ফুলবাড়ী, রামপাল, বুড়িগঙ্গা- সর্বত্র একি সর্বনাশা খেলা! by হায়দার আকবর খান রনো

এক একদা অর্থনীতির উন্নয়ন বলতে শুধু টাকার অঙ্কে লাভালাভের বিষয়টি গণ্য করা হতো। মানুষের জীবন, তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যসংক্রান্ত বিষয়কে অর্থনীতি-বহির্ভূর্ত বলে গণ্য করা হতো।


নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, পাকিস্তানের বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রয়াত মাহবুবুল হক প্রমুখ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণার মধ্যে গণমানুষের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়কে এনেছিলেন। বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের ভেতরই বাম ধারার প্রতিনিধিত্বকারী জোয়ান রবিনসন অথবা পরবর্তীকালে তুলনামূলক কিছুটা উদার (কিন্তু বুর্জোয়া) অর্থনীতিবিদ গলব্রেথ বা স্যামুয়েলসন প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। পুঁজিবাদী মুনাফার তাগিদ কিভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে, সেই সম্পর্কে প্রথম আলোচনা করেছিলেন কার্ল মার্কস তাঁর বিখ্যাত পুঁজি গ্রন্থে ও অন্যান্য রচনায়। ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে পরিবেশকে অর্থনীতির সঙ্গে মিলিয়ে ভাবা হয়নি। এখন মানুষ কিছুটা পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। পরিবেশবাদী আন্দোলনও গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী। তাদের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বহুজাতিক করপোরেশন ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসনের দ্বন্দ্ব প্রায়ই প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। মানবজাতির অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে; অন্ততপক্ষে হুমকির মুখে পড়বে। এসবের আলামত দেখা দিয়েছে জেনেও (যথা- ওজোনস্তরে বিশালাকার ফাঁক তৈরি হওয়া, এসিড বৃষ্টি, গ্রিনহাউস এফেক্ট ইত্যাদি) দৈত্যসম বিশালাকার করপোরেশনের স্বার্থে কার্বন ডাই-অক্সইড বা মনোক্সাইড গ্যাস নিঃসরণকারী দ্রব্য (যথা- রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার) উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করতে সম্মত নয় পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। ভোগবিলাসে অভ্যস্ত পাশ্চাত্যের মানুষও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা এতটুকুও ভাবছে না। অথচ পরিবেশ এখন কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এটি এখন শ্রেণী ও জাতি নির্বিশেষে পুরো মানবজাতির জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি।
বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে আমি এ রচনা লিখতে বসিনি। আমাদের দেশ নিয়েই আপাতত এ আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। আমাদের দেশে বর্তমান সরকারসহ এ যাবৎকালের সরকারগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ কী ভয়াবহরূপে ধ্বংস করছে এবং দেশের মানুষকে কী বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, সেই সম্পর্কে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করব।
দুই
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুরের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি ফুলবাড়ী কয়লাখনিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুপারিশ করেছে। আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই কারণে যে আমাদের সরকার এবং সরকারি সংস্থাগুলো কিভাবে এত স্বল্পকালের ব্যবধানে নিজেদেরই কমিটমেন্টের কথা ভুলে যায়। মাত্র সেদিনের কথা। ২০০৬ সালের আগস্ট মাস। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে না এবং বাংলাদেশ থেকে এশিয়া এনার্জিকে বিতাড়িত করা হবে। সেদিন আন্দোলনকারীদের মনে সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রী পর্যায়ের দুজন অফিসিয়ালি যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেখানে তো এ কথাই বলা হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এবং এর আগে ২৬ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত যে বিশাল গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, সেই পুরো সময়ে তাতে আমি উপস্থিত ছিলাম। জনগণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই এসেছিল সেই সরকারি ঘোষণা, যা ইচ্ছা করলেই পরবর্তী সরকার বাতিল করতে পারে না। এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কয়েক দিন পর এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে এবং জনগণকে অভিনন্দিত করে ফুলবাড়ীতে বক্তৃতা করেছিলেন সেদিনের বিরোধীদলীয় নেতা ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন তাই শেখ হাসিনার নৈতিক ও আইনগত কর্তব্য হচ্ছে সেই চুক্তি কার্যকর করা। অর্থাৎ এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত এবং ফুলবাড়ীতে যাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন না হয় সেই ব্যবস্থা করা। হায়! প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা বুঝি সবই ভুলে গেছেন। তাই এশিয়া এনার্জি এখনো বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে অফিস খুলে বসে আছে এবং নানা ছলে, কখনো পাটোয়ারী কমিটির নামে, কখনো বা বিশেষজ্ঞ কমিটির নামে বহু আগেই নির্ধারিত হয়ে যাওয়া (settled matter) বিষয়কে উত্থাপন করে জনগণের সঙ্গে সরকারের ঐতিহাসিক চুক্তি বাতিল করার অশুভ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
ফুলবাড়ী কয়লাখনিতে মজুদ আছে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা। ১৯৯৭ সালে সরকার সেই খনিটির ব্যাপারে ব্রিটিশ বেনিয়া কম্পানি এশিয়া এনার্জির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল, যাতে এশিয়া এনার্জিকে মাত্র ছয় শতাংশ রয়্যালটির বিনিময়ে খনির পুরো মালিকানা তুলে দেওয়া হবে এবং যেখানে এশিয়া এনার্জি উত্তোলিত কয়লার সবটাই রপ্তানি করতে পারবে। তাহলে বাংলাদেশের কী লাভ হলো। একেই বলে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা। আমার দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশের হাতে তুলে দেওয়া, বিনিময়ে আমার দেশের উচ্চপর্যায়ের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা আমলা হয়তো বা ব্যক্তিগত সুবিধা, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকতে পারেন।
বলা হয় যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে বেশি উৎপাদন হবে, সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে করলে কম হবে। কথাটা সত্য। কিন্তু এর বিনিময়ে পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণটি কত ভয়াবহ তা উল্লেখ করা হয় না।
এবার দেখা যাক, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হলে কী কী পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
(১) প্রায় এক লাখ মানুষকে স্থানান্তরিত করতে হবে।
(২) উপজেলা শহরসহ সব স্থাপনা, বাড়িঘর ইত্যাদি ধ্বংস করতে হবে।
(৩) এখানকার জমি বাংলাদেশের সবচেয়ে উর্বর জমি। সেই জমিতে ফসল হবে না। গরু-ছাগল, পশুপাখি, মাছ- কিছুই থাকবে না। থাকবে না গাছপালা এবং পুকুর-জলাশয়।
(৪) সবচেয়ে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে যে কারণে সেটা হলো, এই যে ভূগর্ভস্থ কয়লার ওপর আছে যে পানির স্তর, তা দূরে কোথাও সরাতে হবে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শূন্য হবে। ফলে মরুপ্রক্রিয়া দেখা দেবে প্রায় উত্তরবঙ্গজুড়ে।
(৫) ৩০ বছর ধরে ভূগর্ভস্থ পানি শূন্য করা হলে দূরবর্তী অঞ্চলেও মাটির উর্বরতা থাকবে না।
(৬) অন্যত্র যেখানে পানি ফেলা হবে, ধরা যাক নিকটবর্তী কোনো নদী বা জলাশয়, সেখানকার পানি আবার বিষাক্ত হয়ে উঠবে। মাছ মারা যাবে। পানি খাবার যোগ্য থাকবে না।
এত বড় বিপর্যয় জেনেও কেন উন্মুক্ত পদ্ধতির জন্য সুপারিশ? এটা একটা বড় প্রশ্ন। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে।
(১) ২০০৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফুলবাড়ী চুক্তিতে উন্মুক্ত পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা হলে কেন তার সঙ্গে বেইমানি করে নতুন করে একই প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে!
(২) এ সরকারের আমলেই ইতিপূর্বে কয়লানীতি প্রশ্নে পাটোয়ারী কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেখানেও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতি অনুমোদিত হয়নি। তবে বলা হয়েছিল, বড়পুকুরিয়ার সামান্য এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত পদ্ধতি দেখা যেতে পারে। সেই ব্যাপারেও প্রবল আপত্তি উঠেছিল জনগণের পক্ষ থেকে।
(৩) এবারের বিশেষজ্ঞ কমিটিও কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পদ্ধতির পরিবেশগত বিপজ্জনক দিক তুলে ধরেছে বিশদভাবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গিয়ে তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিকে সুপারিশ করেছে। কেন? কার স্বার্থে? এই স্ববিরোধিতার কি কোনো জবাব আছে? এর পেছনে কি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে, যা জাতীয় স্বার্থের চেয়েও ওপরে স্থান পেতে পারে? যাঁরা এমন সুপারিশ করছেন, তাঁদের সঙ্গে এশিয়া এনার্জির কি কোনো গোপন সম্পর্ক আছে!
তিন
কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে যে বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে সরকার। ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে আধাআধি মালিকানার ভিত্তিতে এ প্রকল্প ১২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। মুশকিল হচ্ছে এই যে এ ধরনের প্রকল্প অথবা বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়টি সব সময় গোপন রাখা হয়। পার্লামেন্টে পর্যন্ত উত্থাপিত হয় না। ফলে আমরা এ বিষয়ে খুব বেশি জানি না। আমাদের প্রথম দাবি, এ প্রকল্পের বিস্তারিত এবং চুক্তির প্রতিটি বিষয় প্রকাশ্যে করা হোক। প্রকাশ্যে আলোচিত হোক। এটা তো কোনো সামরিক বিষয় নয় যে এত গোপনীয়তার দরকার আছে। ইদানীং যে ধরনের বড় বড় দুর্নীতির কেলেঙ্কারির খবর একটার পর একটা প্রকাশ হচ্ছে, তাতে ভয় হয়, কোথায় কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, রামপালে কেন? বাংলাদেশে আর কোনো জায়গা নেই যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করা যায়? এমন তো নয় যে এর কাছাকাছি কোনো কয়লাখনি আছে। কিন্তু যা আছে তা হলো সুন্দরবন। একেবারে সুন্দরবনের গা ঘেঁষে, এমনকি সুন্দরবনের অংশবিশেষের মধ্যেও ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত জায়গা নিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে। বাতাসে উড়বে কয়লার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা। পানি বিষাক্ত হবে। সর্বোপরি ধ্বংস হবে সুন্দরবন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বি ডি রহমত উল্লাহ এক রচনায় যা বলেছেন, তা রীতিমতো ভয়াবহ। তিনি বলেছেন, 'কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যখন কয়লা পোড়ানো হবে, তখন সেই কয়লা থেকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম এবং এ থেকে আরো কিছু রেডিও-অ্যাকটিভ পদার্থ সৃষ্টি হয়। এগুলো পরিবেশ মারাত্মক দূষণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষকের একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, এ দূষণপ্রক্রিয়া একই ক্ষমতার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র (Nuclear power station) থেকে উদ্গত রেডিও-অ্যাকটিভ ম্যাটেরিয়ালের বর্জ্য থেকে ৪০ থেকে ৮০ গুণ বেশি। কাজেই মনুষ্যজীবন তো বটেই, সুন্দরবনের গাছগাছালিসহ ওই বনের নদীতে বসবাসকারী প্রাণিকুলের জীবনের জন্য এটা এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে।'
তাজমহলের সাদা রং কিছুটা ধূসর হয়ে যাচ্ছে বলে ভারত সরকার তাজমহলের ২০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সব শিল্প-কারখানা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার কেন সুন্দরবন ঘেঁষেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট করার জন্য আগ্রহী? পরিবেশবাদীদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও রামপালেই করতে হবে- এমন জেদ কেন? জনগণের পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা দরকার, এর মধ্যে কোনো মতলববাজি অথবা কার বিশেষ ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করছে। সামান্য ব্যক্তিস্বার্থ অথবা সরকারের চরম অপদার্থতা, অপরিণামদর্শিতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য আমরা জাতির এত বড় ক্ষতি মেনে নিতে পারি না। জনগণকে আরো জোরালো প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যেভাবে তারা মুন্সীগঞ্জের বিশেষ এলাকায় দ্বিতীয় বিমানবন্দর করতে বাধা দিতে সক্ষম হয়েছিল অথবা ২০০৬ সালে ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জিকে তখনকার মতো হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এখনো আমাদের বড় ভরসার জায়গা জনগণ ও তার সংগ্রাম।
চার
আমাদের অতীত ও বর্তমানের সরকারগুলো এবং রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহপ্রাপ্ত ভূমি ও জলদস্যু দল শুধু যে অর্থনৈতিকভাবে লুট করেছে তা-ই নয়, তারা পরিবেশও চরম বিপর্যয়ের জায়গায় নিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেওয়া যায়; কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিণাম অনেক বেশি ভয়াবহ। সে জন্য ফুলবাড়ী ও রামপালের ঘটনা নিয়ে আমরা এত বেশি উদ্বিগ্ন।
রাজধানীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা। ষাটের দশকে আমি কখনো কখনো কামরাঙ্গীরচর যেতাম তদানীন্তন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সাবেক শ্রমিক নেতা ও সাংবাদিক প্রয়াত হাবিবুর রহমানের বাসায়। সোয়ারিঘাট থেকে কামরাঙ্গীরচর। দু-একবার বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানিতে নেমে স্নান পর্যন্ত করেছি। সেই বুড়িগঙ্গার পানি এখন স্পর্শ করলে চর্মরোগ হবে। বুড়িগঙ্গার বাতাসও এখন বিষাক্ত। বুড়িগঙ্গার একি দুর্দশা। কে করল এই সর্বনাশ। নানা ধরনের বর্জ্য দ্বারা নদীর পানি হয়েছে রুগ্ণ ও বিষাক্ত। তার ওপর দুই পাড় দখল করেছেন সরকারের (অতীত ও বর্তমান) আশীর্বাদপুষ্ট ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা।
কিছুসংখ্যক দখলবাজ ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির অতি লোভ ও মুনাফা এবং সরকারের ক্ষমাহীন অবহেলার কারণে বুড়িগঙ্গা আজ শুধু বুড়ি নয়, মৃত্যুপথযাত্রী। নদী, মাটি, বন, পরিবেশ ধ্বংস করে মানুষ বাঁচতে পারে না, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। শোনা যায়, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে নাকি ৯৪৪ কোটি টাকার এক অবাস্তব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখ থেকে ২২৬ কিলোমিটার খনন করে বুড়িগঙ্গায় পানিপ্রবাহ বাড়িয়ে বুড়িগঙ্গাকে তাজা করা হবে। এ-ও আরেক সর্বনাশা প্রকল্প। এতে অসংখ্য গ্রাম, নগর, চাষের জমি ধ্বংস হবে। কিন্তু এ ধরনের উদ্ভট প্রকল্প ছাড়াও অন্যভাবে ড্রেজিং করা এবং আরো অন্য উপায়ে হয়তো বুড়িগঙ্গার প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেটা করতে হবে। সেই সঙ্গে নদী দখলকারীদের উচ্ছেদ ও শিল্পবর্জ্য ফেলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার কি গুরুত্বসহকারে এই কাজ হাতে নেবে? নাকি যেমন চলছে তেমনই চলবে? একই সঙ্গে চলবে শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, গুম, খুন ইত্যাদি!
ফুলবাড়ী, রামপাল, বুড়িগঙ্গা- সর্বত্র একি সর্বনাশা খেলা চলছে! এ খেলা চলতে দেওয়া যায় না। পরিবেশ রক্ষা করা সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য। এই কর্তব্য যেমন সরকারের, তেমনি সরকার ব্যর্থ হলে জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে, সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। কারণ এর সঙ্গে আমাদের গোটা জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত।

লেখক : রাজনীতিবিদ, লেখক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.