উচ্চ আদালতের রায়-নারীর জীবন ফতোয়ার শাসনে চলবে না by হামিদা হোসেন
গত ১২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের এক যুগান্তকারী রায়ে নারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়ার নামে শাস্তিদানকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। ১৭ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে কমলগঞ্জ উপজেলার ছাতকছড়া গ্রামে মাওলানা মান্নানের নেতৃত্বে এক সালিস বসে। সেই সালিসে নুরজাহান নামে এক তরুণীর গায়ে ১০০ বার পাথর ছোড়ার ফতোয়া জারি করা হয়।
এ বিষয়ে কোনো আইন না থাকা এবং ফতোয়াদানকারীদের কোনো আইনি কর্তৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা শাস্তি কার্যকর করেন। এই ঘটনার পর লজ্জা ও লাঞ্ছনার মানসিক আঘাতে মেয়েটি আত্মহত্যা করেন।
এই মর্মান্তিক মৃত্যুর আঘাতে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন জেগে ওঠে এবং নারীদের কর্ম ও সম্পর্ক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে ফতোয়ার মাধ্যমে শাস্তিদান নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের স্থানীয় এক প্রতিনিধির তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে নিম্ন আদালতে একটি ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা হয়। মামলার পরিণতিতে ১৯৯৪ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১১৪ নম্বর ধারা অনুসারে মাওলানা মান্নানসহ তাঁর আট সহযোগীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সাত বছরের সশ্রম কারাবাস ও দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর কারাবাসের দণ্ড দেওয়া হয়। তাহলেও, এই রায়ে ফতোয়া ঘোষণা কিংবা ফতোয়াকে নারী নিপীড়নের অস্ত্র করা বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
গণমাধ্যমের ছাঁকনি পেরিয়ে যতটা জানা যায় তা আমলে নিয়ে ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীদের রক্ষা করায় নারী কর্মীদের পক্ষ থেকে এটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। কিছু কিছু আইনি প্রতিক্রিয়ায় ফতোয়াবাজির বিষয়টা পাদপ্রদীপের নিচে এলেও গ্রাম্য মাতবর ও ইমামদের কেউ কেউ এখনো নারীদের নিশানা করা থেকে বিরত হননি। স্থানীয় ইমামদের ফতোয়া কিংবা মাতবরদের সালিসের মাধ্যমে বছরে গড়ে ৩৫ থেকে ৪৫টির মতো নারী নির্যাতনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসে থাকে। বিভিন্ন বয়সী নারীকে চাবুক, বেত বা লাঠি দিয়ে প্রহারের শিকার হতে হয়। কখনো তাদের একঘরে করা কিংবা স্বামীর দেওয়া তালাক ফেরানোয় হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করা হয়। ওই নারীদের পরিবার এবং স্থানীয় অন্যদের পক্ষে এ ধরনের নির্যাতন ঠেকানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। কারণ, প্রথা ও ধর্মের নামে এসবকে জায়েজ করা হয়। যেকোনো ঘটনাতেই কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি যখন এ ধরনের শাস্তিদানকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, তখন সাধারণ যেকোনো গ্রামবাসীর পক্ষে এর বিরোধিতা করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের একতরফা সন্ত্রাসের কবল থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ অসহায় কোনো নারীর সামনে খোলা থাকে না।
তাই পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল গ্রামীণ নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং আদালতের হস্তক্ষেপ কামনায় উৎসাহিত করা। যেখানে স্থানীয় সালিসি অথবা স্থানীয় আদালত এসব তথাকথিত ধর্মীয় গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ করায় গাফিলতি করছে, সেখানে ২০০০ সালে উচ্চ আদালত ফতোয়া ও নারীর অধিকারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। নওগাঁর এক মাওলানা ফতোয়া দিয়ে এক নারীকে স্বামীর দেওয়া তালাক খারিজ করায় হিল্লা বিয়ের পথে ঠেলে দেওয়ার সংবাদে উচ্চ আদালত স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রশাসনের ওপর সুয়োমোটো রুল জারি করেন। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে ফতোয়াদানকারী মাওলানার বিরুদ্ধে কেন তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি, তার জন্য তাঁদের কারণ দর্শাতে বলা হয়। এর শুনানিতে আইনি সহায়তাদানকারী সংগঠন ও নারী অধিকার রক্ষায় ক্রিয়াশীল গ্রুপগুলোও অংশ নেয়। তারা সাক্ষ্য হাজির করে, কীভাবে আগের এক দশকে ফতোয়া ঘোষণার মাধ্যমে অনেক পরিবারের শান্তি নষ্ট করা হয়েছে, অর্থনৈতিক তৎপরতাকে দমিত করেছে এবং রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেই মাওলানাকে আটক করা হয় এবং রায়ে ফতোয়াকে বেআইনি ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের আইন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কথাও বলা হয়। এসব ঘটতে পারার জন্য দায়ী করা হয় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও।
এই রায়ের মাধ্যমে ফতোয়ার সামাজিক বৈধতা বাতিল করায় নারীদের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এটা একই সঙ্গে সংকীর্ণ স্বার্থবাদীদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও ডেকে আনে। উচ্চ আদালতের এই রায় সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং এর শুনানি কয়েক বছরের জন্য আটকে যায়। এর মধ্যে নারীদের নিজস্ব পছন্দবোধ ও গতিশীলতার বিরুদ্ধে ফতোয়া ঘোষিত হতে থাকে।
এ অবস্থায় আবারও আইনি প্রতিকার দাবি করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং নিজেরা করি পিটিশন দাখিল করে। সেখানে এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়, যেখানে ফতোয়ার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার নারীদের একঘরে করা, শারীরিক নির্যাতন ও জোর করে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
এই পিটিশনের অনুসরণে আরও দুটি আইনি আবেদন দাখিল করা হয়। এ বছর এই তিনটি পিটিশনের জবাবে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপিত গোবিন্দ্র চন্দ্র ঠাকুরের আদালত পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দেন যে, যারা বিচারবহির্ভূত শাস্তি চাপিয়ে দিচ্ছে বা তা কার্যকর করায় সহায়তা করছে, তারা ফৌজদারি কার্যবিধি ও অন্যান্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার অধীনে দায়ী হবে। বিচারকেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসহ কয়েকটি সরকারি সংস্থাকে স্পষ্টভাবে তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিচারের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বলা হয়, সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাকে জানাতে হবে যে এ ধরনের শাস্তিদান সংবিধান লঙ্ঘন করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়, যাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যসূচিতে সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রাধান্য বোঝানোর মতো লেখা রাখা হয়। সরকারকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়, যাতে এই রায় বৈদ্যুতিন মাধ্যম (ইলেকট্রনিক মিডিয়া) ব্যবহার করে প্রচারিত হয়।
রায়ে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলায় বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতার কথা বলে নারীদের স্বাধীনতার অধিকার, সহিংসতা থেকে মুক্তি এবং সমতার অধিকারের কথা পর্যন্ত বলা হয়। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জাতিসংঘের সিইডিএডব্লিউ কমিটির পক্ষ থেকে এ ধরনের বেআইনি শাস্তি বন্ধের আহ্বানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল রায়টি। ২০০১ সালে বাংলাদেশকে যেহেতু সিইডিএডব্লিউ কমিটির কাছে প্রতিবেদন দিতে হবে, সেহেতু তার আগেই দ্রুত আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা উচিত।
আদালতের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রতিষ্ঠিত হলেও তার বাস্তবায়ন আপনাআপনি হবে না। রক্ষণশীল মতামত বাধা দেবে এবং দেখা যাবে যে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করায় বিধিনিষেধ আরোপ করে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার সুযোগ তারা নেবেই। তাই যে মুহূর্তে আমরা নির্যাতনের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষায় সংবিধান ও আইনের বিজয় উদ্যাপন করছি, সেই মুহূর্তে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, আদালতের নির্দেশ যাতে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ পালন করে তার নজরদারি চালিয়ে যাওয়া। এবং এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে আইনের হস্তক্ষেপ দাবি করা। এটা করায় যদি আমরা প্রস্তুত না থাকি, তাহলে এই রায় কেবল চমৎকার কাগুজে দলিল হয়েই থাকবে; ফতোয়ার অত্যাচার বন্ধ করার হাতিয়ার হয়ে উঠবে না।
ড. হামিদা হোসেন: মানবাধিকারকর্মী
এই মর্মান্তিক মৃত্যুর আঘাতে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন জেগে ওঠে এবং নারীদের কর্ম ও সম্পর্ক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে ফতোয়ার মাধ্যমে শাস্তিদান নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের স্থানীয় এক প্রতিনিধির তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে নিম্ন আদালতে একটি ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা হয়। মামলার পরিণতিতে ১৯৯৪ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১১৪ নম্বর ধারা অনুসারে মাওলানা মান্নানসহ তাঁর আট সহযোগীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সাত বছরের সশ্রম কারাবাস ও দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর কারাবাসের দণ্ড দেওয়া হয়। তাহলেও, এই রায়ে ফতোয়া ঘোষণা কিংবা ফতোয়াকে নারী নিপীড়নের অস্ত্র করা বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
গণমাধ্যমের ছাঁকনি পেরিয়ে যতটা জানা যায় তা আমলে নিয়ে ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীদের রক্ষা করায় নারী কর্মীদের পক্ষ থেকে এটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। কিছু কিছু আইনি প্রতিক্রিয়ায় ফতোয়াবাজির বিষয়টা পাদপ্রদীপের নিচে এলেও গ্রাম্য মাতবর ও ইমামদের কেউ কেউ এখনো নারীদের নিশানা করা থেকে বিরত হননি। স্থানীয় ইমামদের ফতোয়া কিংবা মাতবরদের সালিসের মাধ্যমে বছরে গড়ে ৩৫ থেকে ৪৫টির মতো নারী নির্যাতনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসে থাকে। বিভিন্ন বয়সী নারীকে চাবুক, বেত বা লাঠি দিয়ে প্রহারের শিকার হতে হয়। কখনো তাদের একঘরে করা কিংবা স্বামীর দেওয়া তালাক ফেরানোয় হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করা হয়। ওই নারীদের পরিবার এবং স্থানীয় অন্যদের পক্ষে এ ধরনের নির্যাতন ঠেকানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। কারণ, প্রথা ও ধর্মের নামে এসবকে জায়েজ করা হয়। যেকোনো ঘটনাতেই কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি যখন এ ধরনের শাস্তিদানকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, তখন সাধারণ যেকোনো গ্রামবাসীর পক্ষে এর বিরোধিতা করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের একতরফা সন্ত্রাসের কবল থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ অসহায় কোনো নারীর সামনে খোলা থাকে না।
তাই পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল গ্রামীণ নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং আদালতের হস্তক্ষেপ কামনায় উৎসাহিত করা। যেখানে স্থানীয় সালিসি অথবা স্থানীয় আদালত এসব তথাকথিত ধর্মীয় গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ করায় গাফিলতি করছে, সেখানে ২০০০ সালে উচ্চ আদালত ফতোয়া ও নারীর অধিকারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। নওগাঁর এক মাওলানা ফতোয়া দিয়ে এক নারীকে স্বামীর দেওয়া তালাক খারিজ করায় হিল্লা বিয়ের পথে ঠেলে দেওয়ার সংবাদে উচ্চ আদালত স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রশাসনের ওপর সুয়োমোটো রুল জারি করেন। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে ফতোয়াদানকারী মাওলানার বিরুদ্ধে কেন তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি, তার জন্য তাঁদের কারণ দর্শাতে বলা হয়। এর শুনানিতে আইনি সহায়তাদানকারী সংগঠন ও নারী অধিকার রক্ষায় ক্রিয়াশীল গ্রুপগুলোও অংশ নেয়। তারা সাক্ষ্য হাজির করে, কীভাবে আগের এক দশকে ফতোয়া ঘোষণার মাধ্যমে অনেক পরিবারের শান্তি নষ্ট করা হয়েছে, অর্থনৈতিক তৎপরতাকে দমিত করেছে এবং রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেই মাওলানাকে আটক করা হয় এবং রায়ে ফতোয়াকে বেআইনি ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের আইন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কথাও বলা হয়। এসব ঘটতে পারার জন্য দায়ী করা হয় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও।
এই রায়ের মাধ্যমে ফতোয়ার সামাজিক বৈধতা বাতিল করায় নারীদের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এটা একই সঙ্গে সংকীর্ণ স্বার্থবাদীদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও ডেকে আনে। উচ্চ আদালতের এই রায় সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং এর শুনানি কয়েক বছরের জন্য আটকে যায়। এর মধ্যে নারীদের নিজস্ব পছন্দবোধ ও গতিশীলতার বিরুদ্ধে ফতোয়া ঘোষিত হতে থাকে।
এ অবস্থায় আবারও আইনি প্রতিকার দাবি করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং নিজেরা করি পিটিশন দাখিল করে। সেখানে এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়, যেখানে ফতোয়ার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার নারীদের একঘরে করা, শারীরিক নির্যাতন ও জোর করে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
এই পিটিশনের অনুসরণে আরও দুটি আইনি আবেদন দাখিল করা হয়। এ বছর এই তিনটি পিটিশনের জবাবে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপিত গোবিন্দ্র চন্দ্র ঠাকুরের আদালত পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দেন যে, যারা বিচারবহির্ভূত শাস্তি চাপিয়ে দিচ্ছে বা তা কার্যকর করায় সহায়তা করছে, তারা ফৌজদারি কার্যবিধি ও অন্যান্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার অধীনে দায়ী হবে। বিচারকেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসহ কয়েকটি সরকারি সংস্থাকে স্পষ্টভাবে তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিচারের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বলা হয়, সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাকে জানাতে হবে যে এ ধরনের শাস্তিদান সংবিধান লঙ্ঘন করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়, যাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যসূচিতে সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রাধান্য বোঝানোর মতো লেখা রাখা হয়। সরকারকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়, যাতে এই রায় বৈদ্যুতিন মাধ্যম (ইলেকট্রনিক মিডিয়া) ব্যবহার করে প্রচারিত হয়।
রায়ে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলায় বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতার কথা বলে নারীদের স্বাধীনতার অধিকার, সহিংসতা থেকে মুক্তি এবং সমতার অধিকারের কথা পর্যন্ত বলা হয়। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জাতিসংঘের সিইডিএডব্লিউ কমিটির পক্ষ থেকে এ ধরনের বেআইনি শাস্তি বন্ধের আহ্বানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল রায়টি। ২০০১ সালে বাংলাদেশকে যেহেতু সিইডিএডব্লিউ কমিটির কাছে প্রতিবেদন দিতে হবে, সেহেতু তার আগেই দ্রুত আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা উচিত।
আদালতের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রতিষ্ঠিত হলেও তার বাস্তবায়ন আপনাআপনি হবে না। রক্ষণশীল মতামত বাধা দেবে এবং দেখা যাবে যে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করায় বিধিনিষেধ আরোপ করে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার সুযোগ তারা নেবেই। তাই যে মুহূর্তে আমরা নির্যাতনের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষায় সংবিধান ও আইনের বিজয় উদ্যাপন করছি, সেই মুহূর্তে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, আদালতের নির্দেশ যাতে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ পালন করে তার নজরদারি চালিয়ে যাওয়া। এবং এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে আইনের হস্তক্ষেপ দাবি করা। এটা করায় যদি আমরা প্রস্তুত না থাকি, তাহলে এই রায় কেবল চমৎকার কাগুজে দলিল হয়েই থাকবে; ফতোয়ার অত্যাচার বন্ধ করার হাতিয়ার হয়ে উঠবে না।
ড. হামিদা হোসেন: মানবাধিকারকর্মী
No comments