ড. নিয়াজ আহম্মেদ-ছাত্র রাজনীতির সুবাতাস কবে বইবে?
একটা সময় ছিল, যখন সমাজে ছাত্র ও ছাত্রনেতাদের দারুণ কদর ছিল। ছাত্ররাও সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে চলত। তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে যেমন ছিল মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলা, তেমনি মানুষকে বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করার প্রেরণা।
ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বিসর্জন দিয়ে অন্যের জন্য কাজ করে অনেক ছাত্রনেতাকে বৃদ্ধ পর্যন্ত হতে দেখা যেত। এঁদেরই প্রচেষ্টায় আমরা অর্জন করেছি মাতৃভাষা বাংলা, মহান স্বাধীনতা এবং স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের উত্থান। সময় এখন অনেক বদলেছে। অনেক কিছুর পরিবর্তনের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রনেতাদের মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না।
মূলত ছাত্ররাজনীতির পতন শুরু হয় স্বৈরশাসক এরশাদের সময় থেকে। এরশাদের ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ছাত্ররাজনীতি তাঁর জন্য জরুরি হয়ে দেখা দেয়। নিজের দলের ছাত্র সংগঠন গঠন করার জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। অর্থ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতা নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পরও চলতে থাকে। অস্ত্রের মহড়া, টেন্ডারবাজি, গুলি করে ছাত্র হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দেখা দেয়। রাতারাতি ছাত্রনেতারা অর্থবৈভবের মালিক বনে যান। ছাত্ররাজনীতির মূল চেতনা থেকে ছাত্রনেতারা দূরে সরে যান। ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণের কথা বাদ দিয়ে মূল দলের সঙ্গে মিশে যায় ছাত্ররাজনীতি। ন্যায়-অন্যায়ের কথা বাদ দিয়ে ঢালাওভাবে মূল রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দেওয়া রুটিন কাজে পরিণত হয়। ফলে ছাত্রদের কল্যাণের পরিবর্তে কখনো কখনো সাধারণ ছাত্রদের জীবনহানি পর্যন্ত ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার গোলাগুলি কিংবা একই দলের দুই গ্রুপের মধ্যকার মারামারিতে বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যার বলি সাধারণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।
রাজনৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় সাধারণ মানুষও ক্রমান্বয়ে সরাসরি রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। রাজনীতিকে যারা পেশা হিসেবে নিতে চায় অথবা দ্রুত অর্থবিত্তের মালিক হতে চায় তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি লক্ষ করা যায়। সংখ্যায় তারা খুব বেশি নয়, কিন্তু দলকে চাঙ্গা করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর হাত। তখনই ছাত্রনেতাদের ডাক আসে। তাঁরা দলকে সহায়তা করেন। অন্যদিকে তাঁরা হলে সিট পাওয়া থেকে শুরু করে নানা রকম অর্থনৈতিক সুবিধা নেন। আগে যেমন বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা এনে রাজনীতি করতে হতো, এখন তার প্রয়োজন নেই। যথেষ্ট শান-শওকত নিয়েই চলতে পারেন তাঁরা। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণগুলোর মধ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আগেকার সময় হল দখল, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি কারণে মারামারি, হানাহানি পরিলক্ষিত হতো। এখনো এসব নেই তা নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্রনেতাদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও হানাহানির মতো ঘটনা ঘটছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবারের কুপন নিয়ে একজনের মৃত্যু আমাদের হতবাক করে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই আমরা বেশ কিছু ঘটনা লক্ষ করি, যেখানে সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় মারামারির ঘটনা ঘটছে। মানুষের মধ্যকার সহনশীলতার মাত্রা ক্রমে শূন্যের কোটায় নেমে যাচ্ছে। আমরা দারুণ মাত্রায় বি-অ্যাকটিভ হয়ে যাচ্ছি। পরিণামে আমাদের দারুণ ক্ষতি হয়। এ রকম দুটি ঘটনা আমি এখানে ব্যক্ত করছি, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ঘটনার মধ্যে মাত্র দুটি। হয়তো অনেকের জানা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলেও গত চার বছরে এক দিনের জন্যও শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়নি।
সত্যি বলতে এখানেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে; কিন্তু নেই কোনো চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজি। কিন্তু সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু মারামারি হয়েছে। এ রকম একটি ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কনসার্টকে কেন্দ্র করে। ওই অনুষ্ঠানে গান শোনাকে কেন্দ্র করে একজন ছাত্রের সঙ্গে সামান্য ধাক্কাধাক্কি হয়। বিষয়টি এমনই সামান্য ছিল যে তা নিয়ে মারামারির মতো ঘটনা ঘটা উচিত ছিল না। কিন্তু পরের দিন তা-ই ঘটেছে। ছাত্রদের মধ্যকার সহনশীলতার মাত্রা এতই কমে গেছে যে এ জন্য প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। পরের ঘটনাটি তারই প্রমাণ। গত ২৭-১২-২০১০ তারিখ শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ছয়জন ছাত্রকে ক্ষুর দিয়ে আহত করে। পরের দিন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ছাত্রদের পকেটে কলমের পাশাপাশি ক্ষুরও থাকে। ঘটনার সূত্রপাত তার মাত্র কয়েক দিন আগে ট্রেনে (সিলেট-ঢাকা)। ১০০ টাকাকে কেন্দ্র করে সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছু ছাত্র দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়। ঘটনাটি রাতে ছাত্রটি তার বন্ধুবান্ধবদের জানালে পরের দিন সকালে সে এবং তার বন্ধুরা মিলে ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে কয়েক জনকে মারধর করে। ঘটনাটি পত্রিকায় পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরের ঘটনাটি ঘটে সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি আত্মরক্ষার্থে কয়েক জনকে ক্ষুর দিয়ে আহত করে। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থ্থা এমন ছিল যে সময়মতো ডাক্তার না পাওয়া গেলে মৃত্যুও ঘটতে পারত। 'সহনশীলতার মাত্রা কমে যাওয়া'_সমস্যাটি শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নয়, গোটা সমাজেই এটি বিরাজ করছে। যার জন্য আমাদের অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে। আমরা কি পারি না আরো সহনশীল হতে? আমরা কি পারি না ছোটখাটো বিষয়কে সহজে মেনে নিতে কিংবা আইনের আশ্রয় নিতে? প্রশ্নটি সবার কাছে রইল।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। neayahmed_2002@yahoo.com
মূলত ছাত্ররাজনীতির পতন শুরু হয় স্বৈরশাসক এরশাদের সময় থেকে। এরশাদের ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ছাত্ররাজনীতি তাঁর জন্য জরুরি হয়ে দেখা দেয়। নিজের দলের ছাত্র সংগঠন গঠন করার জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। অর্থ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতা নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পরও চলতে থাকে। অস্ত্রের মহড়া, টেন্ডারবাজি, গুলি করে ছাত্র হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দেখা দেয়। রাতারাতি ছাত্রনেতারা অর্থবৈভবের মালিক বনে যান। ছাত্ররাজনীতির মূল চেতনা থেকে ছাত্রনেতারা দূরে সরে যান। ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণের কথা বাদ দিয়ে মূল দলের সঙ্গে মিশে যায় ছাত্ররাজনীতি। ন্যায়-অন্যায়ের কথা বাদ দিয়ে ঢালাওভাবে মূল রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দেওয়া রুটিন কাজে পরিণত হয়। ফলে ছাত্রদের কল্যাণের পরিবর্তে কখনো কখনো সাধারণ ছাত্রদের জীবনহানি পর্যন্ত ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার গোলাগুলি কিংবা একই দলের দুই গ্রুপের মধ্যকার মারামারিতে বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যার বলি সাধারণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।
রাজনৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় সাধারণ মানুষও ক্রমান্বয়ে সরাসরি রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। রাজনীতিকে যারা পেশা হিসেবে নিতে চায় অথবা দ্রুত অর্থবিত্তের মালিক হতে চায় তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি লক্ষ করা যায়। সংখ্যায় তারা খুব বেশি নয়, কিন্তু দলকে চাঙ্গা করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর হাত। তখনই ছাত্রনেতাদের ডাক আসে। তাঁরা দলকে সহায়তা করেন। অন্যদিকে তাঁরা হলে সিট পাওয়া থেকে শুরু করে নানা রকম অর্থনৈতিক সুবিধা নেন। আগে যেমন বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা এনে রাজনীতি করতে হতো, এখন তার প্রয়োজন নেই। যথেষ্ট শান-শওকত নিয়েই চলতে পারেন তাঁরা। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণগুলোর মধ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আগেকার সময় হল দখল, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি কারণে মারামারি, হানাহানি পরিলক্ষিত হতো। এখনো এসব নেই তা নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্রনেতাদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও হানাহানির মতো ঘটনা ঘটছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবারের কুপন নিয়ে একজনের মৃত্যু আমাদের হতবাক করে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই আমরা বেশ কিছু ঘটনা লক্ষ করি, যেখানে সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় মারামারির ঘটনা ঘটছে। মানুষের মধ্যকার সহনশীলতার মাত্রা ক্রমে শূন্যের কোটায় নেমে যাচ্ছে। আমরা দারুণ মাত্রায় বি-অ্যাকটিভ হয়ে যাচ্ছি। পরিণামে আমাদের দারুণ ক্ষতি হয়। এ রকম দুটি ঘটনা আমি এখানে ব্যক্ত করছি, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ঘটনার মধ্যে মাত্র দুটি। হয়তো অনেকের জানা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলেও গত চার বছরে এক দিনের জন্যও শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়নি।
সত্যি বলতে এখানেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে; কিন্তু নেই কোনো চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজি। কিন্তু সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু মারামারি হয়েছে। এ রকম একটি ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কনসার্টকে কেন্দ্র করে। ওই অনুষ্ঠানে গান শোনাকে কেন্দ্র করে একজন ছাত্রের সঙ্গে সামান্য ধাক্কাধাক্কি হয়। বিষয়টি এমনই সামান্য ছিল যে তা নিয়ে মারামারির মতো ঘটনা ঘটা উচিত ছিল না। কিন্তু পরের দিন তা-ই ঘটেছে। ছাত্রদের মধ্যকার সহনশীলতার মাত্রা এতই কমে গেছে যে এ জন্য প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। পরের ঘটনাটি তারই প্রমাণ। গত ২৭-১২-২০১০ তারিখ শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ছয়জন ছাত্রকে ক্ষুর দিয়ে আহত করে। পরের দিন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ছাত্রদের পকেটে কলমের পাশাপাশি ক্ষুরও থাকে। ঘটনার সূত্রপাত তার মাত্র কয়েক দিন আগে ট্রেনে (সিলেট-ঢাকা)। ১০০ টাকাকে কেন্দ্র করে সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছু ছাত্র দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়। ঘটনাটি রাতে ছাত্রটি তার বন্ধুবান্ধবদের জানালে পরের দিন সকালে সে এবং তার বন্ধুরা মিলে ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে কয়েক জনকে মারধর করে। ঘটনাটি পত্রিকায় পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরের ঘটনাটি ঘটে সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি আত্মরক্ষার্থে কয়েক জনকে ক্ষুর দিয়ে আহত করে। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থ্থা এমন ছিল যে সময়মতো ডাক্তার না পাওয়া গেলে মৃত্যুও ঘটতে পারত। 'সহনশীলতার মাত্রা কমে যাওয়া'_সমস্যাটি শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নয়, গোটা সমাজেই এটি বিরাজ করছে। যার জন্য আমাদের অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে। আমরা কি পারি না আরো সহনশীল হতে? আমরা কি পারি না ছোটখাটো বিষয়কে সহজে মেনে নিতে কিংবা আইনের আশ্রয় নিতে? প্রশ্নটি সবার কাছে রইল।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। neayahmed_2002@yahoo.com
No comments