রাজনীতি-হিনা রব্বানির প্রতিধ্বনি শুনি অন্যত্রও by অনিরুদ্ধ আহমেদ

পাকিস্তানের চৌকস তরুণী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানির উদারতার বিষয়ে যে একটা প্রায় কিংবদন্তিতুল্য আশাবাদ রয়েছে, তার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ তার বয়স। সে জন্য অনেকেই আশা করেছিলেন যে,


হিনা তার পূর্বতন বয়োবৃদ্ধ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের চেয়ে অনেকখানি ভিন্ন ধাঁচের মানুষ হবেন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনবেন। তার অতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় সে জন্যই প্রত্যাশা ছিল যে, তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির আহ্বানের উত্তরে যে জবাবটা দেবেন, তাতে তার সুশীল আচরণের পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক এবং সামরিক বাহিনী বাঙালিদের প্রতি যে আচরণ করেছিল; যে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন চালিয়েছিল, তার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার যে আহ্বান জানান দীপু মনি, সে বোধ করি খুব বড় বেশি চাওয়া নয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান এবং পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের জন্য এ যে অত্যন্ত সামান্য দাবি_ সে কথা হিনা রব্বানি বুঝবেন কী করে! এই আবেগের বিষয়টি ছাড়াও দীপু মনি অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টিও যথার্থভাবে উত্থাপন করেছিলেন। এ দুটি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি বাংলাদেশের মানুষকে অতীত ভুলে গিয়ে সামনে চলার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাকে বাহ্যত বিজ্ঞজনোচিত মনে হলেও তিনি যে বাংলাদেশের এই দাবিগুলোকে কার্যত অগ্রাহ্য করেছেন_ সেটি বেশ বোঝা গেছে। তবে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথাটি বেমালুম ভুলে গেছেন সেটি হলো অতীত ভুলে গেলে, যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিও ভুলে যেতে হয়। পাকিস্তানের অস্তিত্ব তখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। অতীত ভুলে গেলে তো পাকিস্তানকে কাশ্মীরের দাবিও ভুলে যেতে হয়। হিনা রব্বানী কি এতটা বিস্মৃতির পথে তার দেশকে নিয়ে যাবেন?
স্পষ্টতই বুঝতে পারি, হিনা রব্বানি যে সময়ে স্কুলে পড়েছেন, আশির দশকে, তখন কিংবা এখনও পাকিস্তানের ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে একাত্তর প্রায় অনুপস্থিত। একাত্তরের যেটুকু উল্লেখ আছে, সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনুপস্থিত। সেখানে কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের কথা আছে। আছে ভারতের কাছে পূর্ব পাকিস্তান হারানোর আফসোস। সেখানে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এমনকি নব্বইয়ের দশকে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে নিয়াজি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কি আদৌ কোনো মুসলমান আছে এখনও! হিনা রব্বানি সে রকম জ্ঞানপাপী নন। তিনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও একাত্তরের ইতিহাস পড়েছেন পত্রপত্রিকায়। জাতীয় না হোক, আন্তর্জাতিক বিবরণও পড়ে থাকতে পারেন সেই গণহত্যার। তবু তিনি অতীতমুখী হতে রাজি নন। কারণ সেই অতীত তার সেই রাষ্ট্রের মুখোশ উন্মোচন করে দেবে, যার প্রতিনিধিত্ব তিনি করছেন।
দুই.
এ তো কেবল হিনা রব্বানির কথা নয়; বস্তুত তার বয়সের কিংবা তার কাছাকাছি বয়সের এমন অনেক তরুণ-তরুণী আছেন খোদ বাংলাদেশে, তারাও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুললে বলেন, অতীতের কথা বলে কী হবে? অতীতের কথা বলা যে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা_ সে কথা যারা মনে করেন, তারা নিজের অস্তিত্বকেই কার্যত অস্বীকার করে বোকার স্বর্গে বসবাস করেন। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কিন্তু চলছে বহুদিন ধরে। বিশেষত ১৯৭৫-পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, জাতীয় চার নেতার হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ওই অধ্যায়টি মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল, যার নাম মুক্তিযুদ্ধ। সুতরাং একজন পাকিস্তানি কূটনীতিক হিসেবে হিনা রব্বানি সহজেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যার বিষয়টি এবং এ ব্যাপারে তিনি ভুট্টো-জামাতা জারদারির কাছে বোনাস পয়েন্টও পেতে পারেন। তাই তার এই নির্দেশনামূলক বক্তব্য যতটাই অগ্রহণযোগ্য এবং ইতিহাসের প্রতি যতটাই অবিচার হোক না কেন, তাকে যতটা ক্ষমা করা যেতে পারে, সেভাবে ক্ষমা করা যায় না সেসব কথিত বাঙালিকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে বলেন_ অতীত নিয়ে কেন এত মাতামাতি! এ যেন হিনা রব্বানিরই প্রতিধ্বনি; যেন ইতিহাসকে এড়িয়ে যাওয়া পাকিস্তানিদের প্রবণতারই আরেক নাম। সে জন্য যখন দেখেছি তারেক রহমান আর মতিউর রহমান নিজামী একই মঞ্চে বসে আলোচনা করছেন, কিংবা নিজামী বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রীর গাড়িতে যাচ্ছেন, তখন বুঝতে পারি, ইতিহাস এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিস্ময়কর এক ঘৃণ্য চেষ্টা। আর তারও বেশ আগে বলতে হবে, ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস হলো, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, যিনি বাঙালির কাছে তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা, বেতারে যার ঘোষণায় সাধারণ মানুষ হয়েছিল উজ্জীবিত, সেই জিয়াউর রহমান ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ রক্ষার্থে স্বাধীনতাবিরোধীদের করলেন তার একান্ত সহচর। যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিলেন বিনা শর্তে। বঙ্গবন্ধু বিষয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেন ধুরন্ধর এই সেনা-রাজনীতিক। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সেই যে বিভাজন রচনা করলেন তিনি রাজনীতিকে কঠিন করার নামে; সেই থেকে বিভাজিত রয়ে গেল জাতি। রয়ে গেলেন রাজনীতিকরাও। সে জন্যই আজকের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ, কি রাজনীতিক, কি বুদ্ধিজীবী, কি সংবাদমাধ্যম_এই অনাকাঙ্ক্ষিত মেরুকরণের জন্য প্রয়াত জেনারেল জিয়াকে দায়ী না করে উপায় নেই।
তবে কেবল জিয়া নন; সত্তর কিংবা আশির দশকের গোড়ার দিকে জন্ম একদল তরুণ-তরুণী এখনও এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাসের সম্মুখীন। এ রকমই এক তরুণ-তরুণীর মধ্যে ফেসবুকে রাজনৈতিক মতবিনিময় চলছিল। তরুণটি তরুণীর চেয়ে অধিকতর উদার; কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি, পড়াশোনা করতে বিদেশে এসেছেন; গবেষণা শেষে মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে যাবেন বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না; যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া শিক্ষা ছুটি ভোগ করে বেতন নিয়েছেন পুরোদমে। তরুণীটিও দেশজ কৃষ্টির চর্চা করেন, কিন্তু অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে দেশে ফিরবেন_ এ রকম মনে হয় না। বরং দেশে ফিরতে চান এমন এক পাত্রের প্রস্তাব পত্রপাঠেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে করেন না_ বাংলাদেশে মানুষ বাস করেন; দুই নেত্রীকে একই পাল্লায় মাপেন এবং এদের প্রসঙ্গ তুললে কটূক্তি করতে দ্বিধাবোধ করেন না, রাজনৈতিক সৌজন্যের পরোয়া না করেই। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, শিবিরের সহিংসতাকে তিনি ছোট করে দেখছেন, সোনার ছেলেদের সহিংসতার তুলনায়। সোনার ছেলে মানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছেলেদের তিনি বুঝিয়েছেন।
তিন.
সত্য বটে, সরকার-সম্পৃক্ত এসব ছাত্র ও যুবগোষ্ঠীর সহিংসতা তীব্র সমালোচনার দাবি রাখে এবং এদের অপরাধ কোনোক্রমেই মার্জনীয় নয়। কিন্তু যখন তিনি সোনার ছেলে শব্দযুগল ব্যবহার করেন, তখন সম্ভবত তিনি বঙ্গবন্ধু ব্যবহৃত সোনার ছেলে শব্দটি তীব্র ব্যঙ্গাত্মকভাবেই প্রয়োগ করছেন। পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে এ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক প্রয়োগ সমালোচনার দাবি রাখে। বঙ্গবন্ধু যে ছাত্রলীগের ছেলেদের সোনার ছেলে বলে অভিহিত করেছিলেন, সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদানের জন্যই। প্রেক্ষাপট না জেনে এই শব্দের ব্যবহার যে বস্তুত বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননা_ সেটি এই তরুণী অনুভব করেননি। তবে মুক্তিযুদ্ধের একটা অনুভূতি এই তরুণ শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে। তিনি যখন বলেন, শেখ সাহেব কিংবা তার চার নেতা, এদের যে ক্যারিশমা বা অন্তত জিয়ারও যে ক্যারিশমা ছিল, এরপর তো সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেল..., তখন মেয়েটি শেখ সাহেব কিংবা তার চার নেতার প্রশংসা না করেই ছোট্ট করে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এই অনীহা দেখে চৌকস এই ছেলেটি বুঝে গেলেন, মেয়েটির ফেসবুক বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হলে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। অন্য এক বন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের জেলহত্যা সম্পর্কে তাজকন্যার একটি চমৎকার লেখা পোস্ট করেছিলেন মেয়েটির ফেসবুক দেয়ালে। দ্রুতই তিনি সেটি মুছে দিলেন। বাঙালি তারুণ্য যদি এই হীনম্মন্যতায় ভোগে, তাহলে হিনার আর দোষ কোথায়! তিনি তো পাকিস্তানের স্বার্থই রক্ষা করবেন। আফসোস শুধু এটুকু যে, গত কয়েক দিন ধরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে পুলিশের ওপর যে আচমকা হামলা চালাচ্ছে, তার সমালোচনা করতে ব্যর্থ হলেন প্রবাসী এই তরুণ-তরুণী। তবে আশার কথা এটুকু, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়। চায় সামনে এগিয়ে যেতে। ইতিহাসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চায়। কিন্তু ভবিষ্যৎকে সোৎসাহে বরণও করতে চায়। তারা মনে করে না কোনোক্রমেই
যে, বিগত দিনগুলো আগত দিনগুলোর
বৈরী পক্ষ।

অনিরুদ্ধ আহমেদ :যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার

No comments

Powered by Blogger.