জীবন-মৃত্যুর চালচিত্র-অপঘাত, নিষ্ঠুরতা, দায়িত্বহীনতা আর হাহাকারের এই দেশ by ফারুক ওয়াসিফ
অপমৃত্যুর যত ধরন আছে, গত এক সপ্তাহে তার প্রায় সব রকমই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। গত কয়েক দিনের প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম এবং তার সঙ্গের ছবিগুলো যেন জীবন-মৃত্যুরই চালচিত্র। ছবি সাক্ষ্য দেয়, ছবি রাজনৈতিক এবং ছবি কথা বলে।
সিরাজগঞ্জের ট্রেনের অপঘাতে ছয়টি মৃত্যু, নাটোরের হত্যাকাণ্ড, তুরাগের মর্মান্তিক বাসডুবি আর যাত্রাবাড়ীতে আগুনে পোড়া মৃত্যুর ছবিগুলো সাক্ষ্য দেয় এবং প্রশ্ন করে—আমাদের দেশটি কি মৃত্যু-উপত্যকাই হয়ে রইবে?
১. অপঘাত
জীবন যার যার কিন্তু মৃত্যুগুলো কার? অপঘাতে মৃত্যুর দায় নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। বিশেষত সেই দেশে, যে দেশে ‘লাশের রাজনীতি’ নামে একটি কথা অনেক দিন ধরেই চালু আছে। মৃত্যুর রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ এখানে অবারিত। সেই সুযোগ নেওয়ার প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। সিরাজগঞ্জে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জনসভায় অসময়ের ট্রেনের ধাক্কায় অনাকাঙ্ক্ষিত ছয়টি মৃত্যুকে পাশে সরিয়ে সামনে চলে এসেছে দোষাদুষির রাজনীতি। এই রাজনীতি আগুন ভালোবাসে, ভাঙচুর ভালোবাসে, ভালোবাসে উত্তেজনা ও অভিযোগ। নিহত সুরত আলী, শাবান আলী, ফারুক, বাচ্চুসহ নাম না জানা আরও দুজনের শোকের দায়ভার যার যার পরিবারের ওপর ন্যস্ত করে সরকার ও বিরোধী দল এখন কোমর কষে ‘রাজনীতি’ করাটাই সাব্যস্ত করেছে। এই গোলমালে যা বিসর্জিত হচ্ছে, তা হলো সত্য।
মৃত্যুগুলো অপঘাতের। কিন্তু অপঘাতটির দায় কার? রেললাইনের পাশে জনসভার স্থান নির্ধারিত না হলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এখন অপঘাতের দায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি চলছে। যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, ‘অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিরোধী দল পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানোয় সিরাজগঞ্জে ট্রেন দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’ আর খালেদা জিয়া বলেছেন, এটি ‘দুর্ঘটনা নয়...সিরাজগঞ্জের সমাবেশে সরকারের একটি এজেন্সি আগন্তুকদের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে।’ আর কেউ না হোক, নিহতদের পরিবার তো জানতে চাইবে, তাঁর কার ‘পরিকল্পনা’র কথা বলছেন, কে তার হোতা? প্রশ্ন হচ্ছে, উভয় পক্ষ কি যার যার অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারবে?
নিজ জনসভায় নিহত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারের দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু সমাবেশের আয়োজকেরা কতটা দায়িত্বশীল ছিলেন? স্থানীয় প্রশাসনই বা এমন জায়গায় সমাবেশের অনুমতি দিল কীভাবে, যার ওপর দিয়ে ট্রেন যায়? বড় জনসভায় আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দল রাখা হয়। সমাবেশের ব্যবস্থাপনা দেখার দায়িত্ব তাদেরই। শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য থাকার কথা পুলিশেরও। রেল কর্তৃপক্ষেরও সজাগ থাকার কথা যে, হাজার হাজার লোকের মাঝ দিয়ে ট্রেন নিতে হলে আগাম সতর্কতা লাগবেই। এবং উপস্থিত জনতা, যাঁরা রেললাইনের ওপর বসে থেকে জনসভা শুনছিলেন, তাঁদের আচরণটাও কি সাবালকসুলভ ছিল? নিয়ম না মানার অভ্যাস যে কতটা আত্মঘাতী হতে পারে, সেই হুঁশ আনতে আর কত জীবনের খেসারত দিতে হবে? সবাই যদি তাদের দায়িত্ব পালন করত, তাহলে মৃত্যুগুলো হতো না। রাজনীতি তাহলে নাটোরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই থাকত, ছয়টি মৃত্যুর বা ট্রেনের রাজনৈতিক চরিত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ধাবিত হতো।
বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি ট্রেন পোড়ানোর প্রবণতারও সমালোচনা করতে পারতেন, পারতেন দলীয় কর্মীদের সংযত হওয়ার নির্দেশ দিতে। তা না করায়, একটি অপঘাত আরেকটি অপঘাতের সুযোগ করে দিল। ট্রেনের অপঘাতে সাধারণ মানুষ মরল আর কর্মীদের অপঘাতে পুড়ল ট্রেন, ভুগল যাত্রীবেশী সাধারণ মানুষই। প্রতিবাদ আর নৈরাজ্যের মধ্যে পার্থক্য না থাকলে সেই প্রতিবাদ সুফল দেয় না। রাজনীতি তাতে সুস্থ হয় না। জীবনের ওপর অপঘাত তখন শান্তির ওপর অপঘাতের সুযোগ তৈরি করে দেয়। সিরাজগঞ্জের পোড়া ট্রেনটি তারই প্রতীক।
যাঁরা দেশ চালান, যাঁরা দল চালান, চালান কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কিংবা চালান যাঁরা ট্রেন বা বাস, তাঁদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও মানবিকতার ছিটেফোঁটা হলেও থাকা উচিত। অনেকের জানমালের দায়িত্ব তাঁদের ওপর। কিন্তু সব কয়টি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, তাঁরা চালানোর ক্ষমতা যতটা উপভোগ করেন, দায়িত্বটা ততটাই ভুলে যান। ক্ষমতার কাছে, বড়র কাছে মানুষ মানবিকতার প্রকাশ দেখতে চায়। সিরাজগঞ্জের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সব মহলই সেই মানবিকতার প্রকাশ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সিরাজগঞ্জে যা হলো, এক কথায় তার নাম অমানবিকতার অপঘাত, অসহিষ্ণুতার অপঘাত।
২. নিষ্ঠুরতা
সব হত্যাই নির্মম। কিন্তু নাটোরের বিএনপি নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরের হত্যা এক বিশুদ্ধ নিষ্ঠুরতা। দলবেঁধে শেয়াল মারার মতো একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছবিটি তাই নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে বারবার সামনে চলে আসবে। নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ায় জীবনের সত্যকে ছাপিয়ে তাঁর মৃত্যুটাই বড় হয়ে উঠেছে। এ ঘটনা মনে করিয়ে দেবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সেখানেও সংঘর্ষের মধ্যে এভাবে স্রেফ পিটিয়ে কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে প্রকাশ্যেই হত্যা করা হয়েছিল।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে মনে করতেন, নিষ্ঠুরতা প্রকাশের মধ্যে সুপ্ত আনন্দের ব্যাপার আছে, আছে প্রতিশোধের তৃপ্তি আর সহিংসতার প্রবৃত্তি। শৈশবে কুখ্যাত এক চোরকে সারা দিন গ্রাম থেকে গ্রামে দড়িবেঁধে হাঁটাতে হাঁটাতে পিটিয়ে মারার দৃশ্য দেখেছিলাম। নারী-পুরুষ-শিশুসহ শত শত মানুষ সম্মোহিতের মতো সেই দৃশ্য দেখতে জড়ো হয়েছিল। দৃশ্যটি সবার সুপ্ত জিঘাংসাকে তৃপ্ত করেছিল। পরাজিত ও কোণঠাসা একটি মানুষকে তিলে তিলে কষ্ট দেওয়ার দৃশ্যের আকর্ষণ কি আমাদের টেনেছিল? টর্চার সেলে পেশাদার নির্যাতকেরাও এমন আনন্দ পেয়ে থাকে। সানাউল্লাহ নূরের হত্যাকারীরা তেমন আনন্দ পেয়েছিল কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু যেভাবে সময় নিয়ে তাঁর প্রাণবায়ু বের করার ব্যবস্থা হয়েছিল, তাঁর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ প্রাণভিক্ষাও যেভাবে ঘাতকদের কোপানোর হাতকে একটুও কাঁপায়নি, তাতে বুঝি, ওই মুহূর্তে সেখানে দলবদ্ধ নিষ্ঠুরতার উৎসবই জমে উঠেছিল।
নিৎসেই বলেছিলেন, মানুষ নিষ্ঠুরতম প্রাণী। ছাত্রশিবিরের রগ কাটা, বাংলা ভাই বাহিনীর তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে হত্যার সময় মাইক বাজিয়ে নির্যাতিতের চিৎকার এলাকাবাসীকে শোনানো আর গাছে উল্টো করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একদলের আরেক দলকে কুপিয়ে চতুর্থ তলা ভবনের জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ক্যাডারদের ছাত্রকে মেরে ম্যানহোলে লুকিয়ে রাখার ঘটনাগুলো কি আসলে বিরল? প্রতিদিন তো কত বীভৎস কায়দায় মানুষ হত্যার খবর আসে। ক্রসফায়ারের নামে রাতের আঁধারে বাঁধের ওপর, ধানখেতে, নদীর ধারে যেভাবে বিনা বিচারে সন্দেহভাজন অপরাধী নিধন হচ্ছে, তা তো প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ঠুরতার চরম উদাহরণ। কিংবা রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা? নিষ্ঠুরতা তাই বিরল নয়, তা সমাজে আছে, প্রতিষ্ঠানে আছে, চিহ্নিত অপরাধীদের মধ্যেও আছে। আমজনতার মধ্যেও তা স্বমহিমায় বর্তমান। ধরা পড়া পকেটমারকে তো সমবায়ী ভিত্তিতেই পিটিয়ে মারা হয়। রোববার রাতেই কুষ্টিয়ায় ‘গণপিটুনি’তে গোপন দলের চার কর্মীকে হত্যার খবর ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়।
তবে, নাটোরের ঘটনাটি কেবল নিষ্ঠুরতা বলেই মারাত্মক নয়। মারাত্মক হলো এ ধরনের নিষ্ঠুরতার চর্চা ক্ষমতাসীন দলের ও সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হতে পারা। ভিডিও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়নি, হলেও বিচার হওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা কম। সরকারের প্রশ্রয়, দলের আশ্রয়, পুলিশের মদদ আর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া এসব চলতে পারত না। পুলিশের একটি পিকআপ পাশ দিয়ে নির্বিকারভাবে চলে গিয়েছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেটাকে দায়িত্বের গাফিলতি মনে করেনি। নিষ্ঠুরতা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি অর্জন করলে বিকৃতি বিস্তার লাভ করে। আইন, প্রশাসন, রাজনীতি ও সংস্কৃতি শিথিল হয়ে গেলে নিষ্ঠুরতার শক্তি বেপরোয়া হয়। বাংলাদেশে এখন সেটাই ঘটছে। মন্দ লোক মন্দ কাজ করলেই সর্বনাশ ঘটে, তা নয়, কিন্তু যখন ভালো লোক বা দায়িত্বে থাকা লোকেরাও সেই মন্দকে মন্দ বলতে বা তার প্রতিকার করতে ভুলে যায়, সর্বনাশের পরিস্থিতি তৈরি হয় তখনই। নিষ্ঠুরতা তাই হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় জীবনের শিরোনাম।
৩. দায়িত্বহীনতা
তারা ডুবে গেল। দায় চালকের। এক চাকা খোঁড়া, তবু সামনের বাসটিকে পাশ কাটাতে হবে। ফল, ৫০ জন যাত্রীসহ বাসটির সলিলসমাধি। একার দায়ে ৫০টি জীবন গেল, ৫০টি পরিবারের একটি করে ‘তারা’ ডুবে গেল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মনোয়ারা খাতুন তারার মৃত্যু আরও করুণ। তীরে উঠেও বাঁচতে পারলেন না। সময়মতো সুচিকিৎসা হয়েছিল কি না, আমরা জানি না। কিন্তু ডুবে যাওয়া বাসটির অবস্থান চিহ্নিত করতেই যে এক দিনের বেশি লেগে গেল, তার দায় কার? ফায়ার সার্ভিস, নৌপরিবহন সংস্থা, সেনাবাহিনীর উদ্ধার দল—কারও হাতে উপযুক্ত সরঞ্জাম নেই। উদ্ধার-সহায়ক একটি যন্ত্র চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনতেই এক দিন লেগে গেছে! এ রকম অদক্ষতা, এ রকম সমন্বয়হীনতা এবং এ রকম নাজুক অবকাঠামোর মধ্যে আমাদের বসবাস যেন গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সঙ্গে বসবাস।
বাসচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার আচরণের একটিই নাম: দায়িত্বহীনতা। অথচ দায়িত্বে ব্যর্থতার দায় কোনো দিন কাউকে নিতে দেখা যায় না। ব্যর্থতাগুলো সব ভূতের কাজ।
তুরাগ ছোট নদ, বর্ষায় বান আসে, কিন্তু ‘বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল’। তাতেই থই পাচ্ছে না উদ্ধারকাজ। আরও বড় বিপর্যয়ে কী হবে? কী হবে বড় ঘূর্ণিঝড়ে, বড় ভূমিকম্পে? এমন অপমৃত্যুর সামনে কী আমাদের রক্ষাকবচ? আমাদের জানমালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, ভালো-মন্দের অভিভাবক সরকার। তবু জীবন আমাদের যেন কচুপাতায় শিশিরের মতো টলমল। কারণ সেই দায়িত্বহীনতা। যাঁদের যা দায়, তাঁরা তা ঠিকমতো পালন করেন না। এর জন্য কোনো অনুশোচনাও তাঁদের হয় বলে মনে হয় না। হলে, দেশ বদলাত, মানুষের কষ্ট কিছু কমত।
ঝড়-বর্ষায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪৯০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। আইলার আঘাতে আগে ভাঙা ছিল ১৬৬ কিলোমিটার। সমুদ্রের সামনে বিরাট অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে সেই সিডরের সময় থেকে।
প্রকৃতির দুর্যোগ চলে যায়, কিন্তু সামাজিক দুর্যোগ অফুরান। নোনা পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবারই ঠাঁই বাঁধ বা সড়ক বা ঘরের চাল। খাবার পানি নেই, কাজ নেই, চিকিৎসা নেই, সাহায্যও নেই ঠিকমতো। এবারের ঝড়টি যদি আরেকটু এগোত বা বাড়ত, তাহলে এসব মানুষের সমুদ্রের জলে ভেসে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারত না। সিডরের পরের তিন বছর, আইলার পরের প্রায় দেড় বছরেও বাঁধগুলো মেরামত করা হলো না, দুর্গতদের কষ্ট কমল না। এর মধ্যে জরুরি সরকার পেরিয়ে রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত সরকার এসেছে। এবং দায়িত্বহীনতাও রেকর্ড গড়েছে। আর জাতীয় জীবনে আবহসংগীতের মতো বাজছে হাহাকার।
৪. হাহাকার
মেয়েটি পুড়ে গেছে আগুনে আর তার বাবা পুড়ছেন শোকে। ছবি যদি সত্যিই কথা বলত, তাহলে গত শুক্রবারের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার শোকার্ত পিতার এ ছবিটি বলত, শোকের হাহাকার কতটা তীব্র। বৃদ্ধ মানুষটির বুকে যখন শোকের আগুন, চোখে তখন জল। কোনো দমকল এই আগুন নেভাতে পারে না, কোনো বাঁধ দিয়েই এই অশ্রু থামানো যায় না, যতক্ষণ না শোক বোবা হয়, যতক্ষণ না কান্না জমাট হয়। কিংবা যতক্ষণ না তারা ন্যায়বিচার পায়।
কিন্তু ছবিটি কেবল শোকের হাহাকারই প্রকাশ করছে না, জানাচ্ছে আরও অনেক কিছু। প্রতিকারে অসহায় হলে, প্রতিবাদের সুযোগ না পেলেই মানুষ হাহাকার করে। হাসপাতালের লোহার খাটিয়ায় শোয়ানো মেয়ের লাশ। সামনে বাবার ডুকরানো কান্না। পঞ্চাশের বেশি বয়স হয়তো, কিন্তু দেখায় আরও বেশি। মুখভর্তি দাড়ির বেশির ভাগই সাদা। বোতাম খোলা শার্টের ভেতর দিয়ে ভেতরের ময়লা গেঞ্জি চোখে পড়ে। মুখের চামড়ায় রোদে পোড়া ছোপ ছোপ কালো দাগ। তাঁর হাঁ হয়ে থাকা মুখের ভেতরটায় কালোমতো অন্ধকার, আবছা দেখা যাওয়া দাঁতগুলো মিশির মতো কালো। বুজে আসা চোখের নিচে একরাশ কালি। সুন্দর-শোভন মানুষদের তুলনায় এঁকে ঠিক ‘মানুষ’ বলা কঠিন। জীবন তাঁকে এ রকম মলিন করেছে আর তাঁর মেয়েকে দিয়েছে পুড়িয়ে। পৃথিবীর কোনো শিল্পীই বুঝি হাহাকারের এমন রূপ এঁকে বোঝাতে পারবেন না। মোগল বাদশা বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে খোদার কাছে সন্তানের প্রাণভিক্ষা করেছিলেন। এ লোকটি বাদশাও নন, বাবুসাহেবও নন, কিন্তু তাঁর সন্তান-বিয়োগের হাহাকার কি কারও থেকে কম? রাষ্ট্র কি পাষাণ? এঁদের জীবন্মুত্যু সেখানে কি কোনো দাগ কাটে?
রাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও কোটি কোটি মানুষের জীবনে রাষ্ট্র গরহাজির। সমাজের এতই তলায় তাদের অবস্থান যে আইন, অধিকার ও উন্নয়নের মতো মহান ব্যাপারগুলো তাদের কেবল হাতছানি দিয়ে রসিকতাই করে যায়, সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এভাবেই তারা জীবনের ঘানি টানে এবং তাদের অজস্রজন অপমৃত্যুর শিকার হয়। তাদের মতো মানুষের জীবন-মরণের দায়িত্ব থেকে কি ভালো থাকা মানুষেরা, ক্ষমতায় থাকা মানুষেরা, দেশ চালানো মানুষেরা দায়মুক্তি নিয়ে নিয়েছেন? হাহাকার তাই আমাদের সমাজের প্রান্তিক ও উপেক্ষিত মানুষের প্রতিদিনকার অনুভূতির নাম, আমাদের সমাজজীবনের যাবতীয় বঞ্চনার প্রতিশব্দ।
কর্মক্ষেত্রে এভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো শ্রমজীবী মানুষ অপঘাতে মরে। পরিসংখ্যান বলে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের থেকে গরিব পরিবারে বিপর্যয়ের সংখ্যাই বেশি। এবং বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্যও তাদেরই সবচেয়ে কম।
কেবল পোশাক কারখানাগুলোতেই ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, আহত হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)। নিমতলীর ১১৮টি মৃত্যুর দাগ এখনো মানুষ ভোলেনি। ভুলিনি যে ভুল পানিব্যবস্থাপনা ও সেচপদ্ধতির জন্য আনুমানিক সাড়ে তিন কোটি থেকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের শরীরে আর্সেনিকের বিষ ঢুকছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলেছে, এত বড় জনগোষ্ঠীর গণবিষের শিকারে পরিণত হওয়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। (প্রথম আলো, ৭ জুন ২০১০)
উদাহরণের অভাব নেই। কান পাতলে অনেক হাহাকারও শোনা যাবে। কিন্তু কখন আসবে সেই দমকল, যা শোকের আগুন নেভাবে, হাহাকারে ডুবতে থাকা মানুষকে বাঁচাতে অন্ততপক্ষে আন্তরিক চেষ্টাটুকু করবে? কখন আসবে, কখন, কখন?
যে গল্পের শেষ নেই
তবু সবাই যেন সন্তুষ্ট। পুলিশপ্রধান রোববার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সরকারের উচ্চ মহল নিজেদের কর্মকাণ্ডে খুশি, বিরোধী দল না থাকলে তাদের সেই সুখ অবাধ হতো। বিরোধী দল তো বিরোধী দল বলে স্বভাবসুলভভাবেই অসুখী। ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় গেলে তারাও নিজেদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, সুখী সুখী ভাব দেখাবে। কিন্তু তাদের সুখই যে জনগণের সুখ আর দেশের শান্তি—অভিজ্ঞতা তা বলে না। তাদের বর্তমান কাজকর্ম দেখেও সেই আশা করা কঠিন।
তাদের এখনকার জনসভায় চলছে ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দান। আর তখনকার নির্বাচনের আগে আওয়াজ উঠবে, সামনে আসছে সুখের দিন, অমুক মার্কায় ভোট দিন। চলতি বিপদ থেকে বাঁচতে মানুষ তখন ভবিষ্যতের আপদকে বেছে নেবে। কিন্তু দুর্নীতি-দলীয়করণ-সন্ত্রাস আর ক্ষমতার অপব্যবহারের বাস্তবতা কিছুমাত্র বদলাবে—এই আশার গুড়ে কেবল বালি-ই নয়, প্রমাণ সাইজের কাঁকর এখনই মিলছে।
একধরনের আশাবাদীরাভাবেন, যা হয়েছে, তা ভালোই হয়েছে, যা হচ্ছে তা-ও ভালোই হচ্ছে এবং যা হবে, তাও ভালোই হবে। কিন্তু আমাদের বেলায়যায় দিন ভালো,আসে দিন খারাপ। অপঘাত, নিষ্ঠুরতা, দায়িত্বহীনতা ও হাহাকারের এই বিষাক্ত বৃত্ত ছিন্ন করার জন্য আশার সমাধিতে বাংলাদেশ আর কতকাল অপেক্ষা করবে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
১. অপঘাত
জীবন যার যার কিন্তু মৃত্যুগুলো কার? অপঘাতে মৃত্যুর দায় নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। বিশেষত সেই দেশে, যে দেশে ‘লাশের রাজনীতি’ নামে একটি কথা অনেক দিন ধরেই চালু আছে। মৃত্যুর রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ এখানে অবারিত। সেই সুযোগ নেওয়ার প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। সিরাজগঞ্জে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জনসভায় অসময়ের ট্রেনের ধাক্কায় অনাকাঙ্ক্ষিত ছয়টি মৃত্যুকে পাশে সরিয়ে সামনে চলে এসেছে দোষাদুষির রাজনীতি। এই রাজনীতি আগুন ভালোবাসে, ভাঙচুর ভালোবাসে, ভালোবাসে উত্তেজনা ও অভিযোগ। নিহত সুরত আলী, শাবান আলী, ফারুক, বাচ্চুসহ নাম না জানা আরও দুজনের শোকের দায়ভার যার যার পরিবারের ওপর ন্যস্ত করে সরকার ও বিরোধী দল এখন কোমর কষে ‘রাজনীতি’ করাটাই সাব্যস্ত করেছে। এই গোলমালে যা বিসর্জিত হচ্ছে, তা হলো সত্য।
মৃত্যুগুলো অপঘাতের। কিন্তু অপঘাতটির দায় কার? রেললাইনের পাশে জনসভার স্থান নির্ধারিত না হলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এখন অপঘাতের দায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি চলছে। যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, ‘অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিরোধী দল পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানোয় সিরাজগঞ্জে ট্রেন দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’ আর খালেদা জিয়া বলেছেন, এটি ‘দুর্ঘটনা নয়...সিরাজগঞ্জের সমাবেশে সরকারের একটি এজেন্সি আগন্তুকদের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে।’ আর কেউ না হোক, নিহতদের পরিবার তো জানতে চাইবে, তাঁর কার ‘পরিকল্পনা’র কথা বলছেন, কে তার হোতা? প্রশ্ন হচ্ছে, উভয় পক্ষ কি যার যার অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারবে?
নিজ জনসভায় নিহত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারের দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু সমাবেশের আয়োজকেরা কতটা দায়িত্বশীল ছিলেন? স্থানীয় প্রশাসনই বা এমন জায়গায় সমাবেশের অনুমতি দিল কীভাবে, যার ওপর দিয়ে ট্রেন যায়? বড় জনসভায় আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দল রাখা হয়। সমাবেশের ব্যবস্থাপনা দেখার দায়িত্ব তাদেরই। শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য থাকার কথা পুলিশেরও। রেল কর্তৃপক্ষেরও সজাগ থাকার কথা যে, হাজার হাজার লোকের মাঝ দিয়ে ট্রেন নিতে হলে আগাম সতর্কতা লাগবেই। এবং উপস্থিত জনতা, যাঁরা রেললাইনের ওপর বসে থেকে জনসভা শুনছিলেন, তাঁদের আচরণটাও কি সাবালকসুলভ ছিল? নিয়ম না মানার অভ্যাস যে কতটা আত্মঘাতী হতে পারে, সেই হুঁশ আনতে আর কত জীবনের খেসারত দিতে হবে? সবাই যদি তাদের দায়িত্ব পালন করত, তাহলে মৃত্যুগুলো হতো না। রাজনীতি তাহলে নাটোরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই থাকত, ছয়টি মৃত্যুর বা ট্রেনের রাজনৈতিক চরিত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ধাবিত হতো।
বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি ট্রেন পোড়ানোর প্রবণতারও সমালোচনা করতে পারতেন, পারতেন দলীয় কর্মীদের সংযত হওয়ার নির্দেশ দিতে। তা না করায়, একটি অপঘাত আরেকটি অপঘাতের সুযোগ করে দিল। ট্রেনের অপঘাতে সাধারণ মানুষ মরল আর কর্মীদের অপঘাতে পুড়ল ট্রেন, ভুগল যাত্রীবেশী সাধারণ মানুষই। প্রতিবাদ আর নৈরাজ্যের মধ্যে পার্থক্য না থাকলে সেই প্রতিবাদ সুফল দেয় না। রাজনীতি তাতে সুস্থ হয় না। জীবনের ওপর অপঘাত তখন শান্তির ওপর অপঘাতের সুযোগ তৈরি করে দেয়। সিরাজগঞ্জের পোড়া ট্রেনটি তারই প্রতীক।
যাঁরা দেশ চালান, যাঁরা দল চালান, চালান কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কিংবা চালান যাঁরা ট্রেন বা বাস, তাঁদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও মানবিকতার ছিটেফোঁটা হলেও থাকা উচিত। অনেকের জানমালের দায়িত্ব তাঁদের ওপর। কিন্তু সব কয়টি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, তাঁরা চালানোর ক্ষমতা যতটা উপভোগ করেন, দায়িত্বটা ততটাই ভুলে যান। ক্ষমতার কাছে, বড়র কাছে মানুষ মানবিকতার প্রকাশ দেখতে চায়। সিরাজগঞ্জের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সব মহলই সেই মানবিকতার প্রকাশ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সিরাজগঞ্জে যা হলো, এক কথায় তার নাম অমানবিকতার অপঘাত, অসহিষ্ণুতার অপঘাত।
২. নিষ্ঠুরতা
সব হত্যাই নির্মম। কিন্তু নাটোরের বিএনপি নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরের হত্যা এক বিশুদ্ধ নিষ্ঠুরতা। দলবেঁধে শেয়াল মারার মতো একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছবিটি তাই নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে বারবার সামনে চলে আসবে। নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ায় জীবনের সত্যকে ছাপিয়ে তাঁর মৃত্যুটাই বড় হয়ে উঠেছে। এ ঘটনা মনে করিয়ে দেবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সেখানেও সংঘর্ষের মধ্যে এভাবে স্রেফ পিটিয়ে কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে প্রকাশ্যেই হত্যা করা হয়েছিল।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে মনে করতেন, নিষ্ঠুরতা প্রকাশের মধ্যে সুপ্ত আনন্দের ব্যাপার আছে, আছে প্রতিশোধের তৃপ্তি আর সহিংসতার প্রবৃত্তি। শৈশবে কুখ্যাত এক চোরকে সারা দিন গ্রাম থেকে গ্রামে দড়িবেঁধে হাঁটাতে হাঁটাতে পিটিয়ে মারার দৃশ্য দেখেছিলাম। নারী-পুরুষ-শিশুসহ শত শত মানুষ সম্মোহিতের মতো সেই দৃশ্য দেখতে জড়ো হয়েছিল। দৃশ্যটি সবার সুপ্ত জিঘাংসাকে তৃপ্ত করেছিল। পরাজিত ও কোণঠাসা একটি মানুষকে তিলে তিলে কষ্ট দেওয়ার দৃশ্যের আকর্ষণ কি আমাদের টেনেছিল? টর্চার সেলে পেশাদার নির্যাতকেরাও এমন আনন্দ পেয়ে থাকে। সানাউল্লাহ নূরের হত্যাকারীরা তেমন আনন্দ পেয়েছিল কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু যেভাবে সময় নিয়ে তাঁর প্রাণবায়ু বের করার ব্যবস্থা হয়েছিল, তাঁর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ প্রাণভিক্ষাও যেভাবে ঘাতকদের কোপানোর হাতকে একটুও কাঁপায়নি, তাতে বুঝি, ওই মুহূর্তে সেখানে দলবদ্ধ নিষ্ঠুরতার উৎসবই জমে উঠেছিল।
নিৎসেই বলেছিলেন, মানুষ নিষ্ঠুরতম প্রাণী। ছাত্রশিবিরের রগ কাটা, বাংলা ভাই বাহিনীর তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে হত্যার সময় মাইক বাজিয়ে নির্যাতিতের চিৎকার এলাকাবাসীকে শোনানো আর গাছে উল্টো করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একদলের আরেক দলকে কুপিয়ে চতুর্থ তলা ভবনের জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ক্যাডারদের ছাত্রকে মেরে ম্যানহোলে লুকিয়ে রাখার ঘটনাগুলো কি আসলে বিরল? প্রতিদিন তো কত বীভৎস কায়দায় মানুষ হত্যার খবর আসে। ক্রসফায়ারের নামে রাতের আঁধারে বাঁধের ওপর, ধানখেতে, নদীর ধারে যেভাবে বিনা বিচারে সন্দেহভাজন অপরাধী নিধন হচ্ছে, তা তো প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ঠুরতার চরম উদাহরণ। কিংবা রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা? নিষ্ঠুরতা তাই বিরল নয়, তা সমাজে আছে, প্রতিষ্ঠানে আছে, চিহ্নিত অপরাধীদের মধ্যেও আছে। আমজনতার মধ্যেও তা স্বমহিমায় বর্তমান। ধরা পড়া পকেটমারকে তো সমবায়ী ভিত্তিতেই পিটিয়ে মারা হয়। রোববার রাতেই কুষ্টিয়ায় ‘গণপিটুনি’তে গোপন দলের চার কর্মীকে হত্যার খবর ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়।
তবে, নাটোরের ঘটনাটি কেবল নিষ্ঠুরতা বলেই মারাত্মক নয়। মারাত্মক হলো এ ধরনের নিষ্ঠুরতার চর্চা ক্ষমতাসীন দলের ও সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হতে পারা। ভিডিও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়নি, হলেও বিচার হওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা কম। সরকারের প্রশ্রয়, দলের আশ্রয়, পুলিশের মদদ আর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া এসব চলতে পারত না। পুলিশের একটি পিকআপ পাশ দিয়ে নির্বিকারভাবে চলে গিয়েছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেটাকে দায়িত্বের গাফিলতি মনে করেনি। নিষ্ঠুরতা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি অর্জন করলে বিকৃতি বিস্তার লাভ করে। আইন, প্রশাসন, রাজনীতি ও সংস্কৃতি শিথিল হয়ে গেলে নিষ্ঠুরতার শক্তি বেপরোয়া হয়। বাংলাদেশে এখন সেটাই ঘটছে। মন্দ লোক মন্দ কাজ করলেই সর্বনাশ ঘটে, তা নয়, কিন্তু যখন ভালো লোক বা দায়িত্বে থাকা লোকেরাও সেই মন্দকে মন্দ বলতে বা তার প্রতিকার করতে ভুলে যায়, সর্বনাশের পরিস্থিতি তৈরি হয় তখনই। নিষ্ঠুরতা তাই হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় জীবনের শিরোনাম।
৩. দায়িত্বহীনতা
তারা ডুবে গেল। দায় চালকের। এক চাকা খোঁড়া, তবু সামনের বাসটিকে পাশ কাটাতে হবে। ফল, ৫০ জন যাত্রীসহ বাসটির সলিলসমাধি। একার দায়ে ৫০টি জীবন গেল, ৫০টি পরিবারের একটি করে ‘তারা’ ডুবে গেল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মনোয়ারা খাতুন তারার মৃত্যু আরও করুণ। তীরে উঠেও বাঁচতে পারলেন না। সময়মতো সুচিকিৎসা হয়েছিল কি না, আমরা জানি না। কিন্তু ডুবে যাওয়া বাসটির অবস্থান চিহ্নিত করতেই যে এক দিনের বেশি লেগে গেল, তার দায় কার? ফায়ার সার্ভিস, নৌপরিবহন সংস্থা, সেনাবাহিনীর উদ্ধার দল—কারও হাতে উপযুক্ত সরঞ্জাম নেই। উদ্ধার-সহায়ক একটি যন্ত্র চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনতেই এক দিন লেগে গেছে! এ রকম অদক্ষতা, এ রকম সমন্বয়হীনতা এবং এ রকম নাজুক অবকাঠামোর মধ্যে আমাদের বসবাস যেন গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সঙ্গে বসবাস।
বাসচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার আচরণের একটিই নাম: দায়িত্বহীনতা। অথচ দায়িত্বে ব্যর্থতার দায় কোনো দিন কাউকে নিতে দেখা যায় না। ব্যর্থতাগুলো সব ভূতের কাজ।
তুরাগ ছোট নদ, বর্ষায় বান আসে, কিন্তু ‘বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল’। তাতেই থই পাচ্ছে না উদ্ধারকাজ। আরও বড় বিপর্যয়ে কী হবে? কী হবে বড় ঘূর্ণিঝড়ে, বড় ভূমিকম্পে? এমন অপমৃত্যুর সামনে কী আমাদের রক্ষাকবচ? আমাদের জানমালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, ভালো-মন্দের অভিভাবক সরকার। তবু জীবন আমাদের যেন কচুপাতায় শিশিরের মতো টলমল। কারণ সেই দায়িত্বহীনতা। যাঁদের যা দায়, তাঁরা তা ঠিকমতো পালন করেন না। এর জন্য কোনো অনুশোচনাও তাঁদের হয় বলে মনে হয় না। হলে, দেশ বদলাত, মানুষের কষ্ট কিছু কমত।
ঝড়-বর্ষায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪৯০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। আইলার আঘাতে আগে ভাঙা ছিল ১৬৬ কিলোমিটার। সমুদ্রের সামনে বিরাট অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে সেই সিডরের সময় থেকে।
প্রকৃতির দুর্যোগ চলে যায়, কিন্তু সামাজিক দুর্যোগ অফুরান। নোনা পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবারই ঠাঁই বাঁধ বা সড়ক বা ঘরের চাল। খাবার পানি নেই, কাজ নেই, চিকিৎসা নেই, সাহায্যও নেই ঠিকমতো। এবারের ঝড়টি যদি আরেকটু এগোত বা বাড়ত, তাহলে এসব মানুষের সমুদ্রের জলে ভেসে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারত না। সিডরের পরের তিন বছর, আইলার পরের প্রায় দেড় বছরেও বাঁধগুলো মেরামত করা হলো না, দুর্গতদের কষ্ট কমল না। এর মধ্যে জরুরি সরকার পেরিয়ে রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত সরকার এসেছে। এবং দায়িত্বহীনতাও রেকর্ড গড়েছে। আর জাতীয় জীবনে আবহসংগীতের মতো বাজছে হাহাকার।
৪. হাহাকার
মেয়েটি পুড়ে গেছে আগুনে আর তার বাবা পুড়ছেন শোকে। ছবি যদি সত্যিই কথা বলত, তাহলে গত শুক্রবারের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার শোকার্ত পিতার এ ছবিটি বলত, শোকের হাহাকার কতটা তীব্র। বৃদ্ধ মানুষটির বুকে যখন শোকের আগুন, চোখে তখন জল। কোনো দমকল এই আগুন নেভাতে পারে না, কোনো বাঁধ দিয়েই এই অশ্রু থামানো যায় না, যতক্ষণ না শোক বোবা হয়, যতক্ষণ না কান্না জমাট হয়। কিংবা যতক্ষণ না তারা ন্যায়বিচার পায়।
কিন্তু ছবিটি কেবল শোকের হাহাকারই প্রকাশ করছে না, জানাচ্ছে আরও অনেক কিছু। প্রতিকারে অসহায় হলে, প্রতিবাদের সুযোগ না পেলেই মানুষ হাহাকার করে। হাসপাতালের লোহার খাটিয়ায় শোয়ানো মেয়ের লাশ। সামনে বাবার ডুকরানো কান্না। পঞ্চাশের বেশি বয়স হয়তো, কিন্তু দেখায় আরও বেশি। মুখভর্তি দাড়ির বেশির ভাগই সাদা। বোতাম খোলা শার্টের ভেতর দিয়ে ভেতরের ময়লা গেঞ্জি চোখে পড়ে। মুখের চামড়ায় রোদে পোড়া ছোপ ছোপ কালো দাগ। তাঁর হাঁ হয়ে থাকা মুখের ভেতরটায় কালোমতো অন্ধকার, আবছা দেখা যাওয়া দাঁতগুলো মিশির মতো কালো। বুজে আসা চোখের নিচে একরাশ কালি। সুন্দর-শোভন মানুষদের তুলনায় এঁকে ঠিক ‘মানুষ’ বলা কঠিন। জীবন তাঁকে এ রকম মলিন করেছে আর তাঁর মেয়েকে দিয়েছে পুড়িয়ে। পৃথিবীর কোনো শিল্পীই বুঝি হাহাকারের এমন রূপ এঁকে বোঝাতে পারবেন না। মোগল বাদশা বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে খোদার কাছে সন্তানের প্রাণভিক্ষা করেছিলেন। এ লোকটি বাদশাও নন, বাবুসাহেবও নন, কিন্তু তাঁর সন্তান-বিয়োগের হাহাকার কি কারও থেকে কম? রাষ্ট্র কি পাষাণ? এঁদের জীবন্মুত্যু সেখানে কি কোনো দাগ কাটে?
রাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও কোটি কোটি মানুষের জীবনে রাষ্ট্র গরহাজির। সমাজের এতই তলায় তাদের অবস্থান যে আইন, অধিকার ও উন্নয়নের মতো মহান ব্যাপারগুলো তাদের কেবল হাতছানি দিয়ে রসিকতাই করে যায়, সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এভাবেই তারা জীবনের ঘানি টানে এবং তাদের অজস্রজন অপমৃত্যুর শিকার হয়। তাদের মতো মানুষের জীবন-মরণের দায়িত্ব থেকে কি ভালো থাকা মানুষেরা, ক্ষমতায় থাকা মানুষেরা, দেশ চালানো মানুষেরা দায়মুক্তি নিয়ে নিয়েছেন? হাহাকার তাই আমাদের সমাজের প্রান্তিক ও উপেক্ষিত মানুষের প্রতিদিনকার অনুভূতির নাম, আমাদের সমাজজীবনের যাবতীয় বঞ্চনার প্রতিশব্দ।
কর্মক্ষেত্রে এভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো শ্রমজীবী মানুষ অপঘাতে মরে। পরিসংখ্যান বলে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের থেকে গরিব পরিবারে বিপর্যয়ের সংখ্যাই বেশি। এবং বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্যও তাদেরই সবচেয়ে কম।
কেবল পোশাক কারখানাগুলোতেই ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, আহত হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)। নিমতলীর ১১৮টি মৃত্যুর দাগ এখনো মানুষ ভোলেনি। ভুলিনি যে ভুল পানিব্যবস্থাপনা ও সেচপদ্ধতির জন্য আনুমানিক সাড়ে তিন কোটি থেকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের শরীরে আর্সেনিকের বিষ ঢুকছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলেছে, এত বড় জনগোষ্ঠীর গণবিষের শিকারে পরিণত হওয়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। (প্রথম আলো, ৭ জুন ২০১০)
উদাহরণের অভাব নেই। কান পাতলে অনেক হাহাকারও শোনা যাবে। কিন্তু কখন আসবে সেই দমকল, যা শোকের আগুন নেভাবে, হাহাকারে ডুবতে থাকা মানুষকে বাঁচাতে অন্ততপক্ষে আন্তরিক চেষ্টাটুকু করবে? কখন আসবে, কখন, কখন?
যে গল্পের শেষ নেই
তবু সবাই যেন সন্তুষ্ট। পুলিশপ্রধান রোববার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সরকারের উচ্চ মহল নিজেদের কর্মকাণ্ডে খুশি, বিরোধী দল না থাকলে তাদের সেই সুখ অবাধ হতো। বিরোধী দল তো বিরোধী দল বলে স্বভাবসুলভভাবেই অসুখী। ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় গেলে তারাও নিজেদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, সুখী সুখী ভাব দেখাবে। কিন্তু তাদের সুখই যে জনগণের সুখ আর দেশের শান্তি—অভিজ্ঞতা তা বলে না। তাদের বর্তমান কাজকর্ম দেখেও সেই আশা করা কঠিন।
তাদের এখনকার জনসভায় চলছে ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দান। আর তখনকার নির্বাচনের আগে আওয়াজ উঠবে, সামনে আসছে সুখের দিন, অমুক মার্কায় ভোট দিন। চলতি বিপদ থেকে বাঁচতে মানুষ তখন ভবিষ্যতের আপদকে বেছে নেবে। কিন্তু দুর্নীতি-দলীয়করণ-সন্ত্রাস আর ক্ষমতার অপব্যবহারের বাস্তবতা কিছুমাত্র বদলাবে—এই আশার গুড়ে কেবল বালি-ই নয়, প্রমাণ সাইজের কাঁকর এখনই মিলছে।
একধরনের আশাবাদীরাভাবেন, যা হয়েছে, তা ভালোই হয়েছে, যা হচ্ছে তা-ও ভালোই হচ্ছে এবং যা হবে, তাও ভালোই হবে। কিন্তু আমাদের বেলায়যায় দিন ভালো,আসে দিন খারাপ। অপঘাত, নিষ্ঠুরতা, দায়িত্বহীনতা ও হাহাকারের এই বিষাক্ত বৃত্ত ছিন্ন করার জন্য আশার সমাধিতে বাংলাদেশ আর কতকাল অপেক্ষা করবে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments