সাক্ষাৎকার-যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় জামায়াত একাত্তরের মতো ভয়ঙ্কর হতে পারে by শাহরিয়ার কবির
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সুভাষ সাহা ও একরামুল হক শামীম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
তিনি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ প্রভৃতি বিষয়ে বই এবং পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখছেন। ১৯৫০ সালের ২০ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন
সমকাল :যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কি সঠিকভাবে এগুচ্ছে বলে মনে করেন?
শাহরিয়ার কবির :বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা আরম্ভ করেছি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের চার দশক পর। পৃথিবীর কোনো দেশে এত পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। এত বছর পর বিচারের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, এর বেশির ভাগ সময় স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীরা ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা সুপরিকল্পিতভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের যত তথ্যপ্রমাণ বিভিন্ন নথিপত্রে ছিল, সেগুলো পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নষ্ট করে ফেলেছে। ফলে বিচার করার ক্ষেত্রে অনেক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ১৯৭২ সালে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; বঙ্গবন্ধু যাদের বিচার শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি_ এ রকম বহু তথ্যপ্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও আমি মনে করি, আমাদের ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়ে গত আড়াই বছরে যতটুকু করেছে, সেটা প্রশংসনীয়। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। ন্যুরেমবার্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য, সেখানে আমরা দেখেছি ১০ মাসের ভেতর বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর কারণ ছিল তাদের পর্যাপ্ত লোকবল ও রসদ। লোকবল এবং রসদের ঘাটতি আমাদের ট্রাইব্যুনালে প্রথম থেকেই ছিল। এখনও সেই ঘাটতি পুরোপুরি কাটেনি। ট্রাইব্যুনালে আরও দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের ট্রাইব্যুনালে গবেষণা সেল নেই; আইনজীবীদের সহকারী নেই। আমি এখনও মনে করি, যদি এই ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটতিগুলো পূরণ করা হয়, তাহলে ২০১৩ সালের মধ্যে যে ১০ জনের বিচার কাজ চলছে, তার রায় পাওয়া সম্ভব। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই বিচার বানচালের জন্য জামায়াতে ইসলামী দেশে ও দেশের বাইরে বহুমাত্রিক প্রচারণা চালাচ্ছে; বিচারের যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; যে আইনে বিচার হবে সেই আইন সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলছে; বিচারকদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; মিথ্যা বা অর্ধসত্য কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। শত শত কোটি টাকা খরচ করে তারা বিদেশে বহু লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সরকার এ অপতৎপরতা কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেনি। কোথাও কোথাও আমাদের রাষ্ট্রদূতরা কিছু কথা বলেছেন। তবে জামায়াতি প্রোপাগান্ডা মোকাবেলায় যে সার্বিক পরিকল্পনা দরকার, তা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এখনও দৃশ্যমান নয়।
সমকাল :পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
শাহরিয়ার কবির :পাকিস্তান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র এই বিচারের পক্ষে নয়। দৃশ্যত তারা সরকারিভাবে কোনো আপত্তি তোলেনি; কিন্তু আমেরিকা বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীকে মডারেট ইসলামী দল মনে করে। আমেরিকার নীতিনির্ধারকরা বহু বার বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তির বিচার হতে পারে, কিন্তু কোনো সংগঠনের বিচার করা যাবে না। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর বিচার যদি করা হয়, তাহলে সরকার বাইরে একটা ভুল সংকেত পাঠাবে। আমরা জানি, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার সরকার আমাদের বিপক্ষে ছিল, কিন্তু সেখানকার গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিক সমাজ আমাদের পক্ষে ছিল। সেটা বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে সম্ভব হয়েছিল। এবার তেমনভাবে সরকারি পর্যায় থেকে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। '৭১-এ যেসব ব্যক্তি, জামায়াতের যেসব শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়ি ছিল, তারা কেউ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ছিল না। তারা ছিল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা। তারা যাবতীয় অপরাধ করেছে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। জামায়াতে ইসলামীর একটা আদর্শ আছে, যেটাকে আমরা বলি মওদুদীবাদ। মওদুদীবাদ ইসলামের নামে, ধর্মের নামে হত্যা, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞকে উৎসাহ দেয়। জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের বিচার না হলে এখন যে বিচার চলছে, তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না। বিচার অপূর্ণ থেকে যাবে।
সৌদি আরব ও পাকিস্তান থেকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বন্ধুর অভাব নেই। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা যারা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছি, আমাদের যাদের বাইরে যোগাযোগ আছে তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা, আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা জরুরি। এগুলো সরকারকেই করতে হবে। জামায়াতের শত শত কোটি টাকার প্রোপাগান্ডা মোকাবেলা করার সামর্থ্য নির্মূল কমিটির নেই। তারপরেও আমরা আমাদের সীমিত সাধ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। গত জানুয়ারিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটা শুনানি হলো। আমরা সরকারকে বলেছিলাম, কেবল দু'জনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেটাও করা হয়নি। আমাদের সরকার বহু ক্ষেত্রে বহু অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে যে অপতৎপরতা চলছে, তাকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেই।
সমকাল :তাহলে কি বিচারের ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক নয়?
শাহরিয়ার কবির :আমি সব সময় যেটা বলি যে, বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু বিচারের জটিলতা সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। তারা এই মামলাকে সাধারণ ফৌজদারি মামলার মতো মনে করেছে।
সমকাল : রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কী রকম?
শাহরিয়ার কবির :বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে_ আমরা কতগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করতে যাচ্ছি দেশীয় আইনে, দেশীয় বিচার ব্যবস্থায় এবং দেশের আদালতে। এটার কিন্তু বড় একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটাকে বাইরে যুক্তিযুক্ত করতে হবে। যখনই আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের কথা ওঠে, তখন সবাই বলে_ আন্তর্জাতিক আদালতে কেন বিচার হচ্ছে না, বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করবে না। কম্বোডিয়া যেমনটা করেছে, রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে হয়েছে, বসনিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। অন্যান্য দেশে যা হয়েছে, বাংলাদেশ কেন তা করছে না। বহু বার জাতিসংঘ থেকে সরকারকে চিঠি লিখেছে, বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করেছে, আর্বিট্রারি গ্রেফতারের অভিযোগ উঠেছেএ বাংলাদেশ এসবের জবাব দেয়নি। ফলে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে বলা হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ চিঠির কোনো জবাব দেয়নি, তাহলে ধরে নিচ্ছি অভিযোগগুলো সত্য। আমাদের কাছে জবাব ছিল, কিন্তু আমরা দেইনি কিংবা জবাব দেওয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা আমাদের স্পষ্ট নয়। আমরা মনে করছি, কোনো দেশের সরকার তো বিরোধিতা করছে না। ব্যক্তি বা সাংগঠনিক পর্যায়ে অভিযোগ এলে তার জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তো রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই।
সমকাল : কেউ কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের একটি গূঢ় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
শাহরিয়ার কবির :যারা এসব বলছেন, তারা হয় জ্ঞানপাপী, না হয় অন্ধ। এই বিচারের জন্য মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় আন্দোলন করছেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিঠি গঠন করেছি। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে একটা প্রবল জনমত সংগঠিত হয়েছে, যার প্রতিফলন আমরা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেখেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মহাজোট সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার; ৩০ লাখ শহীদের পরিবারের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা; মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা। পার্লামেন্টে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই বিচার স্থগিত করার ক্ষমতা মহাজোট সরকারের নেই।
সমকাল :এখন দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এতদিন কিছুটা রাখঢাক ছিল। হঠাৎ এত মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ কী?
শাহরিয়ার কবির :'৭১-এর যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ_ এসব জামায়াত দলগতভাবেই করেছিল। তারা জানে, আজ হোক কাল হোক, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার হবে। এটি আশঙ্কা করে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিচার কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াত যে কোনো চরম পন্থা অবলম্বন করতে পারে। ১৯৭১-এর মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার শরিক থেকে তারা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের নৃশংসতা, তাদের শক্তি।
সমকাল :কেউ কেউ বলেন, তারা আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে...
শাহরিয়ার কবির :শুধু নৈরাজ্যই নয়; বাংলাদেশকে তারা গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে রাস্তায় নেমে পুলিশের ওপর হামলা করা, এ ধরনের লাগাতার হামলা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমরা আগে দেখিনি। তারা একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করছে। দেখাতে চাইছে_ বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। এতে তাদের যে প্রধান শক্তি বিএনপি, তারাও বলার সুযোগ পাচ্ছে_ এই যে জামায়াতকে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব করছে। জামায়াতের এই ধরনের কাজ কেবল উস্কানিমূলক নয়, এটা বাইরে এ বার্তা পেঁৗছে দেওয়া যে, বাংলাদেশের মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমি এটা অশনি সংকেত বলে মনে করছি বাংলাদেশের জন্য; আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমের জন্য; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য তো বটেই।
সমকাল :কেউ কেউ জামায়াতের এই উগ্র আচরণের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাম্প্র্রতিক ভারত সফরের সম্পর্ক খুঁজছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
শাহরিয়ার কবির :সেটা হতে পারে। আরেকটা যেটা হতে পারে, তা হচ্ছে রামুর ঘটনা। রামুর ঘটনায় পুলিশ যেভাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিয়েছে, অভিযানে গেছে; প্রায় ৩শ'র মতো গ্রেফতার করেছে_ এটা জামায়াত আশা করেনি। জামায়াত জানত, কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন তাদের পক্ষে। কিন্তু কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরকার ক্লোজ করবে; তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে এবং তাদের কর্মীকে গ্রেফতার করবে_ এটা ভাবতে পারেনি এবং বিষয়টা তাদের শঙ্কিত করেছে। বাংলাদেশের যে কোনো জেলার তুলনায় কক্সবাজারে জামায়াত সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। প্রশাসন সেখানে আঘাত করেছে। তার জবাব দিতে জামায়াত এসব কর্মকা করছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যে কোনোভাবে এ বিচার জামায়াত বিলম্বিত করতে চায়। বানচাল করতে চায়।
সমকাল :আপনি কি চান জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হোক?
শাহরিয়ার কবির :আমরা তো গত ২০ বছর ধরে এ নিয়ে আন্দোলন করছি। ১৯৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা ের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই নিষেধাজ্ঞাটি তুলে নেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। কোনো বিবেকবান মানুষ ধর্মের নামে রাজনীতি, ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন সমর্থন করতে পারে না। মহাজোট সরকারের সুযোগ ছিল পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা মেনে নিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা। তারা সে পথে যায়নি। ফলে আজকে জামায়াত এতটা সহিংস হতে পেরেছে। সুযোগ রয়েছে এখনও '৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা।
সমকাল :দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
শাহরিয়ার কবির :২০১৪ সালের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, আমরা লক্ষ্য করছি জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের প্রধান সহযোগী মরিয়া হয়ে উঠেছে। জামায়াতের মতো বিএনপিও জানে, এই বিচার যদি সরকার সময়মতো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারে; শুধু জামায়াতের কোমর ভাংবে না, বিএনপির শক্তি অনেকখানি কমে যাবে। তারা চাইছে, নির্বাচনের আগেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটুক, যাতে স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাচন না হয়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর জন্য একটা বড় রকমের দৃষ্টান্ত। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা যে গৃহযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা চলছে, সে সম্পর্কে আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
সমকাল :আপনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। কোন পরিস্থিতি আপনাকে এই লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে?
শাহরিয়ার কবির :১৯৭১-এ ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা বাংলাদেশে চালানো হয়েছে। সেই হত্যার বিচার হবে না_ এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমি নিজেও শহীদ পরিবারের একজন সদস্য। আমার দুই ভাইকে আলবদররা হত্যা করেছে। আমরা যারা শহীদ পরিবারের সদস্য, তারা ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম রাজপথের মিছিল সংগঠিত করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত রাস্তায় আছি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে_ আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা কোন বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানিকরণ, ইসলামীকরণ, তালেবানিকরণ। এ জন্য ৩০ লাখ শহীদ জীবন দেয়নি। ৩০ লাখ শহীদের যে স্বপ্নের বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ আমাদের গড়তে হবে। সেজন্য এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির :সমকালের পাঠকদের শুভেচ্ছা।
সমকাল :যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কি সঠিকভাবে এগুচ্ছে বলে মনে করেন?
শাহরিয়ার কবির :বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা আরম্ভ করেছি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের চার দশক পর। পৃথিবীর কোনো দেশে এত পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। এত বছর পর বিচারের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, এর বেশির ভাগ সময় স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীরা ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা সুপরিকল্পিতভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের যত তথ্যপ্রমাণ বিভিন্ন নথিপত্রে ছিল, সেগুলো পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নষ্ট করে ফেলেছে। ফলে বিচার করার ক্ষেত্রে অনেক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ১৯৭২ সালে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; বঙ্গবন্ধু যাদের বিচার শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি_ এ রকম বহু তথ্যপ্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও আমি মনে করি, আমাদের ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়ে গত আড়াই বছরে যতটুকু করেছে, সেটা প্রশংসনীয়। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। ন্যুরেমবার্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য, সেখানে আমরা দেখেছি ১০ মাসের ভেতর বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর কারণ ছিল তাদের পর্যাপ্ত লোকবল ও রসদ। লোকবল এবং রসদের ঘাটতি আমাদের ট্রাইব্যুনালে প্রথম থেকেই ছিল। এখনও সেই ঘাটতি পুরোপুরি কাটেনি। ট্রাইব্যুনালে আরও দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের ট্রাইব্যুনালে গবেষণা সেল নেই; আইনজীবীদের সহকারী নেই। আমি এখনও মনে করি, যদি এই ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটতিগুলো পূরণ করা হয়, তাহলে ২০১৩ সালের মধ্যে যে ১০ জনের বিচার কাজ চলছে, তার রায় পাওয়া সম্ভব। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই বিচার বানচালের জন্য জামায়াতে ইসলামী দেশে ও দেশের বাইরে বহুমাত্রিক প্রচারণা চালাচ্ছে; বিচারের যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; যে আইনে বিচার হবে সেই আইন সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলছে; বিচারকদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; মিথ্যা বা অর্ধসত্য কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। শত শত কোটি টাকা খরচ করে তারা বিদেশে বহু লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সরকার এ অপতৎপরতা কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেনি। কোথাও কোথাও আমাদের রাষ্ট্রদূতরা কিছু কথা বলেছেন। তবে জামায়াতি প্রোপাগান্ডা মোকাবেলায় যে সার্বিক পরিকল্পনা দরকার, তা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এখনও দৃশ্যমান নয়।
সমকাল :পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
শাহরিয়ার কবির :পাকিস্তান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র এই বিচারের পক্ষে নয়। দৃশ্যত তারা সরকারিভাবে কোনো আপত্তি তোলেনি; কিন্তু আমেরিকা বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীকে মডারেট ইসলামী দল মনে করে। আমেরিকার নীতিনির্ধারকরা বহু বার বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তির বিচার হতে পারে, কিন্তু কোনো সংগঠনের বিচার করা যাবে না। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর বিচার যদি করা হয়, তাহলে সরকার বাইরে একটা ভুল সংকেত পাঠাবে। আমরা জানি, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার সরকার আমাদের বিপক্ষে ছিল, কিন্তু সেখানকার গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিক সমাজ আমাদের পক্ষে ছিল। সেটা বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে সম্ভব হয়েছিল। এবার তেমনভাবে সরকারি পর্যায় থেকে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। '৭১-এ যেসব ব্যক্তি, জামায়াতের যেসব শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়ি ছিল, তারা কেউ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ছিল না। তারা ছিল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা। তারা যাবতীয় অপরাধ করেছে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। জামায়াতে ইসলামীর একটা আদর্শ আছে, যেটাকে আমরা বলি মওদুদীবাদ। মওদুদীবাদ ইসলামের নামে, ধর্মের নামে হত্যা, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞকে উৎসাহ দেয়। জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের বিচার না হলে এখন যে বিচার চলছে, তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না। বিচার অপূর্ণ থেকে যাবে।
সৌদি আরব ও পাকিস্তান থেকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বন্ধুর অভাব নেই। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা যারা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছি, আমাদের যাদের বাইরে যোগাযোগ আছে তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা, আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা জরুরি। এগুলো সরকারকেই করতে হবে। জামায়াতের শত শত কোটি টাকার প্রোপাগান্ডা মোকাবেলা করার সামর্থ্য নির্মূল কমিটির নেই। তারপরেও আমরা আমাদের সীমিত সাধ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। গত জানুয়ারিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটা শুনানি হলো। আমরা সরকারকে বলেছিলাম, কেবল দু'জনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেটাও করা হয়নি। আমাদের সরকার বহু ক্ষেত্রে বহু অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে যে অপতৎপরতা চলছে, তাকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেই।
সমকাল :তাহলে কি বিচারের ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক নয়?
শাহরিয়ার কবির :আমি সব সময় যেটা বলি যে, বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু বিচারের জটিলতা সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। তারা এই মামলাকে সাধারণ ফৌজদারি মামলার মতো মনে করেছে।
সমকাল : রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কী রকম?
শাহরিয়ার কবির :বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে_ আমরা কতগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করতে যাচ্ছি দেশীয় আইনে, দেশীয় বিচার ব্যবস্থায় এবং দেশের আদালতে। এটার কিন্তু বড় একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটাকে বাইরে যুক্তিযুক্ত করতে হবে। যখনই আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের কথা ওঠে, তখন সবাই বলে_ আন্তর্জাতিক আদালতে কেন বিচার হচ্ছে না, বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করবে না। কম্বোডিয়া যেমনটা করেছে, রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে হয়েছে, বসনিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। অন্যান্য দেশে যা হয়েছে, বাংলাদেশ কেন তা করছে না। বহু বার জাতিসংঘ থেকে সরকারকে চিঠি লিখেছে, বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করেছে, আর্বিট্রারি গ্রেফতারের অভিযোগ উঠেছেএ বাংলাদেশ এসবের জবাব দেয়নি। ফলে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে বলা হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ চিঠির কোনো জবাব দেয়নি, তাহলে ধরে নিচ্ছি অভিযোগগুলো সত্য। আমাদের কাছে জবাব ছিল, কিন্তু আমরা দেইনি কিংবা জবাব দেওয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা আমাদের স্পষ্ট নয়। আমরা মনে করছি, কোনো দেশের সরকার তো বিরোধিতা করছে না। ব্যক্তি বা সাংগঠনিক পর্যায়ে অভিযোগ এলে তার জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তো রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই।
সমকাল : কেউ কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের একটি গূঢ় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
শাহরিয়ার কবির :যারা এসব বলছেন, তারা হয় জ্ঞানপাপী, না হয় অন্ধ। এই বিচারের জন্য মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় আন্দোলন করছেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিঠি গঠন করেছি। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে একটা প্রবল জনমত সংগঠিত হয়েছে, যার প্রতিফলন আমরা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেখেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মহাজোট সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার; ৩০ লাখ শহীদের পরিবারের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা; মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা। পার্লামেন্টে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই বিচার স্থগিত করার ক্ষমতা মহাজোট সরকারের নেই।
সমকাল :এখন দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এতদিন কিছুটা রাখঢাক ছিল। হঠাৎ এত মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ কী?
শাহরিয়ার কবির :'৭১-এর যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ_ এসব জামায়াত দলগতভাবেই করেছিল। তারা জানে, আজ হোক কাল হোক, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার হবে। এটি আশঙ্কা করে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিচার কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াত যে কোনো চরম পন্থা অবলম্বন করতে পারে। ১৯৭১-এর মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার শরিক থেকে তারা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের নৃশংসতা, তাদের শক্তি।
সমকাল :কেউ কেউ বলেন, তারা আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে...
শাহরিয়ার কবির :শুধু নৈরাজ্যই নয়; বাংলাদেশকে তারা গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে রাস্তায় নেমে পুলিশের ওপর হামলা করা, এ ধরনের লাগাতার হামলা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমরা আগে দেখিনি। তারা একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করছে। দেখাতে চাইছে_ বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। এতে তাদের যে প্রধান শক্তি বিএনপি, তারাও বলার সুযোগ পাচ্ছে_ এই যে জামায়াতকে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব করছে। জামায়াতের এই ধরনের কাজ কেবল উস্কানিমূলক নয়, এটা বাইরে এ বার্তা পেঁৗছে দেওয়া যে, বাংলাদেশের মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমি এটা অশনি সংকেত বলে মনে করছি বাংলাদেশের জন্য; আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমের জন্য; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য তো বটেই।
সমকাল :কেউ কেউ জামায়াতের এই উগ্র আচরণের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাম্প্র্রতিক ভারত সফরের সম্পর্ক খুঁজছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
শাহরিয়ার কবির :সেটা হতে পারে। আরেকটা যেটা হতে পারে, তা হচ্ছে রামুর ঘটনা। রামুর ঘটনায় পুলিশ যেভাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিয়েছে, অভিযানে গেছে; প্রায় ৩শ'র মতো গ্রেফতার করেছে_ এটা জামায়াত আশা করেনি। জামায়াত জানত, কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন তাদের পক্ষে। কিন্তু কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরকার ক্লোজ করবে; তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে এবং তাদের কর্মীকে গ্রেফতার করবে_ এটা ভাবতে পারেনি এবং বিষয়টা তাদের শঙ্কিত করেছে। বাংলাদেশের যে কোনো জেলার তুলনায় কক্সবাজারে জামায়াত সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। প্রশাসন সেখানে আঘাত করেছে। তার জবাব দিতে জামায়াত এসব কর্মকা করছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যে কোনোভাবে এ বিচার জামায়াত বিলম্বিত করতে চায়। বানচাল করতে চায়।
সমকাল :আপনি কি চান জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হোক?
শাহরিয়ার কবির :আমরা তো গত ২০ বছর ধরে এ নিয়ে আন্দোলন করছি। ১৯৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা ের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই নিষেধাজ্ঞাটি তুলে নেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। কোনো বিবেকবান মানুষ ধর্মের নামে রাজনীতি, ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন সমর্থন করতে পারে না। মহাজোট সরকারের সুযোগ ছিল পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা মেনে নিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা। তারা সে পথে যায়নি। ফলে আজকে জামায়াত এতটা সহিংস হতে পেরেছে। সুযোগ রয়েছে এখনও '৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা।
সমকাল :দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
শাহরিয়ার কবির :২০১৪ সালের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, আমরা লক্ষ্য করছি জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের প্রধান সহযোগী মরিয়া হয়ে উঠেছে। জামায়াতের মতো বিএনপিও জানে, এই বিচার যদি সরকার সময়মতো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারে; শুধু জামায়াতের কোমর ভাংবে না, বিএনপির শক্তি অনেকখানি কমে যাবে। তারা চাইছে, নির্বাচনের আগেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটুক, যাতে স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাচন না হয়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর জন্য একটা বড় রকমের দৃষ্টান্ত। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা যে গৃহযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা চলছে, সে সম্পর্কে আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
সমকাল :আপনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। কোন পরিস্থিতি আপনাকে এই লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে?
শাহরিয়ার কবির :১৯৭১-এ ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা বাংলাদেশে চালানো হয়েছে। সেই হত্যার বিচার হবে না_ এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমি নিজেও শহীদ পরিবারের একজন সদস্য। আমার দুই ভাইকে আলবদররা হত্যা করেছে। আমরা যারা শহীদ পরিবারের সদস্য, তারা ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম রাজপথের মিছিল সংগঠিত করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত রাস্তায় আছি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে_ আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা কোন বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানিকরণ, ইসলামীকরণ, তালেবানিকরণ। এ জন্য ৩০ লাখ শহীদ জীবন দেয়নি। ৩০ লাখ শহীদের যে স্বপ্নের বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ আমাদের গড়তে হবে। সেজন্য এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির :সমকালের পাঠকদের শুভেচ্ছা।
No comments