ইউরোপের চিঠি-আর্কটিকের জ্বালানি-সম্পদকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব by পিটার কাস্টার্স
শুরুতে মনে হবে যেন কোনো পাঠ্যবইয়ে পড়া গল্প। যে গল্পের মূলে আছে জীবাশ্ম জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে কয়েক শতাব্দী ধরে তেতে উঠতে থাকা কয়েকটি ধনী দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। গত ২১ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় আর্কটিকবিষয়ক একটি ফোরামের বৈঠক বসে।
রাশিয়ার জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি এবং জাতীয় সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্তি যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আর্কটিকের সঙ্গে সীমান্ত আছে, এমন দেশগুলো ছাড়াই এদের আশপাশের কয়েকটি দেশ থেকে আসা কয়েক শ বিজ্ঞানী ও রাজনীতিক এতে যোগ দিয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, এই ফোরামের প্রতি রাশিয়ার সরকার সুপ্রসন্ন। উত্তর মেরুর বিরাট এক অংশের (যা এখনো হিমমুকুটের দ্বারা আচ্ছন্ন) ওপর রাশিয়ার দাবি জোরালো করার জন্য এই ফোরামকে ব্যবহার করা হয়। এর আগে ২০০৭ সালে রাশিয়া এ দাবি তুলে ধরেছিল। তখন তাদের বিজ্ঞানীরা একটি খুদে সাবমেরিন নামিয়েছিলেন আর উত্তর মেরুর তলদেশে রাশিয়ার পতাকা পুঁতে দিয়েছিলেন। তারও আগে ২০০১ সালে রাশিয়া ‘লোমোনোসভ’ নামে পরিচিত জলতলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মালিকানার দাবি পেশ করে জাতিসংঘের কাছে। আর্কটিক ফোরামের বিষয়ে রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে ধারণা করা যায়, সমুদ্রবিষয়ক আইন নিয়ে জাতিসংঘের কনভেনশনে যে বিধান প্রণীত হয়েছে, রাশিয়া মনে করে, তার সঙ্গে রাশিয়ার ১২ লাখ কিলোমিটার আর্কটিক সার্কেলের দাবি সংগতিপূর্ণ।
তবে উত্তর মেরুর অংশবিশেষের ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করেছে আরও কয়েকটি দেশ। প্রকৃতপক্ষে আর্কটিকের সীমান্তবর্তী পাঁচটি রাষ্ট্রের সব কটি আলাদাভাবে এমন দাবি তুলেছে। এ প্রসঙ্গে ডেনমার্কের কথা বলা যেতে পারে। গ্রিনল্যান্ডের বরফাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ এলাকা শাসন করে ডেনমার্ক। অনেকাংশে আর্কটিক সার্কেলে পড়েছে গ্রিনল্যান্ড। নিজেদের দাবি জোরালো করার লক্ষ্যে ডেনমার্ক এরই মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়েছে। অন্যদিকে স্ক্যান্ডিনেভীয় প্রতিবেশী নরওয়ে আর্কটিকের পূর্বাংশের ওপর তাদের অধিকার বিস্তৃতির দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলেছে। আর্কটিকের নিকটবর্তী দেশগুলোর এই উত্তেজনার পেছনে কারণ হলো, আর্কটিক সার্কেলের তলদেশে সঞ্চিত তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। উত্তর মেরুর হিমমুকুট গলে যাওয়ার আগে বা পরে যখনই তা উত্তোলন করা যাক না কেন, সেটা এ মুহূর্তে বিবেচ্য নয়। আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই নিশ্চিত জানে, আর্কটিক সমুদ্রের নিচে চাপা পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য কাঁচামাল। আমেরিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্কটিক থেকে আহরণযোগ্য মজুদের মধ্যে ৯০ বিলিয়ন ব্যারেল অশোধিত তেল এবং ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে। জ্বালানি-উন্মুখ দেশগুলো প্রলুব্ধ হওয়ার জন্য এ মজুদ যথেষ্ট। বিশেষত যখন দুনিয়া তেল উৎপাদনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যার পর আরও উৎপাদন বাড়ানো কঠিন।
এসব দেশের ভূখণ্ডসংক্রান্ত দাবিগুলো মনে হতে পারে সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আর্কটিকের সম্পদ আহরণ নিয়ে ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা কোনোভাবেই গড়পড়তা কোনো ব্যাপার হবে না। প্রথমত, উত্তর মেরুতে কোনো মাটি নেই, এটি গভীর সামুদ্রিক অঞ্চল। দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকার মতোই পৃথিবীর বুকে যেদিন প্রথম মানুষের পদচারণ শুরু হয়, সেদিন থেকে উত্তর মেরু বরফে আচ্ছন্ন আছে। কিন্তু দুই মেরু অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিস্থিতির মধ্যকার পার্থক্য ব্যাপক। অ্যান্টার্কটিকায় বরফাচ্ছাদিত মাটি, যার চারপাশে সমুদ্র। অন্যদিকে আর্কটিক হলো গভীর সমুদ্র, হিমমুকুটে ভরা। এই মেরুবৃত্ত থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ দুটি কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যা। প্রথমত, বরফাচ্ছাদিত এলাকায় খননকাজ করার অভিজ্ঞতা বিশ্বের তেল করপোরেশনগুলোর কম। আবার গত এপ্রিলে মেক্সিকো উপসাগরে বিপি তেল নির্গমনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সমস্যা থেকে বোঝা যায়, গভীর সমুদ্রে সব ধরনের খননই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ ধরনের খননের ফলে সহজেই মানবিক ও পরিবেশগত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। মেক্সিকো উপসাগরে তেল নির্গমনের এ ঘটনার পর আর্কটিকে খননকাজের বিরোধীরা আলাস্কার উত্তর তীরে বহুজাতিক কোম্পানি শেল কর্তৃক অনুসন্ধানমূলক খনন ঠেকানোর তৎপরতা জোরদার করেছে। কিন্তু আর্কটিকজুড়ে গভীর সমুদ্রে খননকাজ নিষিদ্ধ করাও তো জরুরি।
এমন ভাবনা যে কষ্টকল্পিত নয়, তা উপলব্ধি করতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিতর্কের প্রেক্ষাপটেই উত্তর মেরু নিয়ে ভূখণ্ডগত বিরোধকে বিবেচনা করা দরকার। আর্কটিকবিষয়ক উপাত্তের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়, পৃথিবী উষ্ণ হয়ে ওঠার ঝুঁকি কত বড়। বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডে যে বরফের চাঁই জমে আছে তা যদি গলে যায়, তাহলে দুনিয়াব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সাত মিটার বেড়ে যাবে—এমনটাই জানিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে যাওয়ার আশঙ্কা কোনো দূরবর্তী ব্যাপার নয়। এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ ভালোমতোই চোখে পড়ছে। যেমন গ্রিনল্যান্ডের কিছু হিমবাহ যে গতিতে দেশটির উপকূল অভিমুখে প্রবাহিত হতো, তার গতি বেড়েছে। এমনকি একটি হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। সামগ্রিকভাবে আর্কটিক সার্কেলের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা হলো, গত ৩০ বছরে বরফের চাঁইগুলো এর পৃষ্ঠভাগের ১৫ শতাংশ এবং পুরুত্বের ৩০ শতাংশ হারিয়ে ফেলেছে। যেসব আদিবাসী শিকারিজীবী এবং পশু জীবনযাপনের জন্য বরফের চাঁইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তুষার-ভালুকের উদাহরণ টানা যেতে পারে। আর্কটিকের প্রতীক এই তুষার-ভালুক শিগগিরই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে।
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মস্কো ফোরাম অন আর্কটিককে এক পরাবাস্তব ঘটনা বলে মনে হয়। কেননা, জলবায়ু বিপর্যয়ের বিশ্বনাটক মঞ্চায়ন এ অঞ্চলেই ঘটার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন এক পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি, যেখান থেকে আর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। যে দুটি বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেগুলো আর্কটিক সার্কেল ও আশপাশের এলাকায় ঘটে। আর্কটিকের বরফের চাঁই আলবেডো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যার মানে হলো সূর্যের আলো মহাশূন্যে ফিরে যাওয়া। তা ছাড়া আর্কটিক বরাবর রাশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের হিমায়িত মাটির ভেতর বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস থাকার আশঙ্কা রয়েছে। মিথেন একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। এভাবে পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় বরফ গলে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী মহাপ্লাবন সৃষ্টি হতে পারে। সমুদ্রের পানির স্তর অত্যন্ত দ্রুত বেড়ে যেতে পারে, যা রাতারাতি কোটি কোটি মানুষকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ সময়ে কয়েকটি রাষ্ট্র আর্কটিকের কিছু অংশের ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক পথে হাঁটারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। খবর বেরিয়েছে যে বিশেষ আর্কটিক সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করছে রাশিয়া। অন্যদিকে কানাডা এ অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করেছে। আর্কটিক সার্কেলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ভাবনা উদ্ভট। বরং উত্তর মেরু ও আর্কটিক থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি আহরণ ও অনুসন্ধান থেকে রাশিয়া এবং অন্য দেশগুলোকে বিরত থাকার দাবির পক্ষেই যুক্তি জোরালো।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ। প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
তবে উত্তর মেরুর অংশবিশেষের ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করেছে আরও কয়েকটি দেশ। প্রকৃতপক্ষে আর্কটিকের সীমান্তবর্তী পাঁচটি রাষ্ট্রের সব কটি আলাদাভাবে এমন দাবি তুলেছে। এ প্রসঙ্গে ডেনমার্কের কথা বলা যেতে পারে। গ্রিনল্যান্ডের বরফাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ এলাকা শাসন করে ডেনমার্ক। অনেকাংশে আর্কটিক সার্কেলে পড়েছে গ্রিনল্যান্ড। নিজেদের দাবি জোরালো করার লক্ষ্যে ডেনমার্ক এরই মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়েছে। অন্যদিকে স্ক্যান্ডিনেভীয় প্রতিবেশী নরওয়ে আর্কটিকের পূর্বাংশের ওপর তাদের অধিকার বিস্তৃতির দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলেছে। আর্কটিকের নিকটবর্তী দেশগুলোর এই উত্তেজনার পেছনে কারণ হলো, আর্কটিক সার্কেলের তলদেশে সঞ্চিত তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। উত্তর মেরুর হিমমুকুট গলে যাওয়ার আগে বা পরে যখনই তা উত্তোলন করা যাক না কেন, সেটা এ মুহূর্তে বিবেচ্য নয়। আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই নিশ্চিত জানে, আর্কটিক সমুদ্রের নিচে চাপা পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য কাঁচামাল। আমেরিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্কটিক থেকে আহরণযোগ্য মজুদের মধ্যে ৯০ বিলিয়ন ব্যারেল অশোধিত তেল এবং ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে। জ্বালানি-উন্মুখ দেশগুলো প্রলুব্ধ হওয়ার জন্য এ মজুদ যথেষ্ট। বিশেষত যখন দুনিয়া তেল উৎপাদনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যার পর আরও উৎপাদন বাড়ানো কঠিন।
এসব দেশের ভূখণ্ডসংক্রান্ত দাবিগুলো মনে হতে পারে সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আর্কটিকের সম্পদ আহরণ নিয়ে ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা কোনোভাবেই গড়পড়তা কোনো ব্যাপার হবে না। প্রথমত, উত্তর মেরুতে কোনো মাটি নেই, এটি গভীর সামুদ্রিক অঞ্চল। দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকার মতোই পৃথিবীর বুকে যেদিন প্রথম মানুষের পদচারণ শুরু হয়, সেদিন থেকে উত্তর মেরু বরফে আচ্ছন্ন আছে। কিন্তু দুই মেরু অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিস্থিতির মধ্যকার পার্থক্য ব্যাপক। অ্যান্টার্কটিকায় বরফাচ্ছাদিত মাটি, যার চারপাশে সমুদ্র। অন্যদিকে আর্কটিক হলো গভীর সমুদ্র, হিমমুকুটে ভরা। এই মেরুবৃত্ত থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ দুটি কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যা। প্রথমত, বরফাচ্ছাদিত এলাকায় খননকাজ করার অভিজ্ঞতা বিশ্বের তেল করপোরেশনগুলোর কম। আবার গত এপ্রিলে মেক্সিকো উপসাগরে বিপি তেল নির্গমনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সমস্যা থেকে বোঝা যায়, গভীর সমুদ্রে সব ধরনের খননই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ ধরনের খননের ফলে সহজেই মানবিক ও পরিবেশগত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। মেক্সিকো উপসাগরে তেল নির্গমনের এ ঘটনার পর আর্কটিকে খননকাজের বিরোধীরা আলাস্কার উত্তর তীরে বহুজাতিক কোম্পানি শেল কর্তৃক অনুসন্ধানমূলক খনন ঠেকানোর তৎপরতা জোরদার করেছে। কিন্তু আর্কটিকজুড়ে গভীর সমুদ্রে খননকাজ নিষিদ্ধ করাও তো জরুরি।
এমন ভাবনা যে কষ্টকল্পিত নয়, তা উপলব্ধি করতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিতর্কের প্রেক্ষাপটেই উত্তর মেরু নিয়ে ভূখণ্ডগত বিরোধকে বিবেচনা করা দরকার। আর্কটিকবিষয়ক উপাত্তের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়, পৃথিবী উষ্ণ হয়ে ওঠার ঝুঁকি কত বড়। বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডে যে বরফের চাঁই জমে আছে তা যদি গলে যায়, তাহলে দুনিয়াব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সাত মিটার বেড়ে যাবে—এমনটাই জানিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে যাওয়ার আশঙ্কা কোনো দূরবর্তী ব্যাপার নয়। এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ ভালোমতোই চোখে পড়ছে। যেমন গ্রিনল্যান্ডের কিছু হিমবাহ যে গতিতে দেশটির উপকূল অভিমুখে প্রবাহিত হতো, তার গতি বেড়েছে। এমনকি একটি হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। সামগ্রিকভাবে আর্কটিক সার্কেলের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা হলো, গত ৩০ বছরে বরফের চাঁইগুলো এর পৃষ্ঠভাগের ১৫ শতাংশ এবং পুরুত্বের ৩০ শতাংশ হারিয়ে ফেলেছে। যেসব আদিবাসী শিকারিজীবী এবং পশু জীবনযাপনের জন্য বরফের চাঁইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তুষার-ভালুকের উদাহরণ টানা যেতে পারে। আর্কটিকের প্রতীক এই তুষার-ভালুক শিগগিরই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে।
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মস্কো ফোরাম অন আর্কটিককে এক পরাবাস্তব ঘটনা বলে মনে হয়। কেননা, জলবায়ু বিপর্যয়ের বিশ্বনাটক মঞ্চায়ন এ অঞ্চলেই ঘটার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন এক পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি, যেখান থেকে আর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। যে দুটি বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেগুলো আর্কটিক সার্কেল ও আশপাশের এলাকায় ঘটে। আর্কটিকের বরফের চাঁই আলবেডো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যার মানে হলো সূর্যের আলো মহাশূন্যে ফিরে যাওয়া। তা ছাড়া আর্কটিক বরাবর রাশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের হিমায়িত মাটির ভেতর বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস থাকার আশঙ্কা রয়েছে। মিথেন একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। এভাবে পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় বরফ গলে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী মহাপ্লাবন সৃষ্টি হতে পারে। সমুদ্রের পানির স্তর অত্যন্ত দ্রুত বেড়ে যেতে পারে, যা রাতারাতি কোটি কোটি মানুষকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ সময়ে কয়েকটি রাষ্ট্র আর্কটিকের কিছু অংশের ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক পথে হাঁটারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। খবর বেরিয়েছে যে বিশেষ আর্কটিক সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করছে রাশিয়া। অন্যদিকে কানাডা এ অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করেছে। আর্কটিক সার্কেলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ভাবনা উদ্ভট। বরং উত্তর মেরু ও আর্কটিক থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি আহরণ ও অনুসন্ধান থেকে রাশিয়া এবং অন্য দেশগুলোকে বিরত থাকার দাবির পক্ষেই যুক্তি জোরালো।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ। প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
No comments