মহাজোট সরকারের আইন ও বিচারিক কর্মকাণ্ড by শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
আমাকে যদি কেউ বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করতে বলেন, তাহলে একটি জায়গায় আমি এ সরকারকে এক শতে এক শ দেব। সেটি হচ্ছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে তাকে এগিয়ে নেওয়া। গত বছরের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ও প্রসিকিউশন প্যানেলের সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়।
এরপর গ্রেপ্তার করা হয় জামায়াত নেতা, ঘাতক-শিরোমণি নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান ও সাঈদী গংকে। এক মাস আগে, অর্থাৎ গত ডিসেম্বরে সরকার গ্রেপ্তার করেছে যুদ্ধাপরাধী ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।
নিজামী-মুজাহিদ-কাদের মোল্লা ও সাকা চৌধুরীরা যে কাজটি করেছিলেন, তাকে বলে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এসব অপরাধের কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই। তাঁরা যে অপরাধগুলো করেছিলেন, তা গোটা মানব জাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। এসব অপরাধের বিচার কখনো তামাদি হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করা। বিষয়টি এত দূর পর্যন্ত পেঁৗছল যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধীদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উঠে গেল। প্রচণ্ড এক লজ্জা ও অপমান বাঙালি জাতির মুখে যেন চুনকালি মেখে দিল!
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যথেষ্ট সাহস ও পৌরুষের পরিচয় দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করে। গণহত্যাকারী ও রগ-কাটা, গলা-কাটা রাজনীতির প্রবর্তক নিজামী-মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী গংকে ধরে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি করে সরকার দেখিয়েছে যে এটাই ঘাতকদের উপযুক্ত স্থান। এরপর আমরা চাইব, সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে এসব ঘাতককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে জাতি যেমন কলঙ্কমুক্ত হয়েছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে বাঙালি জাতিকে পাপমুক্ত করা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি দিয়ে ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে আমরা হত্যার বিচার থেকে অব্যাহতির যে সংস্কৃতি, তা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। গত দু-বছরে আইন ও বিচারের অঙ্গনে মহাজোট সরকারের এ এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। হত্যা ও অপরাধের বিচার থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি কোনো সভ্য জাতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সংবিধান ও আইনের শাসনের চর্চা একটি রাষ্ট্রের সুশাসনকে যেমন দৃঢ় ভিত্তি দেয়, তেমনি উন্নয়নকেও করে গতিশীল। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে হত্যা ও অব্যাহতির সংস্কৃতি (Culture of Impunity) শুরু হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে মৌলিক মানবাধিকারের প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত ও সুরক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের সামন্ত মানসিকতার সামরিক শাসকরা ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করেছিল। ১৯৭১ সালে এসে ওই সামরিক শাসকরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার বাঙালি জাতির ওপর একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। গণহত্যা, লুটতরাজ, অগি্নসংযোগ, নারী নির্যাতন_এ ধরনের চরম মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্য দিয়ে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘাতকের বুলেট ও শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মনে রাখা দরকার, মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘনই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা করেছে। মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা সে জন্য এ রাষ্ট্রে সংবিধানের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। মুক্তিযুদ্ধের পরপর মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যে বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়। এত বড় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, স্বাধীনতাবিরোধী দেশি ও বিদেশি শক্তির অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এক ধরনের নৈরাজ্যও তৈরি করেছিল। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, হত্যা ও হত্যাকারীদের রাষ্ট্রীয় অব্যাহতির সংস্কৃতি ও চর্চা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। তখনকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও আইন ও বিচারিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উচিত ছিল ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। কিন্তু বিচার তো দূরের কথা, ক্ষমতাসীনরা আইন (Law of Indemnity) করে বলে দিল যে ওই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না। অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হলো হত্যাকারীদের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অব্যাহতির আইন বাতিল হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শেষে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর পরই বঙ্গবন্ধুর সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ ও ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ জারি করে। ১৯৭২ সালের আদেশের অধীন ৩৭ হাজার ৪৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই দেশীয় সহযোগীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।
তার পরের ইতিহাস তো জামায়াতি ঘাতকদের আস্ফালন, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস। যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিল, যারা গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছর পরও তাদের '৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি বা অনুতপ্ত হয়নি, ২০০১ সালে তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উঠল। এ ছিল বাঙালি জাতির জন্য চরম লজ্জা, অপমান ও অবমাননার। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে '৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এটা অত্যন্ত আশার কথা।
২০১০ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) তাহেরকে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া এবং এ-সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তার কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনসহ অন্যরা যে আবেদন করেন, তাতে বলা হয় যে বাংলাদেশ সংবিধানে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ বিচারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন অনুযায়ী গোপন বিচারের কোনো সুযোগ নেই।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দেশীয় সহযোগী জামায়াতি ঘাতকদের বিচার চলছে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। বীর-উত্তম কর্নেল তাহেরকে গোপনে ফাঁসি দেওয়ার নথি তলব করেছেন হাইকোর্ট ডিভিশন। '৭৫ সালের পর বাংলাদেশ যে হত্যা ও অব্যাহতির সংস্কৃতির গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, তা বাংলাদেশকে শুধু পশ্চাৎমুখীই করেছে। হত্যা ও অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আশা করি তা বাংলাদেশে একটি সভ্য, গণতান্ত্রিক ও সুশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। এ সরকারের কাছে এও প্রত্যাশা রইল যে ন্যায়বিচার, প্রশাসনকে আরো কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সে ব্যাপারেও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hrkaryon@yahoo.com
নিজামী-মুজাহিদ-কাদের মোল্লা ও সাকা চৌধুরীরা যে কাজটি করেছিলেন, তাকে বলে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এসব অপরাধের কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই। তাঁরা যে অপরাধগুলো করেছিলেন, তা গোটা মানব জাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। এসব অপরাধের বিচার কখনো তামাদি হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করা। বিষয়টি এত দূর পর্যন্ত পেঁৗছল যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধীদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উঠে গেল। প্রচণ্ড এক লজ্জা ও অপমান বাঙালি জাতির মুখে যেন চুনকালি মেখে দিল!
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যথেষ্ট সাহস ও পৌরুষের পরিচয় দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করে। গণহত্যাকারী ও রগ-কাটা, গলা-কাটা রাজনীতির প্রবর্তক নিজামী-মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী গংকে ধরে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি করে সরকার দেখিয়েছে যে এটাই ঘাতকদের উপযুক্ত স্থান। এরপর আমরা চাইব, সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে এসব ঘাতককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে জাতি যেমন কলঙ্কমুক্ত হয়েছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে বাঙালি জাতিকে পাপমুক্ত করা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি দিয়ে ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে আমরা হত্যার বিচার থেকে অব্যাহতির যে সংস্কৃতি, তা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। গত দু-বছরে আইন ও বিচারের অঙ্গনে মহাজোট সরকারের এ এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। হত্যা ও অপরাধের বিচার থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি কোনো সভ্য জাতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সংবিধান ও আইনের শাসনের চর্চা একটি রাষ্ট্রের সুশাসনকে যেমন দৃঢ় ভিত্তি দেয়, তেমনি উন্নয়নকেও করে গতিশীল। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে হত্যা ও অব্যাহতির সংস্কৃতি (Culture of Impunity) শুরু হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে মৌলিক মানবাধিকারের প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত ও সুরক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের সামন্ত মানসিকতার সামরিক শাসকরা ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করেছিল। ১৯৭১ সালে এসে ওই সামরিক শাসকরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার বাঙালি জাতির ওপর একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। গণহত্যা, লুটতরাজ, অগি্নসংযোগ, নারী নির্যাতন_এ ধরনের চরম মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্য দিয়ে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘাতকের বুলেট ও শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মনে রাখা দরকার, মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘনই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা করেছে। মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা সে জন্য এ রাষ্ট্রে সংবিধানের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। মুক্তিযুদ্ধের পরপর মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যে বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়। এত বড় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, স্বাধীনতাবিরোধী দেশি ও বিদেশি শক্তির অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এক ধরনের নৈরাজ্যও তৈরি করেছিল। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, হত্যা ও হত্যাকারীদের রাষ্ট্রীয় অব্যাহতির সংস্কৃতি ও চর্চা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। তখনকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও আইন ও বিচারিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উচিত ছিল ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। কিন্তু বিচার তো দূরের কথা, ক্ষমতাসীনরা আইন (Law of Indemnity) করে বলে দিল যে ওই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না। অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হলো হত্যাকারীদের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অব্যাহতির আইন বাতিল হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শেষে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর পরই বঙ্গবন্ধুর সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ ও ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ জারি করে। ১৯৭২ সালের আদেশের অধীন ৩৭ হাজার ৪৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই দেশীয় সহযোগীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।
তার পরের ইতিহাস তো জামায়াতি ঘাতকদের আস্ফালন, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস। যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিল, যারা গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছর পরও তাদের '৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি বা অনুতপ্ত হয়নি, ২০০১ সালে তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উঠল। এ ছিল বাঙালি জাতির জন্য চরম লজ্জা, অপমান ও অবমাননার। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে '৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এটা অত্যন্ত আশার কথা।
২০১০ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) তাহেরকে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া এবং এ-সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তার কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনসহ অন্যরা যে আবেদন করেন, তাতে বলা হয় যে বাংলাদেশ সংবিধানে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ বিচারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন অনুযায়ী গোপন বিচারের কোনো সুযোগ নেই।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই দেশীয় সহযোগী জামায়াতি ঘাতকদের বিচার চলছে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। বীর-উত্তম কর্নেল তাহেরকে গোপনে ফাঁসি দেওয়ার নথি তলব করেছেন হাইকোর্ট ডিভিশন। '৭৫ সালের পর বাংলাদেশ যে হত্যা ও অব্যাহতির সংস্কৃতির গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, তা বাংলাদেশকে শুধু পশ্চাৎমুখীই করেছে। হত্যা ও অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আশা করি তা বাংলাদেশে একটি সভ্য, গণতান্ত্রিক ও সুশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। এ সরকারের কাছে এও প্রত্যাশা রইল যে ন্যায়বিচার, প্রশাসনকে আরো কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সে ব্যাপারেও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hrkaryon@yahoo.com
No comments