৃষ্টিতে।
২৯ সেপ্টেম্বরের সেই হামলার কথা জানতে চাইতেই ভয়ে কুঁকড়ে ওঠেন তিনি। বিড়বিড় করে বলেন, 'মাঝে মাঝে কান্না আসে। মন্দিরের দিকে তাকালেই চোখে পানি আসে। ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিদের জন্য অনেক ভয় হয়।'
প্রিয়নাথ বড়ুয়ার মতো এ রকম ভয় সাধারণ বৌদ্ধ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যেও। রামুর বৌদ্ধবিহার ও পল্লীর মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও হামলার পর সাড়ে তিন মাস পার হলেও চিহ্নিত কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্ক কাটেনি বৌদ্ধদের। এখন তাদের মনে চেপে বসেছে সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা। অশোক বড়ুয়া (৮০) বললেন, 'এখন পর্যন্ত চিহ্নিত একজনও গ্রেপ্তার হয়নি। এ কিসের আলামত!'
রামুর চৌমুহনী থেকে সামনে রামু কাঁচাবাজার, পেছনে বৌদ্ধপল্লী। সেখানেই কথা হয় বৌদ্ধনেতা দীপক বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সেদিন ট্রাকভর্তি দুর্বৃত্তরা এসে আগে থেকেই হামলার পরিকল্পনা করেছিল। তারা মিটিং, মিছিল ও মাইকিং করে সেখানে লোক জমায়েত করেছিল। কিন্তু তার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন ছিল নীরব। এখন আবার রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ফলে আসল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দোষাদোষীই চলবে, প্রকৃতপক্ষে সুষ্ঠু বিচার আর হবে না।'
হতাশা ও উদ্বেগ : হামলার সাড়ে তিন মাস চলে গেলেও চিহ্নিত আসামি গ্রেপ্তার ও বিচার না হওয়ায় রামুর মানুষ হতাশ ও উদ্বিগ্ন। বৌদ্ধনেতারা বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো বৌদ্ধই রামু ছেড়ে কোথাও যাননি। তাঁরা নতুন করে বাঁচার ও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত চিহ্নিত আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাঁদের মনে ক্ষোভ ও হতাশা চেপে বসেছে।
রামু বাজারে কথা হয় ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী কাজল বড়ুয়ার (৪০) সঙ্গে। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক। কারা হামলা করেছিল জানতে চাইলে তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে ভীতির ছাপ। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, 'ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিল। সেখানে ঘটনার দিন রোহিঙ্গা ও জামায়াতের লোকজনও ছিল।' তিনি আরো বলেন, 'ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত সরকারের উচিত, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু সাড়ে তিন মাস চলে গেলেও প্রকৃত আসামিরা গ্রেপ্তার হয়নি। উপরন্তু বিচারের নামে চলছে নানা প্রহসন, কাদা ছোড়াছুড়ি। এটাই চলবে, শেষ পর্যন্ত বিচার আর হবে না।'
চিহ্নিত আসামিদের এখনো গ্রেপ্তার না করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় বৌদ্ধনেতা বিপ্লব বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রামুর ঘটনায় সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে অনেকেই। এ কারণে বিচারকাজেও গতি নেই।' বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, 'লোক দেখানো বিচার হলে আমরা মেনে নেব না। প্রকৃত আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।'
রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের অধ্যক্ষ সত্যপ্রিয় মহাথেরো বলেন, 'সুষ্ঠু বিচার পাব কি না জানি না। তবে আমরা এই এলাকায় স্থায়ী নিরাপত্তা চাই। প্রতিহিংসাবশত দুর্বৃত্তরা আবার হামলা চালাতে পারে। তখন আমাদের কী হবে?'
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে হামলা চালিয়ে রামুর ১২টি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার এবং ৩০টির বেশি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে আরো সাতটি মন্দির ও ১১টি বসতিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই সব ঘটনায় ১৯টি মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা মামলার আসামি ৩২৩ জন। তবে বৌদ্ধনেতাদের দাবি, প্রকৃত আসামিরা এখানো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
মন্দির পুনর্নির্মাণ চলছে দ্রুত : রামুর বৌদ্ধনেতা ও সাধারণ বৌদ্ধরা মন্দির ও বৌদ্ধপল্লী পুনর্নির্মাণ ও মেরামতকাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বিচারকাজ নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। বৌদ্ধপল্লীর অধিবাসীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি রামুর বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবিহারের (ক্যাং) পুনর্নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। দিন-রাত কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। এরই মধ্যে বিজিবির তত্ত্বাবধানে ২৪টি বৌদ্ধ বসতির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সেনাবাহিনীর কক্সবাজার ১৭ ইসিবির তত্ত্বাবধানে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, লালচিং বিহার, সাদাচিং, অপর্ণচরণ বিহার, জাদিপাড়া আর্যবংশ বৌদ্ধবিহার, অজন্তা বৌদ্ধবিহার, উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনাকেন্দ্র, উখিয়ার ঘোনা জেতবন বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার, চেরংঘাটা বড় ক্যাং, সীমাঘর, বোধিঘর, আর্যবংশ বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষের ঘর এবং উত্তর ফতেখাঁরকুল বিবেকারাম বৌদ্ধবিহারের পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারকাজ চলছে। এজন্য সরকার প্রায় ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সীমা বিহারের নির্মাণকাজ তদারক করছেন সার্জেন্ট রেজওয়ানুল হক। তিনি বলেন, 'আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করতে পারব।'
কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক ও সমন্বয়কারী তরুণ বড়ুয়া জানান, রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহারের মধ্যে কেন্দ্রীয় সীমা বিহার রয়েছে 'এ' ক্যাটাগরিতে। এটি তিনতলা এবং ওপরে কারুকাজসহ গম্বুজ করা হবে। এ ছাড়া 'বি' ক্যাটাগরিতে পাঁচটি এবং 'সি' ক্যাটাগরিতে ছয়টি বিহার পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। ছয় মাসের মধ্যে এগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। তিনি বলেন, মন্দির ও বৌদ্ধপল্লীর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে চললেও বিচারকাজে গতিহীনতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সুষ্ঠু বিচার না পেলে এসব পুনর্নির্মাণ করে লাভ নেই। কেননা এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা তো নেই।' তিনি মন্দির নির্মাণের পাশাপাশি দ্রুত দোষীদের শাস্তির দাবি জানান।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের ভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, 'সবই তো ঠিকঠাক মতো হচ্ছে। কিন্তু আসামিদের তো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। দুর্বৃত্তদের বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।'
চিহ্নিত আসামিরা ধরা পড়েনি : কক্সবাজারের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা আসামি গ্রেপ্তারে তৎপর রয়েছেন। জেলা পুলিশ সুপার মো. আজাদ মিয়া জানান, মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজন আসামি আত্মগোপনে থাকায় তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ধরার জন্য কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত হামলার মূল রহস্য ও হোতাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ফেসবুকের সেই উত্তম বড়ুয়াকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছে পুলিশ প্রশাসন।
এদিকে বৌদ্ধদের বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. বাবুল আক্তার বলেন, 'আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যেই আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারব।'
জানা গেছে, প্রেপ্তার করা আসামিদের মধ্যে ২১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। স্বীকারোক্তি থেকে পুলিশ হামলায় জড়িত ৮৬১ জনকে শনাক্ত করার পর ৪৫৩ জনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে।
বিধ্বস্ত লাল চিংয়ের সামনেই সরু গলিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন বৃদ্ধ প্রিয়নাথ বড়ুয়া। বয়স ষাটের ঘরে। দূর থেকে তিনি দেখছিলেন লালচিং মেরামতকাজ। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে মন্দিরের মেরামত ও পুনর্নির্মাণ। প্রিয়নাথ বড়ুয়ার কাছে গিয়ে বসতেই তিনি তাকান বিহ্বল দৃষ্টিতে।
২৯ সেপ্টেম্বরের সেই হামলার কথা জানতে চাইতেই ভয়ে কুঁকড়ে ওঠেন তিনি। বিড়বিড় করে বলেন, 'মাঝে মাঝে কান্না আসে। মন্দিরের দিকে তাকালেই চোখে পানি আসে। ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিদের জন্য অনেক ভয় হয়।'
প্রিয়নাথ বড়ুয়ার মতো এ রকম ভয় সাধারণ বৌদ্ধ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যেও। রামুর বৌদ্ধবিহার ও পল্লীর মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও হামলার পর সাড়ে তিন মাস পার হলেও চিহ্নিত কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্ক কাটেনি বৌদ্ধদের। এখন তাদের মনে চেপে বসেছে সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা। অশোক বড়ুয়া (৮০) বললেন, 'এখন পর্যন্ত চিহ্নিত একজনও গ্রেপ্তার হয়নি। এ কিসের আলামত!'
রামুর চৌমুহনী থেকে সামনে রামু কাঁচাবাজার, পেছনে বৌদ্ধপল্লী। সেখানেই কথা হয় বৌদ্ধনেতা দীপক বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সেদিন ট্রাকভর্তি দুর্বৃত্তরা এসে আগে থেকেই হামলার পরিকল্পনা করেছিল। তারা মিটিং, মিছিল ও মাইকিং করে সেখানে লোক জমায়েত করেছিল। কিন্তু তার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন ছিল নীরব। এখন আবার রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ফলে আসল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দোষাদোষীই চলবে, প্রকৃতপক্ষে সুষ্ঠু বিচার আর হবে না।'
হতাশা ও উদ্বেগ : হামলার সাড়ে তিন মাস চলে গেলেও চিহ্নিত আসামি গ্রেপ্তার ও বিচার না হওয়ায় রামুর মানুষ হতাশ ও উদ্বিগ্ন। বৌদ্ধনেতারা বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো বৌদ্ধই রামু ছেড়ে কোথাও যাননি। তাঁরা নতুন করে বাঁচার ও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত চিহ্নিত আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাঁদের মনে ক্ষোভ ও হতাশা চেপে বসেছে।
রামু বাজারে কথা হয় ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী কাজল বড়ুয়ার (৪০) সঙ্গে। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক। কারা হামলা করেছিল জানতে চাইলে তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে ভীতির ছাপ। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, 'ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিল। সেখানে ঘটনার দিন রোহিঙ্গা ও জামায়াতের লোকজনও ছিল।' তিনি আরো বলেন, 'ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত সরকারের উচিত, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু সাড়ে তিন মাস চলে গেলেও প্রকৃত আসামিরা গ্রেপ্তার হয়নি। উপরন্তু বিচারের নামে চলছে নানা প্রহসন, কাদা ছোড়াছুড়ি। এটাই চলবে, শেষ পর্যন্ত বিচার আর হবে না।'
চিহ্নিত আসামিদের এখনো গ্রেপ্তার না করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় বৌদ্ধনেতা বিপ্লব বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রামুর ঘটনায় সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে অনেকেই। এ কারণে বিচারকাজেও গতি নেই।' বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, 'লোক দেখানো বিচার হলে আমরা মেনে নেব না। প্রকৃত আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।'
রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের অধ্যক্ষ সত্যপ্রিয় মহাথেরো বলেন, 'সুষ্ঠু বিচার পাব কি না জানি না। তবে আমরা এই এলাকায় স্থায়ী নিরাপত্তা চাই। প্রতিহিংসাবশত দুর্বৃত্তরা আবার হামলা চালাতে পারে। তখন আমাদের কী হবে?'
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে হামলা চালিয়ে রামুর ১২টি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার এবং ৩০টির বেশি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে আরো সাতটি মন্দির ও ১১টি বসতিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই সব ঘটনায় ১৯টি মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা মামলার আসামি ৩২৩ জন। তবে বৌদ্ধনেতাদের দাবি, প্রকৃত আসামিরা এখানো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
মন্দির পুনর্নির্মাণ চলছে দ্রুত : রামুর বৌদ্ধনেতা ও সাধারণ বৌদ্ধরা মন্দির ও বৌদ্ধপল্লী পুনর্নির্মাণ ও মেরামতকাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বিচারকাজ নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। বৌদ্ধপল্লীর অধিবাসীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি রামুর বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবিহারের (ক্যাং) পুনর্নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। দিন-রাত কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। এরই মধ্যে বিজিবির তত্ত্বাবধানে ২৪টি বৌদ্ধ বসতির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সেনাবাহিনীর কক্সবাজার ১৭ ইসিবির তত্ত্বাবধানে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, লালচিং বিহার, সাদাচিং, অপর্ণচরণ বিহার, জাদিপাড়া আর্যবংশ বৌদ্ধবিহার, অজন্তা বৌদ্ধবিহার, উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনাকেন্দ্র, উখিয়ার ঘোনা জেতবন বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার, চেরংঘাটা বড় ক্যাং, সীমাঘর, বোধিঘর, আর্যবংশ বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষের ঘর এবং উত্তর ফতেখাঁরকুল বিবেকারাম বৌদ্ধবিহারের পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারকাজ চলছে। এজন্য সরকার প্রায় ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সীমা বিহারের নির্মাণকাজ তদারক করছেন সার্জেন্ট রেজওয়ানুল হক। তিনি বলেন, 'আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করতে পারব।'
কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক ও সমন্বয়কারী তরুণ বড়ুয়া জানান, রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহারের মধ্যে কেন্দ্রীয় সীমা বিহার রয়েছে 'এ' ক্যাটাগরিতে। এটি তিনতলা এবং ওপরে কারুকাজসহ গম্বুজ করা হবে। এ ছাড়া 'বি' ক্যাটাগরিতে পাঁচটি এবং 'সি' ক্যাটাগরিতে ছয়টি বিহার পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। ছয় মাসের মধ্যে এগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। তিনি বলেন, মন্দির ও বৌদ্ধপল্লীর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে চললেও বিচারকাজে গতিহীনতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সুষ্ঠু বিচার না পেলে এসব পুনর্নির্মাণ করে লাভ নেই। কেননা এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা তো নেই।' তিনি মন্দির নির্মাণের পাশাপাশি দ্রুত দোষীদের শাস্তির দাবি জানান।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের ভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, 'সবই তো ঠিকঠাক মতো হচ্ছে। কিন্তু আসামিদের তো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। দুর্বৃত্তদের বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।'
চিহ্নিত আসামিরা ধরা পড়েনি : কক্সবাজারের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা আসামি গ্রেপ্তারে তৎপর রয়েছেন। জেলা পুলিশ সুপার মো. আজাদ মিয়া জানান, মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজন আসামি আত্মগোপনে থাকায় তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ধরার জন্য কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত হামলার মূল রহস্য ও হোতাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ফেসবুকের সেই উত্তম বড়ুয়াকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছে পুলিশ প্রশাসন।
এদিকে বৌদ্ধদের বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. বাবুল আক্তার বলেন, 'আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যেই আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারব।'
জানা গেছে, প্রেপ্তার করা আসামিদের মধ্যে ২১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। স্বীকারোক্তি থেকে পুলিশ হামলায় জড়িত ৮৬১ জনকে শনাক্ত করার পর ৪৫৩ জনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে।
No comments