বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৬৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবু তাহের, বীর উত্তম অকুতোভয় এক বীর যোদ্ধা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনা-বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটির কাছাকাছি পরিখা খনন করে অবস্থান নেন।


তাঁদের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন আবু তাহের। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় শেষ রাতে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয় চারদিক। তাঁর সহযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেন। সমানতালে যুদ্ধ চলে।
আবু তাহের কামালপুরের উত্তরে বর্ডার লাইনে তেঁতুলগাছের কাছে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। সকালের দিকে যুদ্ধের তীব্রতা কিছুটা কমে যায়। এ সময় যুদ্ধক্ষেত্রের অগ্রভাগ থেকে একজন উপদলনেতা তাঁকে জানান, তাঁরা পাকিস্তানি দুর্গের প্রায় ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। বিজয় প্রায় হাতের মুঠোয় ভেবে তিনি দ্রুত সামনে যান।
তখন আনুমানিক সকাল নয়টা। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি শেল পড়ে আবু তাহেরের ঠিক সামনে। শেলের বড় এক স্প্লিন্টার লাগে তাঁর পায়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিন-চারজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। আশপাশে ছিলেন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা দ্রুত এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর। কামালপুর জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত। মুক্তিযোদ্ধারা আবু তাহেরের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মূল প্রতিরক্ষায় ঢুকে পড়েন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মাইন ও গুলির আঘাতে হতাহত হন। শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে তাঁর একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু একটু চামড়ার সঙ্গে ঝুলে ছিল। পরে তাঁকে ভারতের গৌহাটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
আবু তাহের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নে (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) চাকরি করতেন। ১৯৭০ সালে আমেরিকার ফোর্টব্রাগ ও ফোর্টবেনিং থেকে তিনি সমরবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) অ্যাবোটাবাদে। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি ভারতে যান।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর তাহেরকে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি সেক্টরটিকে ঢেলে সাজান। তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ১১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর একের পর এক আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানিরা তটস্থ হয়ে পড়ে।
এখন জানা যাক আবু তাহেরের নিজ বয়ানে (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্ধকালের কিছু কথা। ‘মুক্তিবাহিনীর প্রধানের নির্দেশে আগস্টের ১২ তারিখে আমি মেঘালয়ে পৌঁছাই। ওই এলাকার মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে আগে থেকেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের মস্ত ঘাঁটি। সিদ্ধান্ত নিলাম কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের।
‘১৫ আগস্ট আমি নিজে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের অস্ত্র বলতে ছিল এলএমজি, রাইফেল এবং কিছু স্টেনগান। আক্রমণ দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। আমাদের আক্রমণে ১৫-১৬ জন পাকিস্তানি হতাহত হয়।
‘এর আগে এই এলাকা কোনো সেক্টরের আওতায় ছিল না। আমি মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে এই এলাকাকে একটি সেক্টরে পরিণত করার কথা জানাই। সেটা মঞ্জুর হয়। সেক্টরের নাম হলো ১১ নম্বর সেক্টর। কমান্ড আমাকেই দেওয়া হলো।
‘যুদ্ধক্ষেত্রে আমি নিয়মিত ও গণবাহিনীকে একত্রে অপারেশনে পাঠিয়েছি। আমি মনে করতাম, নিয়মিত ও গণবাহিনীকে পৃথক করে ফিল্ড অপারেশনে পাঠানো ঠিক নয়। অল্প দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পৃথকভাবে ফিল্ডে পাঠালে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে থাকলে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করত, সেটা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। এ কারণে আমি একটি মাত্র ফোর্স করলাম।
‘১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে আমি একটা জিনিস দেখে বারবার অবাক হয়েছি। প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মতো হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হতে না পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর যুবশিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেওয়ার ডাক আসে।’
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় আবু তাহেরকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০৯।
আবু তাহের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় তিনি আটক হন। পরে সামরিক আদালতের বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আবু তাহেরের পৈতৃক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মহিউদ্দিন আহমেদ, মা আশরাফুন নেছা। স্ত্রী লুৎফা তাহের। তাঁদের এক মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.