কালের পুরাণ-বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি by সোহরাব হাসান
খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়ার জন্য হাইকোর্ট গত বুধবার যে রায় দিয়েছেন, সে সম্পর্কে বিএনপি নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আদালত অঙ্গনেই জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম মিছিল করে বলেছে, ‘এ রায় আমরা মানি না।’ যদিও আইনানুগ নাগরিক হিসেবে সবাই আদালতের রায় মানতে বাধ্য।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপি নেতা টি এইচ খান বলেছেন, ‘রায়ে আমরা হতবাক।’ তিনি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর বিরুদ্ধে বিএনপি প্রতিবাদ জানাবে। সরকারকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না।’ এর মাধ্যমে দলীয় মহাসচিব খালেদা জিয়ার বাড়ি রক্ষায় জোরদার আন্দোলনেরই ইঙ্গিত দিলেন।
পত্রিকায় দেখলাম, ‘খোন্দকার দেলোয়ারের ছেলে পবন মাদকাসক্ত হয়ে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকায় আদালতে হাজির হতে পারেননি। ফলে তাঁর মামলার শুনানি পিছিয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর) সে ক্ষেত্রে বিএনপি মহাসচিবের কর্তব্য ছিল ছেলেকে মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তিনি ছেলেকে রক্ষার চেয়ে নেত্রীর বাড়ি রক্ষাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
দেশে হাজারো সমস্যা আছে, জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ছে, মানুষ বেঘোরে পথেঘাটে মারা যাচ্ছে। বিএনপির ভাষায় ‘সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।’ কিন্তু সেসব নিয়ে বিএনপির নেতারা আন্দোলন করছেন না। এই যে সাভারে ৪০ জন বাসযাত্রী পানিতে ডুবে মারা গেলেন, তাঁদের প্রতি শোক জানাতে বিএনপির কোনো নেতা সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। আমরা জানি, সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের গায়ের চামড়া খুব পুরো হয়। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁদের তেমন স্পর্শ করে না। এখন দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলের নেতাদের চামড়াও পুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনের ইস্যু না পেয়ে এখন তাঁরা খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছেন। কেউ বলছেন হরতাল দেবেন, কেউ বলছেন অবরোধ করবেন। হায়, রাজনীতি!
হাইকোর্টের রায় বিপক্ষে গেছে বলে বিএনপির নেতারা ন্যায়বিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু গত বছর ২৭ মে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার নোটিশের কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করলে তাঁরা সোল্লাসে বলেছিলেন, ‘ন্যায়বিচার পেয়েছি।’ পরবর্তী ন্যায়বিচারের আশায় তাঁরা তিন-চারবার বেঞ্চও বদল করেছেন। এখন বলছেন ভিন্ন কথা। কেবল সরকার নয়, বিরোধী দলও আইন-আদালতকেও নিজের মতো চালাতে চায়।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতায় গিয়ে যেমন আপন সুখে বিভোর হন, তেমনি ক্ষমতার বাইরে গিয়েও সেই সুখ হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকেন। দেশ, জাতি ও জনগণকে নিয়ে তাঁদের ভাবনার সময় কোথায়? বিএনরিপ নেতারা যখন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলেছেন, তখন তাঁদের উচিত আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আইনি বিরোধ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। এ নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করা সমীচীন নয়। মানুষের সমস্যা নয়, খাদ্যপণ্যের দাম নয়, কৃষি বা শিল্প নয়, বিদ্যুৎ সমস্যা নয়, বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্র হচ্ছে একটি বাড়ি। বিএনপির নেতারা একটি বাড়ির ওপর তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেন্দ্রায়িত করতে চাইছেন।
এখানে একটি কথা পরিষ্কার বলা প্রয়োজন, সরকার বাড়ি ছাড়ার নোটিশটি খালেদা জিয়াকে দিলেও তিনি কিন্তু মামলার মূল বিবাদী নন। মূল বিবাদী হচ্ছেন ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর, যিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ বা ইজারা দিয়েছিলেন। বিবাদী হচ্ছেন এই লিজ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। বিচারপতি সাত্তার মারা গেলেও সে সময় বাড়ি বরাদ্দের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বেঁচে আছেন। কয়েক মাস আগে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিনি খালেদাকে বাড়িটি দিয়ে ভুল করেছিলেন।’ সে ক্ষেত্রে বিবাদী খুঁজতে দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এরশাদকে জিজ্ঞেস করলেই অনেক কিছু জানা যাবে। এটি কি তাঁর স্বেচ্ছাকৃত ভুল, না অন্য কিছু? ১৯৮১ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনায় এরশাদের কী ভূমিকা ছিল, কেন বিদ্রোহের নায়ক বলে অভিযুক্ত জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হলো, কেন বিচার না করে তাঁকে হত্যা করা হলো—সেসব প্রশ্নের জবাবও তাঁকে দিতে হবে। মহাজোটের শরিক হওয়ায় সাত খুন মাফ হতে পারে না।
খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। শেখ হাসিনার আগের সরকার বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিপরীতে ২০০১ সালে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন পাস করে তারা প্রচণ্ড সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। অনেকের মতে, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পেছনে সেই বিতর্কিত আইনের ভূমিকাও কম ছিল না। এবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর অনুরূপ আরেকটি আইন পাস করেছে, যাতে ‘বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা ও তাঁদের সন্তানদের ভিআইপি নিরাপত্তা, সরকারিভাবে নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসন এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুবিধা’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
একদিকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে নোটিশ এবং অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের জন্য সুরক্ষিত আবাসনসুবিধার জন্য আইন পাস কি স্ববিরোধী নয়? মানুষ কি একে ভালোভাবে নেবে? আইন তো সবার ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আইনটি বিএনপি বাতিল করে দিয়েছিল। আবার তারা ক্ষমতায় এলে এ আইনও বাতিল করে দেবে। আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নোটিশ দিয়ে একটি বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাঁর নামে দুটি বাড়ি বরাদ্দ করবে। ফের আওয়ামী লীগ সেই বরাদ্দ বাতিল করবে এবং নিজেদের নামে নতুন বরাদ্দ নেবে। বাড়ি নিয়ে এই বাড়াবাড়ি আর কত দিন চলবে?
খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়ার পর জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের জন্য সুরক্ষিত আবাসনের সুবিধাসংবলিত আইন পাস করা বেআইনি না হলেও নীতিবিরুদ্ধ। তিন বছর পর আবারও তো তাদের ভোটারদের কাছে যেতে হবে।
১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান উপসেনাপ্রধান হিসেবে সেনানিবাসের যে বাড়িটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই বাড়িটিতেই ছিলেন। ৬ শহীদ মইনুল সড়কের বাড়ি। উপসেনাপ্রধান থেকে তিনি সেনাপ্রধান হয়েছিলেন, পরে প্রধান সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ৬ মইনুল রোডের বাড়িটি ছাড়েননি। এটি এ কারণে নয় যে তিনি বাড়িটি চিরদিন দখলে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি এর চেয়ে বড় বাড়িতে যেতে চাননি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে থাকতে পারতেন, তাও থাকেননি। তাঁর স্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সেই বাড়িতে আছেন ২৮ বছর ধরে; সরকারের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে লিজ নিয়ে। গুলশানে তাঁর আরেকটি বাড়ি না থাকলে হয়তো এখানে থাকার যুক্তি ছিল। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে এই কাজটি তিনি করতেন না, কাউকে করতে দিতেন না। রাজনীতিতে তিনি বহু বিতর্কের সৃষ্টি করলেও ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ ও সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন। সরকার নোটিশ দেওয়ার আগেই খালেদা জিয়া বাড়িটি স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ছেড়ে দিলে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো।
বাড়িটি যখন খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন তিনি ছিলেন সদ্য স্বামী হারানো একজন অসহায় গৃহবধূ। সঙ্গে দুই শিশুপুত্র। এই নিঃসম্বল পরিবারটির সহায়তায় বিএনপি সরকার গুলশানে একটি বাড়ি বরাদ্দ করে এবং পরিবারের চলার জন্য ১০ লাখ টাকা এফডিআর করে দেয়, যাতে তাঁর সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ হয়। এ বিষয়টিতে কেউ আপত্তি করেননি। জিয়াউর রহমান পরিবারের জন্য তেমন কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ দান অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু সেনানিবাসে আরেকটি বাড়ি দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। যদিও আমাদের দেশে বহু মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিপন্ন ও দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।
আইনের চেয়ে নৈতিকার প্রশ্নটি বড়। যদি ধরে নিই তৎকালীন সরকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের জন্য সেনানিবাসের বাড়িটি লিজ দিয়ে কোনো অন্যায় করেনি। তাঁরা এখন কেউ অসহায় ও নিঃসম্বল নন। সন্তানেরা বড় হয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে পসার জমিয়ে এখন দেশের অন্যতম ধনী পরিবার। খালেদা জিয়াও রাজনীতিতে এসে তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দুবার বিরোধীদলীয় নেত্রী। অন্য কোনো আর্থিক সংস্থান না থাকলেও গুলশানের বাড়িটি ভাড়া দিয়েও সংসার নির্বাহ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জনগণের জন্য রাজনীতি করেন বলে তিনি দাবি করেন। তার পরও সেনানিবাসের বাড়িটি তাঁর দখলে রাখা কতটা সমীচীন? একজন মানুষের, একটি পরিবারের কতখানি সম্পত্তি চাই? কয়টি বাড়ি প্রয়োজন? খুব দূরের উদাহরণ দেব না, প্রতিবেশী ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী গুজরালি লাল নন্দের দিল্লিতে কোনো বাড়ি ছিল না। শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর এবং নন্দের মন্ত্রিত্ব হারানোর পর পরিবারের সদস্যরা রাজধানী ছেড়ে চলে যান।
আমাদের রাজনীতিকেরা যদি একটু লোভ সংবরণ করতেন, যদি জনগণকে কিছু দেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতেন, কেবল নিজের, পরিবারের ও আত্মীয়স্বজনের কথা না ভাবতেন—এই গরিব দেশের মানুষগুলো আরেকটু শান্তিতে থাকত, আরেকটু স্বস্তি পেত। তারা আকাশ উঁচু বাড়ি চায় না, নতুন মডেলের গাড়ি চায় না, নিরাপত্তার জন্য এসএসএফ-সুবিধা চায় না। তারা থাকার মতো একটু আশ্রয় চায়, মোটা চালের ভাত ও মোটা কাপড়েই তারা সন্তুষ্ট থাকে। রাজনীতিকেরা, রাষ্ট্রের চালক বলে পরিচিত সামরিক-বেসামরিক আমলারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এই গরিব দেশের জনগণই তাঁদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশের জন্য যা যা প্রয়োজন সব কিছুর জোগান দেয়। বিনিময়ে আপনারা তাদের কী দিচ্ছেন?
প্রখ্যাত রুশ কথাশিল্পী লিও টলস্টয়ের একটি বিখ্যাত গল্প ‘সাড়ে তিন হাত জমি’। গল্পের নায়ককে বলা হয়েছিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি বিশাল মাঠের যতটা সীমানা ঘুরে আসতে পারবেন, ততটা জমির মালিক হবেন তিনি। এ কথা শুনে ভদ্রলোক পড়িমরি দৌড়াতে থাকলেন, বেলা যত বাড়তে থাকে, তাঁর দৌড়ের গতিও তত বেড়ে যায়। তাঁর উদ্বিগ্ন চোখ হেলে গড়ায় সূর্যের দিকে। অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি আরও জোরে দৌড়াতে লাগলেন। এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে যখন সূর্যাস্ত গেল, তখনই তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অবশেষে জীবিত নয়, মৃত নায়ক সাড়ে তিন হাত জমির মালিক হলেন। আমাদের দেশদরদি ও জননন্দিত নেতা-নেত্রীরা গল্পটি মনে রাখলে বাধিত হব।
আক্ষেপ, দেশকে কিছু দেওয়ার চেয়ে দেশ থেকে নিতেই বরাবর তাঁরা উদগ্রীব থাকেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
পত্রিকায় দেখলাম, ‘খোন্দকার দেলোয়ারের ছেলে পবন মাদকাসক্ত হয়ে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকায় আদালতে হাজির হতে পারেননি। ফলে তাঁর মামলার শুনানি পিছিয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর) সে ক্ষেত্রে বিএনপি মহাসচিবের কর্তব্য ছিল ছেলেকে মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তিনি ছেলেকে রক্ষার চেয়ে নেত্রীর বাড়ি রক্ষাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
দেশে হাজারো সমস্যা আছে, জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ছে, মানুষ বেঘোরে পথেঘাটে মারা যাচ্ছে। বিএনপির ভাষায় ‘সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।’ কিন্তু সেসব নিয়ে বিএনপির নেতারা আন্দোলন করছেন না। এই যে সাভারে ৪০ জন বাসযাত্রী পানিতে ডুবে মারা গেলেন, তাঁদের প্রতি শোক জানাতে বিএনপির কোনো নেতা সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। আমরা জানি, সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের গায়ের চামড়া খুব পুরো হয়। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁদের তেমন স্পর্শ করে না। এখন দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলের নেতাদের চামড়াও পুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনের ইস্যু না পেয়ে এখন তাঁরা খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছেন। কেউ বলছেন হরতাল দেবেন, কেউ বলছেন অবরোধ করবেন। হায়, রাজনীতি!
হাইকোর্টের রায় বিপক্ষে গেছে বলে বিএনপির নেতারা ন্যায়বিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু গত বছর ২৭ মে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার নোটিশের কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করলে তাঁরা সোল্লাসে বলেছিলেন, ‘ন্যায়বিচার পেয়েছি।’ পরবর্তী ন্যায়বিচারের আশায় তাঁরা তিন-চারবার বেঞ্চও বদল করেছেন। এখন বলছেন ভিন্ন কথা। কেবল সরকার নয়, বিরোধী দলও আইন-আদালতকেও নিজের মতো চালাতে চায়।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতায় গিয়ে যেমন আপন সুখে বিভোর হন, তেমনি ক্ষমতার বাইরে গিয়েও সেই সুখ হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকেন। দেশ, জাতি ও জনগণকে নিয়ে তাঁদের ভাবনার সময় কোথায়? বিএনরিপ নেতারা যখন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলেছেন, তখন তাঁদের উচিত আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আইনি বিরোধ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। এ নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করা সমীচীন নয়। মানুষের সমস্যা নয়, খাদ্যপণ্যের দাম নয়, কৃষি বা শিল্প নয়, বিদ্যুৎ সমস্যা নয়, বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্র হচ্ছে একটি বাড়ি। বিএনপির নেতারা একটি বাড়ির ওপর তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেন্দ্রায়িত করতে চাইছেন।
এখানে একটি কথা পরিষ্কার বলা প্রয়োজন, সরকার বাড়ি ছাড়ার নোটিশটি খালেদা জিয়াকে দিলেও তিনি কিন্তু মামলার মূল বিবাদী নন। মূল বিবাদী হচ্ছেন ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর, যিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ বা ইজারা দিয়েছিলেন। বিবাদী হচ্ছেন এই লিজ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। বিচারপতি সাত্তার মারা গেলেও সে সময় বাড়ি বরাদ্দের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বেঁচে আছেন। কয়েক মাস আগে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিনি খালেদাকে বাড়িটি দিয়ে ভুল করেছিলেন।’ সে ক্ষেত্রে বিবাদী খুঁজতে দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এরশাদকে জিজ্ঞেস করলেই অনেক কিছু জানা যাবে। এটি কি তাঁর স্বেচ্ছাকৃত ভুল, না অন্য কিছু? ১৯৮১ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনায় এরশাদের কী ভূমিকা ছিল, কেন বিদ্রোহের নায়ক বলে অভিযুক্ত জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হলো, কেন বিচার না করে তাঁকে হত্যা করা হলো—সেসব প্রশ্নের জবাবও তাঁকে দিতে হবে। মহাজোটের শরিক হওয়ায় সাত খুন মাফ হতে পারে না।
খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। শেখ হাসিনার আগের সরকার বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিপরীতে ২০০১ সালে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন পাস করে তারা প্রচণ্ড সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। অনেকের মতে, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পেছনে সেই বিতর্কিত আইনের ভূমিকাও কম ছিল না। এবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর অনুরূপ আরেকটি আইন পাস করেছে, যাতে ‘বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা ও তাঁদের সন্তানদের ভিআইপি নিরাপত্তা, সরকারিভাবে নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসন এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুবিধা’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
একদিকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে নোটিশ এবং অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের জন্য সুরক্ষিত আবাসনসুবিধার জন্য আইন পাস কি স্ববিরোধী নয়? মানুষ কি একে ভালোভাবে নেবে? আইন তো সবার ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আইনটি বিএনপি বাতিল করে দিয়েছিল। আবার তারা ক্ষমতায় এলে এ আইনও বাতিল করে দেবে। আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নোটিশ দিয়ে একটি বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাঁর নামে দুটি বাড়ি বরাদ্দ করবে। ফের আওয়ামী লীগ সেই বরাদ্দ বাতিল করবে এবং নিজেদের নামে নতুন বরাদ্দ নেবে। বাড়ি নিয়ে এই বাড়াবাড়ি আর কত দিন চলবে?
খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়ার পর জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের জন্য সুরক্ষিত আবাসনের সুবিধাসংবলিত আইন পাস করা বেআইনি না হলেও নীতিবিরুদ্ধ। তিন বছর পর আবারও তো তাদের ভোটারদের কাছে যেতে হবে।
১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান উপসেনাপ্রধান হিসেবে সেনানিবাসের যে বাড়িটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই বাড়িটিতেই ছিলেন। ৬ শহীদ মইনুল সড়কের বাড়ি। উপসেনাপ্রধান থেকে তিনি সেনাপ্রধান হয়েছিলেন, পরে প্রধান সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ৬ মইনুল রোডের বাড়িটি ছাড়েননি। এটি এ কারণে নয় যে তিনি বাড়িটি চিরদিন দখলে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি এর চেয়ে বড় বাড়িতে যেতে চাননি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে থাকতে পারতেন, তাও থাকেননি। তাঁর স্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সেই বাড়িতে আছেন ২৮ বছর ধরে; সরকারের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে লিজ নিয়ে। গুলশানে তাঁর আরেকটি বাড়ি না থাকলে হয়তো এখানে থাকার যুক্তি ছিল। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে এই কাজটি তিনি করতেন না, কাউকে করতে দিতেন না। রাজনীতিতে তিনি বহু বিতর্কের সৃষ্টি করলেও ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ ও সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন। সরকার নোটিশ দেওয়ার আগেই খালেদা জিয়া বাড়িটি স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ছেড়ে দিলে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো।
বাড়িটি যখন খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন তিনি ছিলেন সদ্য স্বামী হারানো একজন অসহায় গৃহবধূ। সঙ্গে দুই শিশুপুত্র। এই নিঃসম্বল পরিবারটির সহায়তায় বিএনপি সরকার গুলশানে একটি বাড়ি বরাদ্দ করে এবং পরিবারের চলার জন্য ১০ লাখ টাকা এফডিআর করে দেয়, যাতে তাঁর সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ হয়। এ বিষয়টিতে কেউ আপত্তি করেননি। জিয়াউর রহমান পরিবারের জন্য তেমন কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ দান অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু সেনানিবাসে আরেকটি বাড়ি দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। যদিও আমাদের দেশে বহু মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিপন্ন ও দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।
আইনের চেয়ে নৈতিকার প্রশ্নটি বড়। যদি ধরে নিই তৎকালীন সরকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের জন্য সেনানিবাসের বাড়িটি লিজ দিয়ে কোনো অন্যায় করেনি। তাঁরা এখন কেউ অসহায় ও নিঃসম্বল নন। সন্তানেরা বড় হয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে পসার জমিয়ে এখন দেশের অন্যতম ধনী পরিবার। খালেদা জিয়াও রাজনীতিতে এসে তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দুবার বিরোধীদলীয় নেত্রী। অন্য কোনো আর্থিক সংস্থান না থাকলেও গুলশানের বাড়িটি ভাড়া দিয়েও সংসার নির্বাহ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জনগণের জন্য রাজনীতি করেন বলে তিনি দাবি করেন। তার পরও সেনানিবাসের বাড়িটি তাঁর দখলে রাখা কতটা সমীচীন? একজন মানুষের, একটি পরিবারের কতখানি সম্পত্তি চাই? কয়টি বাড়ি প্রয়োজন? খুব দূরের উদাহরণ দেব না, প্রতিবেশী ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী গুজরালি লাল নন্দের দিল্লিতে কোনো বাড়ি ছিল না। শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর এবং নন্দের মন্ত্রিত্ব হারানোর পর পরিবারের সদস্যরা রাজধানী ছেড়ে চলে যান।
আমাদের রাজনীতিকেরা যদি একটু লোভ সংবরণ করতেন, যদি জনগণকে কিছু দেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতেন, কেবল নিজের, পরিবারের ও আত্মীয়স্বজনের কথা না ভাবতেন—এই গরিব দেশের মানুষগুলো আরেকটু শান্তিতে থাকত, আরেকটু স্বস্তি পেত। তারা আকাশ উঁচু বাড়ি চায় না, নতুন মডেলের গাড়ি চায় না, নিরাপত্তার জন্য এসএসএফ-সুবিধা চায় না। তারা থাকার মতো একটু আশ্রয় চায়, মোটা চালের ভাত ও মোটা কাপড়েই তারা সন্তুষ্ট থাকে। রাজনীতিকেরা, রাষ্ট্রের চালক বলে পরিচিত সামরিক-বেসামরিক আমলারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এই গরিব দেশের জনগণই তাঁদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশের জন্য যা যা প্রয়োজন সব কিছুর জোগান দেয়। বিনিময়ে আপনারা তাদের কী দিচ্ছেন?
প্রখ্যাত রুশ কথাশিল্পী লিও টলস্টয়ের একটি বিখ্যাত গল্প ‘সাড়ে তিন হাত জমি’। গল্পের নায়ককে বলা হয়েছিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি বিশাল মাঠের যতটা সীমানা ঘুরে আসতে পারবেন, ততটা জমির মালিক হবেন তিনি। এ কথা শুনে ভদ্রলোক পড়িমরি দৌড়াতে থাকলেন, বেলা যত বাড়তে থাকে, তাঁর দৌড়ের গতিও তত বেড়ে যায়। তাঁর উদ্বিগ্ন চোখ হেলে গড়ায় সূর্যের দিকে। অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি আরও জোরে দৌড়াতে লাগলেন। এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে যখন সূর্যাস্ত গেল, তখনই তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অবশেষে জীবিত নয়, মৃত নায়ক সাড়ে তিন হাত জমির মালিক হলেন। আমাদের দেশদরদি ও জননন্দিত নেতা-নেত্রীরা গল্পটি মনে রাখলে বাধিত হব।
আক্ষেপ, দেশকে কিছু দেওয়ার চেয়ে দেশ থেকে নিতেই বরাবর তাঁরা উদগ্রীব থাকেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments