সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি-তেল নিয়ে তেলেসমাতি

ভোজ্যতেল দুর্লভ না হলেও দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। বাঙালির পক্ষে তেল ছাড়া কোনো ভোজন, আহার বা খাওয়া সম্ভব নয়। সয়াবিন ও পাম তেল চাল-ডাল-লবণের মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। কিন্তু দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে নিত্যই যা প্রয়োজন, সেই তেল কিনতে তুমুল পেরেশানির মধ্যে পড়তে হচ্ছে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষকে।


মঙ্গলবারের প্রথম আলোর প্রধান প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, তেলের দাম বাড়ছে অযৌক্তিকভাবে। সরকারের ট্যারিফ কমিশন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখিয়েছে, লাভসহ সব খরচ ধরেও লিটারপ্রতি দাম ১০ থেকে ১২ টাকা বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। গত এক বছরে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ২১ ও ৩৭ টাকা। এ নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক কথা বলা হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ অবধি কোনো সুরাহা করতে পারেনি। কিন্তু এই ফাঁকে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে শত শত কোটি টাকা।
সমস্যার দায় কেউ স্বীকার করতে চাইছেন না। আমদানিকারকেরা দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার দোহাই, পাইকারেরা বলছেন খুচরা বিক্রেতাদের কথা আর খুচরা বিক্রেতারা দোষ দিচ্ছেন পাইকারদের। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিন তরফই কমবেশি দায়ী। আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় স্থানীয় বাজারে দাম ১০-১২ টাকা বেশি। পাইকারদের সঙ্গে যোগসাজশে ডিও ব্যবস্থার সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরাও দাম বাড়াচ্ছেন। দেখাদেখি খুচরা বিক্রেতারাও মুনাফার ভাগ বাড়িয়ে রাখতে পিছপা হচ্ছেন না। এই ত্রিমুখী চাপে সাধারণ ক্রেতারা জেরবার।
সমস্যার প্রতিকারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকাতে ডিও প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিও প্রথার মাধ্যমে উৎপাদকের কাছ থেকে পাইকার হয়ে বাজারে আসতে আসতে তেলের দাম কয়েক দফা বেড়ে যায়। এটি বন্ধ করা গেলে সুফল আসবে। ব্যবসায়ীরাও এর বিপক্ষে নন। কিন্তু এটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে বাজারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না পড়ে। দ্বিতীয়ত, আমদানিমূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের অযৌক্তিক ব্যবধানের জন্য ডিও ছাড়া অন্য কিছু কারণও দায়ী। তাই আমদানি থেকে খুচরা বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। দুঃখজনক যে, দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যতটা গর্জাচ্ছে, ততটা বর্ষাচ্ছে না। সরষের মধ্যেই ভূত থাকলে তা দিয়ে দাম বাড়ানোর ভূত তাড়ানো সম্ভব হবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী একটি চক্রের প্রভাবের কথা বলেছেন, কিন্তু সেই চক্রকে নিয়ন্ত্রণের দায় তো স্বয়ং তাঁর এবং তাঁর মন্ত্রণালয়েরই।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারকে স্বয়ংক্রিয় ভাবার অন্ধ বিশ্বাস প্রচলিত। কিন্তু বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে, দাম বাড়ানো এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী বাণিজ্যিক অপশক্তি নিয়ন্ত্রণে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। গত বছর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানও সেটাই দেখিয়েছেন। বাজারকে অতিমুনাফাকামী অপশক্তির হাত থেকে মুক্ত রাখতে সরকারি হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া বৃদ্ধি থামাতে সেই সরকারি হস্তক্ষেপ এখন খুবই প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.