কালান্তরের কড়চা-শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফরের গুরুত্ব by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পাঁচ দিনব্যাপী লন্ডন সফর শেষ করে গত রবিবার (৩০ জানুয়ারি) ঢাকায় ফিরে গেছেন। তাঁর লন্ডনে আসার খবর যখন প্রথম প্রকাশ পায়, তখন মনে হয়েছিল তিনি দলীয় কাজে আসছেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন এবং কর্মকর্তা নির্বাচন উপলক্ষেই তিনি লন্ডনে আসছেন বলে প্রচারিত হয়েছিল।
গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দল, নেতৃত্বহীনতা, রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা ইত্যাদি কারণে যে অরাজক অবস্থা বিরাজ করছিল, তাতে দলের সভানেত্রী হিসেবে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে এবং নতুন কর্মকর্তা নির্বাচনে শেখ হাসিনার উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সেই পাকিস্তান আমল থেকেই একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই যুদ্ধের সমর্থনে ইউরোপে জনমত গঠনের ব্যাপারে যদিও সব দলমতের প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগ ছিল, কিন্তু নেতৃত্বটা ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। দেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পাকিস্তানের অনুকরণে ও সমর্থনে যে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়, তার বিরুদ্ধেও বিদেশের মাটিতে প্রথম শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ।
এহেন সংগঠনটিকে ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করার আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। বস্তুত, এই আন্দোলনটিকে তখন বিদেশের মাটিতে জিইয়ে রেখেছিল যুক্তরাজ্য যুবলীগ। তাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের হাতে গোনা কয়েকজন নেতা। সাম্প্রতিক দলীয় কর্মকর্তা নির্বাচনে এসব নেতাই ক্ষমতায় এসেছেন।
ইউরোপে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত আওয়ামী লীগের এখন বেশি প্রয়োজন। বিএনপির যুবরাজ তারেক রহমান স্বাস্থ্য উদ্ধারের অজুহাতে লন্ডনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বসবাস শুরু করার পর তাঁর দলের গোপন ও প্রকাশ্য অশুভ তৎপরতায় দ্বিতীয় রাজধানী হয়ে উঠেছে লন্ডন। এই তৎপরতা গণতান্ত্রিক বিরোধিতায় নিয়ম-নীতি মেনে চললে অসুবিধার কিছু ছিল না। কিন্তু প্রচুর অর্থবৃষ্টি, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা, সৌদি সাহায্যপুষ্ট জামায়াতিদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তারেক রহমানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে লন্ডন ও দুবাইভিত্তিক যে ষড়যন্ত্রের খেলা চলছে, তাতে শেখ হাসিনার এবারের সফরেও তাঁর নিরাপত্তা সম্পর্কে শঙ্কিত ছিলেন ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারাও। তাঁর প্রেস কনফারেন্স এবং তাঁর সিভিক রিসেপশনের ব্যাপারটি যে শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাজনিত সতর্কতাও তার একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির শক্তিশালী দ্বিতীয় হেডকোয়ার্টার এখন লন্ডন। বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিন-তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এরা মরিয়া হয়ে উঠছে। বিদেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে এরা বাংলাদেশের ভেতরে অরাজকতা সৃষ্টি এবং যুদ্ধাপরাধী-বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার চক্রান্তে সর্বপ্রকার সাহায্য জোগাচ্ছে। এই চক্রান্ত দেশের মাটিতে শক্তভাবে মোকাবিলা করার পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও অনুরূপভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এ কাজে ইউরোপে_বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়েও হাসিনা সরকারের শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। বিএনপি-জামায়াতের লন্ডনভিত্তিক এই ষড়যন্ত্র রোখার জন্য যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ও তৎপরতা বাড়ানো দরকার।
শেখ হাসিনা যে এই আবশ্যকতা উপলব্ধি করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশে পৌরসভার অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলোর নির্বাচন এবং সংসদের দু-দুটি আসনে (হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া) নির্বাচনের আগে-পরে দেশে থাকার গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করে বিদেশে চলে এসেছেন, তাতে এই মুহূর্তে তাঁর কাছে রাজনৈতিক প্রায়োরিটি কোনটি তা বোঝা যায়। তিনি নির্বাচন-জেতার চেয়েও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রোখার কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফরে বিএনপি-জামায়াতি ঘরানার মিডিয়াগুলো সন্তুষ্ট নয়। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে ঢাকার একটি নিরপেক্ষতার মুখোশধারী ইংরেজি দৈনিকও। শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর অনাবশ্যক এবং অর্থ ও সময়ের অপচয় বলে ইংরেজি দৈনিকটি মন্তব্য করেছে। আমাকে এই খবরটি জানিয়ে ওই দৈনিকেরই একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল এই সম্পাদককে এবারের লন্ডন সফরে তাঁর সম্পাদক-সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যাওয়া। তাহলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এই পাঠক একসময় তাঁর ব্যক্তিগত সচিবদের একজন ছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলেই তখনকার শক্তিশালী কলামিস্ট জেড এ সুলেরি প্রধানমন্ত্রীর ওই সময়কে অনাবশ্যক, সরকারি অর্থের অপচয় বলে সমালোচনা করতেন। এই সচিব প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা জানালে তিনি হেসে বলেছিলেন, এর প্রতিকার আমার জানা আছে। পরবর্তী সময়ে জেড এ সুলেরিকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গী করেন। সুলেরি দেশে ফিরেই তাঁর 'মেন অ্যান্ড ম্যাটার্স' শীর্ষক কলামে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং দেশের জন্য কতটা সুফল বহন করেছে তার এক দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রদান করেন। এই গল্পটি শোনার পর ঠিক করেছি, প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব, তিনি যেন তাঁর পরবর্তী বিদেশ সফরে ঢাকার এই সম্পাদককে তাঁর সফরসঙ্গী করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের লন্ডন সফরকে আমি একটু বেশি গুরুত্ব দিই। কেবল যুক্তরাজ্য বা ইউরোপে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রোখার জন্য দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর জন্যই তিনি এই সফরে আসেননি, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করা, ব্রিটেনের নতুন সরকারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পরিচয় ও উদ্যোগকে কাজে লাগানো। মাত্র পাঁচ দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে এ কাজে তিনি বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছেন। সম্ভবত সাম্প্রতিককালে যুক্তরাজ্যে দক্ষিণ এশিয়ার (ভারত ছাড়া) আর কোনো সরকারপ্রধানের সফরকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
২৬ জানুয়ারি সকালে লন্ডনের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে ছুটে যান। একে একে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে সাবেক লেবার সরকারের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এবং বর্তমান ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লিক ক্লেগের। পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর সেশনে কিছু সময় ভিআইপি দর্শকদের সারিতে ছিলেন। তার পরই শুরু হয় বাংলাদেশের সমস্যা ও স্বার্থ সম্পর্কে বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। জলবায়ু ও পরিবেশ দপ্তরের মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেরেসা মে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়কমন্ত্রী এলান ডানকান প্রমুখের সঙ্গে তাঁর এসব বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার হাসিনাকে সংবর্ধনা দেন এবং তাঁকে গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী অলপার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ ফর বাংলাদেশের সদস্যদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশে জঙ্গি সমস্যা দূর করা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
২৭ তারিখে শেখ হাসিনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি হয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটেনের টোরি-লিব কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে। ৪০ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হয় এবং ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকতর আর্থ-সামাজিক সহযোগিতা গড়ে তোলার পন্থা নিয়ে কথা হয়। এই দিন শেখ হাসিনা অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সভায় গ্লোবাল পিসের ওপর বক্তৃতা করেন এবং তাতে পশ্চিমা বড় দেশগুলোর করণীয় কী সে সম্পর্কে বক্তব্য দেন।
২৮ তারিখে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা, বিবিসি বেতার ও আল-জাজিরা টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেন শেখ হাসিনা। ইন্টার মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের মহাসচিব এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের লন্ডন সদস্য ড. চার্লস ট্যানোক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২৯ তারিখে হিলটন হোটেলে অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ৩০ তারিখে লন্ডন ত্যাগের আগে লর্ড এভাবরি এবং উত্তর কমিউনিটি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
লন্ডন সফরে প্রধানমন্ত্রীর এই টাইট শিডিউলেই বোঝা যায় তিনি গুরুত্বহীন বিদেশ সফরে এবার আসেননি। ইউরোপে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধির স্বার্থেই নিজ সংগঠন শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্য তো তাঁর ছিলই, তার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল সমস্যা-জর্জরিত বাংলাদেশের বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধানে ব্রিটেনসহ ইউরোপের কাছ থেকে ফলপ্রসূ সহযোগিতা আদায় করা। এই সহযোগিতার আশ্বাস তিনি পেয়েছেন বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। এখানেই তাঁর এবারের লন্ডন সফরের সাফল্য।
আওয়ামী লীগ নেত্রীর এবারের লন্ডন সফর সম্পর্কে আমার মনে কেবল একটি দুঃখই রয়েছে। এবারও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নতুন কর্মকর্তারা ইলেকশনে নয়, জননেত্রীর সিলেকশনে হয়েছেন। ব্রিটেন আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার। গণতন্ত্রের সেই পাদপীঠেই যদি আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা নির্বাচন বারবার কেবল ঢাকার সিলেকশনে হয়, তাহলে এই দলে গণতন্ত্র চর্চার শুরুটা কোথা থেকে হবে আমি জানি না।
শুধু যে ইলেকশনের বদলে সিলেকশনই হয়েছে তা নয়, যুক্তরাজ্য আওওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী এই সম্মেলনে উপেক্ষিত ও অপমাণিত হয়েছেন। আমি অভিযোগ পেয়েছি অন্তত কয়েক ডজনের কাছ থেকে। জননেত্রী লন্ডনে এলেই যেসব বসন্তের কোকিল তাঁকে ঘিরে ফেলেন, তাঁদের কারো কারো দ্বারা দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতাদের কেউ কেউ অপদস্থ হয়েছেন। নেত্রীর কাছেও তাঁদের ভিড়তে দেওয়া হয়নি।
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর আমলের একটা গল্প বলি। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী এবং পুরনো গণভবনে বসে আছেন। এই সময় গোপালগঞ্জের একদল নেতা ফুলের মালা ও নানা উপঢৌকন নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁদের স্তুতিবাক্য শুনতে শুনতে বঙ্গবন্ধু একসময় বলে উঠেছিলেন, 'সুদিনে সব সময় আমার চারপাশে তোমাদের ঘুরতে দেখি। তোমাদের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। কিন্তু আমার সেই দুর্দিনের বন্ধুরা কোথায়? যাঁরা চরম দুঃসময়ে আমার পাশে রয়েছেন, আমার জন্য অত্যাচার-নির্যাতন সবকিছু হাসিমুখে সহ্য করেছেন। গোপালগঞ্জ থেকে তাঁরা আসেননি কেন? নাকি তোমরা আসতে দাওনি?'
শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফরের সময় তাঁর চারপাশে যাঁরা ভিড় করেছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশকে এই প্রশ্নটা তিনি করতে পারতেন; কিন্তু করেননি। তাঁদের অনেকেই হিলটন হোটেলের গেট পেরোতেও পারেননি। শুনে দুঃখ পেয়েছি। তাই কথাটা লিখলাম।
লন্ডন, ৩১ জানুয়ারি, সোমবার ২০১১
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সেই পাকিস্তান আমল থেকেই একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই যুদ্ধের সমর্থনে ইউরোপে জনমত গঠনের ব্যাপারে যদিও সব দলমতের প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগ ছিল, কিন্তু নেতৃত্বটা ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। দেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পাকিস্তানের অনুকরণে ও সমর্থনে যে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়, তার বিরুদ্ধেও বিদেশের মাটিতে প্রথম শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ।
এহেন সংগঠনটিকে ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করার আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। বস্তুত, এই আন্দোলনটিকে তখন বিদেশের মাটিতে জিইয়ে রেখেছিল যুক্তরাজ্য যুবলীগ। তাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের হাতে গোনা কয়েকজন নেতা। সাম্প্রতিক দলীয় কর্মকর্তা নির্বাচনে এসব নেতাই ক্ষমতায় এসেছেন।
ইউরোপে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত আওয়ামী লীগের এখন বেশি প্রয়োজন। বিএনপির যুবরাজ তারেক রহমান স্বাস্থ্য উদ্ধারের অজুহাতে লন্ডনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বসবাস শুরু করার পর তাঁর দলের গোপন ও প্রকাশ্য অশুভ তৎপরতায় দ্বিতীয় রাজধানী হয়ে উঠেছে লন্ডন। এই তৎপরতা গণতান্ত্রিক বিরোধিতায় নিয়ম-নীতি মেনে চললে অসুবিধার কিছু ছিল না। কিন্তু প্রচুর অর্থবৃষ্টি, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা, সৌদি সাহায্যপুষ্ট জামায়াতিদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তারেক রহমানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে লন্ডন ও দুবাইভিত্তিক যে ষড়যন্ত্রের খেলা চলছে, তাতে শেখ হাসিনার এবারের সফরেও তাঁর নিরাপত্তা সম্পর্কে শঙ্কিত ছিলেন ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারাও। তাঁর প্রেস কনফারেন্স এবং তাঁর সিভিক রিসেপশনের ব্যাপারটি যে শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাজনিত সতর্কতাও তার একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির শক্তিশালী দ্বিতীয় হেডকোয়ার্টার এখন লন্ডন। বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিন-তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এরা মরিয়া হয়ে উঠছে। বিদেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে এরা বাংলাদেশের ভেতরে অরাজকতা সৃষ্টি এবং যুদ্ধাপরাধী-বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার চক্রান্তে সর্বপ্রকার সাহায্য জোগাচ্ছে। এই চক্রান্ত দেশের মাটিতে শক্তভাবে মোকাবিলা করার পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও অনুরূপভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এ কাজে ইউরোপে_বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়েও হাসিনা সরকারের শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। বিএনপি-জামায়াতের লন্ডনভিত্তিক এই ষড়যন্ত্র রোখার জন্য যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ও তৎপরতা বাড়ানো দরকার।
শেখ হাসিনা যে এই আবশ্যকতা উপলব্ধি করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশে পৌরসভার অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলোর নির্বাচন এবং সংসদের দু-দুটি আসনে (হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া) নির্বাচনের আগে-পরে দেশে থাকার গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করে বিদেশে চলে এসেছেন, তাতে এই মুহূর্তে তাঁর কাছে রাজনৈতিক প্রায়োরিটি কোনটি তা বোঝা যায়। তিনি নির্বাচন-জেতার চেয়েও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রোখার কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফরে বিএনপি-জামায়াতি ঘরানার মিডিয়াগুলো সন্তুষ্ট নয়। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে ঢাকার একটি নিরপেক্ষতার মুখোশধারী ইংরেজি দৈনিকও। শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফর অনাবশ্যক এবং অর্থ ও সময়ের অপচয় বলে ইংরেজি দৈনিকটি মন্তব্য করেছে। আমাকে এই খবরটি জানিয়ে ওই দৈনিকেরই একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল এই সম্পাদককে এবারের লন্ডন সফরে তাঁর সম্পাদক-সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যাওয়া। তাহলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এই পাঠক একসময় তাঁর ব্যক্তিগত সচিবদের একজন ছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলেই তখনকার শক্তিশালী কলামিস্ট জেড এ সুলেরি প্রধানমন্ত্রীর ওই সময়কে অনাবশ্যক, সরকারি অর্থের অপচয় বলে সমালোচনা করতেন। এই সচিব প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা জানালে তিনি হেসে বলেছিলেন, এর প্রতিকার আমার জানা আছে। পরবর্তী সময়ে জেড এ সুলেরিকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গী করেন। সুলেরি দেশে ফিরেই তাঁর 'মেন অ্যান্ড ম্যাটার্স' শীর্ষক কলামে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং দেশের জন্য কতটা সুফল বহন করেছে তার এক দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রদান করেন। এই গল্পটি শোনার পর ঠিক করেছি, প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব, তিনি যেন তাঁর পরবর্তী বিদেশ সফরে ঢাকার এই সম্পাদককে তাঁর সফরসঙ্গী করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের লন্ডন সফরকে আমি একটু বেশি গুরুত্ব দিই। কেবল যুক্তরাজ্য বা ইউরোপে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রোখার জন্য দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর জন্যই তিনি এই সফরে আসেননি, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করা, ব্রিটেনের নতুন সরকারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পরিচয় ও উদ্যোগকে কাজে লাগানো। মাত্র পাঁচ দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে এ কাজে তিনি বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছেন। সম্ভবত সাম্প্রতিককালে যুক্তরাজ্যে দক্ষিণ এশিয়ার (ভারত ছাড়া) আর কোনো সরকারপ্রধানের সফরকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
২৬ জানুয়ারি সকালে লন্ডনের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে ছুটে যান। একে একে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে সাবেক লেবার সরকারের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এবং বর্তমান ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লিক ক্লেগের। পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর সেশনে কিছু সময় ভিআইপি দর্শকদের সারিতে ছিলেন। তার পরই শুরু হয় বাংলাদেশের সমস্যা ও স্বার্থ সম্পর্কে বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। জলবায়ু ও পরিবেশ দপ্তরের মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেরেসা মে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়কমন্ত্রী এলান ডানকান প্রমুখের সঙ্গে তাঁর এসব বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার হাসিনাকে সংবর্ধনা দেন এবং তাঁকে গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী অলপার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ ফর বাংলাদেশের সদস্যদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশে জঙ্গি সমস্যা দূর করা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
২৭ তারিখে শেখ হাসিনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি হয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটেনের টোরি-লিব কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে। ৪০ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হয় এবং ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকতর আর্থ-সামাজিক সহযোগিতা গড়ে তোলার পন্থা নিয়ে কথা হয়। এই দিন শেখ হাসিনা অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সভায় গ্লোবাল পিসের ওপর বক্তৃতা করেন এবং তাতে পশ্চিমা বড় দেশগুলোর করণীয় কী সে সম্পর্কে বক্তব্য দেন।
২৮ তারিখে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা, বিবিসি বেতার ও আল-জাজিরা টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেন শেখ হাসিনা। ইন্টার মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের মহাসচিব এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের লন্ডন সদস্য ড. চার্লস ট্যানোক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২৯ তারিখে হিলটন হোটেলে অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ৩০ তারিখে লন্ডন ত্যাগের আগে লর্ড এভাবরি এবং উত্তর কমিউনিটি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
লন্ডন সফরে প্রধানমন্ত্রীর এই টাইট শিডিউলেই বোঝা যায় তিনি গুরুত্বহীন বিদেশ সফরে এবার আসেননি। ইউরোপে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধির স্বার্থেই নিজ সংগঠন শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্য তো তাঁর ছিলই, তার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল সমস্যা-জর্জরিত বাংলাদেশের বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধানে ব্রিটেনসহ ইউরোপের কাছ থেকে ফলপ্রসূ সহযোগিতা আদায় করা। এই সহযোগিতার আশ্বাস তিনি পেয়েছেন বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। এখানেই তাঁর এবারের লন্ডন সফরের সাফল্য।
আওয়ামী লীগ নেত্রীর এবারের লন্ডন সফর সম্পর্কে আমার মনে কেবল একটি দুঃখই রয়েছে। এবারও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নতুন কর্মকর্তারা ইলেকশনে নয়, জননেত্রীর সিলেকশনে হয়েছেন। ব্রিটেন আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার। গণতন্ত্রের সেই পাদপীঠেই যদি আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা নির্বাচন বারবার কেবল ঢাকার সিলেকশনে হয়, তাহলে এই দলে গণতন্ত্র চর্চার শুরুটা কোথা থেকে হবে আমি জানি না।
শুধু যে ইলেকশনের বদলে সিলেকশনই হয়েছে তা নয়, যুক্তরাজ্য আওওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী এই সম্মেলনে উপেক্ষিত ও অপমাণিত হয়েছেন। আমি অভিযোগ পেয়েছি অন্তত কয়েক ডজনের কাছ থেকে। জননেত্রী লন্ডনে এলেই যেসব বসন্তের কোকিল তাঁকে ঘিরে ফেলেন, তাঁদের কারো কারো দ্বারা দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতাদের কেউ কেউ অপদস্থ হয়েছেন। নেত্রীর কাছেও তাঁদের ভিড়তে দেওয়া হয়নি।
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর আমলের একটা গল্প বলি। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী এবং পুরনো গণভবনে বসে আছেন। এই সময় গোপালগঞ্জের একদল নেতা ফুলের মালা ও নানা উপঢৌকন নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁদের স্তুতিবাক্য শুনতে শুনতে বঙ্গবন্ধু একসময় বলে উঠেছিলেন, 'সুদিনে সব সময় আমার চারপাশে তোমাদের ঘুরতে দেখি। তোমাদের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। কিন্তু আমার সেই দুর্দিনের বন্ধুরা কোথায়? যাঁরা চরম দুঃসময়ে আমার পাশে রয়েছেন, আমার জন্য অত্যাচার-নির্যাতন সবকিছু হাসিমুখে সহ্য করেছেন। গোপালগঞ্জ থেকে তাঁরা আসেননি কেন? নাকি তোমরা আসতে দাওনি?'
শেখ হাসিনার এবারের লন্ডন সফরের সময় তাঁর চারপাশে যাঁরা ভিড় করেছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশকে এই প্রশ্নটা তিনি করতে পারতেন; কিন্তু করেননি। তাঁদের অনেকেই হিলটন হোটেলের গেট পেরোতেও পারেননি। শুনে দুঃখ পেয়েছি। তাই কথাটা লিখলাম।
লন্ডন, ৩১ জানুয়ারি, সোমবার ২০১১
No comments