চেম্বার নির্বাচন নিয়ে সংশয় by একরামুল হক

চট্টগ্রাম চেম্বার নির্বাচন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। নির্ধারিত সময় ৬ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান নাও হতে পারে। কারণ, প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা সংশোধন করার আদেশ দিয়েছে আদালত।


বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের সালিসি আদালত (আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল) ভোটার তালিকার অসংগতি দূর করে চূড়ান্ত তালিকা করতে নির্দেশ দেন।
চট্টগ্রাম চেম্বার নেতারা জানান, ছয় হাজার ৩৭১ ভোটারের কর শনাক্তকরণ নম্বর হালনাগাদ আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগবে। ফলে আগামী ৬ ডিসেম্বর চেম্বার নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে বলে তাঁরা মনে করছেন।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার সালিসি আদালতে শুনানি শেষে ছয় হাজার ৩৭১ জনের কর শনাক্তকরণ নম্বরের হালনাগাদ আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে আদেশ দেওয়া হয়। সালিসি আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এম এ কাশেম। আদেশে ভোটার তালিকায় বিকল্প প্রতিনিধি, মৃত ব্যক্তি, একই কর শনাক্তকরণ নম্বরে একাধিক ভোটার—এসব অসংগতি রয়েছে বলে সালিসি আদালতের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয়। বাণিজ্য সংগঠন বিধি-১৯৯৪-এর আলোকে এসব অসংগতি দূর করতে নির্দেশনা দেওয়া হয় চট্টগ্রাম চেম্বারকে।
গত বৃহস্পতিবার ভি মার্ক ফ্যাশন ওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদ উল্লাহ এবং বনলতা ট্রেডার্সের মালিক জসিম উদ্দিন পৃথকভাবে ভোটার তালিকায় অনিয়ম নিয়ে সালিসি আদালতে অভিযোগ দাখিল করেছিলেন। এতে প্রতিপক্ষ করা হয় চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি, নির্বাচন বোর্ডের সভাপতি এবং নির্বাচন আপিল বোর্ডের সভাপতিকে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের নির্বাচনে প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অর্ডিনারি গ্রুপে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ভোটারসহ এক হাজার ৭৫৬ এবং এসোসিয়েট গ্রুপে ৯৫১ জন বিকল্প প্রতিনিধি রয়েছে। একই কর নম্বরে অনেক ভোটার রয়েছে। মৃত ব্যক্তিকেও ভোটার বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের আদেশ বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম চেম্বারের ভোটার তালিকা প্রণয়নে স্বচ্ছতা আসবে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ভোটার হবেন এবং তাঁরা তাঁদের নেতা নির্বাচন করবেন।
নাম প্রকাশ না করে চেম্বারের একজন পরিচালক জানান, চেম্বারের নেতৃত্ব প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাছে নেই। ১৬ বছর ধরে একটি গোষ্ঠী চট্টগ্রাম চেম্বারকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, যে কারণে মেট্রোপলিটন চেম্বার গঠিত হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। এটা আসলে চট্টগ্রামের বনেদী ব্যবসায়ীদের জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার।
তবে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মো. হাবিবুল হক এই আদেশের সঙ্গে একমত নন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোটার তালিকা করার পর জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কারও কোনো আপত্তি আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কেউ এ ব্যাপারে সাড়া দেননি। হঠাৎ করে আদালতে যাওয়া নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আমরা বসে তাঁর সিদ্ধান্ত কী সেটা জেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।
চট্টগ্রাম চেম্বার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম এবং আগের মেয়াদের সভাপতি ও সাংসদ এম এ লতিফের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়।
এতে তাঁদের দীর্ঘদিনের সখ্য ভেঙে যায় বলে জানান চেম্বারের সসস্যরা। একপর্যায় মোরশেদ মুরাদ সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তাঁর সমর্থন আদায় করেন।

তিনি এত দিন চুপ ছিলেন কেন?
এম এ লতিফ
সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম চেম্বার

প্রথম আলো: বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের সালিসি আদালত ভোটার তালিকা সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
এম এ লতিফ: ভোটার তালিকায় যে অসংগতি দূর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান চেম্বার সভাপতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংশোধন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে এখন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতির প্রতিনিধিও সালিসি আদালতের শুনানিতে এই সংশোধনের পক্ষে একমত পোষণ করেছেন। মূলত নির্বাচন তাঁর প্যানেলের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা না দেখেই মাঝপথে উল্টে গেছেন তিনি।
প্রথম আলো: প্রচার আছে, সংশোধন করা হলে আপনার সমর্থিত ‘ভোটব্যাংকে’ প্রভাব পড়বে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
এম এ লতিফ: সংশোধন করা হলেও আমার সমর্থিত প্যানেলের কোনো সমস্যা হবে না। আমি সব সময় ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পক্ষে। সরকারি কর্মকর্তাদের হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম এবং আছি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা কার পক্ষে আছে সেটি নতুন করে বলার দরকার হয় না।
প্রথম আলো: মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম বলেছেন, চট্টগ্রাম চেম্বার দীর্ঘদিন একজনের হাতে জিম্মি ছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে এটি সংস্কার করে চেম্বার ব্যবসায়ীদের হাতে ফেরত দেওয়ার কথা বলছেন তিনি। আপনাকে ইঙ্গিত করে এসব কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
এম এ লতিফ: ১৬ বছর যদি চেম্বার কোনো চক্রের কাছে জিম্মি থাকে তাহলে মোরশেদ মুরাদ এতদিন চুপ ছিলেন কেন? তিনি তো দুই বছর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ১৬ বছরের মধ্যে একে একে সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সরওয়ার জামাল নিজাম, এস এম আবুল কালাম, ফরিদ আহমদ চৌধুরী, আমীর হুমায়ুনসহ আরও অনেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা কি সবাই এক পরিবার থেকে এসেছেন? আমাকে ইঙ্গিত করে যদি এমন বক্তব্য দেওয়া হয় তাহলে আমি একাই ১৬ বছর ধরে চেম্বারের সভাপতি থাকতাম। আর যারা এত দিন চেম্বার পরিচালনা বোর্ডে ছিল তাঁরা কি ব্যবসায়ী নন?।
প্রথম আলো: আপনারা দুজনেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু কেন নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে আলাদা হয়ে গেলেন।
এম এ লতিফ: আমি আলাদা হতে চাইনি। এ ব্যাপারে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম চেষ্টা করেছিলেন। আমি সেই সমঝোতায় সায় দিয়েছিলাম। কিন্তু মোরশেদ মুরাদের অনড় অবস্থানে সেটি ভেঙে যায়।

চেম্বার একটি চক্রের কাছে জিম্মি
মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম
সভাপতি, চট্টগ্রাম চেম্বার

প্রথম আলো: বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের সালিসি আদালত ভোটার তালিকার অসংগতি দূর করে চূড়ান্ত তালিকা করতে নির্দেশ দেওয়ায় ৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আপনি কি তা-ই মনে করেন?
মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম: ছয় হাজার ভোটারের কর শনাক্তকরণ নম্বর ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের ২৭ নভেম্বরের মধ্যে কাজটি করে দিতে বলেছে। কিন্তু এত স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজটি করা দুরূহ ব্যাপার। তাই ৬ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে।
প্রথম আলো: চেম্বারের নির্বাচন নিয়ে আপনার সঙ্গে আগের সভাপতি ও সাংসদ এম এ লতিফের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির বিষয়টি এখন স্পষ্ট। আপনি সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সহায়তা চেয়েছেন। কিছুদিন আগেও তাঁর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। হঠাৎ করে তাঁর কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য কি?
মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম: আসলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে যে বিবৃতি যায়, সেটা আমি প্রস্তুত করিনি। ওই বিবৃতি আমার নামে গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো হলেও এর সঙ্গে আমার ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক ছিল না। মহিউদ্দিন চৌধুরী আমার বাবার বয়সী। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। উনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক চমৎকার। তাঁর বাসায় যাওয়ার পর তিনি আমাকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রাখেন। উনি বুঝতে পেরেছেন ওই বিবৃতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। আমি কেবল ঘটনার শিকার হয়েছি। চেম্বারের পরের নির্বাচনে আমি তাঁর নৈতিক সমর্থন চেয়েছি। তিনি আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রথম আলো: কে ওই বিবৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যে কারণে আপনি ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে এখন বলছেন?
মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম: কে প্ররোচিত করেছেন, সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? কারা ১৬ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম চেম্বারকে নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করছেন—সেটা তো সবাই জানেন। তাঁর নাম না-ই বললাম। আপনারা বুঝে নেবেন। তবে এই চক্র থেকে চট্টগ্রাম চেম্বারকে রক্ষা করতে হবে। আসল ব্যবসায়ীদের হাতে চেম্বারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। এ জন্য আমি ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের নাগরিকের সহযোগিতা চাই।

No comments

Powered by Blogger.