এই দিনে-আমাদের স্মৃতি, তাদের বিস্মৃতি by সুরঞ্জিত বৈদ্য

নিরন্তর কালের আবর্তনে আবার ফিরে এসেছে ১৫ অক্টোবর, ফিরে এসেছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’। আজ থেকে ২৫ বছর আগের এই দিনে (১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর আকাশে প্রচণ্ড মেঘ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর মাঝেমধ্যে সামান্য দমকা হাওয়া যেন বারবার জানান দিচ্ছিল ভয়াবহ এক মহাবিপদের সংকেত।


কিন্তু যে যৌবন অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দ্রোহ, সে যৌবনের কাছে তো সামান্য বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া নিতান্তই তুচ্ছ।
তাই রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর তখনকার জনপ্রিয় ধারাবাহিক শুকতারা নাটকের দ্বিতীয় পর্ব দেখতে জগন্নাথ হলের পরিষদ ভবনের জরাজীর্ণ টিভি অডিটরিয়াম যখন কানায় কানায় পূর্ণ, ঠিক তখন নিতান্তই একটি তুচ্ছ দমকা হাওয়া যেন সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল। মুহূর্তেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ হল পরিণত হলো এক মৃত্যুপুরীতে। চারদিকে শুধু হাহাকার রব—‘বাঁচাও বাঁচাও’। জগন্নাথ হলের টিভি অডিটরিয়ামের ছাদ ধসে অসংখ্য ছাত্র ছাপা পড়ার কাহিনি ত্বরিত প্রচার হওয়ায় দেখতে দেখতে সেখানে নেমে এল মানুষের ঢল। তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষই নেমে পড়ল উদ্ধারকাজে। ইট, লোহা, কাঠের গরাদসহ চুন-সুরকির ধ্বংসস্তূপ থেকে সারা রাত ধরে সবাইকে উদ্ধারের প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে। জীবিত-মৃত কিছুই বোঝার উপায় নেই, প্রায় সবাই অচেতন। তাঁদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া এবং স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার জন্য জড়ো হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীসহ পথচারী সাধারণ মানুষ। সেখানে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান—কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এ যেন আবহমান বাংলার চিরন্তন অসাম্প্রদায়িক চেতনারই এক মূর্ত দৃষ্টান্ত। যেন শোকগ্রস্ত বাঙালির মানবীয় একাত্মবোধের পরিচয় পুনঃপরীক্ষিত হয়েছিল সেদিন। জগন্নাথ হলের প্রতি তৎকালীন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরম অবহেলা আর অবজ্ঞার অনিবার্য পরিণতিই এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি, যে ট্র্যাজেডির নির্মম শিকার ৩৯ জন মেধাবী ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথিরা এবং গুরুতর আহত শতাধিক। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ বাড়ৈ নামে গুরুতর আহত এক ছাত্রের মৃত্যু হলে মৃতের সঠিক পরিসংখ্যান গিয়ে দাঁড়ায় চল্লিশে।
নিহত মেধাবী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে অনেকে অনেক কিছুই হতে পারতেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’ কবিতায় অমলকান্তির বন্ধুদের মতো তাঁরা অনেকে অনায়াসেই অধ্যাপক, ম্যাজিস্ট্রেটসহ অনেক কিছুই হতে পারতেন কিন্তু তাঁরা কিছুই হতে পারেননি, শুধু লাশ হয়ে ফিরেছিলেন মায়ের কোলে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অনাদরের মাশুল যে একদিন এভাবেই গুনতে হবে তা কি কেউ কখনো ভেবেছিলেন? তাদের চরম অবহেলার কারণে সে দিন পিতা হারালেন তাঁর বুকের ধনকে, মা হারালেন চোখের মানিককে, ভাই ভাইকে, বোন হারালেন প্রিয় দাদাকে, প্রেমিকা হারালেন তাঁর পরম স্বপ্নে লালিত ভালোবাসাকে, আর দেশবাসী হারাল কিছু তরতাজা ফুটন্ত যৌবনকে, যে যৌবন সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার পর হলের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতায় সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হয় ‘অক্টোবর স্মৃতিভবন’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজন আহত ছাত্রকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে দুর্ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকার যে রকম সহমর্মিতা প্রকাশ করেছিল, তৎপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ সে রকম ছিল না। কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে জরাজীর্ণ পরিষদ ভবন সংস্কারের গুরুত্ব অনুভব করেনি। সঠিক সময়ে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিলে এতগুলো সম্ভাবনাময় তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যেত না। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, আমি তখন স্কুলের ছাত্র। সত্যি কথা বলতে কি তখনো জগন্নাথ হল আর জগন্নাথ কলেজের পার্থক্যটা বুঝতাম না। তবুও এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সংবাদে আমার শিক্ষানুরাগী বাবা আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দাদার পাশে বসে অঝোরে চোখের জল ফেলেছি। এ ঘটনার ছয় বছর পর ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতিভবনেই উঠি। এই অক্টোবর স্মৃতিভবনেরই নিচের তলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আজও সযত্নে সংরক্ষিত আছে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে একটি কক্ষ, যেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রত্যেকের ছবি, ব্যবহূত কিছু দ্রব্য আর সেই অভিশপ্ত টেলিভিশন। যত দিন কক্ষটার কাছে গিয়েছি, ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখে জল এসেছে। শুধু নীরবে দুই দণ্ড দাঁড়িয়ে মনে মনে উচ্চারণ করেছি—‘মরণসাগরপারে তোমরা অমর,/তোমাদের স্মরি।’
জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির ২৫ বছর পর এসে আজও মনে হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আবাসিক হলগুলোর প্রতি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার অবসান এখনো পুরোপুরি হয়নি। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের ‘সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন’কে (পূর্ববাড়িকে) ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা সত্ত্বেও সেখানে এখনো কয়েক শ ছাত্র বসবাস করছেন। যদিও এর বিকল্প ভবন হিসেবে পুকুরের পশ্চিমপাড়ে ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে, তবুও দুর্ঘটনা তো মাত্র একটি মুহূর্তের ব্যাপার। এ ছাড়া মুহসীন হলের একাংশ, জহুরুল হক হলের কিছু অংশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত, ওই ভবনগুলোর আশু সংস্কার করা। তা না হলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের বুকে ১৫ অক্টোবরের মতো নেমে আসতে পারে আবার কোনো ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।

No comments

Powered by Blogger.