প্রত্নতত্ত্ব-প্রত্নতাত্ত্বিক আইনগুলোর সংস্কার জরুরি by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
জাদুঘর হলো কৌতূহল উদ্রেককারী এবং দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের প্রতিষ্ঠান। যেকোনো ভূখণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পুনর্গঠন করে তার দ্বারা সেখানকার অধিবাসীদের দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব বর্তায় জাদুঘরের ওপর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাদুঘর বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়েছে।
১৯৭৪ সালের কোপেনহেগেন ঘোষণায় জাদুঘরের কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছে। এখন জাদুঘর রাষ্ট্রীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দেশ বাংলাদেশে জাদুঘরের ভূমিকাও অনেকখানি। দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, লোকতাত্ত্বিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নানা শ্রেণীর জাদুঘর গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে জাদুঘরের সংখ্যা দেড় শর মতো। দেশে জাদুঘরের এই সংখ্যা দেখে মনে করার সংগত কারণ আছে যে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
প্রাক-মৌর্য শাসনামল থেকে ইতিহাসের সুদীর্ঘ কালপরম্পরায় সৃজিত পুরাবস্তু—মৃন্ময় ভাস্কর্য, তাম্রশাসন, মৃন্ময় শিল্পসহ বিভিন্ন শ্রেণীর নিদর্শন দেশের জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে—সংগ্রহের ধারা অব্যাহত। নিদর্শনগুলো হলো বাংলাদেশের মানুষের অতীতের ঠিকানা, আত্মপরিচয়ের দলিল। প্রাপ্ত নতুন নতুন নিদর্শনের মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত হচ্ছে আমাদের অতীত ইতিহাস।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে জাদুঘরের জন্য অপরিহার্য অতীতের স্মারক ওই সাংস্কৃতিক সম্পদের সঠিক সংরক্ষণ হচ্ছে না। দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য নেই হালনাগাদ আইন। বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন, হারিয়ে যাচ্ছে দেশের অমূল্য পুরাবস্তু। ‘প্রাচ্যের রহস্য নগর’ খ্যাত ঢাকার অনেক ঐতিহাসিক ইমারত ভেঙে ফেলা হয়েছে। সংস্কার ও সম্প্রসারণের নাম করে সেসব স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমলে না নিয়ে আধুনিক স্থাপনায় রূপান্তর করা হয়েছে। ঢাকার নারিন্দায় সুলতানি আমলে নির্মিত বিনত বিবির মসজিদ ভাঙা বন্ধ করতে জনগণ আন্দোলন শুরু করেছিল। ফল কিছুই হয়নি। মুসল্লিদের স্থান-সংকুলান হয় না—এই অজুহাত এনে অসাধারণ শিল্প-সুষমামণ্ডিত মসজিদটি ভেঙে ফেলে সেখানে বৃহদাকারের আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
এমন ঘটনা দেশের অন্যত্রও বহু ঘটেছে। রাজশাহী শহরে গত এক দশকে বেশ কটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে কান্তকবি রজনীকান্ত সেন, ‘সিরাজউদদৌলা’ খ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের বাসভবন। ভেঙে ফেলা হয়েছে গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত ‘হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ’ এবং ‘ওয়াটার ওয়ার্কস প্ল্যান্ট’। মহারানি হেমন্তকুমারী রাজশাহী শহরবাসীর জলকষ্ট নিরসনের জন্য নিজ অর্থব্যয়ে ওই ওয়াটার প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপত্তি-আন্দোলন করেও ওই ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করা যায়নি। দেশের বেশি ক্ষতি হচ্ছে প্রত্নপীঠগুলোর। ঔপনিবেশিক শাসনামলে শনাক্ত করা ওই সব ঐতিহাসিক স্থান উপযুক্ত প্রযুক্তি ও অর্থাভাবে খনন করা সম্ভব হয়নি। যদিও এর অনেকগুলো আংশিকভাবে একসময় ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকদের নেতৃত্বে উৎখনন করা হয়েছিল। এসব স্থান থেকে উদ্ধার করা পুরাবস্তু দেশের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন জাদুঘরে প্রদর্শনে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হলো, এসব প্রত্নপীঠের অনেকগুলোরই অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব স্থান এখন আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে নিয়মিত ফসল হয়। রাজশাহীর তানোর উপজেলার বিহারইল প্রত্নপীঠ এখন কবরস্থান আর বসতবাড়ি। অথচ এখান থেকেই গুপ্ত আমলে তৈরি বেলে পাথরের বিখ্যাত বিহারইল বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশে প্রাপ্ত গুপ্ত শিল্পকলার অনন্য দৃষ্টান্ত ওই ভাস্কর্যটি।
দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ জরুরি বলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন। আইনের দ্বারা ঐতিহাসিক ইমারত ধ্বংস বন্ধ করতে হবে, পুরাকীর্তির গুপ্তভান্ডার প্রত্নপীঠগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে, পুরাকীর্তির পাচার রোধ করতে হবে। একই সঙ্গে ‘রিটার্ন অ্যান্ড রেস্টিটিউশন অব কালচারাল প্রপার্টি’ আইনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া পুরাকীর্তিগুলো দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশে পুরাকীর্তি বিষয়ে তিনটি আইন বিদ্যমান: ‘ট্রেজারস ট্রুভ অ্যাক্ট ১৮৭৮’, ‘অ্যানশিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজারভেশন অ্যাক্ট ১৯০৪’ এবং ‘অ্যান্টিকুইটিজ অ্যাক্ট ১৯৪৭’। তিনটি আইনই ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত। আইনগুলো পাকিস্তান আমলে হুবহু আত্তীকৃত হয়েছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর একই অবস্থায় আইনগুলো কার্যকর করা হয়েছে।
ট্রেজারস ট্রুভ আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রাপ্ত সময় থেকে ১০০ বছরের পুরোনো (১০ টাকা মূল্যমানের হলেও) মাটির নিচে থাকা যেকোনো বস্তু পাওয়ামাত্র নিকটতম ট্রেজারিতে জমা করতে প্রাপক বাধ্য থাকবে। আইনটি ১৮৯১ এবং ১৯০৭ সালে কিছু সংশোধন করা হয়। নানা কৌণিকে ব্যাখ্যা করে আইনটির সংস্কার খুবই প্রয়োজন। ‘অ্যানশিয়েন্ট মনুমেন্টস প্রিজারভেশন অ্যাক্ট’ পুরাকীর্তির পাচার রোধ এবং ঐতিহাসিক ইমারত রক্ষা, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও শিল্পকলার নিদর্শনগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল। পুরাকীর্তি পাচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তির বিধান রেখে আইনটির সংশোধনী আশু প্রয়োজন। অ্যান্টিকুইটিজ (এক্সপোর্ট কন্ট্রোল) অ্যাক্ট আইনবলে সরকারি অনুমোদনক্রমে বিদেশে পুরাকীর্তি রপ্তানি করা যায়। বিশাল ফাঁক রয়ে গেছে এ আইনেও। যে কেউ কৌশল অবলম্বন করে দেশের মহামূল্য ওই জাতীয় সম্পদ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠাতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক প্রত্যয়নের বিধান এ আইনে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্মেলন। এর ঘোষণায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। দেশের বিশিষ্টজনেরা বলছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতিকে ব্যবহার করতে হলে প্রয়োজন একটি কমিশন তৈরি করে ‘সাংস্কৃতিক নীতিমালা’ প্রণয়ন। প্রণীতব্য নীতিমালার মাধ্যমেই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষায় আইনগুলো সংস্কার করে হালনাগাদ করা সম্ভব হবে। তাঁদের ভাষ্য, এসব কাজ যত দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে, জাতির জন্য ততই মঙ্গল হবে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক ও অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক পরিচালক, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, রাজশাহী।
saif@yahoo.com
No comments