চারদিক- লোকে ভুলে যেতে চায়... by সুচিত্রা সরকার
‘সকালে কাজের ছেলে বাইরে থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “কারফ্যু শুরু হইছে। রাজাকাররা আমার বুকে রাইফেল ধইরা অনেক কিছু জিগাইছে।” তখনই আজহার ঘুম থেকে উঠলেন। মেডিকেলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগলেন।
দিনটি ছিল ১৫ নভেম্বর, সোমবার। বললাম, আজকে কি না গেলেই নয়? বললেন, মেডিকেলে ফোন করেছি, অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য। যদি অ্যাম্বুলেন্স আসে, তবেই যাব।’
১৯৭১ থেকে ২০১২। কত দিন, মাস আর বছর! এত দিন ধরে স্মৃতিগুলোকে নিজের মধ্যে জিইয়ে রেখেছেন সৈয়দা সালমা হক। তিনি শহীদ ডা. আজহারুল হকের জীবনসঙ্গিনী। আজহারুল হক ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর আলবদর বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। তার পর থেকে তাঁর স্মৃতিগুলোকেই সঙ্গী করে নিয়েছেন।
‘তিনি মেডিকেলে ফোন করে বাসার গেটে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমাদের বাসার তিনতলায় ছিলেন ডা. হুমায়ুন কবীর। তিনিও আজহারের সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগলেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। হঠাৎ আলবদর বাহিনীর একটি দল এল তাঁদের কাছে। দুজনকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। কী কথা, এত দূর থেকে আমি বুঝতে পারিনি। তারপর ওঁদের দুজনকে রাইফেল তাক করে রাস্তার মাথায় গান পয়েন্ট বরাবর নিয়ে গেল।
‘সেদিন ভোররাত থেকেই সব রাস্তা কর্ডন করে রেখেছিল। ট্রাকে করে অনেককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আজহারদের নিয়ে যাওয়ার পরই আমাদের বাসায় আলবদর বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ এল। এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল হুমায়ুন কবীরকে চিনি কি না। তাঁকে বাঁচানোর জন্য বললাম, চিনি না। তারপর আজহার কোথায় জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, হাসপাতালে গেছেন।
‘ওরা এসেছিল পাঁচজন। যে কথা বলছিল, সে চোখে এই দিনের বেলায়ও সানগ্লাস পরে ছিল। আমার উত্তর শুনে সানগ্লাস পরা লোকটা অন্যদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। সেই মুহূর্তে যেন আমার প্রাণটা শুকিয়ে গেল।’
এইটুকু বলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিলেন। না, চোখের জল ফেলার জন্য নয়। নিষ্ঠুরতার দীর্ঘ গল্প বলার প্রস্তুতি এটা।
‘আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। আমার পুরো বাড়ি এলোমেলো করে, আমাকে উদ্বেল করে দিয়ে ওরা চলে গেল। যাওয়ার আগে আলবদররা আমাকে বলেছিল “ডোন্ট মাইন্ড।”
‘কারফিউ তুলে নিল কিছুক্ষণ পরেই। আমার ভাই মেডিকেলে গিয়ে ওঁর খোঁজ করল। তাঁকে না পেয়ে রমনা থানায় গেল। সেখানে দেখল, অনেকের নাম তালিকায় আছে। শুধু আজহার ও হুমায়ুন কবীরের নাম নেই।’
তাঁদের পাওয়া গেল কবে?
‘১৬ নভেম্বর। মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের কাছে কালভার্টের ড্রেনের মধ্যে। এলাকার লোকজন কচুরিপানা আর শেওলার মধ্যে দুজনের লাশ দেখতে পেয়েছিল। পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজে লাশ দুটো নিয়ে আসে। একজন ডাক্তার আজহারকে চিনতে পেরে আমাদের খবর দেয়।’
দীর্ঘ প্রস্তুতির পরও বাঁধ মানে না আবেগের জল। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, ‘তাঁদের দুজনকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে। ওঁদের হাত পেছন দিকে বাঁধা ছিল। দুজনের সারা গায়ে অজস্র ক্ষত। গলার কাছে কালো দাগ দেখে ডাক্তার শনাক্ত করেছিল, শ্বাসরোধ করে ওঁদের মেরেছে।’
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। যুদ্ধের দামামার চেয়েও যেন এই নিশ্চুপতার শক্তি বেশি। নিজের মনেই বলেন, ‘আজহার মানুষকে সেবা করতে ভালোবাসতেন। ২৬ মার্চ থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত গোপনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন। সে সময় অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতেন। তার একটা ছোট্ট ইচ্ছা ছিল। বলেছিলেন, “ছেলে হলে আমি প্রথমে মুখ দেখব।” দেখতে পাননি। তাই ছেলে হওয়ার পর আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না।’
তাঁদের স্মরণ করে কোনো স্মরণস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে?
‘১৯৯৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, তার একটু দূরেই।’
বিদায় নিই শহীদ-জায়ার কাছ থেকে। পরবর্তী গন্তব্য মতিঝিলের নটর ডেম কলেজের পাশে শহীদ ডা. আজহারুল হক ও শহীদ ডা. হুমায়ুন কবীরের স্মৃতিস্তম্ভ। স্মরণস্তম্ভটা দেখে খানিকটা ধাক্কা লাগে। ফুটপাতের ওপরে স্মৃতিস্তম্ভটি। স্তম্ভের আশপাশে শুকনো পাতা, টুকরো কাগজ, একটু দূরে কয়েকটি পচা বনরুটি পড়ে আছে। আর স্মৃতিস্তম্ভের যেখানে ‘জামায়াতে ইসলামী’ লেখা আছে, সেই অংশটা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খুঁচিয়ে তুলে ফেলেছে।
দুই হাত দূরে রিকশা সারানোর যন্ত্রপাতির একটা দোকান। একটা ভ্যান নিয়ে দাঁড়ালেন কাইয়ুম। বয়স ২৭। প্রশ্ন করলাম, এটা কী, জানেন?
‘একটা বাচ্চার কবর। কীভাবে মারা গেছে জানি না।’
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী সালীম সাদমান।
তাঁকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘ঠিক লক্ষ করিনি। একদিন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছি, দুটো পিলার আছে।’ তারপর এক ঝলকে ফলকটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘এটায় লেখা আছে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ বলেই চলে যান নিজের গন্তব্যে।
সালীম ঠিকই বলেছেন, ফলকটির ওপরে তা-ই লেখা রয়েছে। তার নিচে ডা. আজহারুল হক আর ডা. হুমায়ুন কবীরের শহীদ হওয়ার বিবরণ। কিন্তু এগুলো পড়ার সময় কি কারও আছে? দেয়ালের ওপাশে একটা বাগানবিলাসগাছ দাঁড়িয়ে আছে। তারই কিছু ডাল নুয়ে পড়েছে স্তম্ভের ওপর। হয়তো শ্রদ্ধায়!
সুচিত্রা সরকার
১৯৭১ থেকে ২০১২। কত দিন, মাস আর বছর! এত দিন ধরে স্মৃতিগুলোকে নিজের মধ্যে জিইয়ে রেখেছেন সৈয়দা সালমা হক। তিনি শহীদ ডা. আজহারুল হকের জীবনসঙ্গিনী। আজহারুল হক ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর আলবদর বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। তার পর থেকে তাঁর স্মৃতিগুলোকেই সঙ্গী করে নিয়েছেন।
‘তিনি মেডিকেলে ফোন করে বাসার গেটে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমাদের বাসার তিনতলায় ছিলেন ডা. হুমায়ুন কবীর। তিনিও আজহারের সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগলেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। হঠাৎ আলবদর বাহিনীর একটি দল এল তাঁদের কাছে। দুজনকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। কী কথা, এত দূর থেকে আমি বুঝতে পারিনি। তারপর ওঁদের দুজনকে রাইফেল তাক করে রাস্তার মাথায় গান পয়েন্ট বরাবর নিয়ে গেল।
‘সেদিন ভোররাত থেকেই সব রাস্তা কর্ডন করে রেখেছিল। ট্রাকে করে অনেককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আজহারদের নিয়ে যাওয়ার পরই আমাদের বাসায় আলবদর বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ এল। এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল হুমায়ুন কবীরকে চিনি কি না। তাঁকে বাঁচানোর জন্য বললাম, চিনি না। তারপর আজহার কোথায় জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, হাসপাতালে গেছেন।
‘ওরা এসেছিল পাঁচজন। যে কথা বলছিল, সে চোখে এই দিনের বেলায়ও সানগ্লাস পরে ছিল। আমার উত্তর শুনে সানগ্লাস পরা লোকটা অন্যদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। সেই মুহূর্তে যেন আমার প্রাণটা শুকিয়ে গেল।’
এইটুকু বলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিলেন। না, চোখের জল ফেলার জন্য নয়। নিষ্ঠুরতার দীর্ঘ গল্প বলার প্রস্তুতি এটা।
‘আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। আমার পুরো বাড়ি এলোমেলো করে, আমাকে উদ্বেল করে দিয়ে ওরা চলে গেল। যাওয়ার আগে আলবদররা আমাকে বলেছিল “ডোন্ট মাইন্ড।”
‘কারফিউ তুলে নিল কিছুক্ষণ পরেই। আমার ভাই মেডিকেলে গিয়ে ওঁর খোঁজ করল। তাঁকে না পেয়ে রমনা থানায় গেল। সেখানে দেখল, অনেকের নাম তালিকায় আছে। শুধু আজহার ও হুমায়ুন কবীরের নাম নেই।’
তাঁদের পাওয়া গেল কবে?
‘১৬ নভেম্বর। মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের কাছে কালভার্টের ড্রেনের মধ্যে। এলাকার লোকজন কচুরিপানা আর শেওলার মধ্যে দুজনের লাশ দেখতে পেয়েছিল। পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজে লাশ দুটো নিয়ে আসে। একজন ডাক্তার আজহারকে চিনতে পেরে আমাদের খবর দেয়।’
দীর্ঘ প্রস্তুতির পরও বাঁধ মানে না আবেগের জল। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, ‘তাঁদের দুজনকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে। ওঁদের হাত পেছন দিকে বাঁধা ছিল। দুজনের সারা গায়ে অজস্র ক্ষত। গলার কাছে কালো দাগ দেখে ডাক্তার শনাক্ত করেছিল, শ্বাসরোধ করে ওঁদের মেরেছে।’
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। যুদ্ধের দামামার চেয়েও যেন এই নিশ্চুপতার শক্তি বেশি। নিজের মনেই বলেন, ‘আজহার মানুষকে সেবা করতে ভালোবাসতেন। ২৬ মার্চ থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত গোপনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন। সে সময় অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতেন। তার একটা ছোট্ট ইচ্ছা ছিল। বলেছিলেন, “ছেলে হলে আমি প্রথমে মুখ দেখব।” দেখতে পাননি। তাই ছেলে হওয়ার পর আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না।’
তাঁদের স্মরণ করে কোনো স্মরণস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে?
‘১৯৯৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, তার একটু দূরেই।’
বিদায় নিই শহীদ-জায়ার কাছ থেকে। পরবর্তী গন্তব্য মতিঝিলের নটর ডেম কলেজের পাশে শহীদ ডা. আজহারুল হক ও শহীদ ডা. হুমায়ুন কবীরের স্মৃতিস্তম্ভ। স্মরণস্তম্ভটা দেখে খানিকটা ধাক্কা লাগে। ফুটপাতের ওপরে স্মৃতিস্তম্ভটি। স্তম্ভের আশপাশে শুকনো পাতা, টুকরো কাগজ, একটু দূরে কয়েকটি পচা বনরুটি পড়ে আছে। আর স্মৃতিস্তম্ভের যেখানে ‘জামায়াতে ইসলামী’ লেখা আছে, সেই অংশটা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খুঁচিয়ে তুলে ফেলেছে।
দুই হাত দূরে রিকশা সারানোর যন্ত্রপাতির একটা দোকান। একটা ভ্যান নিয়ে দাঁড়ালেন কাইয়ুম। বয়স ২৭। প্রশ্ন করলাম, এটা কী, জানেন?
‘একটা বাচ্চার কবর। কীভাবে মারা গেছে জানি না।’
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী সালীম সাদমান।
তাঁকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘ঠিক লক্ষ করিনি। একদিন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছি, দুটো পিলার আছে।’ তারপর এক ঝলকে ফলকটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘এটায় লেখা আছে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ বলেই চলে যান নিজের গন্তব্যে।
সালীম ঠিকই বলেছেন, ফলকটির ওপরে তা-ই লেখা রয়েছে। তার নিচে ডা. আজহারুল হক আর ডা. হুমায়ুন কবীরের শহীদ হওয়ার বিবরণ। কিন্তু এগুলো পড়ার সময় কি কারও আছে? দেয়ালের ওপাশে একটা বাগানবিলাসগাছ দাঁড়িয়ে আছে। তারই কিছু ডাল নুয়ে পড়েছে স্তম্ভের ওপর। হয়তো শ্রদ্ধায়!
সুচিত্রা সরকার
No comments