অভিমত ভিন্নমত
রেলের জন্য সমবেদনা বাবা অফিস থেকে ফিরে প্রায় গল্প করত, অমুক ইঞ্জিনের পার্টস খুলে তমুক ইঞ্জিনে লাগিয়ে কোনো প্রকারে আজকের ল্যাঠাটা চুকিয়ে এলাম। কিংবা তার-গ্লু দিয়ে কোনো রকমে ফিট দেওয়া গেল অমুক ইঞ্জিনকে। এত কিছুর পরও মাঝেমধ্যে শেষ রক্ষা মিলত না।
পথে কোথাও ট্রেন আটকে গেলে ল্যান্ডফোনের কল। ওপরওয়ালার ভর্ৎসনা।
এসব আজ থেকে ১০ বছর আগেকার ঘটনা। বাবা এখন অবসরে। এই ১০ বছরে পরিস্থিতি নাকি আরও খারাপ হয়েছে। রেলের যেখানে প্রতিদিন ট্রেন চালাতে দরকার ৫০০ ইঞ্জিন, সেখানে আছে মাত্র ২৮৮টি। তাও আবার ৭০ ভাগই ২০ বছরেরও পুরোনো। অথচ উন্নত বিশ্বে একটা ইঞ্জিনের বয়স ১৫ বছর হলেই তাকে লাইন থেকে তুলে নেওয়া হয়। আরও মজার ব্যাপার, ৮২টি ইঞ্জিন আছে ৪০ বছরেরও পুরোনো। এর ওপর তীব্র লোকসংকট। ৫৪ হাজার লোকের কাজ করছে ৩০ হাজারেরও কম মানুষ মিলে।
পরিবারের অনুরোধে প্রায় দূরযাত্রায় রেলের সাওয়ার হতে হয়। প্রায় প্রতিটি ভ্রমণই হয় একেকটা তিক্ত অভিজ্ঞতা। বগিগুলোর কী যাচ্ছেতাই অবস্থা। বাথরুম হয় ব্যবহার অনুপযোগী, নয়তো ভেতর থেকে লক করা। আর পাংচুয়ালিটের কথা নাই বা তুললাম। মাঝেমধ্যে রাগ হয়, মনে মনে বলি, আর রেলের ছায়া মাড়াব না। এ খারাপ অবস্থার জন্য কী একাই রেল দায়ী, আর কারও কোনো দায় নেই? জাতীয় জীবনে কি রেলের কোনো অবদান নেই?
রেলের নাকি এখনো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাছে ১২ হাজার কোটি টাকার ওপর পাওনা আছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান দেনা পরিশোধ না করেই ফতুর হয়ে গেছে। যেমন আদমজী জুটমিলের কাছে রেলের পাওনা ৩৫০ কোটি টাকা। এর ওপর আর্মি-বিডিআরের জন্য রেমিশনে টিকিট, ডাক বিভাগকে নামমাত্র মূল্যে সেবা, অলাভজনক শাখা লাইন পরিচালনা, সড়কপথের তুলনায় অর্ধেক ভাড়ায় টিকিট—রাজ্যের যত দায় তার কাঁধে। অথচ রাষ্ট্রের এই নীরব সেবকের কপালে চোরের অপবাদ আর বঞ্চনার যাতনা ছাড়া কিছুই জুটল না। অবহেলায় অবহেলায় একটি বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর মধ্যে আরেক নতুন দুর্বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে।
হ্যাঁ, ১১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে ছয়জন রেলে কাটার ঘটনা ও পরবর্তী সময়ে রেলগাড়িতে অগ্নিসংযোগের কথা বলছি। আসলে এ ঘটনায় দুটি ক্ষতি হয়েছে—একটা পূরণীয়, আরেকটা অপূরণীয়। অপূরণীয় ক্ষতিটা হয়েছে জানের, পূরণীয় ক্ষতিটা যানের। কিন্তু প্রথমটা ‘অসতর্কতার ফসল’, পরেরটা ‘সতর্কভাবেই’ করা। প্রথমটা লঙ্ঘনীয় ছিল, পরেরটা অহেতুক। তবে সমস্যা হলো, দুই ক্ষতির দায় দুই শিবিরে চলে গেছে। অথচ দুটি ক্ষতিই এ দেশের মানুষেরই।। ছয়টি পরিবারের ছয়টি মানুষ যেমন আর কখনো ফিরে আসবে না, এ দেশের গরিব-ভুখা মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কেনা ইঞ্জিন-বগিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে আমরাই সুলভে পাওয়া রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হব। এই ঘটনায় পুড়ে গেছে সবচেয়ে নতুন সিরিজের একটি ইঞ্জিন। যার মূল্য ২৫ কোটি টাকা। সঙ্গে গেছে ১০টি বগি। আরও ২০ কোটি টাকার দায়। উত্তরবঙ্গের পথে চলাচলকারী তিনটি জনপ্রিয় ট্রেনের একটি ছিল ‘দ্রুতযান’। এটা বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য।
জয়দীপ দে, দক্ষিণ খুলশী, চট্টগ্রাম।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন
প্রথম আলোয় ২১ সেপ্টেম্বর ছিদ্দিকুর রহমানের ‘প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন কৌশল’ শীর্ষক লেখাটি পড়লাম। তাঁর বক্তব্যের কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার এখন শতকরা নব্বইয়ের কাছাকাছি। কিন্তু তাদের অনেকেই পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। পড়া বুঝতে না পারা, বিদ্যালয়ে যেতে না চাওয়া, পরীক্ষায় ফেল করা ইত্যাদি সমস্যা আছে। এসবের পেছনে অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি আছে শিশুর পারিবারিক পরিবেশের সঙ্গে বিদ্যালয়ের পরিবেশের বিস্তর ফারাক। সে জন্য শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার আগে প্রাক-প্রাথমিক একটি পর্যায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের নানা সমস্যার কথা বিবেচনা করে জাতীয় শিক্ষানীতিতে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা বলা হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা।
লেখক দেশের প্রতিটি উপজেলায় ২০০টি করে প্রায় এক লাখ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করার প্রস্তাব করেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু’ নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এতে দেশের মোট ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুশ্রেণী চালু করতে সরকারের ৩১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এখনো দেশের প্রায় দুুুই হাজার গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। চলতি অর্থবছর থেকেই এক হাজার ৫০০ গ্রামে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত দু-একটি কক্ষ বাড়ালেই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কাজ চালু করা যেতে পারে। স্বল্পমাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটালে একই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চেহারা পাল্টে যাবে এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা যাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, পাঠ্যবইয়ের অভাব, শিক্ষার উপকরণের অভাব, পরিষ্কার ও স্বাভাবিক আলো-বাতাসসম্পন্ন শ্রেণীকক্ষের অভাব সবারই জানা কথা। এসব দিকে মনোযোগ দিলেও অল্প খরচে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কারের কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা যাবে। পাশাপাশি যেসব বেবি ক্লাস, কেজি ক্লাস বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসাতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে, সেগুলোকে বন্ধ না করে কার্যকর তত্ত্বাবধান ও নীতির আওতায় এনে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রমকে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদকে এর তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে এর আগে ইউনিয়ন পরিষদের কাজের আওতা, ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সরকারের চিন্তা ও নীতির আধুনিকীকরণ করতে হবে। দুর্গম অঞ্চলগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অনেক পরিবার শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে বিমুখ হচ্ছে। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে মায়েদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অংশ ‘মা-সমাবেশ’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বাবাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা গেলে ভালো হয়।
আমাদের সীমিত সম্পদ সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করে বাস্তবতার নিরিখে নীতি ও বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা উচিত।
হাসান তৌফিক ইমাম ও নাজমুস সাকীব, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। hasant99@yahoo.com
nshimel71@gmail.com
রংপুর বিভাগের উন্নয়ন কত দূর
সরকার রংপুরকে দেশের সপ্তম বিভাগ ঘোষণা করায় রংপুর বিভাগের জনমানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলের খেটে-খাওয়া জনমানুষ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, বৈষম্যের শিকার। দেশের উর্বর এই অঞ্চলের মানুষ সহজ-সরল ও পরিশ্রমী। তবু তারা কেন দরিদ্র, এটাই বড় প্রশ্ন।
সম্প্রতি রংপুর বিভাগের নাগরিক কমিটি নতুন এই বিভাগের উন্নয়নের ১৫টি দাবিতে পথযাত্রা কর্মসূচি পালন করল। দিনাজপুর থেকে শুরু করে বিভাগের আটটি জেলা সফর শেষে রংপুর এসে পথযাত্রার সমাপ্তি ঘটে। পঞ্চগড় থেকে গাড়ির বহর যাত্রা করে চিলাহাটি পৌঁছলাম। চিলাহাটি সরকারি কলেজমাঠ জনমানুষে পরিপূর্ণ। কেউ চাইলেন স্থলবন্দর, কেউ চাইলেন রেলওয়ে স্টেশন, কেউ চাইলেন শিল্পকারখানা। এই অঞ্চলের প্রয়োজন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার সংস্কার। নীলফামারী জেলার সঙ্গে চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ হয়ে পঞ্চগড়ের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নই প্রধান দাবি। রেল যোগাযোগ আরও গতিশীল ও আধুনিক হওয়া উচিত। সৈয়দপুরে রেলওয়ের বেদখল সম্পত্তিও উদ্ধার করা প্রয়োজন।
কুড়িগ্রাম জেলার ৬৮টি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে গত কয়েক বছরে। ভিটেমাটি হারিয়েছে প্রায় ৮০ হাজার পরিবার, দারিদ্র্য তাদের চিরসঙ্গী। জেলার ১৩১টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অর্ধাহারে-অনাহারে ক্লিষ্ট শিশুরা কঠিন শ্রমে নিয়োজিত, কিন্তু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। এক ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপের শিশুশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সারা দিন কাজ করে সে এক বেলা খাবার পায়, দৈনিক বেতন মাত্র ৩০ টাকা। কুড়িগ্রাম জেলাকে নদীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে নদীভাঙন রোধের স্থায়ী ব্যবস্থা প্রয়োজন। ১৩১টি গ্রামের শিশুদের জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা। বর্তমান সরকার দেড় হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে যে প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তাতে কুড়িগ্রাম জেলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নতুন বিভাগের জেলাগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে প্রথমত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া তিন হাজার ২০২টি শিল্পকারখানা এবং বন্ধ হওয়ার পথে দুই হাজার ৩৩টি কারখানায় অতিদ্রুত গ্যাসের সংযোগ দিতে হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। নদীভাঙন প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্থায়ী উদ্যোগ ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় স্থলবন্দর স্থাপন করা উচিত। জেলায় জেলায় কৃষিজ পণ্য সংরক্ষণে পর্যাপ্ত সংখ্যক হিমাগার নির্মাণ করাও প্রয়োজন।
রহিম আবদুর রহিম, শিক্ষক, পঞ্চগড়।
এসব আজ থেকে ১০ বছর আগেকার ঘটনা। বাবা এখন অবসরে। এই ১০ বছরে পরিস্থিতি নাকি আরও খারাপ হয়েছে। রেলের যেখানে প্রতিদিন ট্রেন চালাতে দরকার ৫০০ ইঞ্জিন, সেখানে আছে মাত্র ২৮৮টি। তাও আবার ৭০ ভাগই ২০ বছরেরও পুরোনো। অথচ উন্নত বিশ্বে একটা ইঞ্জিনের বয়স ১৫ বছর হলেই তাকে লাইন থেকে তুলে নেওয়া হয়। আরও মজার ব্যাপার, ৮২টি ইঞ্জিন আছে ৪০ বছরেরও পুরোনো। এর ওপর তীব্র লোকসংকট। ৫৪ হাজার লোকের কাজ করছে ৩০ হাজারেরও কম মানুষ মিলে।
পরিবারের অনুরোধে প্রায় দূরযাত্রায় রেলের সাওয়ার হতে হয়। প্রায় প্রতিটি ভ্রমণই হয় একেকটা তিক্ত অভিজ্ঞতা। বগিগুলোর কী যাচ্ছেতাই অবস্থা। বাথরুম হয় ব্যবহার অনুপযোগী, নয়তো ভেতর থেকে লক করা। আর পাংচুয়ালিটের কথা নাই বা তুললাম। মাঝেমধ্যে রাগ হয়, মনে মনে বলি, আর রেলের ছায়া মাড়াব না। এ খারাপ অবস্থার জন্য কী একাই রেল দায়ী, আর কারও কোনো দায় নেই? জাতীয় জীবনে কি রেলের কোনো অবদান নেই?
রেলের নাকি এখনো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাছে ১২ হাজার কোটি টাকার ওপর পাওনা আছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান দেনা পরিশোধ না করেই ফতুর হয়ে গেছে। যেমন আদমজী জুটমিলের কাছে রেলের পাওনা ৩৫০ কোটি টাকা। এর ওপর আর্মি-বিডিআরের জন্য রেমিশনে টিকিট, ডাক বিভাগকে নামমাত্র মূল্যে সেবা, অলাভজনক শাখা লাইন পরিচালনা, সড়কপথের তুলনায় অর্ধেক ভাড়ায় টিকিট—রাজ্যের যত দায় তার কাঁধে। অথচ রাষ্ট্রের এই নীরব সেবকের কপালে চোরের অপবাদ আর বঞ্চনার যাতনা ছাড়া কিছুই জুটল না। অবহেলায় অবহেলায় একটি বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর মধ্যে আরেক নতুন দুর্বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে।
হ্যাঁ, ১১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে ছয়জন রেলে কাটার ঘটনা ও পরবর্তী সময়ে রেলগাড়িতে অগ্নিসংযোগের কথা বলছি। আসলে এ ঘটনায় দুটি ক্ষতি হয়েছে—একটা পূরণীয়, আরেকটা অপূরণীয়। অপূরণীয় ক্ষতিটা হয়েছে জানের, পূরণীয় ক্ষতিটা যানের। কিন্তু প্রথমটা ‘অসতর্কতার ফসল’, পরেরটা ‘সতর্কভাবেই’ করা। প্রথমটা লঙ্ঘনীয় ছিল, পরেরটা অহেতুক। তবে সমস্যা হলো, দুই ক্ষতির দায় দুই শিবিরে চলে গেছে। অথচ দুটি ক্ষতিই এ দেশের মানুষেরই।। ছয়টি পরিবারের ছয়টি মানুষ যেমন আর কখনো ফিরে আসবে না, এ দেশের গরিব-ভুখা মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কেনা ইঞ্জিন-বগিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে আমরাই সুলভে পাওয়া রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হব। এই ঘটনায় পুড়ে গেছে সবচেয়ে নতুন সিরিজের একটি ইঞ্জিন। যার মূল্য ২৫ কোটি টাকা। সঙ্গে গেছে ১০টি বগি। আরও ২০ কোটি টাকার দায়। উত্তরবঙ্গের পথে চলাচলকারী তিনটি জনপ্রিয় ট্রেনের একটি ছিল ‘দ্রুতযান’। এটা বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য।
জয়দীপ দে, দক্ষিণ খুলশী, চট্টগ্রাম।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন
প্রথম আলোয় ২১ সেপ্টেম্বর ছিদ্দিকুর রহমানের ‘প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন কৌশল’ শীর্ষক লেখাটি পড়লাম। তাঁর বক্তব্যের কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার এখন শতকরা নব্বইয়ের কাছাকাছি। কিন্তু তাদের অনেকেই পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। পড়া বুঝতে না পারা, বিদ্যালয়ে যেতে না চাওয়া, পরীক্ষায় ফেল করা ইত্যাদি সমস্যা আছে। এসবের পেছনে অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি আছে শিশুর পারিবারিক পরিবেশের সঙ্গে বিদ্যালয়ের পরিবেশের বিস্তর ফারাক। সে জন্য শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার আগে প্রাক-প্রাথমিক একটি পর্যায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের নানা সমস্যার কথা বিবেচনা করে জাতীয় শিক্ষানীতিতে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা বলা হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা।
লেখক দেশের প্রতিটি উপজেলায় ২০০টি করে প্রায় এক লাখ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করার প্রস্তাব করেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু’ নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এতে দেশের মোট ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুশ্রেণী চালু করতে সরকারের ৩১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এখনো দেশের প্রায় দুুুই হাজার গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। চলতি অর্থবছর থেকেই এক হাজার ৫০০ গ্রামে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত দু-একটি কক্ষ বাড়ালেই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কাজ চালু করা যেতে পারে। স্বল্পমাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটালে একই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চেহারা পাল্টে যাবে এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা যাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, পাঠ্যবইয়ের অভাব, শিক্ষার উপকরণের অভাব, পরিষ্কার ও স্বাভাবিক আলো-বাতাসসম্পন্ন শ্রেণীকক্ষের অভাব সবারই জানা কথা। এসব দিকে মনোযোগ দিলেও অল্প খরচে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কারের কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা যাবে। পাশাপাশি যেসব বেবি ক্লাস, কেজি ক্লাস বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসাতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে, সেগুলোকে বন্ধ না করে কার্যকর তত্ত্বাবধান ও নীতির আওতায় এনে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রমকে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদকে এর তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে এর আগে ইউনিয়ন পরিষদের কাজের আওতা, ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সরকারের চিন্তা ও নীতির আধুনিকীকরণ করতে হবে। দুর্গম অঞ্চলগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অনেক পরিবার শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে বিমুখ হচ্ছে। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে মায়েদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অংশ ‘মা-সমাবেশ’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বাবাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা গেলে ভালো হয়।
আমাদের সীমিত সম্পদ সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করে বাস্তবতার নিরিখে নীতি ও বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা উচিত।
হাসান তৌফিক ইমাম ও নাজমুস সাকীব, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। hasant99@yahoo.com
nshimel71@gmail.com
রংপুর বিভাগের উন্নয়ন কত দূর
সরকার রংপুরকে দেশের সপ্তম বিভাগ ঘোষণা করায় রংপুর বিভাগের জনমানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলের খেটে-খাওয়া জনমানুষ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, বৈষম্যের শিকার। দেশের উর্বর এই অঞ্চলের মানুষ সহজ-সরল ও পরিশ্রমী। তবু তারা কেন দরিদ্র, এটাই বড় প্রশ্ন।
সম্প্রতি রংপুর বিভাগের নাগরিক কমিটি নতুন এই বিভাগের উন্নয়নের ১৫টি দাবিতে পথযাত্রা কর্মসূচি পালন করল। দিনাজপুর থেকে শুরু করে বিভাগের আটটি জেলা সফর শেষে রংপুর এসে পথযাত্রার সমাপ্তি ঘটে। পঞ্চগড় থেকে গাড়ির বহর যাত্রা করে চিলাহাটি পৌঁছলাম। চিলাহাটি সরকারি কলেজমাঠ জনমানুষে পরিপূর্ণ। কেউ চাইলেন স্থলবন্দর, কেউ চাইলেন রেলওয়ে স্টেশন, কেউ চাইলেন শিল্পকারখানা। এই অঞ্চলের প্রয়োজন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার সংস্কার। নীলফামারী জেলার সঙ্গে চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ হয়ে পঞ্চগড়ের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নই প্রধান দাবি। রেল যোগাযোগ আরও গতিশীল ও আধুনিক হওয়া উচিত। সৈয়দপুরে রেলওয়ের বেদখল সম্পত্তিও উদ্ধার করা প্রয়োজন।
কুড়িগ্রাম জেলার ৬৮টি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে গত কয়েক বছরে। ভিটেমাটি হারিয়েছে প্রায় ৮০ হাজার পরিবার, দারিদ্র্য তাদের চিরসঙ্গী। জেলার ১৩১টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অর্ধাহারে-অনাহারে ক্লিষ্ট শিশুরা কঠিন শ্রমে নিয়োজিত, কিন্তু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। এক ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপের শিশুশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সারা দিন কাজ করে সে এক বেলা খাবার পায়, দৈনিক বেতন মাত্র ৩০ টাকা। কুড়িগ্রাম জেলাকে নদীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে নদীভাঙন রোধের স্থায়ী ব্যবস্থা প্রয়োজন। ১৩১টি গ্রামের শিশুদের জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা। বর্তমান সরকার দেড় হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে যে প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তাতে কুড়িগ্রাম জেলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নতুন বিভাগের জেলাগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে প্রথমত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া তিন হাজার ২০২টি শিল্পকারখানা এবং বন্ধ হওয়ার পথে দুই হাজার ৩৩টি কারখানায় অতিদ্রুত গ্যাসের সংযোগ দিতে হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। নদীভাঙন প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্থায়ী উদ্যোগ ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় স্থলবন্দর স্থাপন করা উচিত। জেলায় জেলায় কৃষিজ পণ্য সংরক্ষণে পর্যাপ্ত সংখ্যক হিমাগার নির্মাণ করাও প্রয়োজন।
রহিম আবদুর রহিম, শিক্ষক, পঞ্চগড়।
No comments