দুর্গোৎসব-দেবী বিসর্জনে যান, দানব যায় না... by আফজাল হোসেন
পূজার মাতামাতি শেষ হয়ে গেল। ঢাকার চারদিকে ঢাকের বাজনা শেষ। শুক্রবার ভেবেছিলাম, বিকেলবেলায় কোনো পূজা প্যান্ডেলে গেলে হয়। বনানী মাঠের পূজামণ্ডপে ঢুকতে যত লম্বা লাইন দেখলাম, ইচ্ছেকে গুটিয়ে আবার জায়গামতো তুলে রাখতে হলো।
গাড়িতে বসে জ্যামের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে ভাবছিলাম, লাইন ছাড়া উপায় বা কী, লাইনে সবাই ঢুকছে বলে হুলস্থুল নেই, হুটোপুটি নেই, শান্তি আছে।
যখন ছোট ছিলাম, গ্র্রামে পূজার আনন্দ শুরু হয়ে যেত ঠাকুরবাড়িতে প্রতিমা বানানো শুরু হলে। এক এক পাড়ায় তখন এক এক রকম আয়োজন, তবে জমজমাট পূজা হতো বাজারের মণ্ডপে। অন্যগুলোর চেয়ে সেখানকার বৈশিষ্ট্য ছিল, পূজামণ্ডপ ঘিরে বিরাটকায় মেলা বসত। সে মেলা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত মেলা ছিল।
ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের বাড়ির পাশে মসজিদ, তার ৩০ ফুট দূরে কালীমন্দির। এক একটি শাসনামল এসেছে এবং গেছে, ওই আসা-যাওয়ার মধ্যে খুটখাট এটা-ওটা ঘটেছে, কিন্তু শেষমেশ মসজিদ আর মন্দির পাশাপাশিই দাঁড়িয়ে থেকেছে সগৌরবে।
খুটখাটের কথা বললাম, সেসব সামান্য সংখ্যার একদল মানুষের অভিপ্রায়। লাই পেয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, আবার অদৃশ্য ইশারায় বসে গেছে, শুয়ে গেছে। ওই যে অদৃশ্য ইশারা বললাম, সেটা আসলে স্পষ্ট করে দায়ী পক্ষকে দেখানোর চেষ্টা। আমাদের মধ্যে দায়ী পক্ষকে দেখিয়ে আনন্দিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে এবং ‘আমি মোটেও দায়ী নই, আমাদের মতো ভালো আর জগতে নেই’ এমন ভেবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শান্তি পাই এক পক্ষ। এ দুটোই যে অশান্তির, সেটা ভেবে দেখার সময় ও সুযোগ কারও হয় না।
ভালো ও মন্দের বসবাস শুধু আমাদের বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে। সেটা থাকুক, মন্দ বিনা ভালোকে আমরা অনুভব করব কীভাবে? ভালোর সঙ্গে থাকাই মানবধর্ম। কিন্তু মানুষের ধর্ম হচ্ছে, নিজের সুবিধা-অসুবিধা, ভালো ও মন্দের সংজ্ঞা নিজেই নির্ধারণ করে নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া। এমন সংজ্ঞামতো, বুশ সাহেব ভাবলেন, তিনি ভালো আর সাদ্দাম লোকটা খুবই মন্দ। নেমে পড়লেন লঙ্কাকাণ্ডে। পৃথিবীর মানুষের জন্য সেটা ভালো হলো না।
এক লাফে অত দূরে না গিয়ে ভাবা যাক নিকট নিয়ে। মন্দ-ভালো নিয়ে আমাদের বিপুল মাথাব্যথা; সুবিধামতো ভালো ও মন্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে নিচ্ছি, এতে আত্মতৃপ্তি হচ্ছে, সুখ জুটছে। কিন্তু চোখে দেখতে পাই না, অসুখ ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। অশান্তি লেজ নাড়িয়ে বলছে, ‘দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!’ শান্তি ও সুখের জন্য সর্বদা চোখে পট্টি বেঁধে যে পথটা বেছে নিচ্ছি, সে পথের শেষে আনন্দের অধ্যায় কি পাব?
হিন্দু ও মুসলমান এ বঙ্গে ভাই ভাই কবে ছিল না? সংকটের অনুগল্পগুলো বৃহৎ-দর্শন কাচের নিচে ফেলে দেখে লাভ কাদের? সুখী হয় কারা? প্রগতিশীলতার আচকান পরে সময়মতো দুই ছত্র হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলা হলো, তার মধ্যে তিন টেবিল-চামচ সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন উসকানি আর এক মুঠো অতীত-বর্তমানের বিশ্লেষণ ঢেলে দিলে হাততালির ঝাঁকুনিতে তা একপক্ষের জন্য বেশ উপাদেয় বলবর্ধক সালসা হয়, কিন্তু তাতে জন্মভূমির মুখে কিন্তু হাসি ফোটে না। দেশমাতার অস্বস্তি কিন্তু এমন পক্ষ-অবলম্বনে ঘোচে না।
ধর্মের প্রসঙ্গ এলে বলা আছে অনেক কিছু। জ্ঞানও তো মানুষকে দেওয়া হয়েছে। একটা কথার মানে জ্ঞান-অনুযায়ী মানুষ অনেক রকম ভেবে নিতে পারে। কিন্তু যে জ্ঞানে, যে অর্থে মনুষ্য সম্প্রদায়ের মঙ্গল হবে না তা জ্ঞান নয়, অন্ধত্ব। যে অর্থ প্রকাশে জীবনে নেমে আসে অনর্থ, তা কি প্রয়োজনহীন নয়?
একটা গল্প বলি, এক বন্ধু গেছেন হজে। মিনাতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষের সমুদ্রে পড়ে অভিভূত তিনি। সফেদ ঢেউয়ের মধ্যে ভাসতে ভাসতে নিজের মনে হঠাৎ এক কষ্টের কাঁটার খোঁচা অনুভব করলেন। সাথি ছিলেন ঢাকার বড় এক মসজিদের তরুণ বয়সী ইমাম। তাঁকে প্রশ্ন করলেন বন্ধুটি, ‘ইমাম সাহেব, আমি পুরান ঢাকায় বসবাস ও ব্যবসা করি, সেখানে হিন্দুসম্প্রদায় পূজা-অর্চনা করে। নিজের এলাকায় পূজা হলে প্রতিবেশীরা আপন মনে করে পূজায় চাঁদা দিতে বলে, আমি দিই, মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি। আজ মনে হচ্ছে, আমি কি অন্যায় করেছি?’ একটু সময় নিয়ে ভাবলেন ইমাম সাহেব, তারপর উত্তর করেন, ‘এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কোথাও লেখা দেখিনি। তবে নিজের জ্ঞানে বলতে পারি, আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৎ পথে, মঙ্গলের পক্ষে থাকতে বলেছেন, মানুষের মঙ্গলকাজে সহায়তা দেওয়া উত্তম কাজ। সে অনুযায়ী আপনি তো মঙ্গলের পথেই রয়েছেন।’ এ ব্যাখ্যায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন সেই বন্ধু।
পশ্চিমবঙ্গে আমার মামাবাড়ি। অনেক পূজা আমি সেখানে কাটিয়েছি। নিজের চোখে দেখেছি, আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় আমার ছোট মামা অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পূজামণ্ডপে কাঁধে বয়ে প্রতিমা এনে স্থাপন করছেন। দেখেছি, আরতিতে দুর্গাদেবীর সামনে ধুনচি হাতে নিয়ে নাচছেন। বিসর্জনে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমা।
এ গল্পে কারও কারও ভাবার সুযোগ থেকে যায়, সে দেশে মুসলমানদের টিকে থাকার করুণ চিত্র এটা। জোঁকের মুখে নুন দেওয়ার মতো আর একটা সত্য ঘটনা বয়ান করি। ১৯৭১ সালে বড় মামা মহসীন সরদার ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বড় নেতা। তাঁর বাড়িতে আগুন দিতে মিছিল করে এসেছিল একদল মানুষ। সেই আগুনের সংকল্প ঠেকিয়েছিল আরও একদল মানুষ। উভয়ের ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। কিন্তু সে বিবেচনা না করে শ্রেয়তর বিবেচনা হচ্ছে—মন্দ মানুষ, ভালো মানুষ। মন্দ লোকেরা পোড়াতে আসে, জ্বালাতে আসে; ভালোরা থাকে প্রতিরোধে, নেভাতে।
১৬ বছর আগে আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে। ছোটবেলা থেকে বৈদ্য নামের প্রায় সমবয়সী একজন আমাদের সংসার, জমিজমা দেখাশোনার দায়িত্বে আছে। বৈদ্যনাথ আমার আব্বার দুই হাতের এক হাত যেন। আব্বার আকস্মিক মৃত্যুতে আমাদের মতো তার মনেও হাহাকার, চোখে জল। আব্বার স্পন্দনহীন দেহটা চাদরমুুড়ি দেওয়া। সৎকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আমি সামলাচ্ছি আম্মা, ছোট ভাই আর ছোট বোনটাকে। বৈদ্যকে বলেছি জোগাড়যন্তর শুরু করতে। দোকান থেকে সে কিনে আনে আগরবাতি আর গোলাপজল। এক ধর্মপ্রাণ ঘনিষ্ঠজন আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে একান্তভাবে বললেন, ‘ওকে দিয়ে ওসব আনা কি ঠিক হচ্ছে?’ এ প্রশ্নে খুব অবাক হই। নাম, ধর্ম—এসব তো আমার মাথায় আসেনি। মনে ভেবেছি, আব্বার মৃত্যু হয়েছে, বৈদ্যের মামারও মৃত্যু হয়েছে। বৈদ্য আব্বাকে ডাকত ‘মামা’। আমি পুত্র হয়ে যত দিন যত মুহূর্ত তাঁর পাশে থাকতে পারিনি, বৈদ্যনাথ সরকার তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আব্বার সঙ্গে ছিল। তাহলে অধিকার আমার একচ্ছত্র হয় কী করে? তার ও আমার শোক, আমার ও তার কান্না একই রকম, তাহলে কেন এই ভেদাভেদ?
হিন্দু-মুসলমান—এই পরিচয় পাশে সরিয়ে রাখি, পৃথিবীতে আরও দ্বন্দ্বের বিষয় রয়েছে। আছে সাদা-কালোর সংঘাত। ধনী দরিদ্রের ওপর সওয়ার হয়ে আছে, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে সগৌরবে। রাজনীতির নামে, মঙ্গলের অজুহাতে অমঙ্গলের রাস্তায় মানুষকে ঠেলে দেওয়ার আয়োজনের শেষ নেই। দলের নামে, পক্ষের গায়ে ভালো ও মন্দের ছাপ লাগানো চলছে। এই ভালো ও মন্দের নির্ধারক হয়ে কী লাভ? অন্যের লোকসানের জন্য ফলবান চেষ্টা করে, নিজের লাভের গুড় যে পিঁপড়ে খেয়ে যায় তাকিয়ে দেখা হয় না।
আমাদের শোনা হয়, অমুক মুসলমান তমুক হিন্দুর জমি দখল করেছে। মন্দির ভেঙেছে, ঘরে আগুন দিয়েছে। এমন কর্ম কি এক মুসলমান অন্য মুসলমানের বিপক্ষে ঘটায় না? ভাই কি ভাইয়ের জমি দখল করে না? ছেলে বাবাকে হত্যা করেছে—এ গল্প কি শোনা হয় না? স্ত্রীর মুখ এসিডে ঝলসে দিয়েছে স্বামী—এমন গল্পে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব কোথায়?
গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। সে গল্প নিয়ে ভারতে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছে। ছবির নাম ফিরাক। অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ সে ছবির পরিচালক। ছবি মুক্তির পর হইহই করে উঠেছিল একদল মানুষ। তারা ভেবেছিল, এ কেমন কথা, পরিচালক নিজে হিন্দু হয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যায় এমন ছবি বানালেন? এমন ভাবনা, অভিযোগ কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কেননা, সুচিন্তাকে রক্ষা করতে সুস্থ ভাবনা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই গেল গেল করা মানুষদের আয়তনের চেয়ে বড় করে ভেবে লাভ নেই। হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, একজন মানুষ মানুষের দৃষ্টিতে সব দেখবে—পৃথিবীর প্রকৃত নিয়ম সেটাই। অথচ আমরা, মানুষেরা ঠিক করে নিয়েছি, ভাবতে হবে, বলতে হবে, করতে হবে স্বার্থমতো। চোখ খুলে দেখা হয় না, সমস্যা শেকড়বাকড় মেলে শুষে নিচ্ছে জীবনের সৌরভ।
দোষারোপে ক্লান্তিহীন সবাই। কিন্তু নিজেদের মধ্যে দুষ্ট স্বভাব ত্যাগে সামান্য আগ্রহ চোখে পড়ে না; হাব ও ভাবে আশাও জাগে না মনে। এক পক্ষ মানুষের কল্যাণ হবে ভেবে, মঙ্গল প্রতিষ্ঠার বিবেচনায় অন্য পক্ষের ওপর হামলে পড়ছে। আমাদের শুনতে হচ্ছে, দেখতে হচ্ছে—অমুক পক্ষের অমুক তমুক পক্ষের তমুককে কুপিয়ে হত্যা করেছে বা গুলিতে মেরে ফেলেছে। পাল্টাপাল্টি ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে। জয় এবং জোর প্রতিষ্ঠার জন্য শুনতে পাই, এবার অমুক পক্ষের অমুককে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরেছে তমুক পক্ষের লোকেরা।
অমুক-তমুক বাদ দিয়ে মূল পরিচয় মানুষ। মানুষ মানুষকে মারছে—গল্পটা কিন্তু এক লাইনের এবং খুবই সরল। এই নির্মম সত্যে কোনো পক্ষের আনন্দিত হওয়ার সামান্যতম সুযোগ নেই। আনন্দিত হওয়া পাপ। ‘বেশ হয়েছে’ এমন অব্যক্ত অনুভবও পাপ। যদি কারও মুখ থেকে ব্যক্ত হয় হত্যাকারীর জন্য প্রশ্রয় জোগানো প্রচ্ছন্ন ভাষা, সেও প্রচণ্ড অন্যায়। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করানো, অন্যায়ে লিপ্ত করার মতো উৎসাহ জোগানো, আগুন জ্বালো, পোড়াও, হত্যা করো, রক্ত ঝরাও—এমন উদ্যোগে ভূমিকা রাখতে দেখছি আমরা, সাধারণ মানুষেরা। আমরা এও দেখছি, অন্যে করলে যেটা পাপ ও ভয়ংকর অন্যায় বিবেচনা করা হয়, নিজের বেলায় সে পাপই পুণ্য, সে অন্যায় খুবই ন্যায়।
মানে দাঁড়াচ্ছে, পক্ষ রক্ষা করতে, পক্ষের মান বাঁচাতে, মন্দকে প্রশ্রয় দিতে সামান্য বুক কাঁপছে না কারও। টিকে থাকতে হলে সংঘাত চাই। মুখে সর্বদা মুখস্থ বুলি ‘শান্তি শান্তি’, কিন্তু শান্তি থাকলে পক্ষ টিকে থাকবে না, তাই পক্ষ টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানুষ—কারও বেঁচে থাকার উপায় থাকছে না।
দেবী গেলেন বিসর্জনে। ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল সব। পূর্বে হয়েছে, পরেও হবে। আমাদের বাংলা মায়ের কোলে মুসলমান বা হিন্দু কখনোই আলাদা ছিল না। কালে কালে পক্ষেরা পক্ষ বাঁচাতে নিন্দা করেছে, প্রশস্তি গেয়েছে। সদাসর্বদা ভালো-মন্দের হিসাব-নিকাশ চলছে। দুঃখের বিষয়, মন্দকে মন্দ বলা হয়েছে অবিরাম, তবু মন্দ আশ্রয়হীন হয়নি। প্রশ্ন জাগে, দিনের পর দিন মন্দের উল্লাসধ্বনি কেন বেড়ে উঠেছে?
টিকে থাকার জন্য মন্দের প্রশ্রয় ছাড়া উপায় নেই—এমন অসহায় ভাবনার মৃত্যু হওয়া দরকার। দরকার মানুষের মৃত্যু থামানো। কুঁজো পিঠ নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে চাইলে কি তা সম্ভব হবে? হিংসা, প্রতিহিংসা বেঁচে থাকলে মানুষ মরবে; আর আমরা ভাবতে থাকব, ভাবতেই থাকব, ‘আমাদের পক্ষ বেঁচে থাকছে’। এমন স্বার্থপর আনন্দে দেশ আনন্দিত হয় না, সে বিষণ্ন হয় আরও।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, নির্মাতা।
fzalhossin1515@yahoo.com
যখন ছোট ছিলাম, গ্র্রামে পূজার আনন্দ শুরু হয়ে যেত ঠাকুরবাড়িতে প্রতিমা বানানো শুরু হলে। এক এক পাড়ায় তখন এক এক রকম আয়োজন, তবে জমজমাট পূজা হতো বাজারের মণ্ডপে। অন্যগুলোর চেয়ে সেখানকার বৈশিষ্ট্য ছিল, পূজামণ্ডপ ঘিরে বিরাটকায় মেলা বসত। সে মেলা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত মেলা ছিল।
ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের বাড়ির পাশে মসজিদ, তার ৩০ ফুট দূরে কালীমন্দির। এক একটি শাসনামল এসেছে এবং গেছে, ওই আসা-যাওয়ার মধ্যে খুটখাট এটা-ওটা ঘটেছে, কিন্তু শেষমেশ মসজিদ আর মন্দির পাশাপাশিই দাঁড়িয়ে থেকেছে সগৌরবে।
খুটখাটের কথা বললাম, সেসব সামান্য সংখ্যার একদল মানুষের অভিপ্রায়। লাই পেয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, আবার অদৃশ্য ইশারায় বসে গেছে, শুয়ে গেছে। ওই যে অদৃশ্য ইশারা বললাম, সেটা আসলে স্পষ্ট করে দায়ী পক্ষকে দেখানোর চেষ্টা। আমাদের মধ্যে দায়ী পক্ষকে দেখিয়ে আনন্দিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে এবং ‘আমি মোটেও দায়ী নই, আমাদের মতো ভালো আর জগতে নেই’ এমন ভেবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শান্তি পাই এক পক্ষ। এ দুটোই যে অশান্তির, সেটা ভেবে দেখার সময় ও সুযোগ কারও হয় না।
ভালো ও মন্দের বসবাস শুধু আমাদের বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে। সেটা থাকুক, মন্দ বিনা ভালোকে আমরা অনুভব করব কীভাবে? ভালোর সঙ্গে থাকাই মানবধর্ম। কিন্তু মানুষের ধর্ম হচ্ছে, নিজের সুবিধা-অসুবিধা, ভালো ও মন্দের সংজ্ঞা নিজেই নির্ধারণ করে নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া। এমন সংজ্ঞামতো, বুশ সাহেব ভাবলেন, তিনি ভালো আর সাদ্দাম লোকটা খুবই মন্দ। নেমে পড়লেন লঙ্কাকাণ্ডে। পৃথিবীর মানুষের জন্য সেটা ভালো হলো না।
এক লাফে অত দূরে না গিয়ে ভাবা যাক নিকট নিয়ে। মন্দ-ভালো নিয়ে আমাদের বিপুল মাথাব্যথা; সুবিধামতো ভালো ও মন্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে নিচ্ছি, এতে আত্মতৃপ্তি হচ্ছে, সুখ জুটছে। কিন্তু চোখে দেখতে পাই না, অসুখ ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। অশান্তি লেজ নাড়িয়ে বলছে, ‘দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!’ শান্তি ও সুখের জন্য সর্বদা চোখে পট্টি বেঁধে যে পথটা বেছে নিচ্ছি, সে পথের শেষে আনন্দের অধ্যায় কি পাব?
হিন্দু ও মুসলমান এ বঙ্গে ভাই ভাই কবে ছিল না? সংকটের অনুগল্পগুলো বৃহৎ-দর্শন কাচের নিচে ফেলে দেখে লাভ কাদের? সুখী হয় কারা? প্রগতিশীলতার আচকান পরে সময়মতো দুই ছত্র হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলা হলো, তার মধ্যে তিন টেবিল-চামচ সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন উসকানি আর এক মুঠো অতীত-বর্তমানের বিশ্লেষণ ঢেলে দিলে হাততালির ঝাঁকুনিতে তা একপক্ষের জন্য বেশ উপাদেয় বলবর্ধক সালসা হয়, কিন্তু তাতে জন্মভূমির মুখে কিন্তু হাসি ফোটে না। দেশমাতার অস্বস্তি কিন্তু এমন পক্ষ-অবলম্বনে ঘোচে না।
ধর্মের প্রসঙ্গ এলে বলা আছে অনেক কিছু। জ্ঞানও তো মানুষকে দেওয়া হয়েছে। একটা কথার মানে জ্ঞান-অনুযায়ী মানুষ অনেক রকম ভেবে নিতে পারে। কিন্তু যে জ্ঞানে, যে অর্থে মনুষ্য সম্প্রদায়ের মঙ্গল হবে না তা জ্ঞান নয়, অন্ধত্ব। যে অর্থ প্রকাশে জীবনে নেমে আসে অনর্থ, তা কি প্রয়োজনহীন নয়?
একটা গল্প বলি, এক বন্ধু গেছেন হজে। মিনাতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষের সমুদ্রে পড়ে অভিভূত তিনি। সফেদ ঢেউয়ের মধ্যে ভাসতে ভাসতে নিজের মনে হঠাৎ এক কষ্টের কাঁটার খোঁচা অনুভব করলেন। সাথি ছিলেন ঢাকার বড় এক মসজিদের তরুণ বয়সী ইমাম। তাঁকে প্রশ্ন করলেন বন্ধুটি, ‘ইমাম সাহেব, আমি পুরান ঢাকায় বসবাস ও ব্যবসা করি, সেখানে হিন্দুসম্প্রদায় পূজা-অর্চনা করে। নিজের এলাকায় পূজা হলে প্রতিবেশীরা আপন মনে করে পূজায় চাঁদা দিতে বলে, আমি দিই, মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি। আজ মনে হচ্ছে, আমি কি অন্যায় করেছি?’ একটু সময় নিয়ে ভাবলেন ইমাম সাহেব, তারপর উত্তর করেন, ‘এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কোথাও লেখা দেখিনি। তবে নিজের জ্ঞানে বলতে পারি, আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৎ পথে, মঙ্গলের পক্ষে থাকতে বলেছেন, মানুষের মঙ্গলকাজে সহায়তা দেওয়া উত্তম কাজ। সে অনুযায়ী আপনি তো মঙ্গলের পথেই রয়েছেন।’ এ ব্যাখ্যায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন সেই বন্ধু।
পশ্চিমবঙ্গে আমার মামাবাড়ি। অনেক পূজা আমি সেখানে কাটিয়েছি। নিজের চোখে দেখেছি, আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় আমার ছোট মামা অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পূজামণ্ডপে কাঁধে বয়ে প্রতিমা এনে স্থাপন করছেন। দেখেছি, আরতিতে দুর্গাদেবীর সামনে ধুনচি হাতে নিয়ে নাচছেন। বিসর্জনে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমা।
এ গল্পে কারও কারও ভাবার সুযোগ থেকে যায়, সে দেশে মুসলমানদের টিকে থাকার করুণ চিত্র এটা। জোঁকের মুখে নুন দেওয়ার মতো আর একটা সত্য ঘটনা বয়ান করি। ১৯৭১ সালে বড় মামা মহসীন সরদার ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বড় নেতা। তাঁর বাড়িতে আগুন দিতে মিছিল করে এসেছিল একদল মানুষ। সেই আগুনের সংকল্প ঠেকিয়েছিল আরও একদল মানুষ। উভয়ের ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। কিন্তু সে বিবেচনা না করে শ্রেয়তর বিবেচনা হচ্ছে—মন্দ মানুষ, ভালো মানুষ। মন্দ লোকেরা পোড়াতে আসে, জ্বালাতে আসে; ভালোরা থাকে প্রতিরোধে, নেভাতে।
১৬ বছর আগে আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে। ছোটবেলা থেকে বৈদ্য নামের প্রায় সমবয়সী একজন আমাদের সংসার, জমিজমা দেখাশোনার দায়িত্বে আছে। বৈদ্যনাথ আমার আব্বার দুই হাতের এক হাত যেন। আব্বার আকস্মিক মৃত্যুতে আমাদের মতো তার মনেও হাহাকার, চোখে জল। আব্বার স্পন্দনহীন দেহটা চাদরমুুড়ি দেওয়া। সৎকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আমি সামলাচ্ছি আম্মা, ছোট ভাই আর ছোট বোনটাকে। বৈদ্যকে বলেছি জোগাড়যন্তর শুরু করতে। দোকান থেকে সে কিনে আনে আগরবাতি আর গোলাপজল। এক ধর্মপ্রাণ ঘনিষ্ঠজন আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে একান্তভাবে বললেন, ‘ওকে দিয়ে ওসব আনা কি ঠিক হচ্ছে?’ এ প্রশ্নে খুব অবাক হই। নাম, ধর্ম—এসব তো আমার মাথায় আসেনি। মনে ভেবেছি, আব্বার মৃত্যু হয়েছে, বৈদ্যের মামারও মৃত্যু হয়েছে। বৈদ্য আব্বাকে ডাকত ‘মামা’। আমি পুত্র হয়ে যত দিন যত মুহূর্ত তাঁর পাশে থাকতে পারিনি, বৈদ্যনাথ সরকার তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আব্বার সঙ্গে ছিল। তাহলে অধিকার আমার একচ্ছত্র হয় কী করে? তার ও আমার শোক, আমার ও তার কান্না একই রকম, তাহলে কেন এই ভেদাভেদ?
হিন্দু-মুসলমান—এই পরিচয় পাশে সরিয়ে রাখি, পৃথিবীতে আরও দ্বন্দ্বের বিষয় রয়েছে। আছে সাদা-কালোর সংঘাত। ধনী দরিদ্রের ওপর সওয়ার হয়ে আছে, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে সগৌরবে। রাজনীতির নামে, মঙ্গলের অজুহাতে অমঙ্গলের রাস্তায় মানুষকে ঠেলে দেওয়ার আয়োজনের শেষ নেই। দলের নামে, পক্ষের গায়ে ভালো ও মন্দের ছাপ লাগানো চলছে। এই ভালো ও মন্দের নির্ধারক হয়ে কী লাভ? অন্যের লোকসানের জন্য ফলবান চেষ্টা করে, নিজের লাভের গুড় যে পিঁপড়ে খেয়ে যায় তাকিয়ে দেখা হয় না।
আমাদের শোনা হয়, অমুক মুসলমান তমুক হিন্দুর জমি দখল করেছে। মন্দির ভেঙেছে, ঘরে আগুন দিয়েছে। এমন কর্ম কি এক মুসলমান অন্য মুসলমানের বিপক্ষে ঘটায় না? ভাই কি ভাইয়ের জমি দখল করে না? ছেলে বাবাকে হত্যা করেছে—এ গল্প কি শোনা হয় না? স্ত্রীর মুখ এসিডে ঝলসে দিয়েছে স্বামী—এমন গল্পে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব কোথায়?
গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। সে গল্প নিয়ে ভারতে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছে। ছবির নাম ফিরাক। অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ সে ছবির পরিচালক। ছবি মুক্তির পর হইহই করে উঠেছিল একদল মানুষ। তারা ভেবেছিল, এ কেমন কথা, পরিচালক নিজে হিন্দু হয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যায় এমন ছবি বানালেন? এমন ভাবনা, অভিযোগ কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কেননা, সুচিন্তাকে রক্ষা করতে সুস্থ ভাবনা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই গেল গেল করা মানুষদের আয়তনের চেয়ে বড় করে ভেবে লাভ নেই। হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, একজন মানুষ মানুষের দৃষ্টিতে সব দেখবে—পৃথিবীর প্রকৃত নিয়ম সেটাই। অথচ আমরা, মানুষেরা ঠিক করে নিয়েছি, ভাবতে হবে, বলতে হবে, করতে হবে স্বার্থমতো। চোখ খুলে দেখা হয় না, সমস্যা শেকড়বাকড় মেলে শুষে নিচ্ছে জীবনের সৌরভ।
দোষারোপে ক্লান্তিহীন সবাই। কিন্তু নিজেদের মধ্যে দুষ্ট স্বভাব ত্যাগে সামান্য আগ্রহ চোখে পড়ে না; হাব ও ভাবে আশাও জাগে না মনে। এক পক্ষ মানুষের কল্যাণ হবে ভেবে, মঙ্গল প্রতিষ্ঠার বিবেচনায় অন্য পক্ষের ওপর হামলে পড়ছে। আমাদের শুনতে হচ্ছে, দেখতে হচ্ছে—অমুক পক্ষের অমুক তমুক পক্ষের তমুককে কুপিয়ে হত্যা করেছে বা গুলিতে মেরে ফেলেছে। পাল্টাপাল্টি ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে। জয় এবং জোর প্রতিষ্ঠার জন্য শুনতে পাই, এবার অমুক পক্ষের অমুককে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরেছে তমুক পক্ষের লোকেরা।
অমুক-তমুক বাদ দিয়ে মূল পরিচয় মানুষ। মানুষ মানুষকে মারছে—গল্পটা কিন্তু এক লাইনের এবং খুবই সরল। এই নির্মম সত্যে কোনো পক্ষের আনন্দিত হওয়ার সামান্যতম সুযোগ নেই। আনন্দিত হওয়া পাপ। ‘বেশ হয়েছে’ এমন অব্যক্ত অনুভবও পাপ। যদি কারও মুখ থেকে ব্যক্ত হয় হত্যাকারীর জন্য প্রশ্রয় জোগানো প্রচ্ছন্ন ভাষা, সেও প্রচণ্ড অন্যায়। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করানো, অন্যায়ে লিপ্ত করার মতো উৎসাহ জোগানো, আগুন জ্বালো, পোড়াও, হত্যা করো, রক্ত ঝরাও—এমন উদ্যোগে ভূমিকা রাখতে দেখছি আমরা, সাধারণ মানুষেরা। আমরা এও দেখছি, অন্যে করলে যেটা পাপ ও ভয়ংকর অন্যায় বিবেচনা করা হয়, নিজের বেলায় সে পাপই পুণ্য, সে অন্যায় খুবই ন্যায়।
মানে দাঁড়াচ্ছে, পক্ষ রক্ষা করতে, পক্ষের মান বাঁচাতে, মন্দকে প্রশ্রয় দিতে সামান্য বুক কাঁপছে না কারও। টিকে থাকতে হলে সংঘাত চাই। মুখে সর্বদা মুখস্থ বুলি ‘শান্তি শান্তি’, কিন্তু শান্তি থাকলে পক্ষ টিকে থাকবে না, তাই পক্ষ টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানুষ—কারও বেঁচে থাকার উপায় থাকছে না।
দেবী গেলেন বিসর্জনে। ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল সব। পূর্বে হয়েছে, পরেও হবে। আমাদের বাংলা মায়ের কোলে মুসলমান বা হিন্দু কখনোই আলাদা ছিল না। কালে কালে পক্ষেরা পক্ষ বাঁচাতে নিন্দা করেছে, প্রশস্তি গেয়েছে। সদাসর্বদা ভালো-মন্দের হিসাব-নিকাশ চলছে। দুঃখের বিষয়, মন্দকে মন্দ বলা হয়েছে অবিরাম, তবু মন্দ আশ্রয়হীন হয়নি। প্রশ্ন জাগে, দিনের পর দিন মন্দের উল্লাসধ্বনি কেন বেড়ে উঠেছে?
টিকে থাকার জন্য মন্দের প্রশ্রয় ছাড়া উপায় নেই—এমন অসহায় ভাবনার মৃত্যু হওয়া দরকার। দরকার মানুষের মৃত্যু থামানো। কুঁজো পিঠ নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে চাইলে কি তা সম্ভব হবে? হিংসা, প্রতিহিংসা বেঁচে থাকলে মানুষ মরবে; আর আমরা ভাবতে থাকব, ভাবতেই থাকব, ‘আমাদের পক্ষ বেঁচে থাকছে’। এমন স্বার্থপর আনন্দে দেশ আনন্দিত হয় না, সে বিষণ্ন হয় আরও।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, নির্মাতা।
fzalhossin1515@yahoo.com
No comments