আখড়ার উত্তরাধিকার-লালন সাঁইয়ের সমাধিতে এরা কারা? by ফারুক ওয়াসিফ
‘মাতবর কানা চোগলখোরে,
সাধু কানা আনবিচারে।
আন্দাজি এক খুঁটি গেড়ে চেনে না সীমানা কার
এসব দেখি কানার হাটবাজার।’
সাধু কানা আনবিচারে।
আন্দাজি এক খুঁটি গেড়ে চেনে না সীমানা কার
এসব দেখি কানার হাটবাজার।’
— ফকির লালন সাঁই
লালনের মৃত্যুর ১২০ বছরে তাঁর আখড়া ও সমাধি তো বেহাত হয়েছেই, সেখানে এখন শুরু হয়েছে নতুন নতুন সব কাণ্ড কারখানা। সেই কারখানায় সবই আছে, কেবল লালন নেই, বাউলসাধক ফকির সাঁইজিরা নেই। এবার সেখানে স্পনসরশোভিত মঞ্চ, ব্র্যান্ড লোগোয় অলংকৃত মেলা ইত্যাদি বসেছে, মাইকে চটুল বাংলা-হিন্দি গান বাজছে। অথচ এই পয়লা কার্তিকই ছিল তাঁর বিদায়ের রাত। এই রাতেই ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের নিয়ে গাইতে গাইতে তিনি বলেছিলেন, ‘গেলাম’। লালনের অনুসারীরা একে বলে তিরোধান। এই দিন সারা বাংলা তো বটেই, বিভিন্ন দেশ থেকে লালন অনুসারী ভক্ত ও গবেষকেরা কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের সাধুসঙ্গে আসেন। তাঁদের জগতে কালীগঙ্গার তীরের লালনের মাজারই হলো তীর্থস্থান, সাধনার কেন্দ্র।
বহু দিন হলো জায়গাটি লালনের দর্শন ও জীবনধারার সঙ্গে একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন কায়কারবারে ভরপুর। লালনের আখড়া তথা সাঁইজির মাজার শরিফ থেকে বাউলেরা বিতাড়িত, লালনের দর্শন বিতাড়িত, লালনের স্মৃতি বিতাড়িত। মাজারসহ পুরো এলাকার মালিকানা এখন জেলা প্রশাসনের। সেখানে এখন আছে কেবল ভবন, বাণিজ্য, স্পনসরশিপ আর আনন্দ-বিনোদনের তুমুল মজমা। লালনের জীবন্ত ঐতিহ্যকে মুমূর্ষু করে জাদুঘরে পোরা হচ্ছে আর সাধনতীর্থকে বানানো হচ্ছে বাণিজ্যিক পর্যটনের খোরাক।
সংস্কৃতির অন্য কোনো পীঠস্থানের বিষয়ে এমনটা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাংলার ভাবুকতার শীর্ষ প্রতিনিধি এবং মানবতার মুক্তিকামী দার্শনিক শিক্ষাগুরু, সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান দিশারি লালনের বেলায় সেটাই করা হয়েছে। করেছে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, করেছে মৌলবাদী শক্তি, করেছে আমলাতন্ত্রের মধ্যে জেঁকে থাকা স্বার্থবুদ্ধির লোকেরা। লালনের ভাব, আদর্শ ও চর্চার সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব মানুষ, বাংলার ভাবুকতার ধারাকে যাঁরা নিছক ‘গ্রাম্য’, ‘অশিক্ষিত’ কবিদের ভাবাবেগের বিষয় মনে করেন, তাঁদের হাতে সংস্কৃতি ও চিন্তার বড় একটি কেন্দ্র কীভাবে নিরাপদ থাকবে?
বাংলার প্রতিষ্ঠানবিরোধী দার্শনিক আন্দোলন লালনের মাধ্যমেই বিপ্লবী বিকাশ পায়। নিম্নবর্গের মানুষের এই দার্শনিক এই নেতার চিন্তা ও কাজ সে যুগেরও যেমন এ যুগেও তেমন প্রতিষ্ঠিত জীবনদর্শনের বিপক্ষে। জীবিতাবস্থায় যিনি জাত-পাত, বৈষম্য, কূপমণ্ডূকতা আর জমিদারি ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন, আজকের যুগের জমিদার ও ঔপনিবেশিক শক্তির উত্তরাধিকারী মোল্লা-পুরোহিত-বণিক-আমলা-রাজনীতিবিদেরা কখনো খোলাখুলিভাবে কখনো পৃষ্ঠপোষকতার ছদ্মবেশে তাঁকে হেয়ই করছে। পিঠে যা পোষকতা করা হয়, তার আরেক নাম কিন্তু ‘মার’।
আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান লালনের সমাধিক্ষেত্রের পাশে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেন। পদাধিকারবলে এর সভাপতি হন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক। ১৯৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় লালন একাডেমি। ১৯৮৪ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেখানে ধর্মসভা বসান এবং লালনভক্তদের বের করে দেন। তিনি তাদের তওবাও করাতে যান। জেলা প্রশাসক এভাবে হন ধর্মেরও শাসক। প্রায় পাঁচ হাজার ফকির-সাধক বিক্ষোভ করলে রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে তাঁদের পিটিয়ে তাড়ানো হয়। মাজারের সিন্দুকের চাবিও সে দিনই বেহাত হয়। লালনের তরিকায় সাধক তাঁরাই, যাঁরা জ্ঞান ও জীবনচর্চায় মানুষের সামাজিক-সাংষ্কৃতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখান। এ কারণেই বোধকরি ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো চিরকালই তাদের বাতিল করতে চেয়েছে।
লালনের ধারার নেতৃস্থানীয় সাধকেরা চেয়েছিলেন সরকার যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু তা যেন মাজারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গাম্ভীর্য নষ্ট না করে এবং তা যেন মাজারের আঙিনার বাইরে কোথাও করা হয়। জাতিসংঘের সুপারিশেও ঐতিহাসিক স্থান ও পুরাকীর্তির চার কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু যেখানে জমি, টাকা ও ধর্ম-অধর্মের প্রশ্ন, সেখানে কে শোনে ন্যায্য কথা?
সবচেয়ে বড় ক্ষতি করা হয় ১৯৯৭ সালে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে লালন কমপ্লেক্স নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন, জাদুঘর ও অতিথিশালাসহ চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য মাজারের মূল চত্বরকেই বেছে নেওয়া হয়। লালনের স্মৃতিবিজড়িত কালীগঙ্গা নদী ভরাট করে বানানো হয় উন্মুক্ত মঞ্চ। অবরুদ্ধ কালীগঙ্গায় নৌবিহার, শৌখিন মাছ শিকার, লালনের শিষ্যদের হাতে রোপিত শতবর্ষী বৃক্ষ কেটে ফেলে বিদেশি গাছ লাগানো ইত্যাদিও ছিল তাদের লালনের স্মৃতিরক্ষা প্রকল্পের অংশ। কোটি টাকা ব্যয়ে লালনের স্মৃতি ধ্বংস করা হয় এবং তাঁর অনুসারীদের করা হয় অবাঞ্ছিত। লালন একাডেমির আর কোনো অবদান আমাদের অজানা।
এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। কবি শামসুর রাহমান এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মীরা নানা কর্মসূচি ও লেখালেখির মাধ্যমে তৎকালীন সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, যা হচ্ছে তাতে লালনের সৃষ্টি, স্মৃতি ও সমাধির অশেষ ক্ষতি হবে। সরকার শোনেনি এবং কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বও লালন আখড়া রক্ষা কমিটির এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। কেননা লালনকে ঘিরে আয়োজিত যাবতীয় অনুষ্ঠানে আসা লাখ লাখ দর্শনার্থী ঘিরে যে বিরাট বাণিজ্য হয়, তার জন্য ভবন দরকার, মেলা দরকার, আখড়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ দরকার; বাউল-ফকিরদের উপস্থিতি সেখানে বড় বাধা। গাছ দেখলে সাধক দেখে প্রাণ, ব্যবসায়ী দেখে কাঠ। এখানেও সেটাই ঘটেছে।
এবারও সেই নবনির্মিত লালন কমপ্লেক্সেই বসেছে ‘লালন মৃত্যুবার্ষিকী’র উৎসব। পত্রিকায় এই বরাতে অনেক খরচ করে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। লালনের দর্শনে এবং বাউলদের কাছে লালনের মৃত্যু নেই। তিনি তিরোধান করেছেন মাত্র। তাঁর ভাব ও আদর্শকে তাঁরা জীবন্ত জ্ঞান করে সাধনা করেন। জন্ম ও মৃত্যুর চেয়ে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ হিসেবে সঠিক দিশায় পৌঁছানোর ঘটনা। মৃত্যু হয় দেহের, চিন্তা ও ভাব যদি সঠিক হয় তবে তা অজর-অমর। তাঁদের চিন্তা ভুল না সঠিক, সেটা অন্য আলোচনা। কিন্তু খোদ লালনের মাজারে বসে লালনের ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ পালন এই বিচারে অন্যায় ও অনৈতিক। প্রথাগত তিন দিনের অনুষ্ঠানটিকে মেলার সুবিধার জন্য করা হয়েছে পাঁচ দিনের। এসবকে ‘কানার হাটবাজার’ মনে করে দুঃখ পেয়ে বাউল-ফকিরেরা এসব থেকে দূরে থাকেন।
লালনের মতোই কালীগঙ্গার তীরেই মাঠের মধ্যে তাঁদের আস্তানা। আর এদিকে চলছে জমজমাট আয়োজন আর রং-রসে ভরা বিনোদন। মাইকে হিন্দি গান বাজে, নানান ভোগ্যপণ্যের পসরা বসে। আগে যেখানে দেশ-বিদেশের বাউলেরা জীবন-জগতের নানান বিষয় নিয়ে গানে গানে আলোচনা চালাতেন, সেখানে এখন ক্লোজআপ তারকারা বিকৃত সুরে লালনের গান গায়। মূল মিলনায়তনটির দোতলায় করা হয়েছে গানের ব্যবস্থা। বাউলেরা সমাধির থেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে গান করবেন না। তাই আখড়ার সাধক কিংবা বড় বড় সাধুগুরুরা এসব থেকে দূরে থাকেন। আয়োজনটা উৎসবের আর কনসার্টের; শ্রদ্ধাভক্তির বালাই সেখানে নেই। এসবই হলো লালনের আখড়ার বাণিজ্যিকায়নের ফল। মাজার তো লাঞ্ছিত হচ্ছেই, তাঁর সমাধির পাশে ঘটা করে তাঁর নামে তাঁকেই অপমান না করলে কি চলত না?
দ্বিতীয়ত, যে দার্শনিক-কবি-গায়ক ও সমাজ-সংগ্রামীর জীবনজোড়া তৎপরতাই ছিল পণ্যায়নের বিরুদ্ধে, মুনাফার বিরুদ্ধে, কৃত্রিম জৌলুশ ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে, তাঁকে এবং তাঁর ঘাঁটি পণ্যশক্তির দখলে যাওয়া যে কত বড় লজ্জা ও পরাজয়ের বিষয়, তা কি কর্তাব্যক্তিদের বোধে আসে? লালন মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের স্পনসর যাঁরা, তাঁরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপনে লিখেছেন, ‘আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হোক আমাদের দিনবদলের অনুপ্রেরণা’। দিন সত্যিই বদলে গেছে এবং সেই দিনবদলে জীবন্ত সংস্কৃতিকে ঐতিহ্য বানানো হচ্ছে এবং মুনাফার রসে সেই ঐতিহ্যকে চুবিয়ে তার ধার ও শক্তি নিভিয়ে দেওয়া চলছে। বাউলেরা তো কোনো দিন সরকারের কাছে ধরনা দেননি। তারপরও সরকার যদি চায়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তহবিল থেকে বাউলদের অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েই সহায়তা করতে পারে।
১৬ বছরের যে কিশোর একদা মুমূর্ষু অবস্থায় কালীগঙ্গার তীরে আধেক পানিতে আর আধেক কাদায় এসে পৌঁছেছিল। স্থানীয় কৃষক মলম ও তাঁর বউ মতিজান যাকে সন্তান-স্নেহে বাঁচিয়ে তুলে ঠাঁই দিয়েছিলেন। একদিন মুসা নবীও এভাবে নদীতে ভেসে এসেছিলেন, ভগবান কৃষ্ণও এভাবে পরের ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। এভাবে মহাপুরুষেরা জাত-জন্ম-পরিচয় মুছে ওঠে আসেন। লালনও তেমনি আধেক পানিতে আধেক ডাঙ্গা থেকে আবার নবজন্ম পান। সেই নবজন্মে তিনি নদীয়ার জাত-পাতবিরোধী মানবমুক্তির দর্শনকে আরও এগিয়ে নেন, তার সঙ্গে যোগ ঘটান তান্ত্রিক ও সুফী সাধকদের মানবীয় দর্শনের। বাংলা ভাষা যে অপার ভাব ধারণ করতে সক্ষম, সহজ মানুষের সহজ সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী দার্শনিক লালনের হাতে সেই ভাষা যেন লীলায়িত ও গভীর হয়ে ওঠে।
মধ্যবিত্ত সমাজের মন-মননে রবীন্দ্রনাথের যে বিপুল অবদান, বাংলার কৃষক-কারিগরের নিম্নবর্গীয় সমাজকে মননশীল ও মুক্তিকামী ভাবরসে সিক্ত করায় লালনের অবদানও তেমনি বিপুল। কোনো দিন রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবানরা তাঁকে কোনো সহায়তা করেনি, জনগণই তাঁদের মনের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁর আদর্শ ও স্মৃতিকে জীবন্ত রেখেছেন। ভবিষ্যতেও রাখবেন। ফকির লালন শাহ আমাদের মানবিক ইতিহাসের অন্যতম স্মারক, দিশা, অনুপ্রেরণা। তার অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের সংস্কৃতির মানবিক ও চিন্তাশীল ধারার বিরুদ্ধেই আঘাত বলে বিবেচিত হোক এবং হোক তার প্রতিকার।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
লালনের মৃত্যুর ১২০ বছরে তাঁর আখড়া ও সমাধি তো বেহাত হয়েছেই, সেখানে এখন শুরু হয়েছে নতুন নতুন সব কাণ্ড কারখানা। সেই কারখানায় সবই আছে, কেবল লালন নেই, বাউলসাধক ফকির সাঁইজিরা নেই। এবার সেখানে স্পনসরশোভিত মঞ্চ, ব্র্যান্ড লোগোয় অলংকৃত মেলা ইত্যাদি বসেছে, মাইকে চটুল বাংলা-হিন্দি গান বাজছে। অথচ এই পয়লা কার্তিকই ছিল তাঁর বিদায়ের রাত। এই রাতেই ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের নিয়ে গাইতে গাইতে তিনি বলেছিলেন, ‘গেলাম’। লালনের অনুসারীরা একে বলে তিরোধান। এই দিন সারা বাংলা তো বটেই, বিভিন্ন দেশ থেকে লালন অনুসারী ভক্ত ও গবেষকেরা কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের সাধুসঙ্গে আসেন। তাঁদের জগতে কালীগঙ্গার তীরের লালনের মাজারই হলো তীর্থস্থান, সাধনার কেন্দ্র।
বহু দিন হলো জায়গাটি লালনের দর্শন ও জীবনধারার সঙ্গে একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন কায়কারবারে ভরপুর। লালনের আখড়া তথা সাঁইজির মাজার শরিফ থেকে বাউলেরা বিতাড়িত, লালনের দর্শন বিতাড়িত, লালনের স্মৃতি বিতাড়িত। মাজারসহ পুরো এলাকার মালিকানা এখন জেলা প্রশাসনের। সেখানে এখন আছে কেবল ভবন, বাণিজ্য, স্পনসরশিপ আর আনন্দ-বিনোদনের তুমুল মজমা। লালনের জীবন্ত ঐতিহ্যকে মুমূর্ষু করে জাদুঘরে পোরা হচ্ছে আর সাধনতীর্থকে বানানো হচ্ছে বাণিজ্যিক পর্যটনের খোরাক।
সংস্কৃতির অন্য কোনো পীঠস্থানের বিষয়ে এমনটা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাংলার ভাবুকতার শীর্ষ প্রতিনিধি এবং মানবতার মুক্তিকামী দার্শনিক শিক্ষাগুরু, সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান দিশারি লালনের বেলায় সেটাই করা হয়েছে। করেছে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, করেছে মৌলবাদী শক্তি, করেছে আমলাতন্ত্রের মধ্যে জেঁকে থাকা স্বার্থবুদ্ধির লোকেরা। লালনের ভাব, আদর্শ ও চর্চার সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব মানুষ, বাংলার ভাবুকতার ধারাকে যাঁরা নিছক ‘গ্রাম্য’, ‘অশিক্ষিত’ কবিদের ভাবাবেগের বিষয় মনে করেন, তাঁদের হাতে সংস্কৃতি ও চিন্তার বড় একটি কেন্দ্র কীভাবে নিরাপদ থাকবে?
বাংলার প্রতিষ্ঠানবিরোধী দার্শনিক আন্দোলন লালনের মাধ্যমেই বিপ্লবী বিকাশ পায়। নিম্নবর্গের মানুষের এই দার্শনিক এই নেতার চিন্তা ও কাজ সে যুগেরও যেমন এ যুগেও তেমন প্রতিষ্ঠিত জীবনদর্শনের বিপক্ষে। জীবিতাবস্থায় যিনি জাত-পাত, বৈষম্য, কূপমণ্ডূকতা আর জমিদারি ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন, আজকের যুগের জমিদার ও ঔপনিবেশিক শক্তির উত্তরাধিকারী মোল্লা-পুরোহিত-বণিক-আমলা-রাজনীতিবিদেরা কখনো খোলাখুলিভাবে কখনো পৃষ্ঠপোষকতার ছদ্মবেশে তাঁকে হেয়ই করছে। পিঠে যা পোষকতা করা হয়, তার আরেক নাম কিন্তু ‘মার’।
আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান লালনের সমাধিক্ষেত্রের পাশে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেন। পদাধিকারবলে এর সভাপতি হন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক। ১৯৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় লালন একাডেমি। ১৯৮৪ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেখানে ধর্মসভা বসান এবং লালনভক্তদের বের করে দেন। তিনি তাদের তওবাও করাতে যান। জেলা প্রশাসক এভাবে হন ধর্মেরও শাসক। প্রায় পাঁচ হাজার ফকির-সাধক বিক্ষোভ করলে রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে তাঁদের পিটিয়ে তাড়ানো হয়। মাজারের সিন্দুকের চাবিও সে দিনই বেহাত হয়। লালনের তরিকায় সাধক তাঁরাই, যাঁরা জ্ঞান ও জীবনচর্চায় মানুষের সামাজিক-সাংষ্কৃতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখান। এ কারণেই বোধকরি ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো চিরকালই তাদের বাতিল করতে চেয়েছে।
লালনের ধারার নেতৃস্থানীয় সাধকেরা চেয়েছিলেন সরকার যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু তা যেন মাজারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গাম্ভীর্য নষ্ট না করে এবং তা যেন মাজারের আঙিনার বাইরে কোথাও করা হয়। জাতিসংঘের সুপারিশেও ঐতিহাসিক স্থান ও পুরাকীর্তির চার কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু যেখানে জমি, টাকা ও ধর্ম-অধর্মের প্রশ্ন, সেখানে কে শোনে ন্যায্য কথা?
সবচেয়ে বড় ক্ষতি করা হয় ১৯৯৭ সালে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে লালন কমপ্লেক্স নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন, জাদুঘর ও অতিথিশালাসহ চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য মাজারের মূল চত্বরকেই বেছে নেওয়া হয়। লালনের স্মৃতিবিজড়িত কালীগঙ্গা নদী ভরাট করে বানানো হয় উন্মুক্ত মঞ্চ। অবরুদ্ধ কালীগঙ্গায় নৌবিহার, শৌখিন মাছ শিকার, লালনের শিষ্যদের হাতে রোপিত শতবর্ষী বৃক্ষ কেটে ফেলে বিদেশি গাছ লাগানো ইত্যাদিও ছিল তাদের লালনের স্মৃতিরক্ষা প্রকল্পের অংশ। কোটি টাকা ব্যয়ে লালনের স্মৃতি ধ্বংস করা হয় এবং তাঁর অনুসারীদের করা হয় অবাঞ্ছিত। লালন একাডেমির আর কোনো অবদান আমাদের অজানা।
এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। কবি শামসুর রাহমান এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মীরা নানা কর্মসূচি ও লেখালেখির মাধ্যমে তৎকালীন সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, যা হচ্ছে তাতে লালনের সৃষ্টি, স্মৃতি ও সমাধির অশেষ ক্ষতি হবে। সরকার শোনেনি এবং কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বও লালন আখড়া রক্ষা কমিটির এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। কেননা লালনকে ঘিরে আয়োজিত যাবতীয় অনুষ্ঠানে আসা লাখ লাখ দর্শনার্থী ঘিরে যে বিরাট বাণিজ্য হয়, তার জন্য ভবন দরকার, মেলা দরকার, আখড়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ দরকার; বাউল-ফকিরদের উপস্থিতি সেখানে বড় বাধা। গাছ দেখলে সাধক দেখে প্রাণ, ব্যবসায়ী দেখে কাঠ। এখানেও সেটাই ঘটেছে।
এবারও সেই নবনির্মিত লালন কমপ্লেক্সেই বসেছে ‘লালন মৃত্যুবার্ষিকী’র উৎসব। পত্রিকায় এই বরাতে অনেক খরচ করে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। লালনের দর্শনে এবং বাউলদের কাছে লালনের মৃত্যু নেই। তিনি তিরোধান করেছেন মাত্র। তাঁর ভাব ও আদর্শকে তাঁরা জীবন্ত জ্ঞান করে সাধনা করেন। জন্ম ও মৃত্যুর চেয়ে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ হিসেবে সঠিক দিশায় পৌঁছানোর ঘটনা। মৃত্যু হয় দেহের, চিন্তা ও ভাব যদি সঠিক হয় তবে তা অজর-অমর। তাঁদের চিন্তা ভুল না সঠিক, সেটা অন্য আলোচনা। কিন্তু খোদ লালনের মাজারে বসে লালনের ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ পালন এই বিচারে অন্যায় ও অনৈতিক। প্রথাগত তিন দিনের অনুষ্ঠানটিকে মেলার সুবিধার জন্য করা হয়েছে পাঁচ দিনের। এসবকে ‘কানার হাটবাজার’ মনে করে দুঃখ পেয়ে বাউল-ফকিরেরা এসব থেকে দূরে থাকেন।
লালনের মতোই কালীগঙ্গার তীরেই মাঠের মধ্যে তাঁদের আস্তানা। আর এদিকে চলছে জমজমাট আয়োজন আর রং-রসে ভরা বিনোদন। মাইকে হিন্দি গান বাজে, নানান ভোগ্যপণ্যের পসরা বসে। আগে যেখানে দেশ-বিদেশের বাউলেরা জীবন-জগতের নানান বিষয় নিয়ে গানে গানে আলোচনা চালাতেন, সেখানে এখন ক্লোজআপ তারকারা বিকৃত সুরে লালনের গান গায়। মূল মিলনায়তনটির দোতলায় করা হয়েছে গানের ব্যবস্থা। বাউলেরা সমাধির থেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে গান করবেন না। তাই আখড়ার সাধক কিংবা বড় বড় সাধুগুরুরা এসব থেকে দূরে থাকেন। আয়োজনটা উৎসবের আর কনসার্টের; শ্রদ্ধাভক্তির বালাই সেখানে নেই। এসবই হলো লালনের আখড়ার বাণিজ্যিকায়নের ফল। মাজার তো লাঞ্ছিত হচ্ছেই, তাঁর সমাধির পাশে ঘটা করে তাঁর নামে তাঁকেই অপমান না করলে কি চলত না?
দ্বিতীয়ত, যে দার্শনিক-কবি-গায়ক ও সমাজ-সংগ্রামীর জীবনজোড়া তৎপরতাই ছিল পণ্যায়নের বিরুদ্ধে, মুনাফার বিরুদ্ধে, কৃত্রিম জৌলুশ ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে, তাঁকে এবং তাঁর ঘাঁটি পণ্যশক্তির দখলে যাওয়া যে কত বড় লজ্জা ও পরাজয়ের বিষয়, তা কি কর্তাব্যক্তিদের বোধে আসে? লালন মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের স্পনসর যাঁরা, তাঁরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপনে লিখেছেন, ‘আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হোক আমাদের দিনবদলের অনুপ্রেরণা’। দিন সত্যিই বদলে গেছে এবং সেই দিনবদলে জীবন্ত সংস্কৃতিকে ঐতিহ্য বানানো হচ্ছে এবং মুনাফার রসে সেই ঐতিহ্যকে চুবিয়ে তার ধার ও শক্তি নিভিয়ে দেওয়া চলছে। বাউলেরা তো কোনো দিন সরকারের কাছে ধরনা দেননি। তারপরও সরকার যদি চায়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তহবিল থেকে বাউলদের অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েই সহায়তা করতে পারে।
১৬ বছরের যে কিশোর একদা মুমূর্ষু অবস্থায় কালীগঙ্গার তীরে আধেক পানিতে আর আধেক কাদায় এসে পৌঁছেছিল। স্থানীয় কৃষক মলম ও তাঁর বউ মতিজান যাকে সন্তান-স্নেহে বাঁচিয়ে তুলে ঠাঁই দিয়েছিলেন। একদিন মুসা নবীও এভাবে নদীতে ভেসে এসেছিলেন, ভগবান কৃষ্ণও এভাবে পরের ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। এভাবে মহাপুরুষেরা জাত-জন্ম-পরিচয় মুছে ওঠে আসেন। লালনও তেমনি আধেক পানিতে আধেক ডাঙ্গা থেকে আবার নবজন্ম পান। সেই নবজন্মে তিনি নদীয়ার জাত-পাতবিরোধী মানবমুক্তির দর্শনকে আরও এগিয়ে নেন, তার সঙ্গে যোগ ঘটান তান্ত্রিক ও সুফী সাধকদের মানবীয় দর্শনের। বাংলা ভাষা যে অপার ভাব ধারণ করতে সক্ষম, সহজ মানুষের সহজ সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী দার্শনিক লালনের হাতে সেই ভাষা যেন লীলায়িত ও গভীর হয়ে ওঠে।
মধ্যবিত্ত সমাজের মন-মননে রবীন্দ্রনাথের যে বিপুল অবদান, বাংলার কৃষক-কারিগরের নিম্নবর্গীয় সমাজকে মননশীল ও মুক্তিকামী ভাবরসে সিক্ত করায় লালনের অবদানও তেমনি বিপুল। কোনো দিন রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবানরা তাঁকে কোনো সহায়তা করেনি, জনগণই তাঁদের মনের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁর আদর্শ ও স্মৃতিকে জীবন্ত রেখেছেন। ভবিষ্যতেও রাখবেন। ফকির লালন শাহ আমাদের মানবিক ইতিহাসের অন্যতম স্মারক, দিশা, অনুপ্রেরণা। তার অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের সংস্কৃতির মানবিক ও চিন্তাশীল ধারার বিরুদ্ধেই আঘাত বলে বিবেচিত হোক এবং হোক তার প্রতিকার।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments