যে দেশে পুলিশও নিরাপদ নয় by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

রাজশাহীর জিরো পয়েন্টে সংঘর্ষের সময় পুলিশের এক সদস্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়েই তাকে পিটিয়েছে শিবিরের একজন কর্মী। রাজশাহীর জিরো পয়েন্টে ব্যাগে রক্ষিত রড ও লোহার পাইপ নিয়ে অতর্কিতে তিন পুলিশের ওপর হামলা চালায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা।


তারা পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও মোশারফের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে তাদের পেটাতে থাকে। একপর্যায়ে তারা একটি রাইফেল ভেঙে ফেলে। রংপুরে জামায়াত-শিবির ভাঙচুর করে পুলিশের পিকআপ ভ্যান। সিলেটের জিন্দাবাজারে জামায়াত-শিবির তিনটি অটোরিকশা, একটি মাইক্রোবাস ও দুটি দোকান ভাঙচুর করে। গ্রামে পুলিশের এক সদস্যকে লাঠি দিয়ে পেটায় শিবিরকর্মীরা। ভাঙচুর করে দুটি যানবাহন। নোয়াখালী শহরে সুধারাম থানার ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত) এবং ছয় পুলিশ সদস্যকে বেধড়ক পেটায় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। এক কনস্টেবলের শটগান ছিনিয়ে নিয়ে পাশের নর্দমায় ফেলে দেয়। এরপর জামায়াত-শিবির কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। এই ছিল ৬ নভেম্বর জামায়াত-শিবির কর্তৃক সহিংসতার কিছু খণ্ডচিত্র। ৭ নভেম্বরের প্রায় সব পত্রিকায় রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার ও পুলিশ পেটানোর চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। ৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার মজমপুর রেলগেট এলাকায় জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার এক পুলিশ সদস্যকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ৫ নভেম্বর বগুড়া, সাতক্ষীরা, নড়াইল, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও দিনাজপুরে জামায়াত-শিবির পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পাথর ও ইটপাটকেল ছোড়ে, লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা পুলিশের ওপর। বগুড়া শহরের সাতমাথা এলাকায় দুজন এসআইকে লাঠি দিয়ে বেদম পেটায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। নোয়াখালীতে একজন এসআইকে বেদম পিটিয়ে রাস্তার পাশে খালে ফেলে দেয় জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। সেখানে আরো তিন কনস্টেবলকেও পেটানো হয়। দিনাজপুরে বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে জখম করা হয় ছয় পুলিশ সদস্যকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে জামায়াত-শিবিরের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে তাদের নেতা-কর্মীদের দুই দিনের বেপরোয়া সহিংসতার খণ্ডচিত্রের কিছুটা ঠিক এ রকম। এর আগেও জামায়াত-শিবির বিভিন্ন সময় পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছিল। টিভি চ্যানেলে একবার দেখেছিলাম, এক শিবিরকর্মী কমান্ডো স্টাইলে কয়েক ফুট দূর থেকে ফ্লাইং স্টাইলে দুই পা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার বুকের ওপর সজোরে আঘাত করেছিল। এই দুই দিনের ঘটনায়ও তাদের সহিংসতার মধ্যে এক ভয়াবহতা এবং প্রশিক্ষণপ্রসূত শারীরিক যোগ্যতার প্রমাণ লক্ষ করা গেছে। তাদের কর্মকাণ্ডটি ছিল এবার পুলিশকে আক্রমণ করে পুলিশ প্রশাসনকে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করা। তাইতো একজন পুলিশ কর্মকর্তা যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তার পরও সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে তারা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে পিছপা হয়নি।
বিশ্বসমাজে যেকোনো দেশে সামাজিক এবং জনগণের নিরাপত্তা বিধানের প্রাথমিক ও বলিষ্ঠ হাতিয়ার সেই দেশের পুলিশ প্রশাসন। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। মানুষের নিরাপত্তার মূল দায়িত্বেই আছে পুলিশ। যে পুলিশকে অন্য সবার নিরাপত্তা প্রদান করার কথা, সেই পুলিশই আজ নিরাপদ নয় জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার কারণে। যেকোনো পুলিশ সদস্য এ দেশের জনগণেরই অংশ এবং তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টিও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের একটি অংশ। এর সঙ্গে আরো বাড়তি দায়িত্ব বৃদ্ধি পায় যখন সেই পুলিশ সদস্য কর্তব্যরত থাকে। একজন কর্তব্যরত পুলিশ অথবা সরকারি যেকোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক বেশি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্ববাহক বিষয়। কর্তব্যরত সরকারি কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলার অপরাধ অনেক বেশি গুরুতর একটি অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয়। অন্যদিকে পুলিশ সদস্যের অস্ত্র সরকারি সম্পত্তি। সেই অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধ আরো গুরুতর অপরাধ। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে এমন গুরুতর অপরাধজনিত কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেছে। এটা তাদের গোপন কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। এটা ছিল তাদের রাজনৈতিক একটি কর্মসূচির কর্মকাণ্ড। একটি রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে পুলিশকে পিটিয়ে মারছে, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে আর আমরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, সরকার, জনগণ, সুশীল সমাজ- সবাই তা চেয়ে চেয়ে দেখছি। আমরা দেখছি, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ প্রশাসনেরই নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত নেই। রাজনৈতিক একটি কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অন্তর্ভুক্ত কোনো রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ সমাবেশ হতেই পারে। তাদের দলের বিচারাধীন কোনো সদস্যের জন্য স্বীকৃত কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন তারা করতে পারে। কিন্তু সেই কর্মসূচির মাধ্যমে কর্তব্যরত পুলিশকে পেটানো, তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া, অস্ত্র ভাঙচুর করা, গাড়ি পোড়ানো ইত্যাদি সহিংস ঘটনা ঘটানোর আইনগত অধিকার কি সেই রাজনৈতিক দলটির আছে? ইতিমধ্যে আমরা পত্রিকায় দেখেছি, নির্বাচন কমিশন বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামী গঠনতন্ত্র সংশোধন এবং পরিবর্তন করে জমা দেয়নি আজ পর্যন্ত। বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সংঘাতময় গঠনতন্ত্র নিয়ে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করছে এবং নির্বাচন কমিশন বারবার তাগিদ দিচ্ছে তাদের গঠনতন্ত্রের যে অংশটুকু সংবিধানের সঙ্গে সংঘাতময় তা পরিবর্তন করতে। কিন্তু ওই রাজনৈতিক দলটি নির্বাচন কমিশনের তাগিদ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন করছে না। নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতাবলে এই গঠনতন্ত্রের অধিকারী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কি তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে? প্রশ্নটি এ দেশের জনগণ নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনকে করতে চাইতে পারে।
ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ রাস্তায় তাদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এর পর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং দেশের জনগণকে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা ঠেকানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
বর্তমান সরকারের প্রায় শেষ সময় উপনীত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের শেষটা এখনো কাছাকাছি আসেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের আসামি মূলত জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই। তাই তাদের রক্ষার স্বার্থে জামায়াত-শিবির দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে- এমনটা এ দেশের সব মানুষের ধারণার মধ্যেই আছে। কিন্তু সেই অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ না দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল সরকার ও পুলিশের। এর পরিবর্তে পুলিশ তাদের কাছে অসহায়- এই বার্তা যদি জনগণের কাছে পেঁৗছে যায়, তাহলে ক্ষতি হবে সরকারের, ক্ষতি হবে এ দেশের সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারার। পুলিশকে লাথি মারা যায়, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া যায়, পুলিশকে পিটিয়ে অজ্ঞান করা যায়- এমন বার্তায় জনগণ সরকারের ওপর ভরসা হারাতে পারে। প্রশ্ন হলো, পুলিশ কেন পড়ে পড়ে মার খেল? পুলিশ কেন শুধু কাঁদানে গ্যাস ছেড়েই বসে রইল? যেখানে পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে, সেখানে পুলিশ কি আত্মরক্ষারও যোগ্যতা রাখে না? দেশ আজ এক মহা পরীক্ষার সম্মুখীন। দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ থাকবে কি থাকবে না, জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবলীলায় আজ তা জাতির সামনে এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সরকারকে, পুলিশকে তাদের পরবর্তী কাজের মাধ্যমে। পুলিশ এতখানি অসহায় হলে জনগণ কাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে? সরকারকে আজ তা গভীরভাবে ভাবতে হবে। তাই শুধু বিবৃতির মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সঙ্গে সঙ্গে এমন তাণ্ডবলীলার জন্য দায়ী জামায়াত-শিবিরের প্রতি গভীরভাবে তাকাতে হবে এ দেশের সব রাজনৈতিক, পেশাজীবী আর সুশীল সমাজকেও। একযোগে তাদের প্রতিহত করার অভিন্ন নীতিতে পাশাপাশি হাঁটতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, সহিংসতা বন্ধ করার কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকর্মীদের নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মীদের এহেন আহ্বানে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেবে এবং দেশ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মতো হুমকির মুখে পড়বে। ঘটনা ঘটার আগেও নয়, এমনকি ঘটনা ঘটার পরও নয়- অর্থাৎ কোনো সময়ই যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহিংসতা ঠেকানোর সামর্থ্য না রাখে এবং সেই সহিংসতা থামানোর জন্য সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হয়, তবে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে অস্বাভাবিক পথেই যেতে পারে- এমনটা খুব সহজেই বলা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে এবং পুলিশ প্রশাসনের দুর্বলতাও খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর পরিবর্তে অশান্ত পরিস্থিতি আরো অশান্ত করার আত্মঘাতী পরিকল্পনা বা ঘোষণা দিলে তা হবে সবার জন্যই দুঃখজনক। সেই সঙ্গে ১৮-দলীয় জোট, বিশেষভাবে বিএনপিকে নতুন করে জামায়াত সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং জোট বাঁধার ব্যাপারে গভীরভাবে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। দেশের নিরাপত্তার বৃহত্তর স্বার্থে বিরোধী দলের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাজনৈতিক দায়িত্ব আছে। সেখানে ভুল করলে এর জন্য তাদের রাজনৈতিকভাবেই দায়ী থাকতে হবে জনগণের কাছে। বিষয়টি হালকাভাবে না দেখে বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে হবে তাদের এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের এটাও ভাবতে হবে, পুলিশ কোনো দলের বাহিনী নয়- তারা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভবিষ্যতে বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে তাদেরও পাশে রাখতে হবে এই পুলিশ প্রশাসনকেই। তাই জাতীয় প্রতিষ্ঠান এই পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা, স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টি সরকারের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও দায়িত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.