চার দিক-হেমন্ত এসেছে তবু... by আশরাফুল হক

‘জানি আমি তোমার দুচোখ আমাকে খোঁজে না
আর পৃথিবীর ’পরে—’
বলে চুপ থাকলাম, কেবলই অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভেতরে
শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া;—অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;


সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু।
— জীবনানন্দ দাশ

আসলে এ রোদটাই পাগল করা। চাঁপা ফুলের মতো যা এ মুহূর্তে জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে আমার মনের ভেতর, মিথ্যে কথার শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে বলে। যেখানে হেমন্ত এসে গেছে। আর হালকা হলুদ পাতায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা। তাকে যদি একটি মেয়ে বলি...খুব কি ভুল হবে! হেমন্ত নিয়ে লিখতে বসে কুয়াশাকে মনে হচ্ছে একটি মেয়ের মতো!
তাহলে শিউলি বিছানো পথকে কী বলব? সেই বাঁকা চোরা পথ...যা আমার শৈশব-কৈশোরে ছিল...এখন হারিয়ে গেছে...কঙ্কাবতীর মতো...তেপান্তরের মাঠ, ঘাট, বন-বাদাড় তন্ন তন্ন করেও যাকে কোনো দিন খুঁজে পাবে না ডালিম কুমার।
সত্যি, নগরজীবন থেকে আর সব ঋতুর মতো হেমন্তও হারিয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে দেখুন, এখন কার্তিক। হেমন্তের শুরু। অথচ শহরে রোদে চাঁপা ফুলের রং ধরেনি বরং ধুলো আর ধোঁয়ায় মলিন।
তবে নিশ্চিত কংক্রিটের জঙ্গল থেকে দূরে কোথাও শরতের হাত ধরে দাঁড়িয়েছে হেমন্ত, যেখানে কাশফুল...শিউলি...সাদা মেঘ...আর রোদ-ছায়ার লুকোচুরির মধ্যে বিস্তীর্ণ সোনার ধান খেতে দুলছে উদাসী হাওয়া...সেই হাওয়ায় মাটির গন্ধে মাতাল দিগ্-বধূরা। রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়েছে মাটির আঁচলজুড়ে, আর ঠিক তখনই আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে বেজে উঠেছে বাঁশি...সেই বাঁশি শুনে আকাশ খুশি হবে এবং তার পরই ঘুম ভেঙে জাগবে চন্দ্রাহত পাগলটা, যে ঘরে বন্দী। হেমন্ত যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে ‘এই বাংলার মায়া ভরা পথে’ বেরিয়ে পড়ার জন্য।
তবে যদি সে বেরিয়ে পড়তে নাও পারে, তার জন্য রইল আকাশ ভরা তারা এবং রবীন্দ্রনাথের গান—
‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে\
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো—‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
জানি, এতক্ষণে আপনার মনে পড়ছে আলোর উৎসব দীপাবলির কথা। তমসা থেকে মুক্তির এই উৎসব হেমন্তের বিশেষ অনুষঙ্গ। তবে প্রধান অনুষঙ্গটি অবশ্যই নবান্ন। সেখানে ফসল কাটা থেকে শুরু করে ঘরে তোলা, রান্না করা ও খাওয়া পর্যন্ত উৎসবপ্রিয় বাঙালিজীবনের এক প্রণত মনোভাব ছড়িয়ে আছে। হেমন্তকে আশ্রয় করে লোকসংস্কৃতির এ প্রকাশটাও তাই দারুণ লাগে।
কিন্তু নবান্ন হোক কিংবা এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ, শিক্ষিত বাঙালির হেমন্তবিলাস জীবনানন্দ ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই ‘ঘাসের ভেতরে শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া’ হলুদ অশত্থ পাতা পড়ে থাকলে, সন্ধ্যার আবছা আঁধারে কুয়াশা নামতে দেখে চিল উড়ে গেলে, তাকে খুব মনে পড়ে। তখন বিড়বিড় করে বলি—
যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে, হূদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে: সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন, চারদিকে ঝাউ, আম, নিম, নাগেশ্বরে হেমন্ত আসিয়া গেছে;— চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি, ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে—শালিকের নেই আর দেরি, হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমোবে সে শিশিরের জলে, ঝরিছে মরিছে সব এইখানে—বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।

No comments

Powered by Blogger.