সাক্ষাৎকার-পরিকল্পিত ঢাকা গড়তে নগরবাসীর সহযোগিতা চাই by মোহাম্মদ নুরুল হুদা
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :সুভাষ সাহা ও তিমির দত্ত প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুরুল হুদা ১৯৭২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বুয়েট থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাসের পর জাপান থেকে ব্রিজ কনস্ট্রাকশন, যুক্তরাজ্যের ওয়ালস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কনস্ট্রাকশন এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেভমেন্ট ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন নিয়ে এডভান্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন।
কর্মজীবনে তিনি সড়ক ও জনপথের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি প্রকৌশলীদের বিভিন্ন পেশার সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন সময় নির্বাচিত হন এবং পেশাজীবী জার্নালও সম্পাদনা করেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সোহরাওয়ার্দী হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও ইউকসুর নির্বাচিত সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
বর্তমানে তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের নির্বাচিত সভাপতি।
তিনি রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান
সমকাল : ঢাকা মহানগরীর অবিরাম সম্প্রসারণ হচ্ছে। তবে তা একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। মহানগরীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন খালি জায়গা উন্নয়ন করে, অনেক ক্ষেত্রেই পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ এবং মেট্রোপলিটন এলাকার প্রান্তে যেসব জায়গা রয়েছে সেগুলো বৈধভাবে হোক আর অবৈধভাবে হোক উন্নয়ন করে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে শহর। অথচ ঢাকার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ড্যাপ মেনে পরিকল্পিত সম্প্রসারিত ঢাকা গড়ে তুলতে অসুবিধা কোথায়?
নুরুল হুদা : ঢাকা মহানগরী ৫৯০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার সম্পূর্ণ এলাকা উন্নয়ন উপযোগী নয়। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা সংবলিত ঢাকা স্ট্র্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে ১৯৯৭ সালে। তবে এর যথাযথ প্রয়োগের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) যা সরকার কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে ২২ জুন ২০১০ তারিখে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ রোধকল্পে ড্যাপ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। অনুমোদন লাভের পরপরই রাজউক তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজউকের বর্তমান সব উন্নয়ন কার্যক্রম ড্যাপের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে।
সমকাল : রাজউক ড্যাপ বাস্তবায়নে কী কী উদ্যোগ নিয়েছে? এসব উদ্যোগ শতভাগ সাফল্যের মুখ দেখতে পারছে না কেন?
নুরুল হুদা : রাজউক ড্যাপ বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে রাজউক এই প্ল্যানের আলোকে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান ও নকশা অনুমোদন করছে। ড্যাপের প্রস্তাবগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তবে এ বিষয়ে রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নগরবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতাও কাম্য।
সমকাল : রাজউকের নকশা ছাড়াই বা নকশায় পরিবর্তন ঘটিয়ে নির্মিত ভবনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৭৩টি ভবনের মালিক প্রভাবশালী। এদের বিরুদ্ধে রাজউকের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কিন্তু যেসব ভবনের মালিক প্রভাবশালী নয় তাদের পান থেকে চুন খসলেই অভিযানের কবলে পড়তে হয়। গণতান্ত্রিক দেশে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগের কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম স্পষ্ট। আপনারা এসব নানা নামের টাওয়ার-স্কয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? কোনো চাপ বা অদৃশ্য সুতার টানেই কি এসব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
নুরুল হুদা :রাজউক আওতাধীন এলাকায় যে কোনো ইমারত নির্মাণের আগে রাজউক কর্তৃক প্রস্তাবিত ইমারতের নকশা অনুমোদন করে নেওয়া অত্যাবশ্যক। অননুমোদিত ও নকশাবহির্ভূত নির্মাণকাজ ইমরাত নির্মাণ আইনের ১৯৫২ (সংশোধিত ১৯৮৭) আওতায় অপসারণ করা হয়। তবে কোনো কোনো ভবনের ক্ষেত্রে মহামান্য আদালত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকায় অপসারণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। মহামান্য আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হওয়ার পর আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
সমকাল : রাজউকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনবল কম বলে তারা অবৈধ বা ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কোনো কোনো নগরবিদ বলছেন, রাজউকের সদিচ্ছা থাকলে তারা এ ব্যাপারে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সাহায্য নিতে পারে। তবে রাজউকের যে লোকবল আছে তাদের দিয়েও অনেক কাজ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
নুরুল হুদা : ৫৯০ বর্গমাইল এলাকাব্যাপী বিস্তৃত রাজউক। এ বিশাল এলাকায় নির্মাণকাজ তদারকি করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল রাজউকের নেই। বিষয়টি উপলব্ধি করে রাজউক প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধির জন্য কারিগরি ও অন্য সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে একটি জনবল কাঠামোর প্রস্তাবনা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে, যা অনুমোদনের জন্য সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এ ছাড়া রাজউক কর্তৃক উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম তদারকির লক্ষ্যে অথরাইজড অফিসার, ম্যাজিস্ট্রেটসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৫টি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। ওই টিম মাঠপর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও অনুমোদনবহির্ভূর্ত নির্মাণকাজ অপসারণের বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সমকাল : ড্যাপে ঢাকার ২১ শতাংশ জায়গা খাল, নদী-নালার জন্য রাখতে বলা আছে। সেটা আদৌ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে কি? কোথাও কোথাও রাজউকের বিরুদ্ধেই জলাভূমি ভরাট করে প্লট তৈরির অভিযোগ উঠেছে। বেসরকারি কোনো কোনো ডেভেলপারের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আছে। রাজউকই যদি আইন না মানে তাহলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ ব্যাপারে দোষ ধরা যাবে কি? জলাভূমি, প্লাবন ভূমি রক্ষা করা গেলে এই মহানগরী এক সময় জলাবদ্ধতার কারণে নাগরিকদের অশেষ দুর্ভোগের কারণ হবে। তাই এ ব্যাপারে রাজউক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
নুরুল হুদা : রাজউক প্রণীত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে খাল, নদী-নালাসহ জলাশয় ও জলাধার চিহ্নিত আছে। এই প্ল্যানের আওতাধীন এলাকায় যেসব উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠান জলাধার ভরাট করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করছে তাদের বিরুদ্ধে রাজউক এর আগে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী একাধিক মামলা করেছে এবং এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সমকাল : রাজউক পরিচালক শেখ আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকার ৮০ শতাংশ বাড়ি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বেআইনি বাড়ির ব্যাপারে রাজউকের ভূমিকা কী হবে? বেআইনিভাবে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে কীভাবে?
নুরুল হুদা :ঢাকা মহানগরী এলাকায় যে কোনো ইমারত নির্মাণের আগে প্রস্তাবিত ইমারতের নকশা রাজউক কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্তির পর সে অনুযায়ী নির্মাণ করতে হয়। নকশাবহির্ভূত যে কোনো নির্মাণকাজ অবৈধ বলে বিবেচিত। এর আগে যেসব ইমারত বেআইনিভাবে গড়ে উঠেছে তা ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় নিয়ে জরিমানা দিয়ে অনুমোদন নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ নির্মাণ রোধের লক্ষ্যে রাজউকের মনিটরিং টিম ও ভ্রাম্যমাণ আদালত সরেজমিনে কাজ শুরু করেছে। এসব কার্যক্রম গ্রহণের ফলে অবৈধ ভবন নির্মাণ কার্যক্রম অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা রাখি। এ ছাড়া অনুমোদনহীন ভবনে যাতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেওয়া হয়েছে।
সমকাল : রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিকুঞ্জ, নিকেতন, জাপান গার্ডেন সিটি প্রভৃতি প্রকল্প নির্মাণ করা হয়নি। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী এসব আবাসিক এলাকায় খেলার মাঠ নেই, ৩০ ফুট সড়কের বদলে রাস্তা হয়েছে ১০ থেকে ১৩ ফুট। গায়ে গায়ে মিলিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা কীভাবে গড়ে উঠল? তখন রাজউকের ভূমিকা কী ছিল? এখন এসব আবাসিক এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এর দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্ট নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা কি রাজউকের রয়েছে? এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন?
নুরুল হুদা : নিকুঞ্জসহ রাজউক কর্তৃক উন্নয়নকৃত সব আবাসিক প্রকল্প অনুমতি লে-আউট প্ল্যান অনুসরণ করে উন্নয়ন করা হয়। এসব প্রকল্পে নাগরিক সুবিধা বিদ্যমান রাখা আছে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণকাজ করা আইনের বিধান। অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যান অনুসরণ না করে যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রমও চলমান আছে। তবে আপনারা জানেন, রাজউকের সীমিত জনবল এ কার্যক্রম তদারকি করে, যা পর্যাপ্ত নয়। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী রাজউকের জনবল বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চলছে। যারা ইমারত নির্মাণ করেছেন বা করেন তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এলাকাবাসীর এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
সমকাল : ধানমণ্ডি অতিদ্রুত আধা-বাণিজ্যিক, আধা-আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। ধানমণ্ডিকে ফের আবাসিক এলাকায় রূপান্তরে রাজউকের কি কিছুই করণীয় নেই? পূর্বাচল, উত্তরা তৃতীয় পর্বের প্রকল্পের চিত্রও কি আগের আবাসিক এলাকাগুলোর মতো হবে? এসব আবাসিক এলাকার চরিত্র কেমন হবে?
নুরুল হুদা : ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক সরকারি বিধিবিধান ও ইমারত নির্মাণ আইন মেনে ইমারতের নকশা অনুমোদন করে। পাশাপাশি সব ধরনের অবৈধ বা অনুমোদনবহির্ভূত নির্মাণ অপসারণের ক্ষেত্রে রাজউক সচেতন। রাজউক পূর্বাচল ও উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পকে আধুনিক মডেল টাউন হিসেবে গড়ে তুলছে, যেখানে সব নাগরিক সুবিধা প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট করে লে-আউট প্ল্যানে প্রদর্শিত আছে। প্ল্যান প্রণয়নকালে প্রকল্প এলাকার জনসংখ্যা, জনসংখ্যার ঘনত্বসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আগের প্রকল্পগুলো থেকে এসব প্রকল্প অনেক আধুনিক ও পরিবেশসম্মতভাবে বাসোপযোগী হবে।
সমকাল :সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা নতুন প্লট নিয়ে নেন রাজধানীর অভিজাত এলাকায়। বর্তমানের সংসদ সদস্য, সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কি প্লটের জন্য আবেদন করেছেন? করলে কতজন করেছেন, কোন এলাকায় করেছেন? কোন কোন কোটায় করেছেন?
নুরুল হুদা : সরকারি নীতিমালার আলোকে রাজউকের উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) এবং পূর্বাচল নিউ টাউন এলাকায় মন্ত্রী বা মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, সংসদ সদস্য বা সংসদ সদস্যের পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিসহ বিচারপতিদের আবেদন বিবেচিত হয়েছে।
সমকাল : রাজউকের কর্মকর্তাদের কার কতটি প্লট ঢাকায় আছে? যেসব কর্মকর্তা এর আগে একই সঙ্গে একাধিক প্রকল্পে প্লট এবং ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি?
নুরুল হুদা : রাজউকের কোন কর্মকর্তার কতটি প্লট ঢাকায় রয়েছে সে তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যা হলফনামা দিয়ে রাজউক বা সরকারি সংস্থা থেকে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট নিয়েছেন তা বেআইনি। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সমকাল : রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। বারিধারা প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই প্লট পাননি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে রাজউকের কোনো পদক্ষেপ আছে কি?
নুরুল হুদা : সরকারি নীতিমালার ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ করা হয়। নীতিমালা অনুসারে প্রকল্প এলাকায় আদিবাসীরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে রাজউকের অনিয়মের বিষয়টি সঠিক নয়।
সমকাল : ঢাকার চারপাশে স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার প্রকল্পের অগ্রগতি কতদূর?
নুরুল হুদা : সরকার ঢাকা শহরের ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ হ্রাসকল্পে ঢাকা শহরের চারপাশে একাধিক স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমার জানা মতে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কয়েকটি স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলবে। রাজউক আপাতত একটি স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা হবে।
সমকাল : রাজউকের অনুমোদন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই যেসব হাউজিং কোম্পানি প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় প্লট বিক্রি করেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা রাজউকের আছে কি?
নুরুল হুদা : যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তাদের আবাসিক প্রকল্প অনুমোদনের আগেই বিজ্ঞাপন দিয়ে প্লট বিক্রি করছে এবং এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজউক কর্তৃক নোটিশ প্রদান, নিবন্ধন স্থগিতকরণসহ স্থানীয় থানা ও আদালতে মামলা করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া জনসাধারণকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
সমকাল : বিজিএমইএ ভবন সম্পর্কে রাজউকের অবস্থান কী?
নুরুল হুদা : বিজিএমইএ ভবন সম্পর্কে মহামান্য আদালত কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী রাজউক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সমকাল :দুর্নীতিমুক্ত রাজউক গড়ে তোলা এবং ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজউকের সীমাবদ্ধতা কী?
নুরুল হুদা : ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে সীমিত জনবল নিয়েই রাজউক আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজউককে দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। রাজউকের কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে জোনাল অফিস স্থাপন, সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান, সব তথ্যকে ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব বিধিবিধান যুগোপযোগী করা প্রয়োজন তাসহ প্রয়োজনীয় নতুন বিধিবিধান প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সমকাল : ঢাকা এখন ভূমিকম্পপ্রবণ। তাই ভবিষ্যৎ ঢাকার ভবন নির্মাণ পরিকল্পনায় ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে কি? এ ব্যাপারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে?
নুরুল হুদা : বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ (অ্যামেন্ডেড ২০০৬) ও ঢাকা মহানগরীর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ মেনে ইমারতের নকশা প্রণয়ন, নকশার অনুমোদন ও নকশা অনুসারে নির্মাণকাজ করতে হবে। প্রচলিত সব বিধিবিধান মেনে দক্ষ স্থপতি, প্রকৌশলীদের পরামর্শ অনুযায়ী ইমারত নির্মাণ করা হলে ভূমিকম্প থেকে ইমারত রক্ষা করা সম্ভব হবে।
সমকাল : পরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ে রাজউকের ভবিষ্যৎ সার্বিক পরিকল্পনা কী?
নুরুল হুদা : রাজউকের আওতাধীন এলাকার ভূমি ব্যবহারে শৃঙ্খলা ও পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে প্রস্তাবনার আলোকে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ঢাকা শহরের আবাসন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব, পূর্বাচল ও ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে বিভিন্ন আয়তনের প্লটসহ ৫২ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের চারপাশে একাধিক উপশহর গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, যা নগরবাসীর আবাসন সংকট ও যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের অংশ হিসেবে নতুন নতুন সড়ক ও লিংক রোড নির্মাণ, ওভারপাস নির্মাণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইন্টার সেকশনে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। অননুমোদিত ইমারতের বিরুদ্ধে রাজউকের যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চালু আছে। যে কোনো অনুমোদিত ইমারতে পার্কিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা সংরক্ষণ করা হচ্ছে কি-না তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে চিহ্নিত খাল, জলাশয় সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানকে আরও সময়োপযোগী করতে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান রিভিউ করা হবে এবং এ লক্ষ্যে নতুন একটি প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পিত ঢাকা শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজউক স্টেকহোল্ডারসহ সব নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করে। ঢাকাকে একটি পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে রাজউক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে।
বর্তমানে তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের নির্বাচিত সভাপতি।
তিনি রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান
সমকাল : ঢাকা মহানগরীর অবিরাম সম্প্রসারণ হচ্ছে। তবে তা একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। মহানগরীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন খালি জায়গা উন্নয়ন করে, অনেক ক্ষেত্রেই পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ এবং মেট্রোপলিটন এলাকার প্রান্তে যেসব জায়গা রয়েছে সেগুলো বৈধভাবে হোক আর অবৈধভাবে হোক উন্নয়ন করে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে শহর। অথচ ঢাকার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ড্যাপ মেনে পরিকল্পিত সম্প্রসারিত ঢাকা গড়ে তুলতে অসুবিধা কোথায়?
নুরুল হুদা : ঢাকা মহানগরী ৫৯০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার সম্পূর্ণ এলাকা উন্নয়ন উপযোগী নয়। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা সংবলিত ঢাকা স্ট্র্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে ১৯৯৭ সালে। তবে এর যথাযথ প্রয়োগের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) যা সরকার কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে ২২ জুন ২০১০ তারিখে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ রোধকল্পে ড্যাপ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। অনুমোদন লাভের পরপরই রাজউক তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজউকের বর্তমান সব উন্নয়ন কার্যক্রম ড্যাপের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে।
সমকাল : রাজউক ড্যাপ বাস্তবায়নে কী কী উদ্যোগ নিয়েছে? এসব উদ্যোগ শতভাগ সাফল্যের মুখ দেখতে পারছে না কেন?
নুরুল হুদা : রাজউক ড্যাপ বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে রাজউক এই প্ল্যানের আলোকে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদান ও নকশা অনুমোদন করছে। ড্যাপের প্রস্তাবগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তবে এ বিষয়ে রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নগরবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতাও কাম্য।
সমকাল : রাজউকের নকশা ছাড়াই বা নকশায় পরিবর্তন ঘটিয়ে নির্মিত ভবনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৭৩টি ভবনের মালিক প্রভাবশালী। এদের বিরুদ্ধে রাজউকের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কিন্তু যেসব ভবনের মালিক প্রভাবশালী নয় তাদের পান থেকে চুন খসলেই অভিযানের কবলে পড়তে হয়। গণতান্ত্রিক দেশে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগের কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম স্পষ্ট। আপনারা এসব নানা নামের টাওয়ার-স্কয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? কোনো চাপ বা অদৃশ্য সুতার টানেই কি এসব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
নুরুল হুদা :রাজউক আওতাধীন এলাকায় যে কোনো ইমারত নির্মাণের আগে রাজউক কর্তৃক প্রস্তাবিত ইমারতের নকশা অনুমোদন করে নেওয়া অত্যাবশ্যক। অননুমোদিত ও নকশাবহির্ভূত নির্মাণকাজ ইমরাত নির্মাণ আইনের ১৯৫২ (সংশোধিত ১৯৮৭) আওতায় অপসারণ করা হয়। তবে কোনো কোনো ভবনের ক্ষেত্রে মহামান্য আদালত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকায় অপসারণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। মহামান্য আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হওয়ার পর আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
সমকাল : রাজউকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনবল কম বলে তারা অবৈধ বা ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কোনো কোনো নগরবিদ বলছেন, রাজউকের সদিচ্ছা থাকলে তারা এ ব্যাপারে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সাহায্য নিতে পারে। তবে রাজউকের যে লোকবল আছে তাদের দিয়েও অনেক কাজ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
নুরুল হুদা : ৫৯০ বর্গমাইল এলাকাব্যাপী বিস্তৃত রাজউক। এ বিশাল এলাকায় নির্মাণকাজ তদারকি করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল রাজউকের নেই। বিষয়টি উপলব্ধি করে রাজউক প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধির জন্য কারিগরি ও অন্য সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে একটি জনবল কাঠামোর প্রস্তাবনা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে, যা অনুমোদনের জন্য সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এ ছাড়া রাজউক কর্তৃক উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম তদারকির লক্ষ্যে অথরাইজড অফিসার, ম্যাজিস্ট্রেটসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৫টি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। ওই টিম মাঠপর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও অনুমোদনবহির্ভূর্ত নির্মাণকাজ অপসারণের বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সমকাল : ড্যাপে ঢাকার ২১ শতাংশ জায়গা খাল, নদী-নালার জন্য রাখতে বলা আছে। সেটা আদৌ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে কি? কোথাও কোথাও রাজউকের বিরুদ্ধেই জলাভূমি ভরাট করে প্লট তৈরির অভিযোগ উঠেছে। বেসরকারি কোনো কোনো ডেভেলপারের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আছে। রাজউকই যদি আইন না মানে তাহলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ ব্যাপারে দোষ ধরা যাবে কি? জলাভূমি, প্লাবন ভূমি রক্ষা করা গেলে এই মহানগরী এক সময় জলাবদ্ধতার কারণে নাগরিকদের অশেষ দুর্ভোগের কারণ হবে। তাই এ ব্যাপারে রাজউক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
নুরুল হুদা : রাজউক প্রণীত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে খাল, নদী-নালাসহ জলাশয় ও জলাধার চিহ্নিত আছে। এই প্ল্যানের আওতাধীন এলাকায় যেসব উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠান জলাধার ভরাট করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করছে তাদের বিরুদ্ধে রাজউক এর আগে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী একাধিক মামলা করেছে এবং এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সমকাল : রাজউক পরিচালক শেখ আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকার ৮০ শতাংশ বাড়ি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বেআইনি বাড়ির ব্যাপারে রাজউকের ভূমিকা কী হবে? বেআইনিভাবে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে কীভাবে?
নুরুল হুদা :ঢাকা মহানগরী এলাকায় যে কোনো ইমারত নির্মাণের আগে প্রস্তাবিত ইমারতের নকশা রাজউক কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্তির পর সে অনুযায়ী নির্মাণ করতে হয়। নকশাবহির্ভূত যে কোনো নির্মাণকাজ অবৈধ বলে বিবেচিত। এর আগে যেসব ইমারত বেআইনিভাবে গড়ে উঠেছে তা ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় নিয়ে জরিমানা দিয়ে অনুমোদন নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ নির্মাণ রোধের লক্ষ্যে রাজউকের মনিটরিং টিম ও ভ্রাম্যমাণ আদালত সরেজমিনে কাজ শুরু করেছে। এসব কার্যক্রম গ্রহণের ফলে অবৈধ ভবন নির্মাণ কার্যক্রম অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা রাখি। এ ছাড়া অনুমোদনহীন ভবনে যাতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেওয়া হয়েছে।
সমকাল : রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিকুঞ্জ, নিকেতন, জাপান গার্ডেন সিটি প্রভৃতি প্রকল্প নির্মাণ করা হয়নি। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী এসব আবাসিক এলাকায় খেলার মাঠ নেই, ৩০ ফুট সড়কের বদলে রাস্তা হয়েছে ১০ থেকে ১৩ ফুট। গায়ে গায়ে মিলিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা কীভাবে গড়ে উঠল? তখন রাজউকের ভূমিকা কী ছিল? এখন এসব আবাসিক এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এর দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্ট নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা কি রাজউকের রয়েছে? এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন?
নুরুল হুদা : নিকুঞ্জসহ রাজউক কর্তৃক উন্নয়নকৃত সব আবাসিক প্রকল্প অনুমতি লে-আউট প্ল্যান অনুসরণ করে উন্নয়ন করা হয়। এসব প্রকল্পে নাগরিক সুবিধা বিদ্যমান রাখা আছে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণকাজ করা আইনের বিধান। অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যান অনুসরণ না করে যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রমও চলমান আছে। তবে আপনারা জানেন, রাজউকের সীমিত জনবল এ কার্যক্রম তদারকি করে, যা পর্যাপ্ত নয়। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী রাজউকের জনবল বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চলছে। যারা ইমারত নির্মাণ করেছেন বা করেন তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এলাকাবাসীর এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
সমকাল : ধানমণ্ডি অতিদ্রুত আধা-বাণিজ্যিক, আধা-আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। ধানমণ্ডিকে ফের আবাসিক এলাকায় রূপান্তরে রাজউকের কি কিছুই করণীয় নেই? পূর্বাচল, উত্তরা তৃতীয় পর্বের প্রকল্পের চিত্রও কি আগের আবাসিক এলাকাগুলোর মতো হবে? এসব আবাসিক এলাকার চরিত্র কেমন হবে?
নুরুল হুদা : ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক সরকারি বিধিবিধান ও ইমারত নির্মাণ আইন মেনে ইমারতের নকশা অনুমোদন করে। পাশাপাশি সব ধরনের অবৈধ বা অনুমোদনবহির্ভূত নির্মাণ অপসারণের ক্ষেত্রে রাজউক সচেতন। রাজউক পূর্বাচল ও উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পকে আধুনিক মডেল টাউন হিসেবে গড়ে তুলছে, যেখানে সব নাগরিক সুবিধা প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট করে লে-আউট প্ল্যানে প্রদর্শিত আছে। প্ল্যান প্রণয়নকালে প্রকল্প এলাকার জনসংখ্যা, জনসংখ্যার ঘনত্বসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আগের প্রকল্পগুলো থেকে এসব প্রকল্প অনেক আধুনিক ও পরিবেশসম্মতভাবে বাসোপযোগী হবে।
সমকাল :সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা নতুন প্লট নিয়ে নেন রাজধানীর অভিজাত এলাকায়। বর্তমানের সংসদ সদস্য, সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কি প্লটের জন্য আবেদন করেছেন? করলে কতজন করেছেন, কোন এলাকায় করেছেন? কোন কোন কোটায় করেছেন?
নুরুল হুদা : সরকারি নীতিমালার আলোকে রাজউকের উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) এবং পূর্বাচল নিউ টাউন এলাকায় মন্ত্রী বা মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, সংসদ সদস্য বা সংসদ সদস্যের পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিসহ বিচারপতিদের আবেদন বিবেচিত হয়েছে।
সমকাল : রাজউকের কর্মকর্তাদের কার কতটি প্লট ঢাকায় আছে? যেসব কর্মকর্তা এর আগে একই সঙ্গে একাধিক প্রকল্পে প্লট এবং ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি?
নুরুল হুদা : রাজউকের কোন কর্মকর্তার কতটি প্লট ঢাকায় রয়েছে সে তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যা হলফনামা দিয়ে রাজউক বা সরকারি সংস্থা থেকে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট নিয়েছেন তা বেআইনি। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সমকাল : রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। বারিধারা প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই প্লট পাননি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে রাজউকের কোনো পদক্ষেপ আছে কি?
নুরুল হুদা : সরকারি নীতিমালার ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ করা হয়। নীতিমালা অনুসারে প্রকল্প এলাকায় আদিবাসীরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে রাজউকের অনিয়মের বিষয়টি সঠিক নয়।
সমকাল : ঢাকার চারপাশে স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার প্রকল্পের অগ্রগতি কতদূর?
নুরুল হুদা : সরকার ঢাকা শহরের ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ হ্রাসকল্পে ঢাকা শহরের চারপাশে একাধিক স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমার জানা মতে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কয়েকটি স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলবে। রাজউক আপাতত একটি স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা হবে।
সমকাল : রাজউকের অনুমোদন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই যেসব হাউজিং কোম্পানি প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় প্লট বিক্রি করেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা রাজউকের আছে কি?
নুরুল হুদা : যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তাদের আবাসিক প্রকল্প অনুমোদনের আগেই বিজ্ঞাপন দিয়ে প্লট বিক্রি করছে এবং এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজউক কর্তৃক নোটিশ প্রদান, নিবন্ধন স্থগিতকরণসহ স্থানীয় থানা ও আদালতে মামলা করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া জনসাধারণকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
সমকাল : বিজিএমইএ ভবন সম্পর্কে রাজউকের অবস্থান কী?
নুরুল হুদা : বিজিএমইএ ভবন সম্পর্কে মহামান্য আদালত কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী রাজউক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সমকাল :দুর্নীতিমুক্ত রাজউক গড়ে তোলা এবং ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজউকের সীমাবদ্ধতা কী?
নুরুল হুদা : ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে সীমিত জনবল নিয়েই রাজউক আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজউককে দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। রাজউকের কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে জোনাল অফিস স্থাপন, সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান, সব তথ্যকে ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব বিধিবিধান যুগোপযোগী করা প্রয়োজন তাসহ প্রয়োজনীয় নতুন বিধিবিধান প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সমকাল : ঢাকা এখন ভূমিকম্পপ্রবণ। তাই ভবিষ্যৎ ঢাকার ভবন নির্মাণ পরিকল্পনায় ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে কি? এ ব্যাপারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে?
নুরুল হুদা : বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ (অ্যামেন্ডেড ২০০৬) ও ঢাকা মহানগরীর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ মেনে ইমারতের নকশা প্রণয়ন, নকশার অনুমোদন ও নকশা অনুসারে নির্মাণকাজ করতে হবে। প্রচলিত সব বিধিবিধান মেনে দক্ষ স্থপতি, প্রকৌশলীদের পরামর্শ অনুযায়ী ইমারত নির্মাণ করা হলে ভূমিকম্প থেকে ইমারত রক্ষা করা সম্ভব হবে।
সমকাল : পরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ে রাজউকের ভবিষ্যৎ সার্বিক পরিকল্পনা কী?
নুরুল হুদা : রাজউকের আওতাধীন এলাকার ভূমি ব্যবহারে শৃঙ্খলা ও পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে প্রস্তাবনার আলোকে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ঢাকা শহরের আবাসন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব, পূর্বাচল ও ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে বিভিন্ন আয়তনের প্লটসহ ৫২ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের চারপাশে একাধিক উপশহর গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, যা নগরবাসীর আবাসন সংকট ও যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের অংশ হিসেবে নতুন নতুন সড়ক ও লিংক রোড নির্মাণ, ওভারপাস নির্মাণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইন্টার সেকশনে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। অননুমোদিত ইমারতের বিরুদ্ধে রাজউকের যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চালু আছে। যে কোনো অনুমোদিত ইমারতে পার্কিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা সংরক্ষণ করা হচ্ছে কি-না তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে চিহ্নিত খাল, জলাশয় সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানকে আরও সময়োপযোগী করতে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান রিভিউ করা হবে এবং এ লক্ষ্যে নতুন একটি প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পিত ঢাকা শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজউক স্টেকহোল্ডারসহ সব নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করে। ঢাকাকে একটি পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে রাজউক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে।
No comments