কল্পকথার গল্প-গতির দুর্গতি, অতএব মৌনব্রত! by আলী হাবিব

এসে গেল ফেব্রুয়ারি। এসে গেল ভাষার মাস। ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে এই জাতি। আর তারই সূত্র ধরে এসেছে এ মাস। ইতিহাস বলে, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলার টান ছিল আমাদের হৃদয়ে। তাই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র এ দেশে টেকেনি।


ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। ইদানীং সেই ভাষা নিয়েও আমাদের মধ্যে একধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। ভাষা নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি বলেও মনে হয় না। একদিন উর্দু দূর করতে আমাদের বুকের রক্ত দিতে হয়েছিল। এখন আমাদের ভাষার মধ্যে বিদেশি ভাষা ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ সহজেই। আমরা সেসব গ্রহণও করছি। বিদেশি ভাষার সিরিয়াল দেখে আমরা ক্লান্ত হই না। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে অদ্ভুত এক খিচুড়ি ভাষায় আমরা অনর্গল কথা বলি। ক্লান্তি বোধ করি না। কখনো টায়ার্ড হলে বিশ্রাম নেওয়ার বদলে আমরা রেস্ট নিতেই আগ্রহী। আমাদের এ দেশেই গান লেখা হয়েছে, 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়...'। আজ আমরা নিজেরাই আমাদের মুখের ভাষা বদলে দিচ্ছি। অদ্ভুত এক ভাষারীতি চালু হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে। আমরা বাসে উঠে ভাড়া দেওয়ার বদলে 'ভারা' দিচ্ছি। চারদিকে সাড়া ফেলে দেওয়া কিংবা নাড়া দেওয়ার বদলে আমরা 'সেনসেশন' তৈরি করতে চাই। ভালোলাগা সিনেমা আমাদের কাছে 'হট' অথবা 'কুল'।
সব বদলে যাচ্ছে আমাদের। বদলে যাচ্ছে জীবন। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। বদলে যেতে যেতে আমাদের দেশের জঙ্গিরা বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আমাদের কথা বলার ভঙ্গি। কথায় কথায় সঙ্গী বদলাতে আমাদের আজকাল আর সময় লাগে না। তেমনি কথা বলার ভঙ্গি বদলাতেও আমাদের জুড়ি মিলবে না। আমরা বাংলায় কথা বলি বিদেশি উচ্চারণে। কেমন সে কথা বলার ভঙ্গি। একটু কল্পনার রং লাগানো যাক। ধরা যাক দুই বন্ধুর কথা। পাশাপাশি বসে কথা বলছে তারা_
: আজকের দিনটা যা গেল না।
: কেমন গেল?
: সারাটা দিন রেস্টলেস।
: কেন?
: ফর নাথিং।
: কয়েক দিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম।
: কেমন ছবি?
: ওয়াও!
'ওয়াও' জিনিসটা কী? খুব ভালো। মনে ভারী দাগ কেটেছে এমন একটা ছবি দেখার পর সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশের চমৎকার একটি শব্দ আমাদের বাংলা শব্দভাণ্ডারে ঢুকে গেছে_ওয়াও। খাবার খুব স্বাদু হয়েছে? ওয়াও! পোশাকে বন্ধুকে (কিংবা প্রিয় বান্ধবীকে) খুব চমৎকার মানিয়েছে? ওয়াও! বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট হস্তগত? ওয়াও! পরীক্ষার ফল আশানুরূপ? ওয়াও! সবকিছুতে ওয়াও? শুধু কি ওয়াও? 'দ্যাটস গ্রেট', 'হাউ ফানি' 'হোয়াটস আপ'_এমন কত কত শব্দ যে আমরা কথায় কথায় বাংলায় 'আপলোড' করে দিচ্ছি, তার ইয়ত্তা নেই। শুধুই কি ইংরেজি? হিন্দি সিরিয়াল ও সিনেমা দেখতে দেখতে কত কত হিন্দি শব্দ যে আমাদের অগোচরে আমরা কথার ভেতর দিয়ে বাংলায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি, তারও হিসাব নেই। শুধু বিদেশি শব্দ যে ঢুকিয়ে দিচ্ছি তা নয়, পাশাপাশি অনেক নতুন শব্দও যোগ করছি। দুই বন্ধুর একটি কল্পিত সংলাপে যাওয়া যাক।
: ওই গানটা শুনেছিস?
: শুনেছি।
: এক্কেবারে জোস না?
: ঝাক্কাস।
: গলাটা কী কুল।
: হু, দেখবি কেমন হিট করে।
দুই বন্ধুর এই কথোপকথনে 'জোস না' শুনে কেউ ভাবতে পারেন জোছনা। 'জোস না' জোছনা ভেবে ভুল করতে পারেন যে কেউ। কিন্তু 'ঝাক্কাস'! কোত্থেকে এল? কেনই বা এল? এভাবেই চলছে। মুখের কথায় এভাবেই তো বদলে যাচ্ছে আমাদের ভাষা। না, একেবারেই 'ভাসা-ভাসা' নয়_ইংরেজি ও হিন্দির মিশেলে সোজাসাপ্টা 'সাড়ে বত্রিশ ভাজা' হয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। আমাদের কথার ভেতর, চলার ভেতর ও বলার ভেতর দিয়ে এভাবেই চলে আসছে এমন কিছু শব্দ_যা আমরা গ্রহণও করছি। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মুখের ভাষা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। এফএম রেডিওর আরজে যাঁরা_তাঁদের বাংলা যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন বদলে যাওয়া কাকে বলে। কেমন করে বদলে যেতে পারে বাংলা ভাষা। আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। তারা শিখছে অন্যভাবে। একেকজন একেকভাবে শিখছে। আগে শিক্ষকরা স্যার ছিলেন। বোধ হয় এখনো তাই আছেন। শিক্ষিকারা ছিলেন আপা। এখন সব পাল্টে গেছে। শিক্ষিকারা আপা থেকে ম্যাডাম, ম্যাডাম থেকে ম্যাম, ম্যাম থেকে মিস হয়ে গেছেন। বিয়ে হয়ে ছেলেপুলের মা হয়েছেন। তবু তাঁরা মিস। হয়তো টিচার্স কমনরুমে তিনি মিসেস অমুক। ক্লাসে এলেই মিস। বাংলা মিস, ইংরেজি মিস, ভূগোল মিস, ইতিহাস মিস_এখন ক্লাস নিচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছেন। পরীক্ষা নিচ্ছেন। পরীক্ষা নিতে গিয়ে নিজেরাও অনেক সময় কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছেন। এমন একটি কাল্পনিক ক্লাসের বর্ণনা দেওয়া যাক। ক্লাসে মিস এসে জানতে চাইলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা। এক শিক্ষার্থী উঠে দাঁড়াল। মিস বেশ খুশি। বলতে শুরু করল শিক্ষার্থী_'ইট ওয়াজ ১৯৭১। আমাদের দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আমাদের ফ্রিডম ফাইটাররা পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে হেভি ফাইট করেছিল। সারা বাংলাদেশটাই ছিল ব্যাটল ফিল্ড। যুদ্ধ হয়েছিল মাত্র নাইন মান্থ। সেই যুদ্ধে আমরা উইন ওভার করি। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করে। দিনটি ছিল ডিসেম্বরের সিঙ্টিন্থ। সেই থেকে সিঙ্টিন্থ ডিসেম্বর আমাদের ভিক্টোরি ডে। যুদ্ধের শুরুতে টুয়েন্টি সিঙ্থ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইনডিপেনডেন্স ঘোষণা করেন। সে জন্য আমাদের ইনডিপেনডেন্স ডে টুয়েন্টি সিঙ্থ মার্চ।' বুঝুন!
আরেকটি গল্প কল্পনা করা যাক। ক্লাসে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলেন একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে। উঠে দাঁড়াল এক শিক্ষার্থী। বলতে শুরু করল সে_'ইন দ্য ইয়ার নাইটিন ফিফটি টু আমাদের দেশে ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট হয়েছিল। পাকিস্তানের শাসকরা চেয়েছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমাদের দেশের ছাত্ররা সেটা হতে দেননি। তাঁরা বাংলাকে স্টেট ল্যাংগুয়েজ করার দাবিতে মুভমেন্ট শুরু করেন। টুয়েনটি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি নাইনটিন ফিফটি টু ছাত্ররা ডেমোনেসট্রেশন বের করলে সেখানে ফায়ার করা হয়। পুলিশ কিলড সালাম, রফিক, বরকত। সেই থেকে টুয়েনটি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি আমাদের শহীদ দিবস। প্রতিবছর এই দিনে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আমরা আমাদের ট্রিবিউট জানাই। দিনটি ন্যাশনাল হলিডে।'
একুশে ফেব্রুয়ারি, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস সম্পর্কে আজকের দিনের কোনো শিক্ষার্থীর এমন বর্ণনা শোনার পর এ কালের ম্যাডাম, ম্যাম বা মিসের অবস্থা কী হতে পারে_সেটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এমনটিই তো ঘটছে বা ঘটে চলেছে। আমাদের বাংলা ভাষায় অনেক বিদেশি শব্দ গ্রহণ করেছি। কিন্তু গ্রহণের পাশাপাশি কী বর্জন করতে হবে, সে শিক্ষাটা বোধ হয় অর্জন করতে পারিনি। ফলে অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই অনুপ্রবেশ আমাদের ভাষার যে সর্বনাশ করছে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। সবচেয়ে বড় যে সর্বনাশটি হয়ে গেছে, সেটা হয়েছে উচ্চারণে। আমাদের ভাষায় যে বর্গীয় বর্ণগুলো আছে, সেগুলোর একটি উচ্চারণরীতি আছে। কোন বর্ণটি কেমন করে উচ্চারিত হবে, তার একটি নিয়ম আছে। কিন্তু সে নিয়ম আজকাল বোধ হয় আর মেনে চলা হয় না। আমরা আজকাল হিন্দি কিংবা ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলি। বলতে গিয়ে একবারও ভেবে দেখি না, বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব। বাংলা একটি মিষ্টি ভাষা। এ বাংলাকে আমরা বিকৃত করে ফেলেছি। উচ্চারণ করছি বিকৃতভাবে।
আর সবকিছুর মতো দিনে দিনে ভাষাও উন্নত হয়। একটি পরিশীলিত রূপ নেয়। আমাদের ভাষা বাংলারও তো তেমন একটা রূপ নেওয়ার কথা। কিন্তু যে বিরূপ অবস্থার ভেতর দিয়ে বাংলা এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তিত হতেই হয়। দিনে দিনে বাংলা ভাষা আরো গতিশীল হবে, গতি পাবে_তেমনটিই অনেকের আশা ছিল। কিন্তু কী অবস্থা বাংলার? 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী।' রাস্তার পাশে অনেক দোকান হয়েছে। গড়ে উঠেছে অনেক বিপণিবিতান। ওই সব দোকানের সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায় ভাষার দুর্গতি। যার যেমনটি ইচ্ছে, তেমনটি লিখে দেওয়া হচ্ছে। পোস্টারে, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে বাংলা নিয়ে যথেচ্ছাচার চোখে পড়ার মতো। একুশের মাসে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাংলা একাডেমীর বইমেলা। বইমেলা উপলক্ষে অনেক বই প্রকাশ হবে। কিন্তু প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য সব বই কি পাঠযোগ্য? প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির বইমেলায় যেসব বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে অনেক বইতেই লেখকদের ভাষার দেউলিয়াত্বের প্রমাণ মেলে। যাঁরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন, তাঁরা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে গতির বদলে এমন দুর্গতির মুখে পড়বে আমাদের ভাষা? ভাষার জন্য জীবন দিয়ে ভাষা অর্জন করে আজ এই ফল? প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে পুরাণের একটি গল্পে যাওয়া যাক।
কুন্তি মহাভারতের এক মনস্বিনী নারী। তিনি দৃঢ়চেতা, তেজস্বিনী ও আদর্শ জননী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়ের পর কুন্তি ছেলেদের কাছে কর্ণের জন্য তর্পণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। ছেলেরা সেটা করেননি। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভ ও অশ্বমেধযজ্ঞের পর তিনি ছেলেদের সব অনুরোধ উপেক্ষা করে রাজর্ষি শতযুপের আশ্রমে চলে যান। সেখানে কঠোর তপস্যায় রত হন তিনি। নেন মৌনব্রত। কর্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের মিলন ঘটাতে না পারার জন্য কুন্তি একদা বিলাপ করেছিলেন। একসময় নেন মৌনব্রত। ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার পরও সেই বাংলা ভাষার একটা প্রমিত রূপ না দেওয়ার দুঃখে আমরাও কি সমস্বরে বিলাপ করব? গতির বদলে ভাষার এ দুর্গতি দেখে আমরা কি কুন্তির মতো মৌনব্রত বেছে নেব?

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.