রেড অক্টোবর নামের ভাইরাস আতঙ্কে সাইবার দুনিয়া- পাঁচ বছর ধরে গোপনে তথ্য চুরি তৈরি করা যায়নি এন্টিভাইরাস

 রেড অক্টোবর শুনলেই মনে হবে অক্টোবর মাসকে লাল বলা হয়েছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। রেড অক্টোবর মানে সাইবার দুনিয়ায় ভয়ঙ্কর একটি নাম। এটি একটি শক্তিশালী কম্পিউটার ভাইরাস।
এই ভাইরাসের হুমকিতে সাইবার দুনিয়া এখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসটি উদ্ভাবন হয়েছে খোদ আমেরিকাতে ২০০৭ সালে। রেড অক্টোবর ভাইরাসটি আক্রমণ করেছে পূর্ব ইউরোপ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে। এ ছাড়াও পশ্চিম ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক দেশও ভাইরাসটির আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
ভাইরাসটি ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন দেশ, দূতাবাস এবং পরমাণু ক্ষেত্র থেকে গোপন ও স্পর্শকাতর তথ্য চুরি করছে। দীর্ঘ ৫ বছরেও ভাইরাসটির বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ভাইরাসটির উপস্থিতি প্রথম সন্ধান পান রাশিয়ান গবেষকরা। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ডকুমেন্ট এবং পিডিএফ ফাইল থেকে শুরু করে এনক্রিপ্টেড ফাইল সবই চুরি করতে সক্ষম এই ভাইরাস। এমনকি ডিলিট করে দেয়া ফাইলও খুঁজে নিতে পারে রেড অক্টোবর। ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস গত ৫ বছর ধরে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে কি পরিমাণ তথ্য চুরি করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। সব চেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে একটি দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য যদি ভাইরাসটি চুরি করতে সক্ষম হয় তাহলে ওই দেশগুলোর নিরাপত্তা চরম হুমকির মধ্যে পড়বে।
সম্প্রতি ভাইরাসটি নিয়ে বিবিসি এ্যান্টিভাইরাস ক্যাসপারস্কির প্রধান নিরাপত্তা গবেষক ভিতালি কামলুকের সাক্ষাতকার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তিনি ওই স্বাক্ষাতকারে বলেন, রেড অক্টোবর আক্রমণের মূল লক্ষ্যগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করেছিল ভাইরাসটির নির্মাতারা। ভাইরাসটির আক্রমণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এর লক্ষ্য ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সরকারী দফতর। ভাইরাসটি নিয়ে আমরা আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে বুঝতে পারি এটি ছিল বড় সাইবার আক্রমণ।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, ভাইরাসও তথ্যপ্রযুক্তির অংশ। কিন্তু এটি যদি খারাপ কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলেই ভয়ঙ্কর। কোটি কোটি ভাইরাস আবিষ্কার হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর এ্যান্টিভাইরাসও বাজারে চলে এসেছে। কিন্তু গত ৫ বছর ধরে রেড অক্টোবর নামের ভাইরাসটি গোপনে দুনিয়ার তথ্য চুরি করে নিলেও এতদিন কেউ তা ধরতে পারেনি। রাশিয়ান গবেষকরা রেড অক্টোবরের মতো ভয়ঙ্কর ভাইরাসটির সন্ধান পান। এ্যান্টিভাইরাস নির্মাতা ক্যাসপারস্কি ল্যাবে ধরা পড়ে রেড অক্টোবর। ২০১২ সালে আবিষ্কৃত আরেকটি ভাইরাস ফ্লেইম-এর সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে রেড অক্টোবরের। অস্ত্রযুদ্ধের চেয়ে সাইবার যুদ্ধ কোন অংশে কম হয়ে দেখা দিচ্ছে না। সাইবার যুদ্ধ নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সাইবার যুদ্ধ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকবার এমন যুদ্ধ হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে। চীনে তো সাইবার যুদ্ধে গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই চলছে সাইবার যুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভেতরেও হ্যাকারগোষ্ঠীগুলো সাইবার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের ‘এ্যাননিমাসের’ সঙ্গে পাকিস্তানের সাইবার যুদ্ধ নিয়ে দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে, পাকিস্তানী হ্যাকারগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের যারা যোগ দিয়েছে তারা জামায়াতের অঙ্গসংগঠন শিবিরের আইটি বিভাগের কর্মী। এ্যানানিমাস ঘোষণা করেছে একদিনে সরকারী-বেসরকারী ৪০টির বেশি ওয়েবসাইটে হামলা চালানো হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ, তিন মাসে ১৩৩টি ওয়েবসাইট হ্যাকড করার ঘটনা ঘটেছে। তবে এই আক্রমণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি ছিল। নীতিগত অবস্থান থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের হ্যাকারগোষ্ঠী ভারতীয় ৫শ’র বেশি ওয়েবসাইটে আক্রমণ করেছিল। তবে তারা তখন একশ’র বেশি ওয়েবসাইট হ্যাকড করতে সমর্থ হয়।
সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে টানা পাঁচ দিন ধরে চলেছে বাংলাদেশ-ভারত সাইবার যুদ্ধ। তখন বাংলাদেশের হ্যাকাররা ঘোষণা দিয়েছিল ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্ভার তারা হ্যাকড করে দিয়েছে। এই আক্রমণে ভারতীয় হ্যাকাররা বাংলাদেশের পুরো সাইবার স্পেসের দখল নেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় হ্যাকারগোষ্ঠী সে যাত্রায় পিছিয়ে যায়। ওই আক্রমণের সময় দুই দেশের পক্ষে-বিপক্ষে আন্তর্জাতিক কিছু নামকরা হ্যাকার গ্রুপও যোগ দিয়েছিল। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুদ্ধে জয় পরাজয় নির্ণয় করা কঠিন ছিল। কারণ বাংলাদেশের ব্ল্যাকহ্যাট গ্রুপ স্পষ্ট বলেছে, তারা খুবই দক্ষ। ভারতীয় হ্যাকারদের পরাজিত করতে তাদের বেগ পেতে হবে না।
এদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের সাইবার আর্মির নামের এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করা সম্ভব হয়। একটি নীতিগত জায়গা থেকে যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সেসের (বিএসএফ) হাতে নিরীহ বাংলাদেশী হত্যার প্রতিবাদে ‘বাংলাদেশ ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস’ (বিবিএইচএইচ) এই গ্রুপটি ভারতের একশ’র ওপরে গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। ব্ল্যাক হ্যাট বাংলাদেশের হ্যাকার গ্রুপ বিদেশী কয়েকটি হ্যাকার গ্রুপের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। তারাও বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছিল। অন্যদিকে ভারতীয় হ্যাকার গ্রুপ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট হ্যাকড করে রেখেছিল কয়েকদিন। এবারের যুদ্ধের উদ্দেশ্য বিভিন্ন রকম বলে মনে করছে দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার্থে পাকিস্তানের হ্যাকারগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি মৌলবাদী হ্যাকারগোষ্ঠী যোগ দিয়েছে। তারা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
ভারত বর্তমানে সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে দেড় শ’ কোটি টাকা খরচ করে সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। যার মধ্যে রয়েছে, জাতীয় স্তরে একটি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে তোলা, সাইবার অপরাধের তদন্তের জন্যই একটি কেন্দ্র গঠন, রাজ্য পুলিশেও এই ধরনের অপরাধের মোকাবিলার পৃথক বিভাগ রাখা, সাইবার অপরাধের তদন্ত ও ফরেনসিক পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়ার কেন্দ্র তৈরি এবং এনটিআরও, সার্টইন, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, ডেটা সিকিউরিটি কাউন্সিলের মতো সংস্থাগুলোর মধ্যে দায়িত্ব আরও স্পষ্টভাবে ভাগ করে দেয়া। আলোচনা করা হচ্ছেÑ সফটওয়্যার সংস্থাগুলোর সংগঠন নাসকমকেও কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.