রাজনীতি-নূর হত্যাকাণ্ড এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ by মোহীত উল আলম

একবার একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগাত্রে চিকা দেখেছিলাম, ‘একটা সন্ত্রাস শুধু আরেকটা সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে।’ এ চিকাটার কথা মনে পড়ল, যখন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় ৮ অক্টোবর শুক্রবার মধ্যাহ্নের সামান্য আগে উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও বনপাড়া পৌরসভা বিএনপির সভাপতি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় নেতা


সানাউল্লাহ নূর নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা ভাবছিলাম। তখন (১২ অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল) গাড়ির চালক আমাকে জানালেন যে তাঁর বড় জামাতার বড় ভাই চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, যুবলীগের নেতা মিজানুর রহমানকে (৪৪) মঙ্গলবার মধ্যরাতে (১২টা ৪৫ মিনিট) তাঁর বাসগৃহের দরজা ভেঙে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। সামনে তিনি উপজেলা নির্বাচনের পদপ্রত্যাশী ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তর্কোন্দল থেকে তাঁকে হত্যা করা হয়।
৮ থেকে ১২—মাত্র চার দিনের মধ্যে দুজন মফস্বলবাসী নেতা খুন হয়ে গেলেন। এতে বোঝা যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
যা হোক, পত্রপত্রিকার মারফত জানা গেল, জীবনানন্দের বনলতা সেনের নাটোরের এ উপজেলাটি কয়েক বছর ধরে রক্তাক্ত রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ হয়ে আছে। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরাজমান বিরোধের ফলস্বরূপ নূরকে হত্যা করা হয়।
২০০২ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বড়াইগ্রাম স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আলম মোল্লা নিহত হন। বিএনপি এর জন্য আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে। আলমের মৃত্যুর ১৯ ঘণ্টা পর বড়াইগ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. আয়নাল হক তালুকদারকে বিএনপির কর্মীরা তাঁর চেম্বার থেকে টেনেহিঁচড়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মেরে ফেলে। এ দুই মৃত্যুর পর থেকে বড়াইগ্রামে রাজনৈতিক ভ্যান্ডেটার বা প্রতিশোধ-স্পৃহার সংস্কৃতি চলে আসছে বলা যায়।
কিন্তু নূরের মৃত্যুর পেছনের প্রতিহিংসার রাজনীতির এ ইতিহাস বিবেচনা অকার্যকর হয়ে যাবে যেহেতু তিনি বিএনপির নেতা ছিলেন। প্রতিটি রাজনৈতিক খুনের একটি দুঃখজনক পরিণতি হলো, ঘটনাটি অত্যন্ত শোকাবহ হলেও সচরাচর সেটা বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন এ মুহূর্তে বিরোধী দল সরকারকে দুই দিনের একটা সময়সীমা বেঁধেও দিয়েছে। সিরাজগঞ্জের জনসভায় বিরোধী দলের নেত্রী বলেছেন, ‘এখন আর শোকসভা নয়, চলবে প্রতিরোধ।’
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, নূরের হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। কারণ, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। তা ছাড়া আদালতের রায়ের ফলে পঞ্চম সংশোধনী অকেজো হয়ে গেলে দেশ বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে কার্যত কোনো বাধা থাকে না। অথচ এ সময়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসমনস্ক নেতা-কর্মীরা এমন বিপজ্জনক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন যে, এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পর্যন্ত নাভিশ্বাস উঠছে।
নূর হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তা পত্রপত্রিকা ও ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে জনসমক্ষে এসেছেন এবং দেখা যাচ্ছে সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নেতা-কর্মী বিএনপির মিছিলে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের এ কাজের দ্বারা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষতিটা কত বড় হলো, তা এ হামলাকারীরা অনুধাবনই করতে পারলেন না। এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি দেওয়া যায় লিও টলস্টয়ের উপন্যাস রিসারেকশান-এ সে রকম একটা কথা আছে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বাইরে থেকে মনে করি, চোর নিজেকে ধিক্কার দেয় না কেন? বা বেশ্যা নিজেকে ঘৃণা করে না কেন?’ টলস্টয় বলছেন, সমাজের মানুষ, তার যে পেশাটাই হোক না, সেটা নিয়ে তার পেশার লোকদের মধ্যে তার একটা অবস্থান আছে। সেখানে তার একটা হয়তো যা হোক মর্যাদা আছে এবং সে কারণে তার একটা আত্মতৃপ্তিও যেমন থাকে, থাকে অহমিকা বোধও। তার পেশার বৃত্তে এ অবস্থানের স্বীকৃতি এবং অহমিকা বোধের অস্তিত্ব তাকে বাঁচিয়ে রাখে। সে জন্য সে জীবন আত্মাহুতি দেয় না।
এমন মনস্তত্ত্ব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে একেবারে থাকে না, তা নয়। যেমন ধরুন, বড়াইগ্রামের চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর খুবই জনপ্রিয় লোক ছিলেন। তাঁর দু-দুটো জানাজায় সমাগত লোকের সংখ্যা দেখে সে ধারণা নিশ্চিত করা যায়। রাজধানীতে বসে মনে হবে, এ আর এমন কি ব্যাপার! সামান্য উপজেলার চেয়ারম্যান বৈ তো নয়। অথচ নূরকে মারার টার্গেট করেই জাকির হোসেনের নেতৃত্বে হামলাটি হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পত্রিকায় এসেছে। অর্থাৎ নূরের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বাইরে থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও বড়াইগ্রামের প্রেক্ষাপটে রাজধানীর কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজধানীতে যে অবস্থান, নূরেরও ঠিক সে রকম অবস্থান ছিল। সেখানে তাঁকে মেরে ফেলা এ জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যে, তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর প্রতিপক্ষ সুবিধা করতে পারে না। এটাও হয়তো হামলাকারীদের মনে আসতে পারে যে, যে দল সরকারে আছে, তার সমর্থক-নেতা উপজেলার চেয়ারম্যান না হয়ে অন্য দলের থাকে কী করে? ওপরে কথিত টলস্টয়ের নিম্ন পেশার লোকদের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মনস্তত্ত্বের মিলটা এখানে: উভয় গ্রুপ নিজেদের অবস্থানকে অতিশয় মূল্য দেয়।
টলস্টয়ের চিন্তাটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাই। ফরাসি সমাজবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিশেল ফুকো সরকারি দলের ক্ষমতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, ক্ষমতার বিস্তৃতি এবং নিয়ন্ত্রণ হয় ক্ষমতার বিভিন্ন উপকেন্দ্র, তস্য উপকেন্দ্র তৈরি করার মাধ্যমে। ঢাকা যদি ক্ষমতার প্রধানকেন্দ্র হয় তা হলে বড়াইগ্রাম হবে ক্ষমতার একটি ক্ষুদ্র কিন্তু প্রয়োজনীয় কেন্দ্র। বড় কেন্দ্রের সঙ্গে ছোট কেন্দ্রগুলোর যে রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকে, সেটাই একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার জালের প্রকৃতি নির্মাণ করে। অর্থাৎ টলস্টয়ের চিন্তার সঙ্গে যদি ফুকোর চিন্তার সংযোগ করি, তা হলে দেখতে পাব যে টলস্টয়ের ক্ষুদ্র অবস্থানকারী পেশার লোকেরাও আর নিজেদের বৃত্তে আবদ্ধ থাকে না, বরং তাদের মধ্যে যারা সামনের কাতারের, তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগাযোগ থাকে। সে জন্য দেখা যায়, রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা হয়তো রাজধানীর অনেক মাঝারি গোছের নেতার চেহারা পর্যন্ত চেনেন না, কিন্তু মফস্বলের কেন্দ্রগুলোর শীর্ষনেতাদের চেনেন। কারণ, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতার বলয় বিস্তৃত থাকে এবং স্থিত হয়।
বলয়, প্রভাব, প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতার এ পিরামিড চেহারা বা ওপর থেকে নিচে রাজনৈতিক সংযোগের প্রয়োজনীয়তার কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে নিচের স্তরের নেতা-কর্মীদের শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না, বরং কিছুটা আশকারা দেওয়া হয়। আমরা যারা সক্রিয় রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে বাস করি, আশ্চর্য হয়ে যাই, কেন প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজ দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত সন্ত্রাস দমন করতে পারছেন না, যেখানে প্রতিটি সন্ত্রাসী কর্মই তাঁদের দলের বিপক্ষে যাচ্ছে। পারেন না তার কারণ ওপরে ব্যাখ্যাত রাজনৈতিক বাস্তবতা।
ফুকোর আরেকটি চিন্তা আমরা এখানে আলোচনায় আনতে পারি। তিনি বলেছেন, আগে রাজাশাসিত রাজ্য আর আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে শাসন-প্রক্রিয়ায় পার্থক্য হলো, আগে রাজার শারীরিক অবস্থানটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রজাদের কাছে সদাসর্বদা রাজার উপস্থিতি জানানোর জন্য বহু রকম আয়োজনের মধ্যে অন্যতম ছিল রাজা/রানির শোভাযাত্রা। আমরা বলতে পারি, মোগল সম্রাটদের হস্তী সমভিব্যাহারে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার ছবি বহু তৈলচিত্রের বিষয় হয়ে আছে। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া বারবার জনসভা করে জনসমর্থন চাঙা রাখেন, ওটিও প্রাচীন শোভাযাত্রার একটি আধুনিক সংস্করণ। নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া।
কিন্তু ফুকোর মতে, আধুনিক রাজনৈতিক সমাজে ক্ষমতার দৃশ্যমানতা আর নিয়ন্ত্রণ ওভাবে প্রত্যক্ষভাবে আর করা হয় না। এখন জোর হচ্ছে অদেখা নিয়ন্ত্রণ। যেমন আমরা বলতে পারি, পাসপোর্ট, টিন নম্বর, ভোটার আইডি, মোবাইল ফোনের সিম, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড, ক্লাব মেম্বারশিপ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নাগরিকের ওপর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফুকো বলছেন, প্রযুক্তিগত উপাদানের সাহায্যে যখন সরকারের তরফ থেকে নাগরিকের ওপর প্রত্যক্ষতা বাড়ে, তখন নাগরিক নিজে হয়তো বোঝে না বা জানে না যে তার ওপর অসরাসরি কিন্তু প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে বলতে পারি, নূরকে যারা মারল, তারা হয়তো বুঝতে চায়নি যে ক্যামেরায় এবং ভিডিওচিত্রে সব ধরা পড়বে বা বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় বিডিআরের জওয়ানরা বুঝতে পারেনি যে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরায় তাদের কর্মকাণ্ড ধরা পড়ছে। ফুকো বলছেন, আধুনিক সমাজে সরকারের ওপর থেকে প্রযুক্তিগতভাবে আরোপিত এ প্রত্যক্ষতা হচ্ছে আসলে একটি ফাঁদ: ‘ভিজিবিলিটি ইজ আ ট্র্যাপ’। (দ্রষ্টব্য: ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’)
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো প্রযুক্তিগত আধুনিকতার ওই পর্যায়ে যায়নি এবং সে জন্যই সরকারের প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতি যেন প্রয়োজন। এবং সে জন্যই সরকারের পক্ষে বড়াইগ্রাম উপজেলায় সন্ত্রাসীমনস্ক সরকারি দলের কিছু নেতা-কর্মী প্রতিপক্ষ দলের মিছিলে হামলা করে নূর নামের একজন নেতাকে মেরেই ফেললেন। তাঁরা মনে করলেন, এতে সরকারি দলের প্রতিপত্তি দেখানো হলো।
কিন্তু, আইরনি বা উল্টো ফল যেটা হলো, তা হলো, ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের এ রকম শারীরিক সন্ত্রাসী প্রত্যক্ষ উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। সেটা সরকারি দলের নিচের কর্মীর স্তরগুলো যত তাড়াতাড়ি হূদয়ঙ্গম করে, ততই সরকারের জন্য ভালো।
 মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.