সরকারি দলের দৃষ্টিভঙ্গি নিন্দনীয়-উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যার বিচার

নাটোরে বিএনপির নেতা সানাউল্লাহ নূরের হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের দিকে তাকিয়ে আছে দেশবাসী। কিন্তু তদন্ত চলমান থাকতেই অনভিপ্রেত বিতর্ক ধূম্রজাল তৈরি করেছে। বড় রাজনীতিকেরা বড় বিতর্কে লিপ্ত হলে তদন্তে তার প্রভাব পড়ে, যদিও তা হওয়ার কথা নয়।


নাটোরে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা সারা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। এটা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি অশনিসংকেত। এখন যদি এ ঘটনা নিয়ে দায় চাপানোর রাজনীতি চলে, তাহলে তার চেয়ে পরিহাসের আর কিছু হতে পারে না।
ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধী শনাক্তকরণ-সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ছিল খুবই ইতিবাচক। কিন্তু গত মঙ্গলবার গণভবনে এক দলীয় কর্মসূচিতে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী ভিন্নতর উক্তি করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘নাটোরের ঘটনা যে তাঁদের অভ্যন্তরীণ না, সেটা তিনি কীভাবে প্রমাণ করবেন?’ বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দলীয় খুনিদের সুরক্ষা করলেন। এখন পুলিশ অন্তর্দ্বন্দ্বের তদন্ত করবে, নাকি হত্যাকারী ধরবে? এ কথা বলে তিনি ওই ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের সাজা দেওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিলেন।’ অন্যদিকে বড়াইগ্রামে আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুল কুদ্দুসসহ স্থানীয় দলীয় নেতারা হুংকার দিচ্ছেন। তাঁরা বায়না ধরছেন যে পুলিশকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আদেশ মানতে হবে। সাংসদের মন্তব্য আইনের শাসনের পরিপন্থী। তাঁর ফরমান: ‘সানাউল্লাহ নূর নিজ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন। অথচ প্রকৃত আসামিদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ ওই মিথ্যা মামলায় আমাদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করছে।’ কুদ্দুস সাহেব শুধু একজন সাংসদ নন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এলাকায় তিনি ‘অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস’ নামেও পরিচিত। কলেজে শিক্ষকতার কারণে তাঁর এই পরিচয়। এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য তাঁর পদমর্যাদার সঙ্গে বেমানান। কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু দায়িত্বশীল লোক মতামত প্রকাশে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ার পরিচয় দিচ্ছেন। ক্রমশ তাঁদের সংখ্যা স্ফীত হচ্ছে। আর আশঙ্কা, সামাজিকভাবে এর একটা গ্রহণযোগ্যতাও সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে যেন আমরা নৈতিক অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছি।
যেকোনো নরহত্যা গুরুতর অপরাধ। সানাউল্লাহ নূর যদি অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও খুন হয়ে থাকেন, তাহলেও তার বিচারের দায় রাষ্ট্রের। সরকারকেই তো মামলা চালাতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার সাংসদ হিসেবে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া, তাদের আশ্বস্ত করার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। সানাউল্লাহ হত্যাকাণ্ডে এজাহারভুক্ত মোট আসামির সংখ্যা ২৭। হত্যাকাণ্ড সংঘটন-পরবর্তী ছয় দিনে পুলিশ এ পর্যন্ত একজনকে আটক করেছে; যে ১৬-১৭ বছরের এক তরুণ, যাকে ছাত্রলীগের কর্মী বলা হয়, সংগঠনে কোনো পদ-পদবি নেই। এর ধাক্কাতেই নাটোরে আওয়াজ উঠেছে যে পুলিশ ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি’ করছে। সরকারি দলের নেতাদের আচরণে নাটোরের পুলিশ ও জনপ্রশাসন বিচলিত বোধ করবে, সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। আমরা সরকারি দলের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা জানাই। হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারই কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.