উৎসব-আবার এল পুজো by মৃত্যুঞ্জয় রায়
আসি আসি করেও শরৎ আসছে না। কদিন আগেও আশ্বিনে চৈত্রের দাবদাহ। এরপর বৃষ্টিপাতে সারা দেশের জনজীবন বিপর্যস্ত, জলোচ্ছ্বাসে উপকূল লন্ডভন্ড। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে অনেক গ্রাম, মাঠের ফসল। সেসব গ্রামের মানুষদের মনে আনন্দ নেই। তাদের দুর্গতির শেষ নেই।
ঝড়ে ঘরচাপা পড়ে, পানিতে ডুবে ও বজ্রপাতে ভোলা, বরগুনা, কক্সবাজার ও বাগেরহাটে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শরতে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়।
শরৎ এক পুলক-জাগানো ঋতু। বর্ষার জল-কাদার পর শরৎ এ দেশে যেন এক আনন্দ-জাগানিয়া ক্ষণ। বাংলার শরৎ মানে চারদিকে শিউলি-টগর ফোটা; বিলের ধারে, খালের পাড়ে, নদীর কোলে রাশি রাশি কাশফুল ফোটা; শরৎ মানে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানো; দিগন্তবিস্তৃত সবুজ-শ্যামল ধানখেতের বুকে ভোরের পাতলা কুয়াশা নামা—এর পরই ঝলমলে সোনারোদে দিনটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠা। কিন্তু সেসব কই? তবে শরৎ তার চিরাচরিত রূপের ডালা সাজিয়ে না এলেও এসেছে কাশফুল, এসেছে শিউলি। সেই সঙ্গে আসছেন দেবী দুর্গা। হাজারো কষ্টের মধ্যে বাঙালিদের মনে তাই একটি আনন্দক্ষণের প্রতীক্ষা, দেবীকে আবাহনের অপেক্ষা। তিনি সবার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন। তাই তো তিনি আনন্দময়ী, তিনি সবার দুর্গতি নাশ করেন। তাই তো তিনি দুর্গা। তিনি বিনাশ করেছেন দুর্গ নামে এক অবিনশ্বর দৈত্যকে, এ থেকেই তাঁর নাম হয় দুর্গা। যিনি দুর্গা, তিনিই পার্বতী, তিনিই উমা। এ রকম ১০৮টি বিশেষণ নামে তিনি বিভূষিতা। এ জন্যই কিনা জানি না, শ্রীরামচন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে অকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। সে জন্য এ পূজার আরেক নাম অকালবোধন। আমরা শ্রীরামচন্দ্রের সেই অকালকেই কাল ধরে এখনো দেবী দুর্গার পূজা করে আসছি। আর কালের দুর্গাপূজা হয়ে গেছে এখন বাসন্তীপূজা।
একটি বছর পর মা তাঁর সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে পিত্রালয়ে বেড়াতে আসেন পাঁচটি দিনের জন্য। তাই তো তাঁর আগমনকে স্বাগত জানাতে, তাঁকে নিয়ে পাঁচটি দিন আনন্দে মাতোয়ারা হতে বাঙালির এত উচ্ছ্বাস, আয়োজন শারদীয় দুর্গোৎসবের। তাঁর আগমনে বাঙালিদের মনে আনন্দ জাগে। সাগরিকা শর্মার ‘দেবী আসছেন’ কবিতায় দেখতে পাই মর্ত্যলোকে দেবীর আগমনের এক শাশ্বত চিত্র—
শিউলি গাছগুলোতে রাশি রাশি ফুল
গাছের নীচেও অজস্র ছড়িয়ে।
কার চরণকমলে ওরা অঞ্জলি হতে চায়?
ভোরের স্নিগ্ধতায় ভৈরবী গান
স্থলপদ্মগুলি হাওয়ায় দুলছে
ওরা যেন কার চরণছন্দ শুনতে উন্মুখ
কাশফুলগুলি আনন্দে টলমল
ওরা জানে আসছেন
শারদীয়া দেবী।
সব অপশক্তি ও শত্রু বা অসুরের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য সব দেবাদিদেবের পুঞ্জীভূত তেজ থেকে জন্ম হয় দেবী দুর্গার। তাঁর দশটি হাত দশটি দিক ও দশপ্রহর ধারণের প্রতীক। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের প্রথম সর্গে কবি কালিদাস চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন দেবীর জন্মদিন। কবি বর্ণনা করেছেন, দক্ষরাজ কন্যা সতী সবার সামনে যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করার পর জন্ম নেন হিমালয়রাজ ও তাঁর স্ত্রী মেনকার মেয়ে হয়ে। কৈলাসের সেই আদুরে মেয়েই পরবর্তীকালে মোষের ছদ্মবেশধারী এক প্রবল পরাক্রমশালী অসুর নিধনের জন্য হয়ে ওঠেন দেবী দুর্গা।
বৈদিক যুগে যজ্ঞাগ্নিতে দেবীর পূজা করা হতো। তখন যজ্ঞকুণ্ডের নাম ছিল ‘দক্ষ-তনা’, যা থেকে পরে দেবীর এক নাম হয়েছে দক্ষ-তনয়া। যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নি রাখা হতো এবং কুণ্ড অগ্নিকে আলিঙ্গন করত বলে বৈদিকোত্তর যুগে ধারণা করা হতো, দুর্গার পতি মহাদেব। মহাদেব শিবই আসলে বেদে উল্লিখিত অগ্নি বা রুদ্রদেব। পরবর্তী সময়ে যজ্ঞকুণ্ড বা যজ্ঞবেদি থেকে দেবী দুর্গার পুজো শুরু হয় ঘটে, এরপর পটে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রতিমা বা মূর্তি না গড়ে তাঁর স্বরূপ কল্পনা করে এই ঘটে-পটে পূজাই চলে এসেছে।
স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘দশপ্রহরধারিণী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি মঠে এনেছিলাম। তাঁর এক চরণ সিংহপরি অপরখানি অসুরের উপর। মায়ের দুপাশে তাঁর দুই কন্যা, ধন-ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী এবং বিদ্যা-সঙ্গীতের দেবী সরস্বতী—তাঁরা কমলদলের ওপর দণ্ডায়মান। তাঁর দুদিকে দুই পুত্র—যুদ্ধ দেবতা কার্তিক এবং জ্ঞানের দেবতা গণেশ।... হাজার হাজার ভক্ত আনন্দ করেছিল।’
যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশে দুর্গাপূজা শুরু করেন বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশীয় রাজশাহীর তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের (১৪৯৩—১৫১৯) সমসাময়িক ছিলেন। শোনা যায়, সে পূজায় তিনি সেই আমলে আট লাখ (মতান্তরে সাড়ে আট লাখ) টাকা খরচ করেছিলেন। ওই আনন্দধারা সেই আমল থেকে এখনো বাংলাদেশে প্রবহমান, খরচের ধারাটিও। তবু আমরা দেবীর আগমনকে স্বাগত জানাই, প্রণাম জানাই তাঁকে তাঁর আসার ক্ষণে—
নমঃ দেব্যৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ
নমঃ প্রকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্\
(অর্থ: দেবীকে, মহাদেবীকে প্রণাম। সতত মঙ্গলদায়িনীকে প্রণাম। সৃষ্টিশক্তিরূপিণী প্রকৃতিকে প্রণাম। স্থিতিশক্তিরূপিণী ভদ্রাকে প্রণাম। আমরা সমাহিত চিত্তে তাঁকে বারবার প্রণাম করি।)
শরৎ এক পুলক-জাগানো ঋতু। বর্ষার জল-কাদার পর শরৎ এ দেশে যেন এক আনন্দ-জাগানিয়া ক্ষণ। বাংলার শরৎ মানে চারদিকে শিউলি-টগর ফোটা; বিলের ধারে, খালের পাড়ে, নদীর কোলে রাশি রাশি কাশফুল ফোটা; শরৎ মানে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানো; দিগন্তবিস্তৃত সবুজ-শ্যামল ধানখেতের বুকে ভোরের পাতলা কুয়াশা নামা—এর পরই ঝলমলে সোনারোদে দিনটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠা। কিন্তু সেসব কই? তবে শরৎ তার চিরাচরিত রূপের ডালা সাজিয়ে না এলেও এসেছে কাশফুল, এসেছে শিউলি। সেই সঙ্গে আসছেন দেবী দুর্গা। হাজারো কষ্টের মধ্যে বাঙালিদের মনে তাই একটি আনন্দক্ষণের প্রতীক্ষা, দেবীকে আবাহনের অপেক্ষা। তিনি সবার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন। তাই তো তিনি আনন্দময়ী, তিনি সবার দুর্গতি নাশ করেন। তাই তো তিনি দুর্গা। তিনি বিনাশ করেছেন দুর্গ নামে এক অবিনশ্বর দৈত্যকে, এ থেকেই তাঁর নাম হয় দুর্গা। যিনি দুর্গা, তিনিই পার্বতী, তিনিই উমা। এ রকম ১০৮টি বিশেষণ নামে তিনি বিভূষিতা। এ জন্যই কিনা জানি না, শ্রীরামচন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে অকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। সে জন্য এ পূজার আরেক নাম অকালবোধন। আমরা শ্রীরামচন্দ্রের সেই অকালকেই কাল ধরে এখনো দেবী দুর্গার পূজা করে আসছি। আর কালের দুর্গাপূজা হয়ে গেছে এখন বাসন্তীপূজা।
একটি বছর পর মা তাঁর সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে পিত্রালয়ে বেড়াতে আসেন পাঁচটি দিনের জন্য। তাই তো তাঁর আগমনকে স্বাগত জানাতে, তাঁকে নিয়ে পাঁচটি দিন আনন্দে মাতোয়ারা হতে বাঙালির এত উচ্ছ্বাস, আয়োজন শারদীয় দুর্গোৎসবের। তাঁর আগমনে বাঙালিদের মনে আনন্দ জাগে। সাগরিকা শর্মার ‘দেবী আসছেন’ কবিতায় দেখতে পাই মর্ত্যলোকে দেবীর আগমনের এক শাশ্বত চিত্র—
শিউলি গাছগুলোতে রাশি রাশি ফুল
গাছের নীচেও অজস্র ছড়িয়ে।
কার চরণকমলে ওরা অঞ্জলি হতে চায়?
ভোরের স্নিগ্ধতায় ভৈরবী গান
স্থলপদ্মগুলি হাওয়ায় দুলছে
ওরা যেন কার চরণছন্দ শুনতে উন্মুখ
কাশফুলগুলি আনন্দে টলমল
ওরা জানে আসছেন
শারদীয়া দেবী।
সব অপশক্তি ও শত্রু বা অসুরের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য সব দেবাদিদেবের পুঞ্জীভূত তেজ থেকে জন্ম হয় দেবী দুর্গার। তাঁর দশটি হাত দশটি দিক ও দশপ্রহর ধারণের প্রতীক। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের প্রথম সর্গে কবি কালিদাস চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন দেবীর জন্মদিন। কবি বর্ণনা করেছেন, দক্ষরাজ কন্যা সতী সবার সামনে যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করার পর জন্ম নেন হিমালয়রাজ ও তাঁর স্ত্রী মেনকার মেয়ে হয়ে। কৈলাসের সেই আদুরে মেয়েই পরবর্তীকালে মোষের ছদ্মবেশধারী এক প্রবল পরাক্রমশালী অসুর নিধনের জন্য হয়ে ওঠেন দেবী দুর্গা।
বৈদিক যুগে যজ্ঞাগ্নিতে দেবীর পূজা করা হতো। তখন যজ্ঞকুণ্ডের নাম ছিল ‘দক্ষ-তনা’, যা থেকে পরে দেবীর এক নাম হয়েছে দক্ষ-তনয়া। যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নি রাখা হতো এবং কুণ্ড অগ্নিকে আলিঙ্গন করত বলে বৈদিকোত্তর যুগে ধারণা করা হতো, দুর্গার পতি মহাদেব। মহাদেব শিবই আসলে বেদে উল্লিখিত অগ্নি বা রুদ্রদেব। পরবর্তী সময়ে যজ্ঞকুণ্ড বা যজ্ঞবেদি থেকে দেবী দুর্গার পুজো শুরু হয় ঘটে, এরপর পটে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রতিমা বা মূর্তি না গড়ে তাঁর স্বরূপ কল্পনা করে এই ঘটে-পটে পূজাই চলে এসেছে।
স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘দশপ্রহরধারিণী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি মঠে এনেছিলাম। তাঁর এক চরণ সিংহপরি অপরখানি অসুরের উপর। মায়ের দুপাশে তাঁর দুই কন্যা, ধন-ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী এবং বিদ্যা-সঙ্গীতের দেবী সরস্বতী—তাঁরা কমলদলের ওপর দণ্ডায়মান। তাঁর দুদিকে দুই পুত্র—যুদ্ধ দেবতা কার্তিক এবং জ্ঞানের দেবতা গণেশ।... হাজার হাজার ভক্ত আনন্দ করেছিল।’
যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশে দুর্গাপূজা শুরু করেন বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশীয় রাজশাহীর তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের (১৪৯৩—১৫১৯) সমসাময়িক ছিলেন। শোনা যায়, সে পূজায় তিনি সেই আমলে আট লাখ (মতান্তরে সাড়ে আট লাখ) টাকা খরচ করেছিলেন। ওই আনন্দধারা সেই আমল থেকে এখনো বাংলাদেশে প্রবহমান, খরচের ধারাটিও। তবু আমরা দেবীর আগমনকে স্বাগত জানাই, প্রণাম জানাই তাঁকে তাঁর আসার ক্ষণে—
নমঃ দেব্যৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ
নমঃ প্রকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্\
(অর্থ: দেবীকে, মহাদেবীকে প্রণাম। সতত মঙ্গলদায়িনীকে প্রণাম। সৃষ্টিশক্তিরূপিণী প্রকৃতিকে প্রণাম। স্থিতিশক্তিরূপিণী ভদ্রাকে প্রণাম। আমরা সমাহিত চিত্তে তাঁকে বারবার প্রণাম করি।)
No comments